undefined
undefined
undefined
বিশেষ নিবন্ধ - শিবাংশু দে
Posted in বিশেষ নিবন্ধএক একটা সময়কে মনে পড়ে যায় তাদের সঙ্গে ওতপ্রোত কিছু অনুষঙ্গে। শরৎকালে বিশেষ একটা হলুদ রোদের ঝলমল টেনে নিয়ে যায় কোনও ছোটো বেলায়। পুজোর ছুটির আগে শেষদিন খালি পায়ে হেঁটে চলেছি ইশকুলে। কাল 'মহালয়া' হয়ে গেছে। আধোঘুমে, ঘোরে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের মায়াবী স্বর। পাড়ার দুর্গাঠাকুর তৈরি হয়ে গেছে। শুধু রং পড়া বাকি। রোদের আলোটাকে বলি, 'না চাহিলে যারে পাওয়া যায়।' একটা সময়। বালক বয়সে এক সুন্দরীতমাকে দেখেছিলুম, যার শাড়ির রং ফিরোজা। মা বলেছিলেন। তার পর থেকে 'ফিরোজা' শুনলেই সেই নারীকে মনে পড়ে। তার মুখ কিছু মনে নেই। সময়টা আছে। বহু দিন পরে কোনও একটি সুগন্ধির সঙ্গে এক প্রিয়তমা নারীর অনুষঙ্গ জড়িয়ে রয়ে গেছে। আর কিছু নেই। থাকার মধ্যে শুধু সেই বিনিসুতোর মালা। সে রামও নেই। অযোধ্যাও। অগণন ভিখারির রাস উৎসব দিয়ে গড়া স্বপ্নের জীবন আমাদের। কালীদা সেই সব স্বপনকে কি মনে রাখে? জানি না। তবে আমাদের প্রজন্মের বঙ্গীয় বালকরা একজন 'স্বপন'-এর জন্য খানিকটা সময় মনের কুলুঙ্গিতে তুলে রেখে দেয়। মাঝে মাঝেই মনে পড়ে তাকে।
গত শতকের তেষট্টি-চৌষট্টি সাল নাগাদ আমাদের প্রথম ইশকুল যাওয়া শুরু হয়। আমি তখন তিন কেলাশ। পঁয়ষট্টির মধ্যেই আমাদের ইশকুল যাপনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে যান একজন রহস্যময় লেখক। নাম, শ্রীস্বপনকুমার। তাঁর আসল নাম যে কী ছিলো, তখনও তা জানা যায়নি। পরে জানা গেছে তাঁর পৈতৃক নাম শ্রী সমরেন্দ্র নাথ পাণ্ডে। রাজশাহী থেকে কলকাতায়, এক আগন্তুক বঙ্গসন্তান। তিনি পৃথিবীর তাবৎ বিষয়ে ভূরি ভূরি জ্ঞান রাখতেন। ডাঃ এস এন পাণ্ডে নামে বটতলা থেকে প্রচুর 'ডাক্তারি' বইও বেরোতো তাঁর। অন্যদিকে 'শ্রীভৃগু' নাম নিয়ে জ্যোতিষের বই। ক্ষণজন্মা মানুষ ছিলেন তিনি। বিবিধ বিষয়ে দুহাতে লিখে বটতলার 'বাজার' আলো করে রাখতেন তিনি। পরবর্তীকালে এও জানা গেছে, যেমনই হোক, এই পরিমাণ বিপুল সংখ্যার গ্রন্থরাজির প্রণেতা দারিদ্র্য প্রপীড়িত জীবন কাটিয়েছেন। শেয়ালদা ইশটিশনের ওয়েটিং রুমে নিখরচায় আলো-পাখার সুবিধে পেতে সেখানে বসেই সারা রাত ধরে একেকটি চটি রচনা করতেন। 'গল্প' হিসেবে এই ঘটনার মাহাত্ম্যও কম নয়।
শোনা যেতো, জেমস হ্যাডলি চেজ সাহেব ( আট-নয় কেলাশে যাবার পর তিনি শ্রীস্বপনকুমারকে হটিয়ে আমাদের অধিকার করে নেন ) এবং সিডনি শেলডন সাহেব ছিলেন নাকি দুটি ‘নৈর্ব্যক্তিক’ ব্র্যান্ড। ব্যক্তিবিশেষ নন। এক দল অক্ষর কারিগর মিলেমিশে দিস্তে দিস্তে রোমাঞ্চকর সাহেবি দাস্তান ছাড়তেন বাজারে। আমাদের মতো বালকরা গোগ্রাসে গিলতো সে সব। 'আমাদের জীবনে 'নো অর্কিড ফর মিস ব্ল্যান্ডিশ' আবির্ভূত হবার আগে পর্যন্ত শ্রী স্বপনকুমারই ছিলেন দ্য কিং অফ ডিটেক্টিভ থ্রিলার। কিছুদিন আগে এক বন্ধুর সঙ্গে স্বপনকুমারকে নিয়ে ফোনে আড্ডা হচ্ছিলো। 'ল্যাখাপড়া' চুলোয় যাক, কে কতোগুলো স্বপন-সিরিজ 'শেষ' করতে পেরেছে তাই নিয়ে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলতো অবিরাম। ন-দশ বছর বয়েসে প্রথম শ্রীস্বপনকুমার শুরু করি। তখন থেকে বারো-তেরো পর্যন্ত, সিরিজের পর সিরিজ, চৌষট্টি পাতার বহাদুর কা খেল আমাদের তৃষ্ণা মেটাতো।
যখন থেকে আমাদের হরমোন জাগতে শুরু করে, তখন থেকে একটা জিজ্ঞাসা বাজারে বেশ চালু ছিলো। মেয়েরা কি স্বপনকুমার পড়ে? মনে হয় পড়তো না। কারণ সে বিষয়ে তাদের থেকে কিছু শোনা যায়নি। সে কালে মেয়েদের ফ্রেমটাই ছিলো অন্য রকম। বাঁধা গতের বাইরে সব কিছুই 'অসভ্য'। এই বিশেষণটির এগজ্যাক্টলি যে কী তাৎপর্য ছিলো সেটা বুঝতে বুঝতে আমাদের 'বিয়ের বয়স' হয়ে যায়। যাঁরা 'ভূতপ্রেত' বা অলৌকিকের চর্চা করেন, তাঁরা বলেন সব কিছু নাকি 'বোঝা' যায় না। 'না বোঝার' মধ্যে যে 'বোঝা' সেটাই নাকি প্রকৃত জ্ঞান। শুধু ভৌতিক প্রপঞ্চ নয়, কাব্যিক সন্দর্ভেও এই কথাটাই চলে। সেকালে মেয়েদের সাইকিতে 'অসভ্য' বিশেষণটিও সে রকমই কিছু একটা ব্যাপার ছিলো হয়তো। কিন্তু শ্রীস্বপনকুমারের কী ভূমিকা ছিলো তাতে, সেটা পোয়েস্কার হয়নি কখনও।
রামকৃষ্ণ মিশনের স্কুলে পড়তুম তখন। সেখানে একটা বিষয় 'পড়ানো' হতো। তার সরকারি নাম ছিলো 'মরাল ইন্স্ট্রাকশনস'। আমরা বলতুম ধর্মক্লাস। প্রতি সপ্তাহেই একটা-দুটো করে 'ধর্মক্লাস' থাকতো। দিনের শেষ পিরিয়ড। সেই সময়ে যে শিক্ষকমশায়ের আসার কথা তিনি একবার এসে বলে দিতেন, তোরা ক্লাসের দরজা বন্ধ করে গল্প কর। কিন্তু খবরদার কোনও হল্লা যেন না হয়। গোলমাল হলে এসে চাবকাবো। আমরাও সুবোধ বালক, শিক্ষকের কথা শিরোধার্য। শংকর নামে আমাদের এক সহপাঠী, তার কাছে ছিলো সীমাহীন স্বপনসমগ্র। ধর্মক্লাসের পবিত্র পরিবেশে সে পড়ে শোনাতো দীপক চ্যাটার্জি এবং রতনলালের রোমাঞ্চকর কীর্তিকলাপ। তারা ছিলো দেশি হোমস আর ওয়াটসন জুড়ি। ফর্ম্যাট বিচার করতে গেলে মোটামুটি দস্যু মোহন এবং কিরীটি রায়ের গরিব আত্মীয় বলা যেতে পারে। আমরা এক কথায় পুলকিত। রোমাঞ্চিত হয়ে শুনতাম। যেহেতু 'বিশ্বচক্র' সিরিজের বইগুলো ছিলো 'কঠোর ভাবে' 'কলেজ স্টুডেন্ট’দের জন্য, তাই সেখানে ডিটেক্টিভ ছাড়াও অনেক সুন্দরীদের আনাগোনা থাকতো। থাকতো সুচিত্রার মতো পিয়ানোতে বসা নায়িকা আর কমল মিত্রের মতো পাইপ ও ড্রেসিংগাউন ওয়ালা বাবারা। অধিকন্তু থাকতো যত্রতত্র রবীন্দ্রসঙ্গীতের উদ্ধৃতি (বাঙালির বাজার এতো সুন্দর আর কে বুঝতে পেরেছে?) । গপ্পোগুলো ছিলো মোটামুটি ভাবে শহর কলকাতার সীমারেখার মধ্যে। শ্যামবাজার থেকে বালিগঞ্জের বর্ডার। অবশ্য আফ্রিকার জঙ্গল বা চিনের মরুভূমি, আফঘানিস্তানের পাহাড় বা ব্রাজিলের ক্রাইম সিন্ডিকেট থেকে বিচিত্র লোকজনের আনাগোনাও চলতো সমানে। কিন্তু আমাদের লেভেলের পাঠকদের বাদ দিলে, এই সব চরিত্রের ব্যাপার-স্যাপার খতিয়ে দেখার চেষ্টা ছিলো ভালো রকম 'ইনজুরিয়াস টু হেলথ'। পুলিশের চরিত্রগুলি ছিলো গবেট 'সুন্দরবাবু'র ছাঁচে। এই সিরিজগুলির প্রকাশনা ইত্যাদির অকুস্থল ছিলো বটতলা। সম্ভবত ঝামাপুকুর থেকেও বেরোতো।
মলাট ও ছবি আঁকতেন প্রধানত তুষার চ্যাটার্জি (তুকাচ) । কখনও প্রতুলচন্দ্রের ছবিও থাকতো ( আহা, প্রতুলচন্দ্র বন্দ্যো , ওঁর মতো ইলাস্ট্রেটর বাংলায় আর আসেননি। হ্যাঁ, আমি সুধীর মৈত্র, পূর্ণ চক্রবর্তী বা নারায়ণ দেবনাথকে স্মরণে রেখেই বলছি)। পরের দিকে আঁকতেন নারায়ণ দেবনাথ। নায়িকাদের যে সব চেহারা বইয়ের মলাটে দেখা যেতো সেগুলি বেশ মনোহরণ। সবারই মুখের ডৌল সুচিত্রা সেনের মতো। তন্বী, পাফ দেওয়া কেশবিন্যাস, লবঙ্গলতা গোছের। চম্পাকলির মতো আঙুল (কেন এরকম বলা হয়, সিম্পলি জানিনা) দিয়ে পিয়ানো বাজাতেন তাঁরা। সচ্চরিত্র নায়করাই তাঁদের বিবাহ করতে পারতেন। সব মিলিয়ে দশ-পনেরো বছর বয়সের উৎসুক বালকদের জন্য সে সব ছিলো খুব উপাদেয় বস্তু। বিশ্বচক্র ছাড়া যে সিরিজগুলো মনে পড়ছে, যেমন, রক্তচক্র সিরিজ, কালনাগিনী সিরিজ, বাজপাখি সিরিজ ইত্যাদি। এই সিরিজগুলোতে নারায়ণ দেবনাথ এঁকেছেন। একটি ডার্ক চরিত্র ছিলো পাগল বৈজ্ঞানিক। যার কীর্তিকলাপ ছিলো টিপিক্যাল জিঘাংসু টাইপের। আর দাড়িটা থাকতো আমার মতো।
শ্রীস্বপনকুমার অবশ্য সেকালে নীহার গুপ্তের সামনে ম্লান হয়ে যেতেন। নীহার গুপ্তকে বেনামে বই লিখতে হতোনা। নিজের নামে তাঁর একটি বিপুল ও স্থায়ী বাজার ছিলো।‘বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয়তম’ পত্রিকা 'নবকল্লোলে' তাঁর লেখা বাঁধা থাকতো। আমার এক বন্ধুর মতে ঐ কাগজটি রেশন কার্ডের থেকেও বেশি সংখ্যায় ছাপা হতো। অন্য আর এক জনের মতে বাঙালির সফ্ট পর্নো পড়ার আহ্লাদকে বৈঠকখানায় সাজিয়ে রাখার সুযোগ করে দিয়েছিলো এই পত্রিকাটি। গদ্য শৈলীর কথা যদি আসে, তাহলে বাংলা হলুদ মলাট বইয়ের ভাষার উৎস আসলে কে ছিলেন, স্বপনকুমার না নীহার গুপ্ত, তা নিয়ে অনেক মেধাবী আলাপও চলতো সেকালে।
মোদ্দা কথা, যাত্রায় স্বপনকুমার আর গোয়েন্দা চটির স্বপনকুমার আমাদের বাল্যকাল ভরিয়ে রেখেছিলেন। আমাদের না ছিলো টিভি, মোবাইল, ইন্টারনেট, ফ্ল্যাট বাড়ি, এসি বা বাইকের বিলাসিতা। ভোর ছটা থেকে ইশকুল। বিকেল চারটে থেকে মাঠে ফুটবল আর সন্ধে ছটা থেকে ন'টা দুলে দুলে 'পড়া করা'। উপরি বোনাস, ইশকুল থেকে বাড়ি, সর্বত্র প্রত্যহ মনে করিয়ে দেওয়া, আমরা চরম আবেগে 'উচ্ছন্নে'র পথে ভেসে যাচ্ছি। আজ বুঝছি, স্নেহময় পিতামাতা ও শিক্ষকদের ভবিষ্যদবাণী 'সত্য' প্রমাণ হয়েছে। নয়তো ধর্মক্লাসের সরকারি টেক্স্ট বই স্বামীজীর 'প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে'র আলোচনা না করে এই বয়সে শ্রীস্বপনকুমারকে নিয়ে এহেন স্মৃতিমেদুরতা কোন প্রবৃত্তিতে আসে? এ কি 'দেশদ্রোহ' নয়? হয়তো এই বিচ্যুতির জন্যই আমাদের না হলো 'দীপক চ্যাটার্জি' হওয়া। না সেই কালজয়ী লেখকের চৌষট্টি পাতা চটির মলাটে আঁকা নায়িকারা আমাদের নসিব হলেন । যাঁরা যোধপুর পার্ক বা নিউ আলিপুর নামক নির্জন পাড়াগুলির বাগান ঘেরা প্রাসাদ আলো করে থাকতেন। আর অর্গান বাজিয়ে গাইতেন,
'স্বপন পারের ডাক শুনেছি
জেগে জেগে তাই তো ভাবি ...'
নস্টালজিক! তবে জীবন মৃত্যু তে ছিল rasa রোড আর bentink Street
ReplyDeleteহ্যাঁ, মোকাম কলকাতার বাইরে ওঁকে বেরোতে দেখিনি... 🙂
Delete