0

প্রবন্ধ - কৌশিক চট্টোপাধ্যায়

Posted in





মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ (১১ জুলাই ১৯৩৬ – ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯) যিনি আল মাহমুদ নামে অধিক পরিচিত, ছিলেন আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি।বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়াংশে সক্রিয় থেকে তিনি আধুনিক বাংলা কবিতাকে নতুন আঙ্গিকে, চেতনায় ও বাক্‌ভঙ্গীতে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করেছেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, প্রবাসী সরকারের দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে।তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে প্রতিষ্ঠিত সরকার বিরোধী সংবাদপত্র দৈনিক গণকণ্ঠ (১৯৭২-১৯৭৪) পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন এবং এই সময়ে অসামান্য সব রচনা দিয়ে সমৃদ্ধ করেছেন৷

মাহমুদ ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলার মোড়াইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতৃপ্রদত্ত নাম মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ। তার পিতার নাম মীর আবদুর রব ও মাতার নাম রওশন আরা মীর।মাহমুদের বড় দাদার নাম আব্দুল ওহাব মোল্লা যিনি হবিগঞ্জ জেলায় জমিদার ছিলেন।

কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি থানার সাধনা হাই স্কুল এবং পরে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড হাই স্কুলে পড়ালেখা করেন। মূলত এই সময় থেকেই তার লেখালেখির শুরু। আগেই বলেছি আল মাহমুদ বেড়ে উঠেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। তিনি মধ্যযুগীয় প্রণয়োপাখ্যান, বৈষ্ণব পদাবলি, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল প্রমুখের সাহিত্য পাঠ করে ঢাকায় আসার পর কাব্য সাধনা শুরু করেন এবং ষাট দশকেই স্বীকৃতি ও পাঠকপ্রিয়তা লাভ করেন।অর্থাৎ কবিতার প্রেক্ষাপট তৈরী হয়েছিল আগেই৷সাধনার ফল মিলেছিল অচিরেই৷


১৯৫৪ সাল অর্থাৎ কবির যখন ১৮ বছরের দুঃসহ বয়স, তখন থেকেই তার কবিতা প্রকাশ পেতে থাকে। ঢাকা থেকে প্রকাশিত সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সমকাল পত্রিকা এবং কলকাতার নতুন সাহিত্য, চতুষ্কোণ, ময়ূখ ও কৃত্তিবাস ও বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত 'কবিতা' পত্রিকায় লেখালেখির সুবাদে ঢাকা-কলকাতার পাঠকদের কাছে তার নাম জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং তাকে নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত হয়। কাব্যগ্রন্থ "লোক লোকান্তর" (১৯৬৩) সর্বপ্রথম তাকে স্বনামধন্য কবিদের সারিতে জায়গা করে দেয়। এরপর কালের কলস (১৯৬৬), সোনালি কাবিন (১৯৭৩), মায়াবী পর্দা দুলে উঠো (১৯৭৬) কাব্যগ্রন্থগুলো তাকে প্রথম সারির কবি হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করে। ১৯৯৩ সালে বের হয় তার প্রথম উপন্যাস "কবি ও কোলাহল" যা সমালোচকমহলে প্রশংসা আনে৷

তিনি আধুনিক বাংলা কবিতার নগরকেন্দ্রিক প্রেক্ষাপটে ভাটি বাংলার জনজীবন, গ্রামীণ আবহ, নদীনির্ভর জনপদ, চরাঞ্চলের জীবনপ্রবাহ এবং নরনারীর চিরন্তন প্রেম-বিরহকে তার কবিতায় অবলম্বন করেন। নারী ও প্রেমের বিষয়টি তার কবিতায় ব্যাপকভাবে এসেছে। উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী হিসেবে নারীর যৌনতা, আকাঙ্ক্ষা ও ভোগের লালসাকে তিনি শিল্পের অংশ হিসেবেই দেখিয়েছেন।এখানেই তার সাফল্য৷আধুনিক বাংলা ভাষার প্রচলিত কাঠামোর মধ্যে স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ততায় আঞ্চলিক শব্দের প্রয়োগ তার অনন্য কীর্তির সাক্ষর রাখবে ।

১৯৬৮ সালে ‘লোক লোকান্তর’ ও ‘কালের কলস’ নামে দুটি কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন।তবে সাহিত্য সমালোচকদের মতে তার সবচেয়ে সাড়া জাগানো সাহিত্যকর্ম "সোনালি কাবিন"।

আল মাহমুদের কাব্যগ্রন্থ ‘সোনালী কাবিন’ সমকালীন বাংলা কবিতার একটি বাঁকের নাম। বলা হয়ে থাকে, তিনি যদি শুধু এই একটিমাত্র কাব্যগ্রন্থ রেখে যেতেন, তাতেও বাংলা কবিতার রাজ্যের অধীশ্বর হয়ে থাকতেন। কবি হিসেবে পরিচিত হলেও আল মাহমুদ একাধারে ছিলেন ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার, শিশুসাহিত্যিক ও সাংবাদিক৷

রবীন্দ্র উত্তর আধুনিককালের কবিদের মধ্যে যিনি শব্দচয়নে, জীবনবোধে একেবারেই অন্যরকম নান্দনিকতায় আর বর্ণনায় অসামান্য আর ধ্রুপদী কবি হিসাবে চিরভাস্বর হয়ে থাকবেন৷

যিনি দীর্ঘ সময় ধরে কবিতার খাতায় এঁকেছেন বাঙালিয়ানার এক চিরায়ত ছবি। বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবিদের দলে তার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে এই কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। কালের কলসের পরে ‘সোনালী কাবিন’ কাব্যগ্রন্থটির কথা আগেই বলেছি৷এটি একটি মাস্টারপিস হিসেবেই সমাদৃত হয়েছে, এমনকি যারা কবির একচোখা সমালোচক ও নিন্দুক তারাও স্বীকার করেছেন একবাক্যে৷এই কাব্যগ্রন্থটি অনুবাদ হয়েছে অনেকগুলো ভাষায়। আর এমন কবিই উচ্চারণ করেন:

"আমরা তো বলেছি আমাদের যাত্রা অনন্ত কালের।
উদয় ও অস্তের ক্লান্তি আমাদের কোন দিনই বিহ্বল করতে পারেনি।
আমাদের দেহ ক্ষত-বিক্ষত,
আমাদের রক্তে সবুজ হয়ে উঠেছিল মৃতর প্রান্তর।
পৃথিবীতে যত গোলাপ ফুল ফোটে তার লাল বর্ণ আমাদের রক্ত!

কবি তার কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন আলোকিত চেতনার আবেগ। তার সেই চেতনাকে মূর্ত করেছেন শব্দে, অনুভূতির অবয়বে। কবিতায় ফুটে উঠেছে তার বিশ্বাসের প্রতিচ্ছবি, প্রকাশ পেয়েছে দৃঢ়তা আর জীবনের নিঃসঃশয় গন্তব্য৷

এইভাবে আমরা দেখতে পাচ্ছি আধুনিক কবিতার একটি মৌলিক বিষয় শব্দের সমাহার বা চিত্রকল্পের ব্যবহার। প্রখ্যাত সমালোচক অধ্যাপক শিবনারায়ণ রায় বলেন, ‘সমকালীন যে দুজন বাঙালি কবির দুর্দান্ত মৌলিকতা এবং বহমানতা আমাকে বারবার আকৃষ্ট করেছে তাদের মধ্যে একজন হলেন বাংলাদেশের আল মাহমুদ, অন্যজন পশ্চিমবঙ্গের শক্তি চট্টোপাধ্যায়।’ অধ্যাপক ড. রাজীব হুমায়ুনের মতে, ‘তিনি চল্লিশের পরবর্তী কবিদের মধ্যে অন্যতম মৌলিক কবি, নতুন কবি।’

পঞ্চাশ দশকের প্রধান কবি আল মাহমুদ যখন গ্রামে ফেরেন এবং গ্রামের মেঠো পথ বেয়ে চলতে গিয়ে লিখতে থাকেন

"এখন কোথায় যাওয়া যায়?
শহীদ এখন টেলিভিশনে।
শামসুর রাহমান সম্পাদকীয় হয়ে গেলেন।
হাসানের বঙ্গ জননীর নীলাম্বরী বোনা
আমার দ্বারা হবে না। জাফর ভাই ঘোড়ার গায়ে হাত বোলান।

অতএব কবির কোথাও যাওয়া হলো না, কেননা:

আমার সমস্ত গন্তব্যে একটি তালা ঝুলছে। (আমার সমস্ত গন্তব্যে)

আল মাহমুদ লোকজ অভিমুখে যাত্রা করে লোকায়ত বাংলার চিরায়ত শব্দ সুষমাকে আধুনিক বাক্য বন্ধনে উপস্থাপন করলেন।অর্থাৎ যেন একটা সাঁকো নির্মাণ৷ তার নির্মিত পটভূমির কেন্দ্রবিন্দু মানবতাই শেষ ,একপ্রখর আত্মবিশ্বাস। জসীম উদ্দিন এবং জীবনানন্দ উভয়ের থেকে তিনি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির অন্য ধারার কবি। কারও প্রতিধ্বনি নয়, নির্মীয়মাণ স্বকীয়তাই তাকে আধুনিক কাব্যজগতে অন্য আসন এনে দিয়েছে৷


"আমার বিষয় তাই, যা গরীব চাষির বিষয়
চাষির বিষয় বৃষ্টি ফলবান মাটি আর
কালচে সবুজে ভরা খানা খন্দহীন
সীমাহীন মাঠ।

চাষির বিষয় নারী।

উঠোনে ধানের কাছে নুয়ে থাকা।

পুর্নস্তনী ঘর্মাক্ত যুবতী। (কবির বিষয়)"


ইমরাণ মাহফুজ বলছেন "স্পন্দমান আবেগের ভূগোল, দেশজ চেতনা, লোককাহিনী ও ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর সৌন্দর্যে আপ্লুত আল মাহমুদ একজন মিথলজিক্যাল রোমান্টিক কবি। যেমন তিনি তার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি ‘সোনালী কাবিন’ এ মাতৃভূমির ইতিহাস খনন করে তুলে এনেছেন ঐশ্বর্যময় ও বীর্যবান অনুষঙ্গসমূহ। তিনি এখানে শক্তিমত্তার সঙ্গে রোমান্টিসিজম প্রবেশ করিয়েছেন যা ‘সোনালী কাবিন’ সনেট গুচ্ছকে করেছে অন্যান্য।"


"সোনার দিনার নেই, দেন মোহর চেয়ো না হরিণী
যদি নাও, দিতে পারি কাবিনহীন হাত দুটি
আত্মবিক্রয়ের স্বর্ণ কোনকালে সঞ্চয় করিনি
আহত বিক্ষত করে চারদিকে চতুর ভ্রুকুটি;
ছলনা জানিনা বলে আর কোন ব্যবসা শিখিনি।"

আসলে ভালোবাসার মানুষের কাছে আর্থিক প্রলোভন মিথ্যে মেকী৷

"বিবসন হও যদি দেখতে পাবে আমাকে সরল
পৌরুষ আবৃত করে জলপাইয়ের পাতাও থাকবে না
তুমি যদি খাও আমাকেও দিও সেই ফল
জ্ঞানে ও অজ্ঞানে দোঁহে পরস্পর হবো চিরচেনা (সোনালী কাবিন)

আবার কখনো লিখছেন

"কবিতা তো কৈশোরের স্মৃতি। সে তো ভেসে ওঠা ম্লান
আমার মায়ের মুখ; নিম ডালে বসে থাকা হলুদ পাখিটি
পাতার আগুন ঘিরে রাতজাগা ভাই-বোন
আব্বার ফিরে আসা, সাইকেলের ঘন্টাধ্বনি–রাবেয়া রাবেয়া–
আমার মায়ের নামে খুলে যাওয়া দক্ষিণের ভেজানো কপাট!

কবিতা তো ফিরে যাওয়া পার হয়ে হাঁটুজল নদী
কুয়াশায়-ঢাকা-পথ, ভোরের আজান কিম্বা নাড়ার দহন
পিঠার পেটের ভাগে ফুলে ওঠা তিলের সৌরভ
মাছের আঁশটে গন্ধ, উঠানে ছড়ানো জাল আর
বাঁশঝাড়ে ঘাসে ঢাকা দাদার কবর।"

(কবিতা এমন/আল মাহমুদ)

"কাক ও কোকিল "আবার অন্ত্যমিলের কবিতা তাতে কবি লিখেছেন

"একবার এক শহুরে কাকের দলে
মিশে গিয়েছিলো গানের কোকিল পাখি
মনে ছিলো তার কোন মতে কোনো ছলে
শেখা যায় যদি জীবিকার নানা ফাঁকি।

শুধু গান ছাড়া বুদ্ধির নানা খেলা
শিখবে সে এই চালাক কাকের ভিড়ে,
পার হয়ে মহানগরীর অবহেলা
কন্ঠ সাধবে প্র‍ভাতের বুক চিরে।

কিন্তু বাতাসে ফিরে এলো ওর গান
জন জীবনের কোলাহলে ভয় পেয়ে
ধুলোয় হাওয়ায় কেবলি যে অপমান
কাকের কলহ আকাশের মন্দিরে।

কাকেরা যে বোঝেনা গানের ভাষা
রুক্ষ পালকে তীব্র‍ কন্ঠে হাসে
গানের পাখির নিভে যায় কত আশা
সবুজ পাহাড়ে একদিন ফিরে আসে।

মহুয়ার গাছে দুঃখের নানা শ্লোক
তারপর থেকে শোনা যায় রোজ রোজ
কার সঙ্গীতে কাঁপে অরণ্যলোক
কোন্ পক্ষীর হৃদয়ের নির্যাসে?"

এ কবিতা কী অসম্ভব প্রতীকি নয়?

কবি অতীত গৌরব, সাম্য মানসিকতা, ইতিহাস থেকে ঐতিহ্য, কাম থেকে প্রেম এবং কামকলার অভূতপূর্ব চিত্রায়নের সঙ্গে ধর্মের মিথলজিক্যালের ব্যবহার করেছেন। আল মাহমুদ মানুষের মানবিক মেধা ও মননের বিষয়গুলো খুব চমৎকারভাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন। কবির দৃষ্টিভঙ্গি যুগপৎ সমাজনিষ্ঠ।তার কবিকৃতি সব মিলিয়েই বহুযুগ ধরে আলোচিত হবে৷





তথ্যসূত্র ও কৃতজ্ঞতাঃ

ইমরান মাহফুজ
রাজীব হুমায়ুন
ডেলি হান্ট
শিবনারায়ণ রায়

0 comments: