0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in




















২৩

‘দুর ছাই!...’ লেফটেন্যান্ট ফিসফিস করেন… ‘ব্যাপারটা ঝামেলার দিকে গড়াচ্ছে, এটা সত্যি সত্যি লড়াই!’ --- পায়ের শব্দগুলো ক্রমশ কাছে আসে। তবে এখন আর তারা কেউ দৌড়ে আসছে না।

‘অনর্থ কাণ্ড!’ ফাইনহালস নরমভাবে বলে… ‘ওরা কেউ রাশিয়ান নয়!’

লেফটেন্যান্ট জবাব দেন না।

‘আমি বুঝতে পারছি না এদের দৌড়াদৌড়ি করবার কী প্রয়োজন? তাও আবার এত শব্দ করে…’

লেফটেন্যান্ট জবাব দেন না।

‘এরা সব আপনার লোকজন!’ বলে ফাইনহালস। পায়ের শব্দগুলো এখন খুব কাছাকাছি।

যদিও এদের শারীরিক গড়ন এবং মাথায় স্টিলের হেলমেটের উল্টানো কোণ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল যে এরা জার্মান, তবুও লেফটেন্যান্ট মৃদুস্বরে বলে উঠলেন…

‘হল্ট! সঙ্কেত, হল্ট!’ লোকগুলো থেমে গেল। ফাইনহালস দেখতে পেল যে এরা বিষম চমকেছে।

‘ইসস… দূর ছাই!’ একজন বলে উঠল… ‘কী সঙ্কেত? দূর ছাই!’

‘তানেনবার্গ!’ বলে উঠল আরেকটা কণ্ঠ…

‘অভিশপ্ত জীবন!’ বলে উঠলেন লেফটেন্যান্ট… ‘আপনারা এখানে কী করছেন? শীগগির সব্বাই দেওয়ালের আড়ালে চলে যান। একজন কোণের দিকে থাকবেন এবং শুনে যান কী করতে হবে।’

ফাইনহালস এদের দেখে বিস্মিত হল। অন্ধকারে গুনবার চেষ্টা করছিল সে। ছয়, সাতজন হবে সব মিলিয়ে। ঘাসের গাদার উপরে বসে পড়ল তারা। ‘ওয়াইন আছে…’ লেফটেন্যান্ট বোতলগুলি হাতড়ে বের করে ওদের দিকে এগিয়ে দিলেন… ‘আপনারা ভাগাভাগি করে নিন।’

‘প্রিন্স’ লেফটেন্যান্ট বলে উঠলেন… ‘সার্জেন্ট প্রিন্স, কী ব্যাপার?’

কোণে যে ছিল, তার নাম প্রিন্স। ফাইনহালস দেখতে পেল যে অন্ধকারে তার বুকের মেডেলগুলো চকচক করছে।

‘লেফটেন্যান্ট’ প্রিন্স বলে ওঠে… ‘একেবারে যাচ্ছেতাই ফালতু ব্যাপার! বাঁদিক, ডানদিক দিয়ে ওরা বেরিয়ে গেছে। এবার এই একমাত্র জায়গা মধ্যিখানে, এই গ্রামের মাঝে, এই জঞ্জালের মাঝে যেখানে আমাদের মেশিনগান বসানো আছে, সেই ফ্রন্ট বন্ধ করতে হবে। এই ফ্রন্ট প্রায় কয়েকশ কিলোমিটার চওড়া… আর এই জায়গাটা সরু হয়ে দেড়শ মিটার… এবার এইখানে খামকা লড়াই করে আমরা নাইট ক্রস জিততে পারব না। বরঞ্চ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, এই জায়গাটা থেকে বেরিয়ে যাওয়া দরকার। এখানে আমাদের কথা কে ভাববে? আটকে গেলে… ‘

-‘ফ্রন্ট বন্ধ করা দরকার কোথাও… এখানে কি আপনারা সবাই আছেন?’

‘হ্যাঁ!’ বলে ওঠে প্রিন্স… ‘এখানে সবাই আছে… তবে আমার মনে হয় না অপেশাদার লোকজন আর যারা সদ্য আঘাত-অসুখ সারিয়ে লড়াইতে নেমেছে তারা ফ্রন্ট বন্ধ করতে পারবে। ও হ্যাঁ, ভালো কথা, গেনৎস্কি আহত, ওর গুলি লেগেছে… গেনৎস্কি!’ সে নরমভাবে ডাকে… ‘তুমি কোথায়?’

একটা শীর্ণ অবয়ব দেওয়াল থেকে একটু সরে দাঁড়ায়।

‘বেশ!’ বলেন লেফটেন্যান্ট… ‘আপনি চলে যান… ফাইনহালস সঙ্গে যাবেন। ফার্স্ট এড স্টেশন আছে, যেখানে আমাদের ট্রাক থেমেছিল। সেখানে চীফ যিনি আছেন, তাকে জানিয়ে দিন যে মেশিনগান ত্রিশ গজ পিছিয়ে দেওয়া হল। প্রিন্স, ওদের সঙ্গে আরেকজন কাউকে পাঠিয়ে দিন।’

-‘ভেকে, সঙ্গে যাও’ প্রিন্স এবার ফাইনহালসের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে… ‘তোমরাও কি ফার্নিচার ভ্যানে এলে এখানে?’

-‘হ্যাঁ’

-‘আমরাও’

‘এগিয়ে যান’ বলেন লেফটেন্যান্ট… ‘ওই পে বুক আর পরিচয়পত্র চীফকে দেবেন!’

‘একজন মারা গেছে?’ প্রিন্স প্রশ্ন করে।

‘হ্যাঁ’ অধৈর্য হয়ে বলেন লেফটেন্যান্ট… ‘যান, এগিয়ে যান!’

ফাইনহালস ধীরে ধীরে গ্রামের দিকে এগিয়ে যায় আরও দুজনকে সঙ্গে নিয়ে। এখন দক্ষিণ আর পশ্চিম দিক থেকে অনেক ট্যাঙ্কের শব্দ আসছে যেগুলি গোলা ছুঁড়ে যাচ্ছে। তাদের বাঁ দিকে, যেখানে প্রধান সড়ক গ্রামের দিকে চলে গেছে, সেখানে চিৎকার এবং গোলাগুলির শব্দ শোনা গেল। এক মুহূর্ত থেমে তারা পরস্পরের দিকে তাকাল।

‘অসাধারণ!’ বলে উঠল ছোটখাট চেহারার লোকটি, যার হাতে গুলি লেগেছে। তারা সবাই তাড়াতাড়ি এগোতে লাগল। তবে ট্রেঞ্চ থেকে বেরিয়ে আসা মাত্র একটা কণ্ঠস্বর বলে উঠল, ‘সঙ্কেত?’

‘তানেনবার্গ!’ তারা সমস্বরে গড়গড়িয়ে বলে উঠল।

‘ব্রেশট? ব্রেশটের বাহিনী?’

‘হ্যাঁ!’ উত্তর দিল ফাইনহালস!

‘ফিরে আসুন। এখনই সব সুদ্ধ ফেরত আসুন, গ্রামের প্রধান সড়কের উপরে।’

‘দৌড়ে যাও!’ ভেকে বলে ওঠে ফাইনহালসকে… ‘তুমি দৌড়ে গিয়ে বল।’

ফাইনহালস দৌড়ে আবার নেমে যায় ট্রেঞ্চের মধ্যে। দৌড়ে গিয়ে ফিরে যায় দেওয়ালের কাছে, বলে ওঠে… ‘শুনছেন, লেফটেন্যান্ট ব্রেশট!’

‘কী হল?’

‘ফিরে আসুন। সব সুদ্ধ… গ্রামের প্রধান সড়কের উপরে…’

তারা সবাই ধীরে ধীরে ফিরতে থাকে।

লাল ফার্নিচার ট্রাকটা প্রায় ভর্তি হয়ে গিয়েছে। ফাইনহালস ধীরে ধীরে ট্রাকের ঢালু পাটাতন ধরে উঠে গিয়ে সামনের দিকে বসে। তার পিঠটা একটু দেওয়াল খুঁজে নিয়ে হেলান দেয়, একটু ঝিমোবার চেষ্টা করে। ভয়ানক গোলাগুলির শব্দ চারদিকে, তার হঠাৎ এই সব কিছু ভীষণ হাস্যকর বলে মনে হয়। তার কানে আসে যে এখন জার্মান ট্যাঙ্ক গোলা ছুঁড়ছে নিজেদের পথ পরিষ্কার করবার চেষ্টায়। বড় বেশি গোলা ছুঁড়ছে এরা; সাধারণ ভাবে যা প্রয়োজন, তার চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু এগুলো সবই যুদ্ধের অঙ্গ।

সবাই ট্রাকে উঠে পড়েছে। একজন মেজর, যিনি মেডেল দিচ্ছেন তিনি ছাড়া। আর কিছু লোক মেডেল পাবে, তারাও ট্রাকে ওঠেনি। একজন সার্জেন্ট, তিনজন পদাতিক সৈন্য আর একজন ফিল্ড অফিসার দাঁড়িয়ে আছেন কাঁচা পাকা চুলের ছোটখাট চেহারার মেজরের সামনে। মেজরের মাথায় কোনো টুপি নেই। তিনি তাড়াতাড়ি এদের হাতে মেডেল এবং সার্টিফিকেট তুলে দিলেন। দিয়েই চিৎকার জুড়ে দিলেন…

‘ডঃ গ্রেক, চীফ লেফটেন্যান্ট!’ নামটা উচ্চারণ করে দ্বিগুণ জোরে চেঁচিয়ে উঠলেন ‘ব্রেশ্‌ট! লেফটেন্যান্ট ব্রেশট কোথায় গেলেন?’

ট্রাকের ভেতর থেকে সাড়া দিলেন ব্রেশট… ‘ইয়েস স্যার!’ তারপর ধীরে ধীরে ট্রাকের সামনের দিকে এসে মাথার টুপিতে হাত রাখলেন স্যালুটের ভঙ্গিতে, তারপর বলে উঠলেন ‘লেফটেন্যান্ট ব্রেশট, মেজর স্যর’

‘আপনার কম্পানির কম্যান্ডার কোথায়?’ মেজর প্রশ্ন করলেন। মেজরকে ঠিক রাগান্বিত নয়, বিরক্ত দেখাচ্ছে। যেসব সৈন্যরা এখনই পুরস্কৃত হল, তারা ট্রাকে উঠবার সময় সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্রেশটকে ধাক্কা মেরে মেরে ভিতরে ঢুকিয়ে দিচ্ছিল বার বার। মেজর গ্রামের রাস্তার উপরে একাকী তার হাতিয়ার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ব্রেশট একটু বোকা বোকা মুখ করে উত্তর দিলেন, ‘মেজর স্যার, আমার কোনো ধারণা নেই যে তিনি এখন কোথায়! ডঃ গ্রেক এইমাত্র আমাকে অর্ডার পাঠালেন কম্পানিকে নিয়ে এখানে একত্র হতে। তিনি অবশ্য পেটের যন্ত্রণায় বেশ কষ্ট পাচ্ছিলেন… ‘

‘গ্রেক!’ গ্রামের দিকে চেয়ে মেজর চিৎকার করে উঠলেন… ‘গ্রেক!’ ঘুরে দাঁড়ালেন এবার। মাথা নেড়ে হতাশার ভঙ্গিতে বলে উঠলেন… ‘আপনার কম্পানি খুব ভালো লড়াই দিলো… কিন্তু আমাদের এখন বেরিয়ে যেতে হবেই…’

দ্বিতীয় জার্মান ট্যাঙ্কটা রাস্তার সামনে ডানদিকে গোলা ছুঁড়তে ছুঁড়তে বেরিয়ে গেল। গ্রামের অনেকগুলো বাড়ি জ্বলছে। এমনকি গির্জাটাও… যেটা গ্রামের ঠিক মাঝখানে সব বাড়ির মাথা ছাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে, সেটাও লালচে আগুনে দাউদাউ করে জ্বলে উঠল। ফার্নিচার ট্রাকের ইঞ্জিনটা গুমগুম করে চলতে শুরু করল। মেজর পথের ধারে দ্বিধান্বিত অবস্থায় একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে তারপর ট্রাকের চালকের দিকে চেঁচিয়ে উঠে নির্দেশ দিলেন…

‘এগিয়ে যাও…’

ফাইনহালস পে বুকটা খুলে দেখল… ‘ফিঙ্ক, গুস্তাভ, কর্পোরাল অফিসার, নাগরিক পেশা- সরাইমালিক, বাসস্থান- হাইডেসহাইম’ --- হাইডেসহাইম! জায়গাটার নাম দেখে ফাইনহালস স্তম্ভিত হয়ে গেল। তার বাড়ি থেকে মোটে তিন কিলোমিটার দূরে। সে বহুবার দেখেছে সরাইখানাটা, বাদামী কালি দিয়ে লেখা সাইনবোর্ড ‘ফিঙ্কের ওয়াইন ট্যাভার্ন ১৭১০ সালে স্থাপিত’। ওই জায়গাটা দিয়ে বহুবার গাড়ি চালিয়ে গেছে সে, যদিও কখনো ভেতরে ঢোকেনি। দড়াম করে একটা শব্দ হল। লাল ট্রাকের দরজাটা বন্ধ হল। ট্রাকটা চলতে শুরু করল।



গ্রেক উঠে আসবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। গ্রামের সড়কের উপরে সবাই অপেক্ষা করছিল তার জন্য। সে জানে, কিন্তু সে উঠে আসতে পারছিল না। পেটের যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাচ্ছিল সে। তার মনে হচ্ছিল একটু মলত্যাগ করতে পারলে আরাম হবে। নোংরা ডোবা আর একটা বাড়ির দেওয়ালের মাঝের একটা জায়গা বেছে নিয়ে উবু হয়ে বসে পড়ল সে। খুব সামান্য পরিমাণ মল বেরিয়ে এল তার মলদ্বার দিয়ে। কতটা পরিমাণ হবে? এক চামচেরও কম। অথচ, তার পেটের যন্ত্রণা সাঙ্ঘাতিক বেশি। সে ঠিকভাবে বসতেও পারছেনা ব্যথার জন্য। পেটে চাপ লাগছে। তবে উবু হয়ে বসে কোঁত পাড়লে একটু মল বেরোবে। হ্যাঁ, একটু মল বেরোলে, ঠিক সেই মুহূর্তে তার মনে আশা জাগে। আশা জাগে যে হয়তো ব্যথাটা একটু কমবে। এই ঘ্যানঘেনে ব্যথাটার জন্য শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছে তার। ঠিকভাবে হাঁটতেও পারেনা সে যখন ব্যথাটা তাকে ছিঁড়েখুঁড়ে খায়। হাঁটতে পারেনা, হামাগুড়ি দিতেও পারেনা। তখন এগিয়ে চলার একমাত্র উপায় হল মাটিতে উপুড় হয়ে শুয়ে দুই হাতে ভর দিয়ে বুকে হেঁটে যাওয়া। সেটুকু যাওয়া তখন সম্ভব ছিল না তার পক্ষে। তখনো প্রায় তিনশ মিটার দূরে ছিল সে। গোলাগুলির আওয়াজের মধ্যেও সে শুনতে পেয়েছিল যে মেজর ক্রেনৎজ তার নাম ধরে ডাকছিলেন। কিন্তু সেই মুহূর্তে দুনিয়ার কোনোকিছু নিয়ে ভাবনাচিন্তা ছিলনা তার। বীভৎস পেটব্যথায় সে বেঁকে গিয়েছিল।

দেওয়ালটা ধরে ধরে উঠে দাঁড়াল সে। তার উন্মুক্ত পশ্চাদ্দেশ কেঁপে কেঁপে উঠছিল। ব্যথাটা তার অন্ত্রের মধ্যে ঘূর্ণিপাকের মত ঘুরপাক খাচ্ছিল, ধীরে ধীরে জমে ওঠা বিস্ফোরক বারুদের মত, একটা রাক্ষসের মত বিশাল হয়ে উঠছিল। তারপর একটু কমল। কিন্তু বেশি মল নিঃসৃত হয়নি শরীর থেকে। ব্যথায় তার চোখ দিয়ে জল পড়ছে। এই যুদ্ধটা নিয়ে এই মুহূর্তে তার আর কোনো মাথাব্যথা নেই। যুদ্ধের চিন্তা বেরিয়ে গিয়েছে তার মাথা থেকে। যদিও চারদিকে গোলাগুলির শব্দ। এছাড়াও সে পরিষ্কার শুনতে পেয়েছে গাড়িগুলোর ইঞ্জিনের শব্দ। গাড়িগুলো গ্রাম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। ট্যাঙ্কগুলো গোলা ছুঁড়তে ছুঁড়তে পিছিয়ে যাচ্ছে শহরের দিকে, সে পরিষ্কার বুঝতে পারছে। এটা পরিষ্কার যে, এই গ্রামটাকে শত্রুপক্ষের বাহিনী একেবারে ঘিরে ফেলেছে। কিন্তু তার শরীরের যন্ত্রণা, পেটব্যথা এগুলো অনেক বড়, অনেক ভয়ঙ্কর এই মুহূর্তে; এই ব্যথাটা শত্রুপক্ষের থেকেও অনেক কাছে এসে তাকে ঘিরে ফেলেছে। তাকে একেবারে অবশ করে ফেলেছে। যত ডাক্তারকে সে অদ্যাবধি দেখিয়েছে পেটের সমস্যার জন্য, বুনো জন্তুর মত ভয়ানক ক্রুর হাসি হেসে হেসে যেন তারা তার সামনে দিয়ে মিছিল করে যাচ্ছে। ওই মিছিলের পুরোভাগে আছেন এক যাচ্ছেতাই রকমের বিষাক্ত মানুষ, তার জন্মদাতা পিতা। এদের হতাশাব্যঞ্জক মানসিকতা তাকে কোনোদিন বলেনি যে বেড়ে উঠবার বয়সে সাঙ্ঘাতিক রকম খাবারের অভাব, পুষ্টিগুণের অভাবই তার অসুখের প্রধান কারণ।

একটা গোলা এসে নোংরা ডোবার উপরে পড়ল। একটা ঢেউ তৈরি হল। ঢেউটা তাকে একেবারে ভিজিয়ে দিল। নোংরানগোলা জলের স্বাদ এসে লাগল তার জিভে। যতক্ষণ সে বুঝতে পারেনি যে ওই বাড়িটা সরাসরি ট্যাঙ্ক আক্রমণের আওতায় চলে এসেছে, ততক্ষণ সে কেঁদে যাচ্ছিল। এক চুল তফাতে গোলা পড়তে থাকে তার চারপাশে। তার মাথার উপর দিয়ে একটা গোলা চলে যায়। বাড়িটার কাঠামো কেঁপে ওঠে। কাঠকুটো ছড়িয়ে পড়ে। বাড়িটার ভেতর থেকে এক নারীকণ্ঠের কান্নার শব্দ আসে। তার চারপাশে ধুলো, ধোঁয়া, কাঠকুটোর টুকরো উড়ছে। সে আবার বসে পড়ে। দেওয়ালের আড়ালে যায়। সাবধানে প্যান্টের বোতাম লাগায়। যদিও তার অন্ত্রের ব্যথার দমক মাঝে মাঝেই তাকে ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলতে চাইছে, তবুও সে গড়িয়ে গড়িয়ে ঢালু পাথরের রাস্তা ধরে ওই বাড়িটার চৌহদ্দির বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করে। সে প্যান্টটা ঠিকভাবে পরে নিয়েছে। কিন্তু সে এগোতে পারেনা একচুল। ব্যথাটা তার সর্বাঙ্গ অবশ করে দিয়েছে। সে ওই জায়গাতেই শুয়ে থাকে। তার সারাটা জীবনের দৃশ্য ক্যালাইডোস্কোপের টুকরো টুকরো নকশার মত ঘুরতে থাকে চোখের সামনে। সেই দৃশ্যগুলির অধিকাংশ একঘেয়ে অকথ্য অত্যাচার আর অপমানের ঘটনায় ভর্তি। সেই মুহূর্তে শুধুমাত্র নিজের চোখের জলটা সত্য বলে মনে হয় তার। বাকি সব কিছু মিথ্যে। দু চোখ ছাপিয়ে নেমে আসা অশ্রু মিশে যায় নোংরা ধুলোর সঙ্গে। তার ঠোঁটে এখন নোংরা ধুলো, বর্জ্য আর খড়কুটোর স্বাদ। যতক্ষণ না একটা গুলি এসে পাশের খামারের চালে ঢুকে সেই চালটা উড়িয়ে দিল, এবং সেই খামার থেকে বিশাল খড়ের গাদা এসে তাকে চাপা দিয়ে দিল, ততক্ষণ অবধি সে কেঁদে যাচ্ছিল। (চলবে)

0 comments: