0

প্রবন্ধ - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in






উনবিংশ শতকের বাংলায় যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ও মহিমাময় ঘটনাটি ঘটেছে বলে আমরা ধন্য, তা হল শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের অধ্যাত্মজগতে পদার্পণ। অদ্ভুত, অলৌকিক, অবতার, ইত্যাদি ভূষণে ভূষিত করে তাঁকে ঠেলে দূরে সরিয়ে না রেখে বরং একান্ত আত্মজনের মতন হৃদয়ে ধরলে আমরা এক এমন মানুষকে আমাদের মধ্যে পাব, যিনি প্রেমে ভালোবাসায় আমাদের নিয়ে যেতে চেয়েছেন সেই অমৃতলোকে যেখানে তাঁর নিজের স্বচ্ছন্দ বিচরণ। না, তাঁর কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। তিনি একক। তিনি অনুপম। ভালোবেসে তাঁকে অনুসরণ করা চলতে পারে, কিন্তু তাঁকে কোনো গণ্ডিতে বা গোষ্ঠীতে আবদ্ধ করা মূর্খের কাজ। তিনি সার্বজনীন। সর্বকালের।

আসুন, তাঁকে ফিরে দেখি।

ঈশ্বরতত্ত্ব এমনই তত্ত্ব যা মানুষ বিনা ধারণা হয়না। এরকমই একটি সত্যের প্রকাশ করেছেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব। তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবন একনিষ্ঠভাবে শুধু ঈশ্বর অনুভবেই পূর্ণ। জাগতিক আর যা কিছু আমরা মনে করে থাকি, বা বলা ভালো আমাদের ভাবনার ভুলে, মনে করি আবশ্যক, সেসব তাঁর জীবনে অনাবশ্যক। বেঁচে থাকতে গেলে যতটুকু ব্যবহারিক জীবন প্রয়োজন সেটুকুই ছিল তাঁর। তাই বলতেন, আমি খাই দাই আর থাকি। আমি খাই দাই আর মায়ের নাম করি। মা মানে ঈশ্বরী, সগুণ ব্রহ্ম। তিনি বলছেন, ম মানে ঈশ্বর, রা মানে জগৎ। আগে ঈশ্বর পরে জগৎ। ‘মরা’ ‘মরা’ শুদ্ধমন্ত্র ঋষি দিয়েছেন বলে। এই ম’য়ে আকার দিলে মা। নিরাকার ব্রহ্ম সাকার হলেন। সাকার কী রূপে? মানুষের রূপে। কারণ, মানুষই একমাত্র ঈশ্বর চিন্তা করতে পারে। হাতি এত বড়ো জন্তু কিন্তু ঈশ্বর চিন্তা করতে পারেনা। পারে কেবল মানুষ। এ এক অভিনব ঘটনা। এমন শ্রেষ্ঠ প্রাণী কিনা পাশবিক কর্মে লিপ্ত থাকবে? তাই হয়? তাই মুক্তকণ্ঠে বলছেন – মনুষ্যজীবনের উদ্দেশ্য ঈশ্বর দর্শন। তারপর আর একটু এগিয়ে বলছেন – মনুষ্যজীবনের উদ্দেশ্য ঈশ্বর লাভ। শুধু দর্শন করলেই হবেনা। লাভ করতে হবে। শুধু দেখলে কী হবে? তাঁর সঙ্গে আলাপ করতে হবে। ক্রমে তিনি বুঝিয়ে দেবেন, তুই আর আমি কি আলাদা? আমরা তো এক! ঠাকুর গল্পের ছলে জানিয়ে দিচ্ছেন গভীর সত্য। বাবুর কাছে গিয়ে কেউ চুপ করে একদিকে দাঁড়িয়ে। তার বাবুর কাছে চাইবার কিছু নেই। সকলেই এটা ওটা আর্জি নিয়ে এসেছে। বাবু নায়েবকে হুকুম করছেন সেসব মিটিয়ে দিতে। হঠাৎ চোখ পড়ল এই চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটির দিকে। বললেন, কি গো কি চাই? সে বলল – কিছু চাইনা। সে শুধু বাবুকে দেখতে এসেছে। সে বাবুকে ভালোবাসে কিনা, তাই দেখতে এসেছে। বাবু তখন নির্জনে তাকে ডাকলেন আর কাছে বসালেন। বললেন – নে এখানে বোস। তুই আর আমি কি আলাদা? অতএব ঈশ্বরলাভ মানে মানুষটা নিজেই ঈশ্বরে পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। সেই অনন্য অনুভূতির প্রকাশ ঘটছে যখন তিনি বলছেন, যে জ্ঞানী সে শুধু জেনেছে ঈশ্বর আছেন, আর যে বিজ্ঞানী সে তাঁর সঙ্গে আলাপ করেছে। এখন আলাপ হয় কী করে? দর্শনই যেখানে দুঃসাধ্য! কিন্তু ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ আমাদের সামনে অতি সরল ভাষায় ব্যক্ত করেছেন পরমতত্ত্ব। প্রথমে ঠাকুরের কথা ধরে চলে যাই সেকথায়। তারপর গভীর কথাটি উপনিষদের আলোয় যাচাই করা যাবে। ঠাকুর নিজেই যেখানে বলছেন – আমার কথার দুটি অর্থ, শব্দার্থ আর মর্মার্থ। মর্মার্থটাই লও না কেন? তাই তাঁর কথার খেই ধরে প্রবেশ করি তাঁর অধ্যাত্ম চিন্তার জগতে।



পণ্ডিত শশধর তর্কবাগীশের দাদা ভূধর এসেছেন দক্ষিণেশ্বরে। তিনি মায়ের মূর্তি দেখে আনন্দ প্রকাশ করছেন। বলছেন, শুনেছি নবীন ভাস্করের নির্মাণ। ঠাকুর তার উত্তরে বলছেন – তা জানিনে, জানি মা আমার চিন্ময়ী। অর্থাৎ, ঠাকুরের মা জ্যোতির্ময় আলোকে তাঁর অন্তরে প্রকাশ পান। এ জ্যোতি বাইরে থেকে আসেনা। আসে ঠাকুরের মধ্যে থেকেই। সেই জ্যোতির্ময়ী প্রতিমা সপ্রাণ। সেই মূর্তি বাইরের প্রস্তরমূর্তিতে প্রতিফলিত হয়। ঠাকুর দেখেন মৃন্ময়ী প্রতিমা চিন্ময়ী হয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলছেন। রঙ্গ করছেন। এই উন্মেষ কীভাবে হয়? ঠাকুর বলছেন, মা চাইলেই হয়। আমরা চাইলে হয়না। ছোটো ছেলে নতুন কাপড় পরে সকলকে দেখাচ্ছে আর বলছে আমার বাবা দিয়েছে। সকলেই তাকে মজা করে বলছে, কাপড়খানা দাও। সে দেবেনা। বলছে, উঁ, আমার বাবা দিয়েছে। এখন একজন চুপ করে বসে ছিল। সে চায়নি, কিন্তু ছেলে তাকেই কাপড় দিল। এই যে না চাইতেই পাওয়া, এই ধর্মলাভ, ঈশ্বর লাভ। কিছু করে পাওয়া যায়না। ঠাকুরের কথা- বিজয় তুমি হাজার চেষ্টা করো, তাঁর কৃপা ব্যতীত কিছুই হবার নয়। আবার তাঁর কৃপা হলে ‘হাজার বছরের অন্ধকার ঘর এক নিমেষে আলো হয়। একটু একটু করে হয় কি?’ তাহলে কথাটা ‘কৃপা’। কৃপার অর্থ আপনা থেকে হওয়া। স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ।

সাধনা করে ঈশ্বরকে পাওয়া যায়না। সাধনা একরকম অহংকারের জন্ম দেয়। ‘কি? আমি এত জপ করেছি, অত পুরশ্চরণ করেছি!’ অহংকার জ্ঞানের পথে সবচেয়ে বড়ো বাধা। যেকোনো কিছু শিখতে চাইলে আগে ছাত্র হতে হয়। তাহলে এত যে গুরু চারিদিকে? ঠাকুর নিজেও কি আমাদের শিক্ষা দিচ্ছেন না? এইখানে জানার কথাটা এই যে, ঠাকুর তাঁর জীবনে কাউকে কোনোরকম দীক্ষা দেননি। মন্ত্র তো নয়ই, খুব বেশি হলে পাত্র বুঝে শাক্তি করেছেন। কয়েকটি উদাহরণ দিই বরং। প্রথমটি অবশ্যই শ্রদ্ধেয় স্বামী বিবেকানন্দ। তিনি নরেনের বুকে পা দেওয়াতে নরেনের সামনে থেকে জগৎ অন্তর্হিত হয়ে গেল। এক অস্বাভাবিক ঘূর্ণনের মধ্যে তাঁর নিজের অস্তিত্ব যেন পাক খেতে লাগল। সে নিজেকে খুঁজে না পেয়ে আর্তস্বরে বলে উঠল – ওগো আমার যে বাপ মা আছে, এ তুমি কি করলে? তাহলে স্বামীজির মতন আধারও এই শক্তিসঞ্চারের জন্য প্রস্তুত ছিল না! দ্বিতীয় উদাহরণ পণ্ডিত শ্যামাপদ ভট্টাচার্যর। তাঁর মনে দুঃখ ছিল, ঠাকুর কেন নরেনের মতন তাকেও ছুঁয়ে দিলেন না। ঠাকুর তাই তাকেও দিলেন। কিন্তু আমরা দেখতে পেলাম পণ্ডিত মশাই দুঃখ করছেন – কই নরেনের মতন তো আমার কিছু হলনা? তৃতীয় উদাহরণ রাখাল মহারাজ ওরফে শ্রদ্ধেয় স্বামী ব্রহ্মানন্দ মহারাজ। ঠাকুর তাঁর জিভ টেনে ধরে কি যেন লিখে দিলেন। নাহ, কিচ্ছু লেখেননি। এও শক্তিই সঞ্চার করলেন। ফল জগতে প্রকাশিত।

একটু বরং দেখা যাক, ঠাকুর যা চাইলেন তাঁর সঙ্গকারীরা সেদিকে কতটা অগ্রসর হতে পারলেন। ঠাকুরকে গুরু হতে বললে তিনি বলতেন, ‘গুরু বাবা কর্তা এই তিন কথায় আমার গায়ে কাঁটা দেয়। গুরু এক সচ্চিদানন্দ। সচ্চিদানন্দ বই গতি নাই। গুরুগিরি বেশ্যাগিরি। যারা শিষ্য করে বেড়ায় তারা হালকা থাকের লোক। আমার কোনো শালা চেলা নেই’। এই সমস্ত কথার মধ্যে প্রমাণিত ঠাকুর জগতে প্রচলিত গুরুশিষ্য পরম্পরা অস্বীকার করছেন। প্রচলিত ধর্মের সংস্কার ত্যাগ করছেন। তাঁর কথা অনুসারে দেহস্থ চেতনাই শুদ্ধ হয়ে ঈশ্বরে পরিবর্তিত হয়। সেখানে বাইরে থেকে কারুর প্রয়োজন নেই। এমনকি, ধর্মকথায় তিনি সেবা দান আদি পুণ্যকাজেরও অবদান অস্বীকার করেছেন। তিনি শম্ভু মল্লিককে বলছেন – ঈশ্বর যদি তোমার সামনে এসে দাঁড়ান তাহলে কি তুমি কতগুলো হাসপাতাল ডিসপেনসারি চাইবে? বলছেন – সেবা যারা করবে তারা অন্য থাকের লোক। অর্থাৎ তাদের ঈশ্বরতত্ত্ব ধারণা হবেনা। অথচ আমরা জানি যে, ঠাকুর ধর্মসম্পর্কে ইতিবাচক কথাই বলে গেছেন। তাঁর কথায় – দুটো আছে। অস্তি আর নাস্তি। অস্তিটাই লও না কেন?

তাহলে তিনি অস্তিবাচক কি দিলেন? তিনি বললেন – জগতে একরকমের মানুষ জন্ম নেয়। এরা যেন হোমাপাখি। এ পাখি আকাশে থাকে। সেখানেই ডিম দেয়। ডিম ফুটে বাচ্চা বেরোয়। বাচ্চা মাটিতে পড়তে থাকে। পড়তে পড়তে তার চোখ ফোটে। সে যেই দেখতে পায় যে সে মাটিতে পড়ছে, আর মাটি গায়ে লাগলেই দেহ চুরমার, তখনই সে প্রাণপণে ওপরে উঠতে চেষ্টা করে। তার ডানা মেলে সে উড়তে থাকে ওপরে। সেই হোমাপাখির মতন মানুষও এই পার্থিব মায়ায় আটকায় না। সে জন্মেই এমন মাথা নিয়ে জন্মায় যে মায়ায় আটকানোর আগেই তার মন উর্দ্ধমুখী। সে চোঁ চা করে উঠতে থাকে। যতক্ষণ না তার মায়ের সঙ্গে দেখা হয়। আবারও বলি, ঠাকুরের মা কোনো প্রতিমা নয়, মা মানে সাকার ঈশ্বর। ঠাকুর তাই কেশবচন্দ্র সেনকে বলছেন – তোমরা যাকে ব্রহ্ম বলো আমি তারেই মা বলে কই। এখন সবাই তো হোমাপাখি হয়ে জন্মায় না। যার পূর্বপুরুষের অর্জিত সংস্কার মস্তিষ্কে যেমন ছাপ ফেলে সে সেই অনুপাতে প্রাণশক্তির উন্মেষ ধারণা করতে পারে।

কিন্তু এর ওপরের কথাটা ঠাকুর যা বললেন তা হল, হোমাপাখি বা নিত্যসিদ্ধ ছাড়াও কয়েকরকমের সিদ্ধি হয়। তিনি যে আরও সিদ্ধির কথা বলেছেন সেগুলো হল, স্বপ্নসিদ্ধ, হঠাৎসিদ্ধ, ধ্যানসিদ্ধ, কৃপাসিদ্ধ, এবং সাধনসিদ্ধ। ঠাকুরের কথায়, ‘হঠাৎসিদ্ধ কিনা – গরিবের ছেলে বড় মানুষের নজরে পড়ে গেছে। বাবু তাকে মেয়ে বিয়ে দিলে। সেই সঙ্গে বাড়ি ঘর গাড়ি দাস দাসী সব হয়ে গেল’। এর মর্মার্থ কী? বাবু – ভগবান। মেয়ে বিয়ে দেওয়া – দেহের মধ্যে ভাগবতী তনু, যা ঈশ্বর অনুভবের অপরিহার্য অঙ্গ। বাড়ি – ভূমি বা চক্র। সাততলা। সপ্তভূমি। ঘর – প্রতি ভূমির অনুভূতি। গাড়ি – অন্তর্নিহিত প্রাণশক্তি বা কুণ্ডলিনীর উর্দ্ধগতি। দাস – ইন্দ্রিয় দাস। দাসী – মায়া দাসী। স্বপ্নসিদ্ধ হল সে যার স্বপ্নে ঈশ্বর অনুভূতি হয়। ঠাকুর পূজনীয় মাষ্টারমশাই, কথামৃতকার শ্রীম’কে বলছেন – স্বপ্নে যদি আমাকে শিক্ষা দিতে দেখো, জানবে সে সচ্চিদানন্দ। মাষ্টারমশাই একবার বলছেন, তিনি একটি অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছেন। তিনি দেখেছেন একটি নদীতে অসংখ্য জাহাজ। সেগুলি ডুবে যাচ্ছে। তিনিও একটি জাহাজে। এমন সময় এক ব্রাহ্মণ তাঁকে বললেন, এই আমি যাচ্ছি দেখো। জলের তলায় ধাপ আছে। তুমি আমাকে অনুসরণ করে চলে এসো। এই স্বপ্ন শুনে ঠাকুর বলেছিলেন যে তাঁর রোমাঞ্চ হচ্ছে। স্বপ্নটি শ্রদ্ধেয় মাষ্টারমশাইয়ের আসন্ন আধ্যাত্মিক বিকাশের ইঙ্গিত। এরকম স্বপ্নের কথা কথামৃতয় অনেক আছে। ঠাকুরের একটি মার্কামারা কথাই হল – স্বপ্নসিদ্ধ যেই জন মুক্তি তার ঠাঁই। ধ্যানসিদ্ধও অনুশীলনের নয়। যে ধ্যানসিদ্ধ তার আপনা থেকে ধ্যান হয়। যেমন, একটা ময়ূরকে রোজ বিকেল চারটের সময় আফিম দেওয়া হতো। সে তারপর রোজ বিকেল চারটে বাজলেই আফিমের আশায় চলে আসত। আফিমের এই ঘড়িধরা আমেজ হল ধ্যানসিদ্ধের উপমা। যে ধ্যানে সিদ্ধ তার আপনা থেকে দিনের নির্দিষ্ট সময় চোখ বন্ধ হবে ধ্যানে। আমরা স্বামীজির জীবনে এর উপমা পেয়েছি। কৃপাসিদ্ধ যেন আনকোরা একজন যে ধর্ম বা অধ্যাত্মচেতনা সম্পর্কে একেবারেই অনভিজ্ঞ। যেমন কেউ অমৃতসাগরের পারে এসেছে। কেউ তাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল। সেই ধাক্কায় সে অমৃত লাভ করল। এখন ধাক্কা কে দেয়? সচ্চিদানন্দ দেন, ঠাকুরের আশ্বাস। সাধনসিদ্ধের উপমা দেবার সময় ঠাকুর দুই বন্ধুর গল্প বলেছেন। গভীর বনে দুই বন্ধু শব সাধনা করতে গিয়েছে। সব উপচার প্রস্তুত। এমন সময় বাঘ পড়ল। এক বন্ধু সবে আয়োজন সেরে জপে বসতে যাবে। আর একজন বাঘ দেখে গাছে চড়ে বসল। যে আয়োজন করছিল বাঘ তাকে টেনে নিয়ে গেল। আর যে গাছে ছিল সে তখন নেমে শবের ওপরে বসে ধ্যান শুরু করল। তখনই সে মায়ের দেখা পেল। কিন্তু তার মনে দুঃখ। সে জিজ্ঞেস করল – মা, সে সব আয়োজন করল আর তাকেই কিনা বাঘে নিলো? আমি তো কিছুই করিনি। সাধন ভজনহীন। আমাকে কেমন করে দর্শন দিলে? মা হেসে বললেন – বাবা তোমার আর জন্মে সব করা ছিল। দেখা যাচ্ছে, ঠাকুর সাধনসিদ্ধের কথাতেও কৃপার কথাই বলছেন। সুতরাং কৃপাই যে সিদ্ধির উৎস এটি তাঁর অনুভব।

এসব কথার মধ্যে থেকে তাঁর গভীর ঈশ্বরচেতনার একটি খণ্ডচিত্র পাই। সম্পূর্ণ পাওয়া সম্ভব নয়। তাই একটু ভেতরে ডুব দিয়ে দেখা যাক, তাঁর কথার মধ্যেকার সারকথা কি। তিনি তো শাস্ত্র আলোচনার প্রয়োজনীয়তাকেও গৌণ বলছেন! ধ্যান জপও পথ নয়! যদিও ঘটি সোনার হলেও রোজ মাজতে হয় বলে তিনি অনুশীলনের কথা বলেছেন, তবু একে কখনই ঈশ্বরলাভের পথ বলেননি। অথচ যখন তিনি বলছেন, প্রতিমায় ঈশ্বরের পুজা হয় আর মানুষে হয়না? তখন বুঝতে পারছি যে মানুষকে তিনি ঈশ্বরের আসনে বসাচ্ছেন। যে মানুষ বিকশিত উদ্ভাসিত, সে মানুষ নিজেই ঈশ্বরত্বলাভ করে ঈশ্বর হয়েছে। এই ঈশ্বরত্বলাভ হয় কখন? যখন একটা মানুষ স্তরে স্তরে পাশব মানবিক ও বৌদ্ধিক চেতনা থেকে উন্নীত হয়ে ঐশ্বরিক চেতনায় স্থিত হয়। তখন তাঁর ইন্দ্রিয়সকল অন্তর্মুখ হয়ে তাঁকে পার্থিব স্থুল চেতনার স্তর থেকে মুক্তি দেয়। বার দুয়ারে তালা পড়ে – ঠাকুরের কথা। তখন কি সেই মানুষটা জগতের মধ্যে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব অনুভব করে জগতকে হীন মনে করে? না, সে তখন গোটা জগতকে নিজের মধ্যে অনুভব করে। ঠাকুর বলছেন – বেলের শাঁস খোলা বিচিসহ গোটা বেল। সব জড়িয়ে এক। জীবজগৎবিশিষ্ট ব্রহ্ম। জগৎকে নিজের মধ্যে পেলে সেই একাত্মতা তাঁর মধ্যে এক অদ্ভুত প্রেমের জন্ম দেয়। রস। সেই প্রেমের চিহ্ন স্বরূপ সেই মানুষটা জগতের সব মানুষকে আপন শুধু নয়, এক মনে করেন।

এবার উপনিষদের আলোয় দেখি পরমহংসদেবকে।

আমরা জানি, যে কোনও ধর্মের মূল উদ্দেশ্য ঈশ্বরদর্শন ও ঈশ্বরলাভ। এ সম্পর্কে অনুসন্ধিৎসু ব্যক্তি তাই অতীতের ধর্মইতিহাস জানতে, অধ্যাত্মবিজ্ঞান জানতে শাস্ত্র পড়ে। শাস্ত্র তাই ঈশ্বর চেতনার পাঠ। শাস্ত্র আলোচনা এই অনুশীলনেরই একটা পর্যায়। শাস্ত্রে স্বাভাবিক ভাবেই অনুসন্ধান চলে যে কীভাবে সেই পরমরূপ কে আমরা প্রত্যক্ষ করতে পারি। ও তাঁকে লাভ করতে পারি। এযাবত বহু চেষ্টায়ও সেরকম কোনও নির্দিষ্ট পথের খোঁজ পাওয়া যায়নি। কাল্পনিক ভক্তের ভগবান গোছের রূপের কথা এখানে হচ্ছেনা। যদিও ঠাকুরের অর্ধবাহ্য দশায় এমন ভক্তির প্রাবল্য অনেককে মুগ্ধ করেছে, তবু বলি, এ তাঁর প্রাণের সঙ্গে খেলা। কোনো দ্বিতীয় অস্তিত্ব এখানে নেই। তাঁর প্রাণের রূপ। যে রূপ স্বতোৎসারিত এবং স্বয়ংপ্রভ সেই রূপের কথা হচ্ছে। মানুষের কল্পনা রূপধারণ করতে পারে। তাকে পরম সত্য বলা যায়না। কারণ সত্য সকল কালে এক। আর কল্পনার মূর্তি নানা। আর তাইতেই যত ভেদাভেদ। উপনিষদ বলছেন, হিরন্ময় পাত্রের দ্বারা সত্যের মুখ আবৃত। অর্থাৎ সত্য আছেই। তা সোনার পাত্রে ঢাকা। সোনার থালার রূপকটি কে সরল করতে চাইলে ভাবা যেতে পারে এটি দেহের কোনও অংশের একটি আবরণ। যেহেতু আমাদের অনুভূতি ও উপলব্ধির কেন্দ্র মস্তিষ্ক সেহেতু এমন ধরে নেওয়া ভুল নয় যে মস্তিষ্কের সেই মূলকেন্দ্রটি সোনার থালায় ঢাকা। কেন সোনার থালা? কারণ তা জ্যোতির্ময়, যেমন সূর্য। এই আবরণটি সরে গেলে উন্মোচিত হবে তৃতীয় নয়ন। এরপর উপনিষদ বলছেন – কেমন হবে সেই পুরুষের রূপ? তিনি অণু হইতেও ক্ষুদ্রতর আবার মহৎ হইতেও মহত্তর। শ্বেতকেতু আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, কি করে অণুপরিমাণ ও নামরূপ বিহীন আত্মা হতে এই সুবিশাল জগত উৎপন্ন হতে পারে? উত্তরে তাঁর পিতা বলছেন, বীজের সূক্ষ্ম অংশ থেকে যেমন বিশাল বটবৃক্ষ জন্মায় তেমন নামরূপবিহীন সূক্ষ্ম কারণ হতে এই জগত সৃষ্ট। এখানে দ্রষ্টব্য যে এই পরম কারণকে নামরূপবিহীন বলা হচ্ছে। তাহলে তাঁকে দর্শন করা যায় কিরূপে? উপনিষদ বলছেন পরমজ্যোতি রূপে। বলছেন সম্প্রসাদ, অর্থাৎ যিনি আত্মার প্রসন্নতা লাভ করেছেন, নিজের দেহ থেকে উত্থিত হয়ে পরমজ্যোতি রূপে সঙ্কলিত হবেন। দেহ থেকে উত্থিত হয়ে সঙ্কলন ঘটবে হিরন্ময় পাত্রে। সমস্ত দৈহিক চেতনা সঙ্কলিত হবে মস্তিষ্কে। জ্যোতি রূপে। অর্থাৎ আলো রূপে। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায় যে, একজন এমন ব্যক্তি যার দেহের প্রতিটি কোষ অটুট, তাঁর প্রতি কোষের থেকে প্রাণশক্তি সঙ্কলিত হয়ে মেরুদণ্ডস্থিত প্রধান স্নায়ুসূত্রটির (সুষুম্না) মধ্যে দিয়ে মস্তিষ্কে আসবে। যেহেতু মস্তিষ্কই দেহকে চালনা করে ও সমস্ত রকমের অনুভূতি ও উপলব্ধির কেন্দ্রও মস্তিষ্ক, সুতরাং এই সঙ্কলিত জ্যোতিকে মস্তিষ্কে সঙ্কলিত হতে দেখা যায়। কেমন করে? মস্তিষ্কের পিনিয়ান গ্ল্যান্ড যেখানে অবস্থিত সেটিকেই তৃতীয় নয়ন বলা হয়। মাথাকে যদি একটি বৃত্ত ভাবা যায়, তবে যে কোনও দিক থেকে একটি শলাকা তার কেন্দ্রে প্রবেশ করালে সেখানে ছোঁবে সেটিই তৃতীয় নয়ন। যদি সংশয় হয় যে এভাবে প্রাণশক্তিকে কি করে দেখা যায়, তাহলেও বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ মাত্রেই জানবেন যে শক্তির একটি মাত্র প্রকাশই দেখা যায়। সেটি হোল আলো। এখন আলোর দ্বৈতসত্ত্বা আছে। শক্তি ও পদার্থ দুইই। উপনিষদ অনুসারে আলোর শক্তিসত্ত্বা সঙ্কলন শেষে পদার্থসত্ত্বা রূপে মস্তিষ্কে ধরা দেয়। প্রশ্ন হোল এই যদি হয় ঈশ্বরের জ্যোতির্ময় রূপ তবে তা আমাদের পরমপুরুষ প্রেমাস্পদ হবেন কেমন করে? আমাদের কল্পনার ইষ্টকে এখানে সযত্নে আলোচনার বাইরে রাখতে হবে। এ প্রশ্নের উত্তর ও উপনিষদে আছে। উপনিষদ বলছেন এই পুরুষ সহস্রশীর্ষ, সহস্র চক্ষুবিশিষ্ট। বাস্তবে এমন একটি পুরুষের কল্পনাও তো ভয়াবহ! এই রূপকটি কে সুতরাং ভাঙ্গা দরকার। হাজারটা মাথা বা হাজার হাজার মাথা হতে হলে হাজার হাজার মানুষ চাই। হাজার হাজার মানুষ অর্থাৎ জগতের মানুষ। অতএব উপনিষদ বলছেন জগতের প্রতিটি মানুষের সম্মিলিত প্রাণই ঈশ্বর। কোনও মানুষই এই বিশ্বব্যাপী অস্তিত্বের বাইরে নয়। সর্বব্যাপী সঃ ভগবান, তস্মাৎ সর্বগত শিবঃ। তাহলে তো এই বিশ্বব্যাপিত্বের উপলব্ধি একক মানুষে সম্ভব নয়। না তা কিন্তু নয়। একক ব্যাক্তিও এই বিশ্বপ্রানের উপলব্ধির অধিকারী। বিশ্বরূপ দর্শনের যে কথাটি আমরা জানি তা হোল এই, আত্মস্বরূপের মধ্যে প্রকাশিত বিশ্বস্বরূপ। শ্রীকৃষ্ণ হাঁ করলেন। তাঁর তালুর মধ্যে বিশ্বকে দেখলেন মা যশোদা। উপনিষদ বলছেন তালু থেকে লম্বমান মাংসপিণ্ডের অপর পারে সেই দ্বার। আঘাত করলে খুলে যাবে। তালুর অপর পিঠেই সহস্রার। মস্তিষ্কের সকল অনুভূতির কেন্দ্র। এই বিশ্ব প্রাণ উপলব্ধির ফলে ব্যাক্তি প্রাণে যে পরিবর্তন আসে তা বিস্ময়কর। ব্যাক্তি প্রাণ আর তখন কোনও দেহবদ্ধ চেতনা নয়। সে তার প্রাণে জগদপ্রাণ কে উপলব্ধি করে। অনুভব করতে পারে – আমি ও আমার সামনে এই জগত আসলে এক। আর এই অনুভূতির ফলে তার প্রকৃত ঈশ্বর চেতনার বিকাশ হয়। উপনিষদ বলছেন সঃ অহম। সঃ, সেই বিশ্বপ্রানই আমি। ‘আমি’ ছাড়া আর কোনও কিছুর অস্তিত্বই নেই। অদ্বিতীয়, অনুপম। একমেবাদ্বিতীয়ম। সঃ একঃ। দ্বিতীয় না থাকলে ভয় নেই, ঈর্ষা নেই, ক্ষমতার লড়াই নেই। অভয়ং বৈ জনক প্রাপ্তোহসি। জনক তুমি অভয়পদ প্রাপ্ত হইয়াছ। জনক - সত্যের জনক। জনক পুরুষ। পিতা তো পুরুষই হবেন। বীজের মধ্যে লুকিয়ে থাকা মহীরুহের মতন এই বিশ্ব সেই পুরুষের বীজেই নিহিত। অতীত, আগত ও অনাগত সমস্ত অস্তিত্ব এই বিশ্ব প্রাণে লুকিয়ে আছে। ইনিই ব্রহ্ম। যতক্ষন না এই বিশ্বপ্রানের সঙ্গে বা জনকের সঙ্গে একত্ব অনুভব করছি ততক্ষণ ব্রহ্মকে জানা হলনা। যেমন যীশু বলছেন I and my Father in heaven are but One। তাই এঁকে জানা না হলে ভালবাসা তো দুরস্থান। ভালবাসা কথাটির মধ্যে দ্বৈতবোধ আপাতদৃষ্টিতে প্রবল ভাবে বর্তমান। তুমি একটি ও আমি একটি। ভালবাসার পাত্র না হলে সে ভালবাসা কাকে দেওয়া যায়? কিন্তু এ হোল ভালবাসার অতি সাধারণ ধারণা। আত্মরতি বলে যে কথাটি বৈষ্ণব শাস্ত্রে বহুল প্রচলিত তার ব্যাঞ্জনা কিন্তু অসাধারণ। শ্রীরাধা তাঁর দেহসমেত শ্রীকৃষ্ণে পরিবর্তিত। নিজের আমি খুঁজে পাচ্ছেননা। তিনি নিজেই ঈশ্বরে পরিবর্তিত হয়ে আত্মপ্রেমে মগ্ন হয়েছেন। বলা বাহুল্য এ শুধু আলোচনার খাতিরে। কারণ শাস্ত্রের ব্যাখ্যা স্বয়ংবেদ্য। তবে এই আলোচনা কেন? কারণ অনুশীলন। কে হবেন স্বয়ংবেদ্য? উপনিষদ বলছেন নায়মাত্মা বলহীনেন লভ্য, ন মেধয়া, ন বহুনা শ্রুতেন, যমেবৈষ বৃণুতে তেন লভ্য, স্তস্যৈষ আত্মা বিবৃনুতে তনুং স্বাম। অর্থাৎ শাস্ত্র পড়ে, সাধন করে আত্মাকে জানা যায়না। আত্মা যাকে বরং করেন তাঁরই হয়। এই প্রেক্ষিতে একটি কাহিনীর অবতারণা করা চলে। শ্রীরামানুজ, বিশিষ্টাদ্বৈতবাদের জনক। জীবজগৎবিশিষ্ট সর্বব্যাপী ব্রহ্মত্বের ধারণার জনক। ছান্দোগ্য উপনিষদে বর্ণিত পরমাত্মার রূপ বর্ণনাকালে তাঁর গুরু শ্রীযাদবপ্রকাশ ব্যাখ্যা দিলেন, তাঁর রূপ বাঁদরের পশ্চাদ্দেশের ন্যায়। কপ্যাসং। কপি - মর্কট। আসম – পশ্চাদ্দেশ। রামানুজ এই বর্ণনা শুনে কেঁদে ফেললেন। পরম প্রেমাস্পদের রূপের এমন কদর্য তুলনা? যাঁকে মনে পড়লেই তিনি আনন্দসাগরে ভাসেন, কারণ রসো বৈ সঃ – তিনি রসস্বরূপ, তাঁর মুখের এমন তুলনা! গুরু জানতে চাইলেন তবে কি রামানুজ অন্য কোনও ব্যাখ্যা দিতে পারেন? রামানুজ এমন এক ব্যাখ্যা দিলেন যা একজন ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষের পক্ষেই দেওয়া সম্ভব। কি সে ব্যাখ্যা? কপি – অর্থাৎ বাল সূর্য। আসম – জলকণা। কপ্যাসং অর্থ ব্রহ্মের রূপ সেই উদীয়মান বাল সূর্যের ন্যায় যিনি জলকনা পান করেন। দিনের প্রারম্ভে প্রকৃতি জুড়ে যে হিমকণা থাকে, দিনের প্রথম সূর্যকিরণ তাকে পান করে। এই সময়ে সেই অরুণকান্তি সূর্যের রূপ ব্রহ্মের সঙ্গে তুলনীয়।

উপরের পর্বের আলোচনাটি শ্রীরামকৃষ্ণের অধ্যাত্মচিন্তার আলোয় লিখিত। যাতে করে জ্ঞান ও ভক্তির একটি সাযুজ্য পাওয়া যায়। ঠাকুরের উদ্ধৃতি উহ্য রেখে আলোচনা করলেও মূল উদ্দেশ্য তাঁকেই প্রকাশ করা। কারণ তিনি যে বলেছেন – না দেখলে ভালোবাসবি কাকে? ক্ষুদ্র অনুভবে তাঁকে ধরা একরকম বামন হয়ে চাঁদে হাত দেওয়ার মতন। তবু প্রকাশ করতে ইচ্ছে হয়। যাকে বয়ে চলেছি এই দেহের মধ্যে তিনি যদি নিজেকে জানান দেন তবে যে কী পরিমাণ আনন্দ জাগে তা বর্ণনার অতীত। আবার অদ্বৈতবাদে বলতে হলে, নিজের এই পরিবর্তন, নিজের অস্তিত্বের এই ঈশ্বরত্বের বিকাশে ক্ষুদ্র অস্তিত্বটি লোপ পায়, বৃহৎটি জাগে।

শ্রীরামকৃষ্ণ তবে কী বলে গেলেন? আমাদের যদি করার কিছুই না থাকে তাহলে কি আর বাকি থাকে? তিনি বলে গেলেন – সৎ একটি জীবন যাপন করতে। যেখানে শঠতা নেই ক্রুরতা নেই জটিলতা নেই। সৎ ও সরল জীবন আমাদের চেতনাকে বিকশিত হতে সাহায্য করে। কোনোরকম পার্থিব আকর্ষণ থেকে আমরা নিজে নিজে মুক্ত হতে পারিনা। তাই আমরা আমাদেরই সেই মহৎ অস্তিত্ব, যাকে ঈশ্বর বলছি, তাঁর কাছে প্রার্থনা জানাতে পারি – হে ঈশ্বর আমাকে মোহমুক্ত করো। এতে সেই মহৎ অস্তিত্ব কৃপা করতে পারেন কিংবা আমাদের মধ্যে পরিবর্তন ঘটতে পারে। আমরা ক্রমাগত একই প্রার্থনা করতে করতে ক্রমে পরিবর্তিত হতে থাকি। একই কথা, একই চিন্তা আমাদের মস্তিষ্কে আঘাত করতে থাকে। আমাদের কোষ উন্মুক্ত হতে থাকে। এবং, এ হয়। ঠাকুর এর রেফারেন্স রাখছেন। তাঁর ভাগ্নে হৃদয় মুখুজ্যে যখন বলছেন, মামা তুমি রোজ রোজ এক কথা কও কেন? তোমার বুলিগুলো ফুরিয়ে যাবে যে। ঠাকুর তার উত্তরে বলছেন – বেশ করব। আমার বুলি আমি একশ বার বলব। তোর তাতে কি রে? এ কথারও গভীর দ্যোতনা আছে। একই কথা সমানে আওড়ালে তা ব্রেনে আঘাত করে।

শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস আসলে এসব কিছুর মাধ্যমে ধর্মের প্রচলিত আনুষ্ঠানিকতাকে উড়িয়ে দিয়ে গেছেন। আশ্রমবাসী প্রতিষ্ঠানবাসী গুরুদের উচ্ছেদ করে গেছেন। কারণ, তাঁর মতে, ধর্ম কোনো সর্বসিদ্ধিদায়ী মাদুলি নয়, ধর্ম আমাদের চাহিদা পূরণের যন্ত্র নয়। ধর্ম হল নিজের ঈশ্বরচেতনার বিকাশ। আজ এই ধর্মব্যবসার সময়ে তাঁর কথার মর্ম উপলব্ধি করা আরও বেশি প্রয়োজন। তাতেই আমাদের মঙ্গল বলে মনে হয়।

[মাতৃশক্তি কল্পতরু সংখ্যা ২০২০]

0 comments: