0

ধারাবাহিক - রাজা মুখোপাধ্যায়

Posted in





পর্ব ২৬

আস্পারাগাস আর বেকন – এক জার্মান প্রণয়গাথা

গ্রীষ্মকাল। এই শব্দটা মাথায় এলেই আমাদের মতো দেশে যে অনুষঙ্গগুলি অবধারিতভাবে এসে পড়ে, তার মধ্যে প্রধান অবশ্যই বিপুল এক সময় জুড়ে নির্মম দাবদাহের রাজত্ব। এর ঠিক বিপরীত চিত্রটিই চোখে পড়ে শীতপ্রধান দেশগুলিতে। গরমকালটি সেখানে উৎসবের। পারিবারিক অবসর যাপনের জন্য নির্দিষ্ট। পাশ্চাত্যে এই ছুটি কাটানোর রকমফের আছে। অনেকে সাইকেল নিয়ে সপরিবারে বেরিয়ে পড়ে দূর-দূরান্তরে। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য। বাবা-মা আর তাদের দুটি ছোট ছেলেমেয়ে সারিবদ্ধভাবে পরপর সাইকেল চালিয়ে চলেছে ফুটপাথে সাইকেল চালানোর জন্য চিহ্নিত অংশটি দিয়ে। নানান সরঞ্জাম তাদের সঙ্গে। যার মধ্যে নিশ্চিতভাবে নজর কাড়বে একটি তাঁবু আর একটি গ্রিল – যাতে যাত্রাপথের যেকোনও জায়গাতেই একটু জিরিয়ে নেওয়া যায়, বিশেষত তা যদি সন্ধের দিকে হয়, তাহলে সেই গ্রিলের ওপর মাংস বা মাছের টুকরো ঝলসে নিয়ে জমে ওঠে সান্ধ্য অথবা রাত্রিকালীন আড্ডা।

কুড়ি বছরেরও বেশি সময় আগের এক গরমকাল। হঠাৎই সুযোগ এসে গেল উত্তর জার্মানির এক বিখ্যাত মুদ্রণসংস্থায় এক স্বল্পকালীন শিক্ষানবিশির। হামবুর্গ শহরের কাছে আহরেন্সবুর্গের সেই অস্থায়ী কর্মস্থলের খুব কাছে একটি ছোট গ্রামের এক সরাইখানায় থাকার বন্দোবস্ত হল আমার। প্রতিদিনের আসা-যাওয়ার জন্য বন্ধু কারিন দিয়েছিল একটা সাইকেল। প্রাত্যহিক সেই আসা-যাওয়ার পথে ধীরে ধীরে উপলব্ধি করলাম, আমার ভিতরে প্রবেশ করছে তখনও পর্যন্ত অচেনা এক পৃথিবীর রং, রূপ আর গন্ধ। একইসঙ্গে বদলে যাচ্ছে সামনের দৃশ্যপট। নিঃসঙ্গ সেই সময়ে সপ্তাহান্তে মনি (মনিকা) আর রল্‌ফের হামবুর্গের বাড়িতে এবং অন্যত্র ওদের সঙ্গ ছাড়া আমার প্রধান সঙ্গী ছিল প্রকৃতি। তখনও পর্যন্ত সম্পূর্ণ অপিরিচিত এক প্রকৃতি। এমনিতেই প্রায় শ্বাসরোধকারী নৈঃশব্দ ওদেশের প্রকৃতির এক অবিচ্ছেদ্য চারিত্রিকতা। তার সঙ্গে যখন মিশে যায় দিগন্তচুম্বি সবুজের সমারোহ, এক অনবদ্য ক্যানভাস তৈরি হয় তখন। সে বছর প্রথম আরেকটি অভিজ্ঞতা হয়েছিল আমার। ঘন সবুজ ক্ষেত, সূর্যের আলো থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য দৈত্যাকার পাখা এসব তো ছিলই, হঠাৎ দেখলাম তার মধ্যে হলুদ, চোখ-ধাঁধানো হলুদ। জানতে পারলাম উজ্জ্বল পীতবর্ণ সেই শস্যের নাম রাপস্‌, যাকে আমরা রেপসিড বলে জানি। এইভাবে যখন প্রতিদিন সেই গরমকালের খুঁটিনাটি আবিষ্কার করছি, এক সপ্তাহান্তে কারিন আর ওর বন্ধু হ্বলে আমাকে নিয়ে হাজির হয়েছিল উত্তর জার্মানির সীমান্তে সমুদ্রের ধারে টোডেনহফ বলে একটি ছোট্ট জনপদে। সেদিনের সান্ধ্য আড্ডা আর রাত্রিবাসের কথা আগেই সবিস্তারে লিখেছি। পরদিন ছিল রবিবার। দুপুরের পর আমাদের আবার ঘরমুখো হওয়ার কথা। সকাল দশটা নাগাদ প্রাতরাশের জন্য আমরা মিলিত হয়েছিলাম। জানতাম না আমার জন্য সেখানে অপেক্ষা করে আছে এক বিস্ময়। সেইদিনই প্রথম পরিচিত হয়েছিলাম এই ‘সাদা সোনা’র সঙ্গে। জেনেছিলাম জার্মানদের সঙ্গে আস্পারাগাসের নাছোড় প্রেমকাহিনির কথা। সে প্রায় রূপকথার মতো। ২২ এপ্রিল থেকে ২৪ জুন সময়টা জার্মান ক্যালেন্ডারে বিশেষ উল্লেখের। এই সময়টায় জার্মানির কিছু বিশেষ অঞ্চলে পাওয়া যায় আস্পারাগাস। জার্মান ভাষায় যা ষ্পারগেল। আস্পারাগাসের জনপ্রিয়তা পশ্চিমি পৃথিবীর অনেক জায়গায় থাকলেও এই আপাত-সাধারণ খাদ্যটি নিয়ে জার্মান আবেগের কোনও তুলনা আর কোথাও পাওয়া যাবে না। এবং তার বর্ণ হওয়া চাই সাদা। এই সাদা ষ্পারগেলকেই সোহাগ করে ‘সাদা সোনা’ বলে সম্বোধন করে জার্মানরা। এক বিশেষ আবহাওয়ায় এবং মাটিতে জন্মায় এই ফসল। সঠিকভাবে বললে মাটির তলায়। এবং সূর্যালোক থেকে বঞ্চিত হওয়ার ফলেই এর রং হয় সাদা। ভোরবেলা টাটকা ষ্পারগেল তুলে খেতে হবে দুপুরের আগেই বা দুপুরবেলা। তবেই যে স্বাদটি একটি গোটা জাতকে মজিয়ে রেখেছে অনেক শতাব্দী জুড়ে, তার ঠিকঠাক মূল্যায়ন হবে।

তথ্য বলছে খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ এ প্রথম আস্পারাগাসের খোঁজ পাওয়া যায় মিশর দেশে। তারপর ইতিহাসের অনেক অধ্যায় পেরিয়ে রোমানদের হাত ধরে ইউরোপে প্রবেশ ঘটে আস্পারাগাসের কিন্তু তারপর কোন মন্ত্রবলে তা হয়ে উঠল জার্মান হেঁশেলের ভিতরমহলের সদস্য, তার শিকড়সন্ধান না করেও একথা বলা যায়, অনেক ক্ষেত্রে অনেক বিষয় থেকে যায় ব্যাখ্যার বাইরে। চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে গেলে হারিয়ে যেতে পারে তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মাধুর্যটি। তথ্য আরও বলছে সতেরো শতকে ফরাসিদেশে আজকের এই ষ্পারগেলের দেখা পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু ওই পর্যন্তই। এমন আভাস হয়ত সেদিনও ছিল না বছরের দু’মাস বস্তুটি এইভাবে জার্মানদের রান্নাঘরটি এইভাবে তার দখলে রাখবে। আগেই বলেছি জার্মানদের প্রিয় আস্পারাগাসের রং সাদা। ইউরোপের অন্যান্য দেশের খাবার টেবিলে সবুজ বা গোলাপি রঙা আস্পারাগাসের দেখা পাওয়া যায়। সাদা আস্পারগাসের সঙ্গে এদের একটা মৌলিক পার্থক্য আছে। সবুজ বা গোলাপি আস্পারাগাস ফলে মাটির ওপর আর সূর্যকিরণের প্রভাবে আপন খেয়ালে রং ধরে তাতে। আর সাদা আস্পারাগাস বা ষ্পারগেল হয়ে থাকে অসূরজম্পশ্যা। এর স্বাদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য বজায় রাখার জন্য কোনও মশলা ব্যবহার করা হয়না। সামান্য নুন দিয়ে সিদ্ধ করে নেওয়া হয়। সঙ্গে থাকে সিদ্ধ আলু, গলানো মাখন আর বেকন অথবা হ্যাম। মাখনের বদলে হলান্ডিস সসও ছড়িয়ে নিয়ে খাওয়া যেতে পারে। কিন্তু সেদিনের সেই শুরু থেকে যখনই ওই সময়ে ওদেশে থেকেছি আর ষ্পারগেল খাওয়ার সৌভাগ্য (হ্যাঁ ভেবেচিন্তেই লিখলাম, সৌভাগ্য) হয়েছে, গলানো মাখনকেই ষ্পারগেলের শ্রেষ্ঠ জুড়িদার বলে মনে হয়েছে আর সঙ্গে নিশ্চিতভাবেই চেয়েছি শিঙ্কেন ওরফে বেকন।

বছরের কোনও এক সময়ে একটি বিশেষ সবজির ফলনকে নিয়ে এমন উছ্বাস আর তাকে কেন্দ্র করে উৎসব - পৃথিবীর নানান প্রান্তে খাদ্যবস্তু নিয়ে এই ধরনের উন্মাদনা বিরল নয়। এক্ষেত্রে নজর কাড়ার মতো বিষয়টি হল এর অনুপুঙ্খতা, যার জন্য উত্তর-পশ্চিম জার্মানির প্রায় সাড়ে সাতশো কিলোমিটারের একটি বিস্তীর্ণ অঞ্চলের নামকরণ হয়েছে ‘ষ্পারগেল সরনি’, এর মধ্যে লোয়ার সাক্সনির নিনবুর্গে রয়েছে একটি ষ্পারগেল যাদুঘর, যেখানে একটি চারশো বছরের পুরনো কাঠের বাড়িতে পাওয়া যাবে সুদূর অতীত থেকে এখনও পর্যন্ত সংগৃহীত ষ্পারগেল-সংক্রান্ত যাবতীয় জ্ঞাতব্য। জানা যাবে কেমন ছুরি ব্যবহার করতে হয় ক্ষেত থেকে ষ্পারগেল কেটে আনার জন্য। কীভাবে কখন গলাধঃকরণ করতে হয় নরম, কোমল এই খাদ্যটিকে। মানের দিক থেকে যদিও সেরা বলে ধরে নেওয়া হয় বাডেন-হ্বুরটেম্বার্গের শোয়েৎসিঙ্গেনের ষ্পারগেল, যে কারণে শোয়েৎসিঙ্গেন-কে বলা হয় ষ্পারগেল রাজধানী।

টোডেনহফের সেই রবিবাসরীয় সকালে প্রথমবার ষ্পারগেল খাওয়ার সময়েও আসল বিষয়টি আবিষ্কার করতে পারিনি। সেদিনের কয়েকবছর পর আমাদের খাদ্যরসিক বন্ধু রল্‌ফের হামবুর্গের বাড়ির পিছনের বাগানে একদিন ষ্পারগেল-সমন্বিত মধ্যাহ্নভোজের আড্ডায় উপলব্ধি করেছিলাম মাটির সঙ্গে মানুষের আজন্মলালিত সম্পর্কই আসলে এমন আবেগকে উসকে দিতে পারে। সেই পথেই জন্ম নেয় এক একটি খাদ্য সংস্কৃতি। বাকিটুকু আড়ম্বর বললে অত্যুক্তি হবে না

0 comments: