0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - দিলীপ মজুমদার

Posted in






সাহিত্যের সঙ্গে বাঙালির প্রাণের যোগ । নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু বোধহয় তার একটা কারণ । বাল্যকালে কবিতা বা ছড়া লেখেন নি , গান শুনে মুগ্ধ হন নি , এমন বাঙালি বিরল । তবে সাহিত্য নিয়ে আলোচনা , বৈঠক , সম্মেলন –এ সব ব্যাপার মধ্যযুগে ছিল না । এটা পাশ্চাত্য প্রভাবের ফল । উনিশ শতকের নবজাগরণেই তার সূত্রপাত । । উনিশ শতকের প্রথমার্ধে সাহিত্যকে কেন্দ্র করে সংঘবদ্ধ হবার প্রয়াস দেখা যায় । ‘বঙ্গীয় সাহিত্য সভা’ গঠিত হয় ১৮৩৬ সালে । তার আগে হিন্দু কলেজের শিক্ষক ডিরোজিও গঠন করেছিলেন ‘ অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন । ঈশ্বর গুপ্তের ‘সংবাদ প্রভাকর’ , অক্ষয়কুমার দত্তের ‘তত্ত্ববোধিনী’ , বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকাকে কেন্দ্র করেও তৈরি হয়েছিল লেখক গোষ্ঠী । সেখানে লেখকরা মাঝে মাঝে মিলিত হয়ে সাহিত্য নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতেন ।

আধুনিক সাহিত্য সম্মেলনের ভ্রূণ ছিল ‘বঙ্গ একাডেমি’ অথবা ‘ বঙ্গীয় সাহিত্য সমাজে’র ( ১৮৭২) মধ্যে । এই একাডেমির প্রস্তাবক কোন বাঙালি নন , একজন ইংরেজ সিভিলিয়ান , জন বীমস । বাংলা ভাষার স্থিরতা বিধানের জন্য তিনি এই একাডেমি গঠনের প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন । একাডেমিটি বাস্তবায়িত হলে সেখানে অবশ্যই বাংলা ভাষার আলোচনার পাশাপাশি বাংলা সাহিত্য স্থান করে নিত । কিন্তু তখনকার কালের বিশিষ্ট বাঙালিরা জন বীমসের প্রস্তাবকে গ্রাহ্য করেন নি । ১৮৮২ সালে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘কলিকাতা সারস্বত সম্মেলন’ , বঙ্কিমচন্দ্র যার নাম দিতে চেয়েছিলেন ‘ একাডেমি অব বেঙ্গলি লিটারেচর’ । এই সংগঠনটি অল্প কিছুকাল পরে ‘সারস্বত সমাজ’ নামে পরিচিত হয় । ১৮৯৩ সালে জন্ম হল আর একটি গুরুত্বপূর্ণ সংগঠনের । তার নাম ‘দ্য বেঙ্গল একাডেমি অব লিটারেচর’ । এর উদ্যোক্তা ছিলেন বিনয়কৃষ্ণ দেব , এল লিওটার্ড , হীরেন্দ্রনাথ দত্ত , ক্ষেত্রপাল চক্রবর্তী প্রমুখ ।

এই বেঙ্গল একাডেমি থেকে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের জন্ম ১৮৯৪ সালে । সাহিত্যানুরাগী যে কোন মানুষ এর সদস্য হতে পারতেন । সভাপতি , সহকারী সভাপতি , দুই সম্পাদক ও ৬ সদস্য নিয়ে গঠিত হয় এর কার্যনির্বাহক সমিতি । সাহিত্য পরিষদের তিন ধরনের অধিবশন হত – মাসিক অধিবেশন , বিশেষ অধিবেশন ও বাৎসরিক অধিবেশন । রমেশচন্দ্র দত্তের সভাপতিত্বে সাহিত্য পরিষদের প্রথম বার্ষিক সম্মেলন হয় ১৮৯৫ সালের ৫-৬ এপ্রিল । সাহিত্য পরিষদের ১২টি বার্ষিক অধিবেশনের বিবরণ পাওয়া যায় ড. অমরনাথ করণের বইতে । বাংলার বাইরে পরিষদের বিস্তৃতির মূলে আছে রবীন্দ্রনাথের প্রস্তাব । পঞ্চম বার্ষিক অধিবেশনে তিনি প্রস্তাব করেন বাংলার বিভিন্ন জেলায় পরিষদের শাখা স্থাপন করা হোক এবং অনুষ্ঠিত হোক বার্ষিক অধিবেশন ।

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে ১৯০৬ সালে বরিশাল প্রাদেশিক সম্মেলনের মঞ্চে বঙ্গীয় প্রাদেশিক সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করা হয় এবং রবীন্দ্রনাথকে নির্বাচিত করা হয় সভাপতি । তবে এই সম্মেলন পণ্ড হয় ইংরেজ সরকারের দমনমূলক নির্দেশে । ১৯০৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর কলকাতায় ‘সাহিত্য সম্মিলন’ নামে একটি সংগঠনের জন্ম হয়েছিল , যার সভাপতি ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সম্পাদক নরেন্দ্রনাথ সেন । ‘সাহিত্য সম্মিলনে’র উদ্যোগে ২০০৭ সালের ১৯ জানুয়ারি যে সারস্বত সম্মিলন অনুষ্ঠিত হয় সেখানে রবীন্দ্রনাথ পাঠ করেন তাঁর ‘সাহিত্য সম্মিলন’ প্রবন্ধটি, যা বরিশাল প্রাদেশিক সাহিত্য সম্মেলনের জন্য তিনি লিখেছিলেন ।

প্রতি বৎসর বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছিল বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ । এর প্রথম অধিবেশন হয় বহরমপুরের কাশিমবাজারে , ১৯০৭ সালের ৩-৪ নভেম্বরে । সভাপতি রবীন্দ্রনাথ ; উপস্থিত ছিলেন মনীন্দ্রচন্দ্র নন্দী , যোগেন্দ্রনারায়ণ রায় , রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী , ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় , হেমচন্দ্র রায় , শশধর রায় , অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় , জগদানন্দ রায় , শিবচন্দ্র বিদ্যানিধি প্রমুখেরা । প্রথম অধিবেশন থেকে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে কুমিল্লায় অনুষ্ঠিত (১৯৩৮) দ্বাবিংশ সম্মেলন পর্যন্ত নিয়মিত হয়েছে বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মিলনের অধিবেশন । তারপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকায় তার কার্যক্রম বন্ধ থাকে । ১৯৫৯ সালে শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে মেদিনীপুরের বৈষ্ণবচকে যে ত্রয়োবিংশ অধিবেশন হয় , সেখানে সংগঠনটি ‘বঙ্গ সাহিত্য সম্মিলন’ নাম ধারণ করে ।

বাংলাদেশের অন্যান্য জেলার মতো উত্তরবঙ্গেও সাহিত্য পরিষদের শাখা স্থাপিত হয় । উত্তরবঙ্গের শাখার উদ্যোগে আয়োজিত হয় উত্তরবঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের । এখানে ১৯০৮ সালের ২৭ জুন প্রথম সম্মেলন হয় রংপুরে অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়ের সভাপতিত্বে । পরবর্তী সম্মেলনগুলি হয় বগুড়া , গৌরীপুর , মালদহ , কামাখ্যাধাম , দিনাজপুর , পাবনা , রাজশাহি , রংপুর, বগুড়া প্রভৃতি স্থানে ।

বাংলাদেশের বাইরে , ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে জীবিকার সূত্রে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিলেন বহু বাঙালি । সাহিত্য রসপিপাসা চরিতার্থ করার জন্য তাঁরা স্ব স্ব অঞ্চলে গড়ে তুলেছিলেন সাহিত্য সংগঠন । যেমন লাহোরের ‘বঙ্গ সাহিত্যসভা’ , সিমলার ‘বান্ধব সমিতি’ , কাশীর ‘বঙ্গসাহিত্যাশ্রম’ , কানপুরের ‘বঙ্গ সাহিত্য সমাজ’ । কিন্তু প্রবাসী বাঙালিরা একটি কেন্দ্রীয় সাহিত্যমঞ্চের জন্য আকাঙ্খিত ছিলেন , যেখানে নানা রাজ্যের বাঙালি প্রতিনিধিরা মিলিত হতে পারবেন । ১৯২২ সালে সাহিত্য পরিষদের বারাণসী শাখার এক অধিবেশনে কানপুরের সুরেন্দ্রনাথ সেন , লক্ষ্মৌএর অতুলপ্রসাদ সেন , কাশীর ললিতবিহারী সেনের উপস্থিতিতে ‘ উত্তর ভারতীয় বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের’ পরিকল্পনা করা হয় । ১৯২৩ সালের ৩-৪ মার্চ কাশীতে উত্তর ভারতীয় বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের প্রথম অধিবেশন হয় । সম্মেলনে আগ্রা , লাহোর , পাটনা , দিল্লি , রামপুর , বারাণসী , এলাহবাদ , কানপুর , লক্ষ্মৌএর বিশিষ্ট প্রতিনিধিরা যোগদান করেন । সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন রবীন্দ্রনাথ । ১৯২৩ সালের ২৬-২৭ ডিসেম্বর এলাহবাদে এর দ্বিতীয় অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় প্রমথনাথ তর্কভূষণের সভাপতিত্বে । অমরনাথ করণ লিখেছেন , “ এর পর লক্ষ্মৌতে অনুষ্ঠিত তৃতীয় অধিবেশনে (১৩৩১) সংস্থাটি ‘প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন’ নামে আত্মপ্রকাশ করে । ১৯৫২ সালে কটকে অনুষ্ঠিত অষ্টাবিংশতি অধিবেশন পর্যন্ত এই নামে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশে সম্মেলন হয়েছে । এর মধ্যে ১৯২৯ সালের ১৩ জুন লক্ষ্মৌতে সম্মেলনটি ‘প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন’ নামে রেজিস্ট্রিও করা হয় । ” ১৯২৯ থেকে ১৯৫২ পর্যন্ত প্রবাসী বঙ্গে সাহিত্য সম্মেলনের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়েছে বারাণসী , এলাহবাদ , লক্ষ্মৌ , কানপুর , দিল্লি , মীরাট , ইন্দোর , নাগপুর , আগ্রা , এলাহবাদ , গোরখপুর , কলকাতা , দিল্লি , রাঁচি , পাটনা , গৌহাটী , কানপুর , জামসেদপুর , বারাণসী , এলাহবাদ , দিল্লি , কানপুর , মীরাট , কলকাতা , বোম্বাই , দিল্লি , পাটনা , কটক প্রভৃতি স্থানে ।

১৯৫৩ সালে জয়পুরের অধিবেশনে আবার পরিবর্তিত হয় সংগঠনের নাম । ‘প্রবাসী’ শব্দটি অনেকের আপত্তির কারণ হয় । নতুন নাম হয় ‘নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন’ । ১৯৮১ সালের ২১ ডিসেম্বর এই নামেই সংস্থাটিকে রেজিস্ট্রি করা হয় । ঐতিহ্যবাহী এই সংগঠনের বার্ষিক অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেছেন দেবেশ দাস , নীহাররঞ্জন রায় , দেবীপ্রসাদ রা্যচৌধুরী , হুমায়ুন কবীর , নির্মলকুমার সিদ্ধান্ত , সত্যেন্দ্রনাথ বসু , কালিদাস রায় , দিলীপকুমার রায় , শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় , তুষারকান্তি ঘোষ , বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় , প্রেমেন্দ্র মিত্র , আশাপূর্ণা দেবী , অশোককুমার সরকার , শিবনারায়ণ রায় , প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত , প্রবোধচন্দ্র সেন , অন্নদাশংকর রায় , রাধারাণি দেবী , সত্যেন্দ্রনাথ রায় , সমরেশ বসু , লীলা মজুমদার , জগদীশ ভট্টাচার্য , অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় , প্রতাপচন্দ্র চন্দ্র , সুভাষ মুখোপাধ্যায় , মনিশংকর মুখোপাধ্যায় প্রমুখেরা । ২০২২ সালে শতবর্ষে পা দিয়েছে এই সংগঠন । শতবর্ষের সে অনুষ্ঠান হবে কলকাতায় । আগামী ডিসেম্বর মাসে । ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের প্রতিনিধিরা তো থাকবেনই , তার সঙ্গে ভারতের বাইরের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানানো হবে । আমন্ত্রণ জানানো হবে মাননীয় রাষ্ট্রপতিকে । আয়োজকরা একটি চমৎকার প্রদর্শনী ও তথ্যচিত্রেরও পরিকল্পনাো করেছেন । [ লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত ( ভারত সরকার ) গবেষক ও কলামিস্ট ]

ঋণ :

সাহিত্য সম্মেলনের গবেষক ড. অমরনাথ করণের ‘ সাহিত্য সম্মেলনের ইতিবৃত্ত’ ( নবজাতক প্রকাশন , ১৯৯৪ ) ; ‘বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মিলনের প্রথম অধিবেশন ও রবীন্দ্রনাথ’ ( বঙ্গীয় সাহিত্য সংসদ , ২০১৩) ; ‘সভাপতির অভিভাষণ/ বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মিলন ১৯০৭-১৯৩৯’ ( লালমাটি , ১৪২৪ ) ; ‘সভাপতির অভিভাষণ / উত্তরবঙ্গ সাহিত্য সম্মিলন’ ( লালমাটি , ২০১৯ )

0 comments: