6

গল্প - নন্দিনী বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in




















'ভোর? ভোরবেলা? আমার দুধ ভোর? উঠেছিস? ওঠ, ওঠ, ওঠ বলছি এক্ষুনি! নইলে কিন্তু আমি...'

উঠলাম। খচমচ করে। বাঁ হাতটা ঝিঁঝিঁতে অবশ, বাঁদিকে চাপ দিয়ে শুয়ে ছিলাম আবারও। টিভিতে হাত-পা নেড়ে নারী পুরুষ ব্রণের দাগ মেলানোর মলম বিক্রি করছে। টিভিটা মিউট, তবে আমি প্রতিটা কথা জানি।

বারান্দার দরজাটা আবারও লাগাতে ভুলেছি। তমোঘ্ন'র মুখটা ভেসে উঠেই মিলিয়ে গেল। ডিয়ানার বারান্দায় বাহারি চাইমের টুংটাং কানে এলো। পর্দার ফাঁকে ছানার জলের মতন ভোর দুলছিল। ঘরের ভেতর আলো-আঁধারিতে আমিও দুলছিলাম। অনন্যার ভোর। সুপ্রতীকের ভোর। তমোঘ্ন'র ভোর নয় আর।

স্বপ্নগুলো আমার সব সময় ওমনি। কমলালেবুর ছাড়ানো খোসার মতন, রঙিন, মেদুর, সুগন্ধীও কিন্তু একেবারে খালি, এলোমেলো। এর বেশি কখনওই তেমন কিছু দেখি না। খালি গলাটা শুনি, অবোধবেলার মায়ের গলা। যখন স্বপ্নগুলো ঘোড়ায় চড়ে আসত, যখন ঘুমটা ছিল আদরের, ভালোবাসার, কাঙ্ক্ষিত। যখন গায়ের চাদরটাকে কয়েক পাক জড়াতাম সারা গায়ে ঘুমের ঘোরে আর বাবা ডাকতো গুটি পোকা।

প্যাটিওতে সকাল হচ্ছে। গাছগুলো জেগে উঠছে। বেগোনিয়া আর জেরোনিয়াম আমার মুখে হাসি ফোটানোর জন্য প্লামবেগোর সাথে মাথা দুলিয়ে হাসছে আর আমি এক বিষম বিপন্নতায় ওদের মাঝে দাঁড়িয়ে হারাতে চাইছি এই গোমরা আমি কে, কিন্তু পারি কই?

ডাক্তার জনসন, যে সাইকোলজিস্ট এর কাছে আমি সবচেয়ে বেশিদিন গিয়েছিলাম, আমায় বলতেন, ''Talk like I'm not here...talk to yourself, only aloud..."

আমি অবাক চোখে তাকিয়ে বলেছিলাম, "I do that all the time, in the crowded aisles of Walmart, while making dinner by myself, in parties I used to get dragged into attending..."

কিন্তু ওঁর সামনে আমি কিছুতেই পারিনি। সচেতন ভাবে অনেক চেষ্টাতেও পারিনি মনকে কথা বলাতে। উনি তখন জার্নাল লেখার কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, যা কিছু নিয়ে লিখতে রোজ, মন খারাপ বা ভালো থাকার কথা, পাওয়া বা না পাওয়া, তার কথা লিখতে যাতে যখন ওঁর কাছে যাব তখন ওগুলো নিয়ে আলোচনা বা বিশ্লেষণ করা যায়।

আমার কলিগ লিজার মেয়ে সুসান তখন সাইকোলজি নিয়ে পড়াশোনা করছিল। সুসান শুনে বলেছিল, "sound unconventional, but hey to each his own, right?"

আমি জার্নাল লিখতাম। ডক্টর জনসনের কাছে যাওয়ার আগের রাতে। পরীক্ষার পড়ার মতন। বাদবাকি সপ্তাহটা রোজ ভাবতাম জার্নাল লিখতে হবে কিন্তু লিখতে বসা হত না। প্রতিরোধটা ভেতরের, পাঁচিলের ওপর পাঁচিল বসানো, বাসনটা মাজা হয়নি, আইডলটা একবারও দেখা হয়নি, লাইব্রেরী থেকে একটা বই দুবার রিনিউ করেছি কিন্তু এক পাতাও পড়া হয়নি। নিজের কাছেই নিজের সাফাই।

জার্নালটা তাই দায়সারা মতো। আড়ালটা থেকেই যেত। এসব তমোঘ্ন চলে যাওয়ার পর অবশ্য। যখন একদিন lunch-এ বেরিয়ে Pizza-য় কামড় দিয়ে হঠাৎ এক টেবিল সহকর্মীদের সামনে ডুকরে কেঁদে উঠেছিলাম, তার পর দিন, মেলিসা আমার সহকর্মী, খুব সন্তর্পনে ডক্টর জনসনের কথা তুলেছিল। বলেছিল যে আমি সবকিছু চাপা দেওয়ার চেষ্টা করছি। নিজে নিজেই সামলানোর চেষ্টা করছি তমোঘ্নর চলে যাওয়াটা, আর তারই জন্য নাকি আমি হঠাৎ কোনও আপাত কারণ ছাড়াই ভেঙে পড়েছিলাম সবার মাঝে।

আমি যেন বাহারি ফুলদানি, ভেঙ্গে পড়ার জন্য ব্যাকুল। খুব রাগ হয়েছিলো শুনে।

চুপচাপ শুনে শূন্য ঘরে ফিরে এলাম। ক'টা দিন কেটে গেল মোটামুটি স্বাভাবিক ভাবে। অফিস - বাড়ি, সপ্তাহের বাজার, লাইব্রেরী, চাইনিজ খাবার আর জলের বিল, গতানুগতিক বেঁচে থাকা, যেমন থাকে আরও অনেকেই। আর তারপর হঠাৎ এক রবিবারের সকালে উঠে দেখলাম আগের রাতের ঝরে উল্টিয়ে পড়ে আছে আমার আদরের বেগোনিয়া, গোলাপি পাঁপড়ি কাদায় মাখামাখি আর আমি উবু হয়ে বসে ভাঙা টব আর লুটানো ফুল হাতে নিয়ে, আবার টুকরো টুকরো হয়ে ভাঙলাম।

মনে আছে সোমবার সকালে মেলিসার কাছ থেকে নম্বর নিয়ে ডক্টর জনসনের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছিলাম। উনি খুব চেষ্টা করেছিলেন। আমার প্রতিরোধটা যদিও ছিল আরও নাছোড়বান্দা। উনি যখন বলতেন, আমার গলাটা বুজে আসতো, যদিও চোখ উপচিয়ে উঠত। আমি ওঁকে বোঝাতে পারিনি, যেমন তমোঘ্নকেও কখনও বোঝাতে পারিনি যে নিজের কথা, চাওয়া - পাওয়া, ভালোলাগা - মন্দলাগা মুখ ফুটে বলতে আমি কোনওদিন শিখিনি।

যে আমাকে ভালবাসে সে তো আমি কী ভাবছি, কী ভালবাসি না বাসি চোখের আয়নার মধ্যে প্রতিবিম্বিত দেখতে পায়। আমি তো ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝি এক টেবিল লোকের মাঝে যে ও নুন খুঁজছে না গোলমরিচ। ও যখন অফিস পার্টিতে কথা বলতে বলতে আমার চোখে চোখ বাঁধতো, ক্লান্তি বা আমোদ সহজেই পড়ে নিতাম। ড্রয়ারে যেমন চামচ রাখা থাকে গায়ে গা মিলিয়ে, রাতে তেমনভাবে পাশে ফিরে ড্রয়ারের চামচ না হলেই জানতাম যে সেদিন ওর মন ভালো নেই। কই ওকে তো কখনও মুখে কিছু বলতে হয়নি।

অথচ ও চলে যাওয়ার পরে একবার অনুরাধাদিকে বলেছিল যে ও নাকি কখনও বোঝেইনি যে আমি সঠিক কী চাই। কখন যে রাগ হত বা দুঃখ, কেন যে হঠাৎ বিনা কথায় চোখের জলে ভাসতাম ও বলেছিল ওর পক্ষে ফিগার করা আর সম্ভব হচ্ছিল না। বলেছিল যে জীবনে অনেক অংক করেছি, জীবিকার কারণে করতেও হয়, বাড়ি গিয়ে ওই জটিলতা আর ভালো লাগতো না। বলেছিল যে ও হাপিয়ে উঠেছিল আমার সান্নিধ্যে। বলেছিল যে ও সরল জীবন চায়, এত বাঁক, এত চোরা ঘুর্নি ওকে ভেতরে ভেতরে শুকিয়ে দিচ্ছিল।


আমার জীবনে আমি যাদের ভালবেসেছি তারা প্রায় সকলেই একসময় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে আমার থেকে। মনে হয় আমার কাঙালপনায় ওরা হয়তো শুকিয়ে যায় ভেতরে ভেতরে। আমি হয়তো এমন ভাবে আঁকড়ে ধরি জলে ডুবন্ত মানুষের মতো যে ওদের নিজস্ব সত্তা সংকটে পড়ে যায়।

আসলে তমোঘ্নকে আমি দোষ দিই না। কলেজে যে ছেলেটা আমায় ভালোবেসেছিল, যে আমার শত সহস্র খুশির জন্য নিলাম করতো ক্লাবের টেবিল টেনিস বা পাড়ার আড্ডা, সে তো কবেই নিরুদ্দেশ। তাই তো হয়। কেউ কেউ পাশে থেকে যায়, টুকটাক কথা বলে সুখ-দুঃখের, অসুখ-বিসুখে জলপট্টি আর গলা ভাত কিন্তু আদতে ওই অভ্যেসে কর্তব্য করছে। প্রয়োজনে পাশে দাঁড়াচ্ছে। অন্য আর পাঁচজন যা করে।

আর কেউ কেউ আছে যারা হঠাৎ হারিয়ে যায়। বাথরুমে এক বালতি গেঞ্জি - সায়া - কাপড় সার্ফে ভিজিয়ে, কড়াই-এ ঝিঙেতে পোস্ত বাটা দিয়ে,টেবিলে মাসকাবারি বাজারের ফর্দ লিখেও নিঃসারে চলে যায়, কোনও পথ নির্দেশ না রেখে। যেমন অনন্যা। অসীম বিষণ্ণতায় আর বিপন্নতায় আমি আর বাবা, বাবা আর আমি তলিয়ে গিয়েছিলাম এক অন্ধ কুয়োর মধ্যে। দিনরাত্তিরের হিসেব, স্কুল - কলেজের ক্লাস গুলো, দুর্গাপুজো আর দীপাবলীর আলো জ্বালা রাত্তির, সব গভীর আঁধারে ঢেকে গিয়েছিল।

থানা পুলিশ হয়েছিল। পাড়া পড়শির উদ্বেগ - কৌতূহল - ইঙ্গিত ক্রমশ সব থিতিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মাকে আর পাওয়া যায়নি। তাও আজ প্রায় কুড়ি বছর হয়ে গেল। আলমারিতে শাড়ি ছিল পাটে পাটে, মাসকাবারি টাকা, টুকটাক কানের দুল, আংটি, শোকেসে মায়ের বাবার আঁকা ছবি, সব ছিল, শুধু আমার মা-ই হারিয়ে গেল।

আমার সেই জুলাইয়ে কুড়ি হয়েছিল। তমোঘ্নর সঙ্গে আলাপ তার আগের বছর থেকে। লাজুক, নরম দাড়ি, উজ্জ্বল চোখ যুবক। মায়ের হারিয়ে যাওয়াটা আমি আর বাবা কেউ মেনে নিতে পারছিলাম না আর ওই সময় থেকে ও বাড়িতে আসা যাওয়া শুরু করল। এসে আমার আর বাবার সঙ্গে গল্প করত, টিভি দেখত, কখনও সখনও রাতের খাবার খেয়ে যেত যাতে আমাদের খাওয়া হয়। আমাদের তখন বিকেলে রাধুনী মাসি আসতো। এমন অনেক দিন হয়েছে যে তমোঘ্নই ক'টা ডিম আর আলু নিয়ে এসেছে পাড়ার দোকান থেকে কারণ বাজার যাওয়ার কথা আমাদের কারো মনেই পড়েনি।

আস্তে আস্তে উপরের মুখপাতটা একটু স্বাভাবিক হল। ভেতরের ক্ষত যদিও কুড়ে কুড়ে খেত আমাদের। আজ কুড়ি বছর পরও বিদেশের পথে যদি কোনও একপিঠ বিনুনি করা উজ্জ্বল শ্যাম রমণী দেখি তবে সাবওয়ে বা বাস বা ট্যাক্সি যাতেই থাকি না কেন তার মুখ দেখার জন্য এক নিমেষে পিছু নিই। আমার বুদ্ধিমতী মা চেনা ভিড়ের মাঝে হারিয়ে যাবে আমি যে আজও তা মেনে নিতে পারি না। একটা জলজ্যান্ত মানুষ যেন হঠাৎ কোনও মন্ত্রবলে উধাও হয়ে গেল। আমাদের সাজানো তিন জনের পরিপাটি সংসার এক লহমায় এলোমেলো। ভেঙেচুরে একাকার।

ডঃ জনসন আমাকে অনেকবার মায়ের হারিয়ে যাওয়া নিয়ে কথা বলতে বলেছিলেন, কিন্তু আমি কেবল আমার ছোটবেলার কথা বলতাম। মায়ের কানের জ্বলজ্বলে মুক্ত আর থোকাথোকা চুল, ল্যাভেন্ডার ডিউ সাবান আর চুরির রিনঠিন, আনমনে গাওয়া গান আর চুপচাপ গ্রিলের বারান্দায় বাবার বাড়ি ফেরার পথের দিকে তাকিয়ে থাকা... খালি সেগুলোই লিখতাম। আমার ভালো থাকার দিনগুলোর কথা।

তমোঘ্নর কথা যখন লিখতাম তখন বিয়ের আগের ভাললাগা, ভালবাসা, বিয়ের পর এদেশে আসার দিন গুলোর কথাই আমি খালি লিখতাম। আমার অবচেতন আমাকে কিছুতেই আমার মন খারাপের মুখোমুখি হতে দিত না। যেমন একবার অনেকদিন পর বৃষ্টি দেখে আমি ভিজবো বলেই হাঁটতে বেরিয়েছিলাম আর একটু পরে দেখি আমার পাশে ও-ও পায়ে পা মিলিয়েছে। সেটার কথা লিখেছিলাম — আমার ভীষণ ভালো লেগেছিল যে — কিন্তু কিছুতেই লিখতে পারিনি যে সেই রাতে যখন আমার হাঁচি, কাশি, গলা খুসখুস তখন আমার নির্বুদ্ধিতার জন্য আমায় ফালাফালা করে দিয়েছিল। কখনও লিখিনি যে যদি কখনও ব্যথা পেয়েছি বা শরীরটা খারাপ হয়েছে তবে সেটা আমার অপারগতার জন্যই যে হয়েছে সেটাই বারবার প্রমাণিত করত ও।

আমাকে যে ও কি পরিস্থিতি থেকে সামলিয়েছে আর সমানে সামলিয়ে যাচ্ছে খালি সেই কথাই ঘুরেফিরে – এ কথা আমি কোনওদিন শেয়ার করতে পারতাম না। প্রতিরোধটা ভেতরের — ওকে কারোর সামনেই যে ছোট হতে দিতে পারতাম না।

তাই যাওয়াই ছেড়ে দিলাম ডাক্তারের কাছে। নিজেকে মোটামুটি সামলিয়ে নিলাম।


সপ্তাহে দু-বার বাবার কাছে যাই। Alzheimers-এ ভুগছে বছর ছয়েক। একটা বয়স্ক অসুস্থ মানুষদের নার্সিংহোমে থাকে। চোখের দৃষ্টি প্রায় শূন্য। এই মানুষটা চোখের সামনে তিল তিল করে সব হারালো। কখনও সখনও বিড়বিড় করে ডাকে 'ছোট' - 'ছোট' — মা'কে তাই বলেই ডাকত বাবা। মাস তিনেক আগে লাজুক হেসেছিল আমায় দেখে।

অনন্যার ভোর। সুপ্রতীকেরর ভোর হারিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। তমোঘ্নর ভোর তো দু'বছর ১৬ দিন আগেই হারিয়ে গিয়েছে। একাকী যখন সিঁড়ি দিয়ে উঠি, দুপদাপিয়ে নেমে যায় আমার প্রতিবেশীর সাত বছরের ছেলে Joshua। তিন তলার দরজার ভেতরে ডাকে লিজার কুকুর জিপসি ... আমার খুব ইচ্ছা করে সব ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে — কোনও দিকে না তাকিয়ে, কিন্তু পারি কই? যদি ফিরে আসে অনন্যা? কলকাতার বাড়িতে বড় বড় করে ঠিকানা আছে এখানকার। যদি ফিরে আসে সুপ্রতীক? আবার? কত উন্নতি তো হচ্ছে আজকাল, কত গবেষণা, কত নতুন ওষুধ। যদি ফিরে আসে তমোঘ্ন? একবার অফিসে আধাপথ গিয়ে ফিরে এসেছিল উল্টানো নখ নিয়ে, পা এগিয়ে বলেছিল, "ভাগ্যিস তুমি বেরোওনি এখনও!"

তাই আরও একদিন থেকে যাই। চা বসাই। টিভি চালাই। আমার বেগোনিয়া আর জেরেনিয়ামকে জল দিই, গায়ে হাত বোলাই।

6 comments:

  1. এক লহমায় শুষেছি অনন্যা- তমোঘ্ন- সুপ্রতীক- বেগোনিয়া- জলপট্টি- আলুডিম। আর প্রতিরোধের অস্তরাগ।

    ReplyDelete
  2. Lekha ta pore mon bhore gelo. Oshadharon , Onobodyo

    ReplyDelete
  3. Wonderful composition. Superb imagery......pensive, smooth, very touching. Loved the writing style.

    ReplyDelete