ধারাবাহিক - শ্যামাপ্রসাদ সরকার
Posted in ধারাবাহিক(৪)
' নৈকট্যের অভাব নেই আমাদের
শুধু একটা নদী নেই কাছে।
জ্বলে আকাশ ভরা তারা
তবু অমরত্ব বাঁচে।
কেন পাইনা ছুঁতে আলো
জমে মনের কোণে ক্ষোভ।
উন্মাদ হই আমি
আমার যে খুব লোভ...'
অরাতিদমনের পাঠানো এই লাইনগুলো আজ ইনবক্সে পড়তে পড়তে রাইএর ভেতর থেকে উদ্গত কান্নাগুলো সব গুঁড়ি মেরে ঠেলে বেরিয়ে এল। কিছু কিছু কথা সঙ্গোপনে রয়ে গিয়ে অকারণেই গভীরতার তল খুঁজে মরে। এই খোঁজাখুঁজিতে শান্তি নেই মোটেও তবুও যেন একটুখানি আঁকড়ে পাওয়ার আকাঙ্খাকে ছেড়ে দিতেও মন চায় না। সম্পর্কের সহজতায় আজকাল খুব তীব্র স্পর্শে অরাতিকে মাঝে মাঝে ছুঁতে ইচ্ছে করে রাইএর। একটা বাঁধভাঙা আদরের পর ক্লান্তিজর্জর রাগমোচন, যেটা এখনো পর্যন্ত অধরাই তার জন্য বেঁচে থাকতে লোভ হয়। ঐহিক সমর্পণের একটা চোরাটান সে আজকাল টের পায় ভিতরে ভিতরে। যদিও এভাবে অভিসারে যাওয়া আজকের দিনে খুব একটা কঠিন নয় মোটেও; কিন্তু তাও কেন এত হাজারো দ্বিধা সামনে এসে বারবার দাঁড়িয়ে পড়ে?
রাই একটা অদ্ভূত ব্যাপার লক্ষ্য করেছে যে সে ফোন করলে বা ভিডিও কল করলে অরাতিদমন তা কখনো তা ধরে না বা পরে নিজেও কলব্যাক করে না। এ নিয়ে প্রশ্ন করলে আজন্মকালের রহস্য মেলে ইনবক্সে সে পাঠায় তার কন্ঠের প্রত্যুত্তরের বার্তা কিংবা অজানা আদিম অক্ষরবৃত্ত আর মধুমূরলীর টুকরো সুর। রাই ভাবে ও হয়তো ধরা দিতে চায় না। বোধহয় বাঁধা পড়তে চায়না কিংবা হয়তো চরিত্র ভাল নয়, ক্যাসানোভা গোত্রীয় হয়তো।
কিন্তু অরাতির ঘনঘন বদলে যাওয়া প্রোপিক বা টাইমলাইনের ছবি গুলো দেখলে পালান খেতে চাওয়া গাভীর মত চঞ্চল হয়ে ওঠে রাই। এত বিদ্যূত ধরে রাখার স্পর্ধা কি করে পায় সে?
খানিক পরে তিতলির সাথে অনেকক্ষণ ধরে ভিডিও কলে কথা হল। ওর পরীক্ষার পর তিতলি চাইছে মা-বাবার সঙ্গে ওর বয়ফ্রেন্ডের পরিচয় করিয়ে দিতে। ছেলেটিরও অল্প বয়স ওদের ইনস্টিটিউটের নবীনতম অধ্যাপক, ভাল কবিতা লেখে আর ছেলেটি, নাকি তার বাবার চাকরিসূত্রে শান্তিনিকেতনে ছোটবেলায় থেকেছে ! ব্যস্ এইটুকুই বলল আপাতত! বাকি সংলাপ আর প্রলাপ হবে সাক্ষাতে।
আজ বিকেলের দিকে একটা অদ্ভূত ঘটনা ঘটল। ওয়াটার পিউরিফায়ারটা সার্ভিসিং করাতে অনেকদিনই লোক ডাকা হয়েছিল। ঠিক কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে তিনটেয় বেল বাজার পর রাই দরজা খুলে যাকে দেখলো তাকে কখনো এভাবে এই বেশে দেখবে তা সে কস্মিনকালেও ভাবেনি। নামী বহুজাতিক ওয়াটার পিউরিফায়ার কোম্পানির সার্ভিস এক্সিকিউটিভের বেশে আবার কুড়ি বছর পর ঋজুর সাথে এভাবে আচম্বিতে দেখা হয়ে যাবে এ যেন এক অতিলৌকিক ব্যাপার।
দুজন দুজনকে খানিক্ষণ নিষ্পলকে দেখল। সব জমে থাকা কথা আর প্রতিশ্রুতি কুড়ি বছর ধরে একটু একটু করে ক্ষয়ে গেছে। অকস্মাৎ দেখতে পাওয়ার সেই বরফকঠিন শৈত্য কাটিয়ে ঋজুই আগের মত স্বাভাবিক গলায় বলে উঠল,
' সম্বল নেই স্বর্ণ আনিনি এনেছি কনকবরণ ধান্য/ ও দুটো চোখের তাৎক্ষণিকের সাড়া পাব কি সামান্য?'
মুহূর্তবদলের তারুণ্যে কুড়িটা বছর পিছিয়ে গিয়ে রাই অস্ফূট স্বরে বলে ওঠে - ' হাতের ওপর হাত রাখা সহজ নয়/সারাজীবন বইতে পারা সহজ নয়...'
************
মীরার কাছে দুপুরের দিকে চম্পাবাঈ এসে ফিসফিস করে ভয়ংকর খবরটা দিয়ে গেল। রাণা বিক্রমজিৎ আজ পুজোর থালায় করে কালসাপ পাঠাচ্ছে তার জন্য। গিরিধারীর জন্য মালা গাঁথতে গিয়ে যাতে বিষাক্ত সেই সাপ মীরার শেষযাত্রাকেও নিশ্চিত করে, এই তার উদ্দেশ্য। মীরা এসব কিছুই জানতনা। কাল জন্মাষ্টমী, লালার জন্য বেসনের লাড্ডু আর হালওয়া বানাচ্ছে মীরা আর গুনগুন করে গাইছে-
" মেরে রাণাজী, মৈ গোবিন্দ গুণ গানা
রাজা রুঠৈ নগরী রাখৈ হরি রুঠ্যা কহঁ জানা!
রানৈ ভেজ্যা জহর পিয়ালা অমৃত কহি পী জায়!
ডরিয়া মে কালা নাগ ভেজ্যা
সালগরাম করি জানা।।
মীরাবাঈ প্রেম দিয়ানী সাঁয়লিয়া বর পানা।"
মীরার আজকাল ঐশী প্রেমের পরম খোঁজ চলছে আরো গভীরে। ইষ্টকে প্রেম নিবেদন করে আসলে সে খুঁজছে নিজেকেই। আজকের মধ্যবয়সে এসে পৌঁছেও তার মন প্রেমে বাঁধা পড়তে চায় এখনো। এই উন্মাদনা বাইরের লোকের বোধগম্য হয়না। তারা মীরাকে কূলটা ভেবেই আনন্দ পায়। তা পাক, মীরা এখন বীতস্পৃহ হতে শিখেছে। শ্যামসুন্দর যে তার অন্তরাত্মার ডাকে সাড়া দেন এটাই তো পরম কামনার ধন।। একদিন ওই কালো সায়রের দীঘিতেই হবে মীরার মরণ।
*********
চন্দ্রাবলীর কুঞ্জ থেকে খুব ভোরে কানহাইয়া লুকিয়ে বেরোতে গিয়েই আচম্বিতে রাধার সামনে পড়ে গেল। গতরাতের প্রেমবিলাসের রতিচিহ্ন কানহাইয়ার সর্বাঙ্গে। রাধার তা দেখেই ভিতরে জ্বলন হয়। কানহাইয়া কেন এত চঞ্চল? রাধার স্বামী আয়ান ক'দিন অসুস্থ বলে সে ঘাটে আসেনি। কুঞ্জপথেও তাকে কম দেখা গেছে এই কদিন। এরমধ্যেই কানহাইয়া এতটা বদলে গেল? কদিন আগের কানহাইয়া আর এই কানহাইয়া যেন অন্য দুটো মানুষ। চন্দ্রাবলীকেও দোষ দেওয়া যায়না। গোপবালাদের সবার প্রিয়তম তো কানহাইয়া একাই। কিন্তু রাধার অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে এভাবে যে চন্দ্রায় আবিষ্ট হতে পারে,তা মানতে যেন মন চায়না। চন্দন বা অন্নসেবা না নিয়ে এতো একেবারে কায়াসমর্পণ করল চন্দ্রা!
রাধার কাছে ধরা পড়ে কানহাইয়া কিন্তু একটুও অপ্রস্তুত হয়না। তার সেই দুষ্টুমিমাখানো হাসি হেসে সে রাধার হাতটা এগিয়ে এসে ধরে। স্ফূরিত অধরে রাধা তার হাত ছাড়িয়ে চলে যেতে উদ্যত হয়। কানহাইয়া তবু নির্বিকার। মিটিমিটি হাসিতে তার দুচোখ জ্বলজ্বল করে।নির্লজ্জ কানহাইয়া আজ আর তার পীতাম্বরও ধারণ করেনি। অভিসারের পর চন্দ্রাবলীর প্রিয় কাষায় বস্ত্রটিই পড়েছে। এত সহজে কানহাইয়ার মন বদলে যায়! রাধার ভেতরে চাপা অভিমান ধিকিধিকি করে ওঠে। নাঃ এই লম্পট শঠের রাজা কানহাইয়ার অার সে মুখদর্শন করবেনা জীবদ্দশায়।
একটিও বিরুদ্ধবাক্য না বলে শুধু কানহাইয়ার প্রতি একটি তীর্যক কটাক্ষ হেনে দর্পিত পদক্ষেপে সে পা বাড়ায়।
রাধার এই চলে যাওয়াটি দেখতে দেখতে কানহাইয়া মনে মনে খুব মজা পায়। মাটি থেকে রাধার নূপূরের একটি মঞ্জীর ছিঁড়ে পড়ে গিয়েছিল। কানহাইয়া সেটিকে দেখতে পেয়ে যত্ন করে তুলে নেয় হাতে। একটি চুম্বন এঁকে সেটিকে শিখিপাখার উষ্ণীষে গেঁথে নেয় সে। যাক! বৃষভানু নন্দিনী এখন কিছুদিন দহন - জ্বলনে অতিষ্ঠ হবে, তার পরেই তো হবে আসল মিলনের আনন্দ ! সকল অবদমনের মুক্তি।
প্রকৃত প্রেমের প্রাথমিক অবস্থায় অভিমান, ঈর্ষা, অধিকার, জ্বলন এইসব পার্থিব বোধগুলি থাকবেই। অভেদসত্ত্বায় পরিপক্ক হতে আর রাধার আর একটু সময় লাগবে। তখন হবে সর্বদাই প্রেমানন্দস্বরূপের আস্বাদন ! কানহাইয়ার প্রেম অত সহজ ব্যাপার নয় মোটেও।
(এই পর্বে বন্ধুনী/কবি শ্রী সেনগুপ্ত তাঁর -'নৈকট্যের অভাব নেই আমাদের' কবিতাটি উদ্ধৃতি হিসাবে ব্যবহৃত করতে সম্মতি দিয়েছেন)
0 comments: