প্রবন্ধ - ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়
Posted in প্রবন্ধঅনেক সময়ই কোন স্থান কিংবা রাস্তার নাম থেকে সেই স্থান বা রাস্তার অতীত সম্বন্ধে জানা যায়। যেমন, আমি যে মফস্বল শহরে থাকি, তার একটি রাস্তার নাম হল –পাকমারা গলি। খোঁজখবর নিয়ে জানা গেল, ওই অঞ্চলে এক সময় ছিল পাখিমারাদের বসবাস। হতেই পারে। রাজা-রাজড়া, তারও আগে নবাবদের অধীনে ছিল এই অঞ্চল। তাঁরা বসবাস করেছেন যখন পায়রা-বুলবুলি যে উড়বে এই অঞ্চলে এ আর বিচিত্র কি? তাই পাখিমারাদেরও সেখানে বসবাস স্বাভাবিক। পাখিমারা থেকে ক্রমশঃ চলতি কথায় তা রূপ নিয়েছে -পাকমারা। আবার অন্য ব্যাখ্যাও আছে। কেউ কেউ বলছেন,গলিটা সোজা নয়, কয়েক পাক দিয়ে যেতে হয়,তাই পাকমারা। হবেও বা। আবার এই শহরেই অন্য একটি গলির নাম জানতাম—তুলা গলি। কারণ কি? ওই অঞ্চলে নাকি আগে ধুনুরীদের বাস ছিল। বছর তিরিশেক আগেও ওই গলির আশেপাশে সত্যি সত্যিই অনেক লেপ-তোষকের দোকান দেখেছি। ধুনুরীরা লেপ ইত্যাদি তৈরি করত। আজ অবশ্য এসব দেখে বোঝার উপায় নেই। সব ভেঙ্গেচুরে ঝাঁ চকচকে দোকান, নার্সিং হোম তৈরি হয়েছে। সে যাই হোক, ধান ভানতে শিবের গীত গাওয়া হয়ে যাচ্ছে, আসল কথায় আসি।
‘পাখিমারা’, ‘কাকমারা এসব নাহয় শুনেছি কিন্তু ‘হনুমারা’? এ নাম কতজন জানেন জানিনা। কিন্তু অনেকদিন আগে একদল হনুমারাদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। শুধু পরিচয় নয়, তাদের কয়েকজন মেয়ের সঙ্গে বেশ বন্ধুত্বও হয়েছিল। আজ হনুমারাদের কথা একটু বলি।
.
‘হনুমারা’ নামে যে কোন গোষ্ঠী আছে আমার জানা ছিলনা। বস্তুত, এইনামে কোন দল বা গোষ্ঠীর নাম আমরা কোথাও পাই না। আদিবাসী এই গোষ্ঠীটি তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী যাযাবর শ্রেণীর। নানা স্থানে দলবেঁধে ঘুরে বেড়ায় আবার পছন্দমত জায়গা পেলে দীর্ঘদিন বসবাসও করে। আমি যে গোষ্ঠীটিকে দেখেছি, তারা দীর্ঘদিন ওই একই স্থানে বাস করছে। বর্ধমান জেলার কাটোয়া শহর থেকে কালনা যাবার যে হাইওয়ে তার আশেপাশের কয়েকটি গ্রামে আমার এদের সঙ্গে দেখা। মেদিনীগড়, টিকরখাঁজি, নলাহাটি, নলাহাটি সংলগ্ন গঙ্গার চরের আশেপাশেও এদের কয়েক ঘরের বসবাস। এইভাবেই কয়েকটি গ্রামে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে এই গোষ্ঠীটির বেশ কিছুজনকে বসবাস করতে দেখেছি। এরা আদিবাসী সমাজভুক্ত, কিন্তু সাঁওতাল নয়। যে ধরনের কাজকর্ম করে, তাতে মনে হয়েছিল এরা বীরহোড় সম্প্রদায়ের কিন্তু তারা নিজেরা বলে তারা ‘হনুমারা’।
বিহারের প্রত্যন্ত গ্রামে কাকমারা, পাখিমারাদের দেখেছি। অত্যন্ত অপরিচ্ছন্ন, নোংরা জামাকাপড় পরনে, শিশুদের তাও নেই, একেবারে উলঙ্গ । সঙ্গে ভাঙ্গা বাসনকোসন, ছেঁড়া বিছানাপত্র যা আছে সব নিয়ে দলবেঁধে দুপুরে গৃহস্থের বাড়িতে কিংবা কোন অনুষ্ঠান বাড়ির আশেপাশে এদের খাবার জন্য ভাত চাইতে দেখেছি। সঙ্গে বাসনকোসন না থাকলে নোংরা শতচ্ছিন্ন কাপড়েই খাবার বেঁধে নিয়ে যেতেও দেখেছি। অভাব, দারিদ্র্যের সঙ্গে স্বভাবও কিছুটা এইরকমই । .
হনুমারা গোষ্ঠীটি ঠিক ততটা না হলেও খুব যে পরিচ্ছন্ন তেমন কথা বলা যায় না। কিন্তু গোষ্ঠীটির নাম’ হনুমারা’ কেন? কেননা, তারা হনুমান দেখলেই পাথর ছুঁড়ে, তীরধনুক নিয়ে তাড়া করে যেভাবেই হোক মারার চেষ্টা করে। গ্রামবাসীদেরই মুখে শোনা এরা আদতে নাকি রাবণের ভক্ত, তাই হনুমান দেখলেই মেরে ফেলে। কারণ সহজেই অনুমেয়, হনুমান লঙ্কা দহন করেছেন, সীতা উদ্ধারে সাহায্য করেছেন ইত্যাদি। যদিও এই যুক্তির সপক্ষে কোথাও কোন তথ্য পাইনি। তবে গ্রামবাসীদের একাংশ কোন এক সময় হনুমান মেরে ফেলার জন্যই হয়ত তাদের এই নাম দিয়ে থাকবেন। মুখে মুখে বহুদিন ধরে সেই থেকে গোষ্ঠীটির নাম হনুমারাই হয়ে গেছে। বস্তুত,তাদের জিজ্ঞাসা করলেও তারা এখন নিজেদের ওই নামই বলে থাকেন—হনুমারা।
যে সকল গ্রামে তাদের দেখেছি অবস্থা সকলেরই প্রায় একই রকমের। ঘর বা গৃহ বলতে যা বুঝি তেমন কিছু নয়। গ্রামের একপ্রান্তে কোন এক জলাশয়ের ধারে গাছ-গাছালিতে ঘেরা জায়গায় থাকে। একদিকে এবড়োখেবড়ো মাটির দেওয়াল কিংবা কোনো পুরনো বাড়ি থেকে ভাঙ্গা ইঁট তুলে নিয়ে এসে কোনোরকমে একটা দেওয়াল জাতীয় কিছু খাড়া করে তার মাথায় গাছের ডাল,পলিথিন, প্লাস্টিক কিংবা ছেঁড়া চট যা পাওয়া যায় তাই দিয়েই ছাদ ঢাকা দেয় ও এভাবেই তৈরি করা একটা ঘরে এক একটা পরিবার থাকে। অতজন মিলে কিভাবে থাকে তা সত্যিই বিস্ময়কর। হতদরিদ্র মানুষগুলির কাছে মূল্যবান কিছু থাকতে পারে এমন কথা ভাবাই যায় না। যদিও তাদের বাড়ির আশেপাশে থাকে বেশ কয়েকটি কুকুর। তারা রাস্তার কুকুর হলেও হনুমারাদের বশ্যতা স্বীকার করে।
অনেকের মতে, হনুমারা দলটি আদতে ‘বেদে’ শ্রেণীর। যেমন পাখিমারা, কাকমারাদের দল। হতেই পারে। Risley ‘র ‘ Tribes and Castes of Bengal’ বইতে তিনি বেদেদের সম্বন্ধে লিখছেন--- Bediya, the generic name of a number of vibrant gypsy-like groups, of whom it is different to say whether they can properly described as castes.’
বস্তুতঃ, বেদেদের জীবনযাপনের প্রণালীর ওপর নির্ভর করেই তাদের নামকরণ। যেমন—পাখিমারা কাকমারা ইত্যাদি। সুতরাং এই গোষ্ঠটির নামও যে ক্রমে ক্রমে ‘হনুমারা’ হতে পারে, এটি স্বাভাবিক বলেই মনে হয়।
খাদ্যদ্রব্য বলতে ভাতই প্রধান খাদ্য। তবে খুবই গরীব বলে ভাতের ব্যবস্থা সব সময় থাকেনা। গরু, মোষ, ছাগল, শুয়োর, বনবিড়াল,পাখি সব ধরনের মাংস এরা খায়। গ্রামবাসীদের কাছে শোনা এরা হনুমানের মাংসও খায়। সত্যি কি মিথ্যা জানা নেই।
অনাহার, অপুষ্টি, চিকিৎসা সম্বন্ধে অজ্ঞানতা এদের জীবনযাত্রার উপর প্রভাব ফেলে খুব বেশিভাবে। আর আছে অবাধ যৌনতা। গোষ্ঠীতে যখন যার সঙ্গে থাকার ইচ্ছে, তার সাথেই জীবন কাটানো এদের স্বাধীনতার মধ্যে পড়ে। ফলে প্রায় প্রতি বছরই শিশুদের জন্ম এবং প্রায় প্রতি বছরই শিশুর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে আবার গর্ভধারণ এদের অবাধ যৌনতার ফল। যদিও বিবাহ নিজেদের গোষ্ঠীর মধ্যেই হয়। কিন্তু প্রয়োজনে বা ইচ্ছা হলে স্বামী ছাড়া গোষ্ঠীর অন্য পুরুষমানুষের কাছে যেতে কোন দ্বিধা করে না। নারী-পুরুষ নির্বিচারেমদখেয়ে পড়েথাকে। মদ খাবার জন্য কি আকুলি-বিকুলি! তার জন্য টাকা-পয়সা চাইতেও দেখেছি। মেয়েদের শরীর অসুস্থ, শিশুদের মৃত্যু এসব হলেও তার প্রভাব জীবনযাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করে না। তবে সভ্য সমাজের কাছাকাছি ও পাশাপাশি থাকার ফলে কিছু উন্নতি দেখা যাচ্ছে, এটুকুই আশার কথা। অন্তত, অপেক্ষাকৃত যুবতী এবং এই প্রজন্মের মেয়েরা স্বাধীন হলেও জীবনের লাগাম কিছুটা টেনে রাখতে শিখেছে। সমাজও সংসারে নারীর প্রাধান্যই বেশি বলে মনে হয়েছে।
মির-শিকারীদের মত এরাও সুতো বা দড়ি দিয়ে নানা ধরনের কাজকর্ম করতে পারে যা শিকার করার পক্ষে উপযুক্ত। হাঁড়ি বা ভাঁড় টাঙ্গিয়ে রাখার জন্য দড়ির ‘শিক’ তৈরি করতে পারে। কিন্তু এসব হাতের কাজ তৈরি করলেও তা বাজারে বিক্রি করে উপার্জনের পথে তারা খুব একটা যায় না। অর্থাভাব অনুভব করলেও উপার্জনে সক্ষম নয়,অনীহাও আছে। দরিদ্র হলেও তাদের মধ্যে চৌর্যবৃত্তি নেই,যা তাদের একটি বড় গুণ।
মৃত্যুর পর দাহ করার রীতি ওদের সমাজে থাকলেও অর্থাভাবে কবরই বেশি দিয়ে থাকে। সবচেয়ে মজার কথা, হনুমান সংক্রান্ত যে সকল ব্যাখ্যা বা মুখে মুখে চলে আসা গল্প-কাহিনি গুলি শোনা যায় এখন তারাও সেগুলি অস্বীকার করে। হয়ত সভ্য সমাজের কাছাকাছি থাকার ফল। তবে ইতিমধ্যেই মেদিনীগড় নামে একটি গ্রামের হনুমারার দল ইতিমধ্যেই অন্যত্র চলে গেছে। অর্থাৎ যাযাবর বৃত্তি তাদের মধ্যে এখনও আছে।
আদতে বেদে সম্প্রদাভুক্ত হনুমারা নামক আদিবাসী গোষ্ঠীটির বৈশিষ্ট্য এখনও বর্তমান।
0 comments: