গল্প - অচিন্ত্য দাস
Posted in গল্পবি এড পাশ করেছিলাম ভালো ভাবেই। তারপর কত দরখাস্ত যে করেছিলাম তার ঠিক নেই। পাকাপাকি চাকরি কিন্তু পাইনি। এখন এই চুয়াল্লিশ বছরে এসে অবশ্য আর চেষ্টা করি না। বাড়ির কাজও অনেক – ছেলেমেয়েরা উঁচু ক্লাসে, কর্তার আপিসে কাজের চাপ বেড়েছে। ফিরতে দেরি হয়। তবে হ্যাঁ, আমার নাম কিন্তু এখনো প্যানেলে আছে। কোনো ইস্কুলে কেউ লম্বা ছুটি নিলে দু-তিন মাসের জন্য ডাক আসে। সেও গত কয়েক বছর নিচ্ছি না। আগে ছোট ক্লাসে বেশ কবার পড়িয়েছি।
তবে এবারেরটা ছাড়া গেল না। প্রভাবতী বালিকা বিদ্যালয়, ক্লাস নাইনে ইংরেজি পড়ানো, তিন মাসের মেয়াদ। মনটা যেন কেমন হয়ে উঠল। বইএর ভাষায় যাকে ‘স্মৃতিমেদুর’ বলে তাই। আমাদের ইস্কুল। আজ সাতাশ বছর হলো ইস্কুল ছেড়েছি। তারপর একদিনও যাইনি। অনেক ইস্কুলে প্রাক্তনীদের সম্মেলনে নানা ধরনের অনুষ্ঠান হয়, আমাদের তো সেরকম কিছু নেই, ছিলও না। সে যাই হোক, ওই তিন মাস পড়ানোর চাকরির চিঠিটার দিকে দু-এক পল তাকিয়ে রইলাম। মনে হলো যেন শৈশব-কৈশোরে বেড়িয়ে আসার টিকিট পাঠিয়েছে কেউ আমায়।
রাত্তিরে খাবার টেবিলে কথাটা সবাইকে বললাম। ছেলেমেয়েরা তো খুব খুশি। বললাম – “তোরা সবদিক ম্যানেজ করতে পারবি তো?” ওরা একবাক্যে বলল যে খুব পারবে। ডুপ্লিকেট চাবিটাবিগুলো ঠিক করে রাখতে হবে এই যা। তা ঠিক, বাড়ি আসতে তো ওদের থেকে আমার দেরি হবে।
সুজনকে বললাম “আচ্ছা, এখান থেকে কত নম্বর বাস ধরলে সুবিধে …” সুজন আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল –“আরে বাসফাস ছাড়ো। প্রথম কদিন অ্যাপ-ট্যাক্সি নিয়ে নিও, তারপর নয় ওসব ভাবা যাবে।“
তার মানে বুঝলাম সুজনের কোনো আপত্তি নেই।
***
প্রথম দিন একটু সময় হাতে নিয়েই গেলাম। ইস্কুল বসার আগে প্রিন্সিপালের ঘরে এসে নিজের পরিচয় দিলাম। মহিলাটি তখন এক মনে বাংলা খবরের কাগজ পড়ছিলেন। আমি যে এই ইস্কুলের ছাত্রী ছিলাম তা জেনেও ইনি তেমন আগ্রহ প্রকাশ করলেন না। দু-একটা দায়সারা কথা, ব্যাস। আমি উঠে ক্লাসের দিকে এগোলাম। যেতে যেতে মনে হলো ইস্কুল-বাড়ির চেহারাটা একই রকম আছে। সেই মাঠ, সেই বটগাছটা, সেই হলঘর। কিচ্ছু পাল্টায়নি। তবে বড় বেশি হৈচৈ হচ্ছে, বারান্দাগুলোতে কত মেয়ে যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওরা ক্লাশে যাবে না? আগে তো ক্লাস শুরু হবার আগে হলঘরে প্রার্থনা হতো – অন্তর মম বিকশিত করো অন্তরতর হে…
ক্লাসে ঢুকে বন্ধুত্ব পাতাবার চেষ্টা করলাম। এই বিদ্যালয়ে আমিও পড়েছি, এইসব। তেমন সাড়া কিন্তু পেলাম না। সে যাকগে। ভাবলাম এই তিন মাস খুব ভালো করে পড়াবো। তার আগে অবশ্য জানতে হবে এদের এলেম কতটা। সেই মতো পড়াতে হবে। একটা ছোট রচনা লিখতে দিয়েছিলাম। ক্লাস হয়ে গেলে শিক্ষিকাদের ঘরে এসে খাতার বাণ্ডিলটা খুললাম যদিও সেখানে বসতে ভালো লাগছিলো না। শিক্ষিকাদের কেউ ভালো করে কথাই বলল না, আলাপ করা তো দূরের কথা। শিক্ষিকাদের ছোটছোট জটলা – মানে মেলামেশা কম। লেখাগুলো দেখলাম। বেশ খারাপ। বানানের দিকটা না বলাই ভালো। কয়েকজন দেখলাম কুড বানান লিখেছে সি ইউ ডি। পরের দিন জিগেস করতে একজন ব্যাগ থেকে ফোন বার করে দেখিয়ে দিল – ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপে এই বানানই চলে।
ক্লাসে পড়ায় কেউ মন দেয় না। মনে পড়ল আমাদের সেই শেফালিদিদি ইংরেজি ক্লাসে মাঝেমাঝে বিখ্যাত লেখকদের গল্প বাংলায় বুঝিয়ে বুঝিয়ে পড়ে শোনাতেন। মোঁপাসা, ও হেনরী এইসব। আমাদের খুব ভালো লাগতো। আমি ও হেনরীর ‘দ্য লাস্ট লীফ’ নিয়ে চেষ্টা করতে গিয়ে দেখলাম কেউ শুনছেই না। হতাশ হয়ে বললাম – “ভালো লাগছে না?” একটি মেয়ে নিস্পৃহ গলায় বলল – “এসব তো পরীক্ষায় আসবে না।”
একদিন বলেছিলাম “এইকটা লাইন লিখে রাখো, মাধ্যমিকেও কাজে লাগবে।” একজন লিখছে না দেখে বললাম “কী হলো?” সে বলল “এসব তো নেটে পাওয়া যায়।”
টিফিনের সময়টা গেটের কাছে ভীড়। আগেও হতো। তবে চুরণ-গুলির জায়গায় এগ-রোল পাওয়া যাচ্ছে। মনে পড়ল গেটের বাইরে সাইকেল নিয়ে একটা ছেলে দাঁড়িয়ে থাকত রোজ – আমি আর শিপ্রা এদিকে এলেই তাকিয়ে থাকত একদৃষ্টে। আমি বলতাম “অ্যাই শিপ্রা তোকে দেখছে!” শিপ্রা বলত “না, তোকে” আমরা দুজন হেসে গড়িয়ে পড়তাম। তবে একটা রোমাঞ্চের ভাব ছিল ঠিকই। এখন আর সেদিন নেই। রোজই দেখি ছুটির সময় বেশ কয়েকটা মোটর-বাইকে ছেলেরা অপেক্ষা করে। মেয়েরা পটাপট পেছনে বসে ভোঁ করে চলে যায়। খোলাখুলি, স্বাভাবিক। কোনো লুকোনো রোমাঞ্চ-টোমাঞ্চ নেই। ক্লাসের পেছনের বেঞ্চির মেয়েরা কিন্তু খুব শান্ত হয়ে বসে থাকে। সারাক্ষণ মোবাইল দেখে তো, তাই। ব্যাপারটা বন্ধ করতে গিয়ে দেখলাম প্রধান শিক্ষিকারই কোনো গা নেই।
কী করে যে তিন-তিনটে মাস কাটলো তা আমিই জানি। বাসে ফিরছি – আর দুটো দিন মানে শুক্রবারটা কাটলেই পর্ব শেষ। বাঁচা যাবে। কাজটা না নিলেই যেন ভালো করতাম।
সময় বয়ে গেছে কত, দিনও পাল্টে গেছে। আমরা যা ছিলাম, এরা কী করে সেরকমই থাকবে? আমরা আমাদের মতো ছিলাম, এরা এদের মতো। এতে ভালো-খারাপ, ঠিক-বেঠিকের হিসেব করার কোনো মানে হয় কি? আর হিসেব করবই বা কী করে। সেই চোদ্দ-পনেরো বছরের আমি আর আজকের আমি তো এক নই। ফিনফিনে পাতলা কাগজে নরম তুলি দিয়ে পুরোনো মধুর ছবিগুলো স্মৃতিতে আঁকা থাকে। ধরাছোঁয়ার বাইরে দূরের কোনো দেয়ালে তা টাঙ্গানো থাকাই ভালো। কাছে এসে সে ছবি ছুঁতে গেলে ছবির কাগজ বিচ্ছিরি ভাবে ছিঁড়ে যায়।
A lovely story.
ReplyDelete