22

ছোটগল্পঃ স্বপন দেব

Posted in


ছোটগল্প




এলিজাবেথ টেলর
স্বপন দেব



হিসেব কষা আমাদের চিরকালের বদভ্যেস। আবার হিসেব না কষলেও দিন চলেনা। টাকা পয়সার হিসেব, সময়ের হিসেব, বয়সের হিসেব, জীবনে কি পেলাম আর কি পেলাম না তার হিসেব, আরো কত কি! প্রায় সব মহাপুরুষই বলে গেছেন যে জীবনখাতার শেষ পাতাটা নাকি শূন্যই থাকে, তাও আমরা অহরহ হিসেব কষেই চলেছি!! টুকটুকির বাবা অবশ্য কোনদিন হিসেব কষেছেন বলে মনে হতনা। টুকটুকি মানে আমাদের পাড়ার টুকটুকি। যখনই সরস্বতী পুজোর চাঁদার খাতা হাতে নিয়ে ওদের দরজায় দাঁড়িয়েছি, বিরক্তি দেখিনি একটুও। বরং স্বাগত সম্ভাষণ… এতো দেরি করে এলে যে? পুজোতো এসেই গেল। লেখো লেখো কত দিতে হবে! অন্যদের বাড়িতে যখন সরস্বতীর বানান কি, সরস্বতীর আর তিনটে নাম জিগ্যেস করত, তখন সেই জমানায় টুকটুকি দের বাড়ির দরজা ছিল আমাদের মত অভাজনদের জন্যে সবসময়ে খোলা। দরজা দিয়ে অবশ্য খুব একটা ভেতরে ঢোকা হয়নি, টুকটুকির সাথে আমার আলাপ পুব দিকের রাস্তার পাশের জানালা দিয়েই। ওই জানালার ফাঁক দিয়ে হাত বাড়িয়েই টুকটুকির আমাকে অবাক করে দেওয়া প্রথম সুরেলা কন্ঠস্বর, এই শোন…। সেই গলায় এমন একটা কিছু ছিল যা না শুনে এড়িয়ে যাওয়া যায়না। তারপর সেই অদ্ভুত প্রশ্ন, “এই, তুই সিগারেট খাস ?” না, খাইনা। আমার মুখে একরাশ বিরক্তি, আর খেলেই বা…তোর বাবার পয়সায় খাই নাকি? কি বেহায়া মেয়েরে বাবা ! মনে মনে বলেছিলাম। টুকটুকি দমবার মেয়ে নয়। স্বভাবসুলভ তীক্ষ্ণ গলায় বলে উঠলো, “লায়ার লায়ার, প্যান্টস অন ফায়ার, এই যে সেদিন দেখলাম তুই সরস্বতী পুজোর প্যান্ডেলের পেছনে বসে ধোঁয়া ছাড়ছিস?” এবার একটু বেশ ভয়ে ভয়ে চারপাশটা দেখে নিয়ে বললাম, বেশ করেছি। সবে হাফ প্যান্ট ছেড়ে ফুল প্যান্ট ধরেছি, সিগারেটে এক টান দিতে এক মাইল হেঁটে রেল শেডের অন্ধকার গোডাউনে যেতে হয়। জানতে পারলে কান টেনে ছিঁড়ে নেবে বাবা। খাই তো তোর কি? আমার মরিয়া উত্তর। জানালা থেকে মুহূর্তের জন্যে উধাও হয়ে গেল টুকটুকির মসৃণ মুখ।এক নিমেষেই আবার আবির্ভাব, “এই নে তোর জন্যে রেখেছি বাপির পকেট থেকে চুরি করে”। গ্রিলের পেছন থেকে বেরিয়ে এলো টুকটুকির শ্বেতশুভ্র প্রাংশু হাত, লম্বা সুললিত আঙ্গুলগুলোর মুঠোয় সযত্নে লুকিয়ে রাখা বিদেশি মার্লবরো সিগারেটের প্যাকেট। সেই থেকে টুকটুকি আমার বন্ধু। ওদের বাড়িটা ছিল ঠিক আমাদের বাড়ি থেকে পাঁচটা বাড়ির পরে। বাইরে থেকে দেখলে আর পাঁচটা বাড়ির মতোই দেখতে। শুধু ভেতরে ঢুকলেই বোঝা যেত ওরা আমাদের পাড়ার আর পাঁচটা লোকের মত নয়। সবসময়ে একটা অজানা বিদেশী গন্ধ ছড়িয়ে থাকতো ওদের ঘরে। মেঝেতে পা ফেললেই মনে হত এই বুঝি পিছলে যাব। বুকশেলফে বিদেশি বই, টেবিলে অচেনা বিদেশি ম্যাগাজিন, এমন কি ভারী ভারী বিদেশি পর্দাগুলো মনে হত যেন সিনেমায় দেখা। টুকটুকির বাবা ছিলেন খুব ব্যাস্ত লোক। বেশীর ভাগ দিনই বাড়ি ফিরতেন অনেক রাতে। শুনেছিলাম কাস্টমসের খুব বড় অফিসার। টুকটুকির নাম টুকটুকি ছিল কেন কে জানে, সবজান্তা টুকটুকি আমায় বুঝিয়েছিল ওর গায়ের রঙ মোটেই টুকটুকে নয়। ওটাকে বলে অলিভ কালার। রঙ নিয়ে টুকটুকির খুঁতখুঁতুনির শেষ নেই। আমার চোখের রঙটা নাকি অ্যাম্বার, ওদের স্কুলের ইউনিফর্ম টা অ্যাকোয়া মেরিন ব্লু। হলদে, সবুজ, লাল, কালোর বাইরেও পৃথিবীতে যে এত রঙ আছে সেটা টুকটুকি আমায় শিখিয়েছিল। টুকটুকি সবকিছুই এত জোরের সাথে বলত যে মনে হত হয়ত ঠিক ই বলছে। একবার বলেছিল, ষোল বছর বয়েস হলেই আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে যাব। সেবার একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। জিগ্যেস করা উচিত ছিল কেন পালাবি। কিন্তু মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল,‘‘কার সাথে পালাবি ?’’ “কার সাথে আবার, তোর সাথে নয়। একাই পালাবো। বাড়ি থেকে না পালালে কেউ বড় হয়না, বুঝলি?” ‘‘বাজে বকিস না,’’এবার পৌরুষে একটু ঘা লাগলো। ‘‘এতো বড়ো বড়ো লোক সবাই বাড়ি থেকে পালিয়েছে নাকি?’’ টুকটুকি কখনই তর্কে হারেনা। “জানিস, বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন বাড়ি থেকে পালিয়েছিল?” বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের ঘুড়ি ওড়ানোর গল্প শুনেছি। পালানোর গল্প পড়িনি। বললাম, ‘‘সেসব বিদেশে হয়।’’ “ভগৎ সিং পালিয়েছিল, জানিস ? তুই কিছুই জানিস না”। স্বীকার করতেই হল, এটাও জানতাম না। ইতিহাস বইয়ে কোথাও লেখা নেই। টুকটুকির সাথে পাড়ার কারো আলাপ ছিলনা। থাকার কথাও নয়। ও পড়তো অনেক দূরে, কলকাতার এক দামী স্কুলে। ওদের বাড়িটার মত টুকটুকিও ছিল একদম অন্যরকম। একদিন হঠাৎ আমায় জিগ্যেস করেছিল, “এই, বড় হয়ে তুই কি হবি রে ?” তখন সবে বড়োদের কাছ থেকে মধ্যবিত্ত ভণ্ডামির ট্রেনিং নিতে শিখেছি, পরীক্ষার খাতা হলে লিখে দিতাম বড় হয়ে গ্রামের ডাক্তার হব, দেশবাসীর সেবা করব, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু টুকটুকির চোখ দুটো ছিল পরীক্ষার খাতার থেকে অনেক বড়। তাই প্রশ্নটা শুনে একটু থমকে গেলাম, সত্যিতো, সেটা তো ভাবিনি কখনো। কিন্তু আমার উত্তরের তোয়াক্কা না করেই টুকটুকির পরের প্রশ্ন, “আমি কি হব জানিস ?” ‘‘কি?’’ “আমি হব এলিজাবেথ টেলর”। হলিউড তো দূরের কথা, তিন ভুবনের পারেতে সৌমিত্রর ট্যুইষ্টও তখনো দেখা হয়নি। সেটা হলেও নাহয় একটা ক্লু পেতাম, তাই বোকার মত প্রশ্ন করলাম, ‘‘সে আবার কে রে?’’ “ধুর হাঁদা!” এক মুহূর্তে ছুটে গিয়ে সোফা থেকে কুড়িয়ে নিয়ে এল কি একটা ম্যাগাজিন। জানালার গ্রিলের ওপর ঠেসে ধরল এলিজাবেথ টেলরের সাদা-কালো ব্লো-আপ ছবি। টুকটুকি আমাদের মত হিসেব নিকেশ করে স্বপ্ন দেখতোনা।

সেই দিন টা ছিল রবিবার। মনে আছে, কারণ আমার ভোরবেলা ফুটবল প্র্যাকটিসে যাওয়ার দিন। দেখলাম টুকটুকিদের বাড়ির সামনে বেশ কয়েকটা গাড়ি দাঁড়িয়ে। তারমধ্যে পুলিশের গাড়িও আছে। পুবদিকের জানালাটা খোলা।জানালার পাশে দাঁড়িয়ে টুকটুকি যেন কিসের অপেক্ষায়। ‘‘কিরে, পুলিশ কেন ? চোর এসেছিল নাকি?’’ কেমন যেন ভাঙা গলায় উত্তর এল, “বাপির অফিসে কি যেন হিসেব মিলছেনা। তাই ওরা এসেছে।” পুলিশ আবার হিসেব বোঝে নাকি? আসল খবরটা অবশ্য পরদিন নিয়ে এলেন আমাদের প্রতিবেশী হরিহর বাবু। পাড়ার সব বাজে খবর উনিই সর্বাগ্রে দিতেন। ‘‘শুনেছেন তো মশাই? আর বলবেন না, দেশটা দুর্নীতিতে একেবারে ভরে গেল! এতোবড়ো জোচ্চোর শেষে কিনা এই পাড়াতেই? আগেই জানতুম, এত টাকার গরম; এবার টানুক জেলের ঘানি। নির্ঘাৎ দশ বছর হবে, বুঝলেন দত্তবাবু?’’ উত্তেজিত হয়ে হরিহর চলে গেলেন লম্বা লম্বা পা ফেলে। বাজারের ব্যাগটা একটু যেন জোর জোরে দুলছে অন্যদিনের তুলনায়। সেদিন থেকেই টুকটুকিদের বাড়িটা তালাবন্ধ। পুবের জানালাটাও। কোথায় গেছে, সেটা আর বাবাকে বা হরিহর কাকুকে জিগ্যেস করার সাহস হয়নি। কোনদিন আর টুকটুকির সাথে দেখা হবে সেটাও ভাবিনি। দেখা না হলেই বোধহয় ভালো হত। গোঁজামিল দিয়ে একটা স্মৃতিমেদুর গল্প বানানো যেত। কিন্তু দেখা হয়ে গেল আবার, এবং এবারেও সেই জানালা দিয়েই। এটা অবশ্য সেই জানালা নয়, এটা হল পরিভাষায় যাকে বলে ক্যাশ-উইন্ডো। পার্ক স্ট্রীটের শাড়ির দোকানের ক্যাশ উইন্ডো। ফাল্গুন মাস, সহকর্মীর ছেলের বিয়ে সেদিনই, কিন্তু গিফট কেনা বাকি। অগত্যা তাড়াহুড়ো করে অফিস থেকে বেরিয়ে দল বেঁধে ঢুকতেই হল সেই পার্কস্ট্রীটের শাড়ির দোকানটাতে, সাথে একদল মহিলা সহকর্মী। মেয়েরা এমনিতেই সব কিছু বেশি বোঝে, শাড়ির ব্যাপারে আরো বেশি! আমি ক্যাশ নিয়ে হাঁ করে দাঁড়িয়ে, কখন কেনাকাটা শেষ হবে। এই দোকানগুলোর অদ্ভুত একটা ব্যাপার আছে। দোকানগুলোর মালিকরা মাড়োয়ারী বা গুজরাটি যাই হোকনা কেন, কর্মচারীরা সবাই বাঙালি এবং বেশিরভাগই মহিলা। বাণিজ্যের পসরা নিয়ে সন্ধ্যার মেট্রোপোলিস যখন ঝলমল করে, সেই আলোর তলায় যে অন্ধকার, এরা সেই অন্ধকার শহরের নাগরিক। দল বেঁধে আসে উত্তর-দক্ষিণের শহরতলীর ট্রেনে বনগাঁ, নৈহাটি কিংবা লক্ষ্মীকান্তপুর লোকালে গাদাগাদি ভিড়ে লেডিস কম্পার্টমেন্টে। ক্ষয়াটে চেহারা, ভয়ার্ত চাহনি, মালিকের ভয়ে শশব্যস্ত। দোকানের ভেতরে কাউকে কোনদিন হাসতে দেখিনি। সেখানেই আবার দেখা হল টুকটুকির সাথে। বিল মেটাতে গিয়ে চমকে উঠেছিলাম; ছোটো এক চিলতে ক্যাশ কাউন্টার, সামনে গ্রিলের বেড়া, পেছনে ধূপ ধুনোর আড়ালে গণেশ ঠাকুর। ঘষে যাওয়া কাঁচের আড়াল থেকেও চিনতে ভুল হয়নি। ‘‘এই টুকটুকি, তুই ?’’ প্রায় চেঁচিয়ে উঠেছিলাম। টুকটুকি কিন্তু নিরুত্তাপ, এক মুহূর্তের জন্যেও ঘাড় উঠলোনা। মুখ নিচু করে গাবদা একটা লাল খাতায় লিখতে লিখতে জবাব দিল, “ভুল করছেন।” নাঃ, ভুল করিনি। ছুরির মত চেহারাটা কেমন যেন একটু ভোঁতা, গলার স্বরটা অবশ্য আগের থেকে অনেক ধারালো। আবার কি একটা বলতে গিয়েছিলাম, পাশের কাউন্টার থেকে আওয়াজ এল, ‘‘মসল্লা কেয়া হ্যায়?’’ কে এই তিলক-কাটা ঢাউস ভুঁড়িওয়ালাকে মসলা বোঝাবে, তাই চুপ করতেই হল। কাঁচে মোড়া গ্রিলের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এল এলিজাবেথ টেলরের সেই হাত। বিবর্ণ, স্ট্যাম্পপ্যাডের কালি মাখা আঙুল, সস্তা চটে যাওয়া নেল-পালিশ। তবে সেটা বারগেন্ডি কালারই। যেটা টুকটুকি পছন্দ করত। স্মৃতিশক্তি আমার বরাবরই ভালো। আঙুলের ফাঁকে আমার ক্যাশ-মেমো। পেইড ইন ফুল। টুকটুকিটা চিরকালই স্মার্ট। হাতটা কাঁপলোনা একটুও। বাইরে বেরিয়ে আসতেই হল। খোলা হাওয়া দরকার ছিল খুব। বাইরে অপেক্ষায় থাকা অধৈর্য বন্ধুদের প্রশ্ন, “কিরে, এতো দেরি হল যে ?” কোথা থেকে একটা বিদেশি গন্ধ ভেসে এল চৌরঙ্গীর বাতাসে। সেই মার্লবরো সিগারেটের কি? ক্যাশমেমোটা পকেটে ঢোকাতে ঢোকাতে একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে বললাম, “হিসেব মিলছিল না।”

22 comments:

  1. সোনালি বিশ্বাস11 March 2016 at 09:29

    যেমন সুন্দর গল্পের বুনোট তেমন ই সুন্দর এর প্লট! আর গল্প বলার ভঙ্গিটা তো অসাধারণ!

    ReplyDelete
  2. স্বপন দেবের প্রতিটি লেখাই ভালো। কিন্তু এটা শিল্প নৈপুণ্যে আর গল্পের দিক থেকে এক কথায় অপূর্ব!

    ReplyDelete
  3. ধন্যবাদ সবাইকে!

    ReplyDelete
  4. খুব ভালো লাগলো!

    ReplyDelete
  5. অসম্ভব সুন্দর একটি ছোটো গল্প!!

    ReplyDelete
  6. ইদানীং কালে এত সুন্দর ও মর্মস্পর্শী লেখা খুব কম পড়েছি!

    ReplyDelete
  7. খুব ভালো লাগলো!!

    ReplyDelete
  8. এক নিঃশ্বাসে পড়ে গেলাম!! অনবদ্য লেখা!

    ReplyDelete
  9. চমৎকার লেখা! অনবদ্য গল্প কথা!

    ReplyDelete
  10. অসাধারণ লেখা!!

    ReplyDelete
  11. অসাধারণ একটি গল্প!

    ReplyDelete
  12. যতবার পড়ি ততবার ভালো লাগে!

    ReplyDelete
  13. ভীষণ ভালো লেখা!

    ReplyDelete
  14. অসাধারণ বললেও কম বলা হয়! সুখপাঠা!

    ReplyDelete
  15. গল্পের মতো গল্প
    অসাধারণ
    কুর্নিশ

    ReplyDelete
  16. যতবার পড়ি, মুগ্ধ হয়ে যাই!

    ReplyDelete
  17. eta niye tin charbar ghuriye firiye porlam ghor ta kintu ekhono katche na

    ReplyDelete