2

প্রচ্ছদ নিবন্ধঃ পল্লববরন পাল

Posted in


প্রচ্ছদ নিবন্ধ


ই-ম্যাগাজিন - ঋতবাক - ভবিষ্যৎ
পল্লববরন পাল



এক

গত লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে এক ক্ষণজন্মা রূপোলি প্রার্থীর বিখ্যাত উপদেশ-বাণী ধর্ষিতাদের উদ্দেশ্যে – ‘হয় চীৎকার করো, নয় উপভোগ করো’ – ২০১৪-র বর্ষসেরা বাণী – আমরা তাঁর সেই বাণীর মর্ম উপলব্ধি করে আহ্লাদিত হয়ে তাঁকে বিপুল ভোটে জনপ্রতিনিধি বানিয়েছি| 

দুই

মানবসভ্যতার বিবর্তনের ইতিহাস প্রস্তরযুগ দিয়ে শুরু করে আধুনিকযুগে এলেও বাংলা সঙ্গীতজগতে রাইচাঁদ বড়াল কমল দাশগুপ্ত থেকে হেমন্ত মান্না সলিল হয়ে সুমন অবধি বিস্তৃত আধুনিক যুগের সমাপ্তির পরে এখন পুরোদস্তুর প্রস্তর যুগ চলছে| এই যুগের একটি জনপ্রিয় প্রস্তর গানের একটি জনপ্রিয়তর লাইন – ‘আসলে সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই’|


একটু উপক্রমণিকা করে নিলাম, মাননীয়া সম্পাদিকা মহাশয়া| আসলে এমন একটা ‘রডোডেণ্ড্রন’ মার্কা বিষয় দিয়েছেন – প্রাথমিক মাথা চুলকে নেওয়ার সময়টুকু চুরি করে নিলাম| 

ঋতবাকের ভবিষ্যৎ!!!!

১৪৪০-এ আবিষ্কার হয়ে গেছে মুদ্রণযন্ত্রের – জোহান্স গুটেনবার্গের হাতে| আরও ২৪৪ বছর পরে সাহিত্য পত্রিকার প্রথম প্রকাশ প্যারি শহরে| ঊনিশ শতক থেকে ছড়িয়ে পড়লো দেশে দেশে| ই-ম্যাগের আত্মপ্রকাশ ১৯৯৬ সালে – সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ| তাই তো ভবিষ্যৎ ভাবনা|

ভবিষ্যৎ? উরিব্বাবা! আমার নিজের জীবনে এক মুহূর্ত পরে কী হবে বা হতে চলেছে – সেটাই জানিনা| আমি কোন লাটসাহেবের পুত, মাননীয়াসু? আমার কোনো টি-আর-পিও নেই যে আমাকে ভবিষ্যৎদ্রষ্টা দেখিয়ে আপনার কোনো লাভ হবে - দ্রষ্টা হয়ে ওঠার প্রাথমিক শর্ত দৃষ্টিশক্তি থাকা – পেটসূত্রে চব্বিশ গুণ সাত আমার চোখ কম্পিউটার-জানলায় ফ্রেমবন্দী – ওই ছাব্বিশ ইঞ্চি দূরত্বটুকুই আমার কাছে ঈশ্বরসত্য, হযবরল-য়ের ছাব্বিশ ইঞ্চির মতো – গলা বুক পেট পাছা – সব ছাব্বিশ ইঞ্চি – সেই অর্বাচিন চতুষ্পদ - আমার ডানদিক বাঁদিক সামনে পিছনে যেদিকেই তাকাই – ওই জানলা – ওই ছাব্বিশ ইঞ্চি - যার বাইরেটা শুধুই ঝাপসা – ঘষা কাঁচ – বিশ্বায়িত পৃথিবীতে অস্তিত্বরক্ষার একমাত্র ফর্মুলা – আজ, এই মুহূর্ত – ব্যাস, পৃথিবী দাঁড়িয়ে আছে একটা বিন্দুর ওপর – অতীতহীন, ভবিষ্যৎহীন| 

গতকাল নেই – আগামীকাল নেই – আমাদের কাছে এই সামান্য মুহূর্তটুকুই আস্ত জীবন!

দু’ ধরণের মানুষ আছেন যারা ভবিষ্যৎ দেখতে বা বলতে পারেন - একদল নাকি ঠিকুজি-কুষ্ঠী পেলে ভবিষ্যৎ স্যাটাস্যাট কড় গুনে বলে দিতে পারেন – তাঁদের ইচ্ছেমতো ভবিষ্যৎ বদলেও দিতে পারেন পাথর-টাথর দিয়ে| আর এক দল – কবি – নিজের চক্ষে দেখা – ইদানিং সময়ের বিশ্বায়িত স্বনামধন্য কবি ওইসব বস্তাপচা পাথরটাথরে না – নিজের গলার উত্তরীয় দিয়ে শুধু কেদারা মুছলেন এবং পরবর্তী সময়ে অবলীলায় রাজশিরোপা লাভ করলেন – এঁরাও অতিমানুষ!

মুশকিল এই আমার মতো না-জ্যোতিষী না-কবি হিজবিজবিজদের নিয়ে – আমাদের না আছে ঠিকুজি কুষ্ঠী, না আছে উত্তরীয় – আছে সবেধন নীলমণি একটা জানলা| আমাদের না আছে অতীত, না ভবিষ্যৎ| আমরা গতকাল মৃত ছিলাম – আজও মৃত – আগামীকালও তাই| বানতলা কামদুনি মধ্যমগ্রাম রাণাঘাট সাত্তোরে যা হচ্ছে হোক, আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে! গোধরা থেকে মুজফ্‌ফরনগর, ছোটো আঙারিয়া থেকে নানুর, সংগ্রামপুর থেকে খাগড়াগড়, নন্দীগ্রাম থেকে যাদবপুর, বিজন সেতু থেকে জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেস, সজল বাড়ুই থেকে সুদীপ্ত সেন, হেতাল পারেখ থেকে সুজেট জর্ডন – আমাদের দায়িত্ব ওই এ কান থেকে ও কান এপাং ওপাং ঝপাং – ফিসফিস করে নিজেকেই বলি – আপনি কিন্তু কিছু দেখেননি মাস্টারমশাই, যা শুনছেন সব ষড়যন্ত্র, সাজানো ঘটনা| 

‘ফুটপাথ কারো বাপের জায়গা নাকি?
তা যদি ভাবিস, ঘুমিয়ে থাকিস
সেই ফুটপাথে – মদ্যপ রাতে 
তোর কপালেও গাড়ি চাপা পড়া বাকি’ – 

আলোকিত মঞ্চে এই গান শুনে আমরা সিটি দিয়েছি, উদ্‌বাহু নৃত্য করেছি | যিনি গাড়িচাপা দিয়ে মানুষ মারলেন, তাঁকে আমরা মনে মনে রূপোলি নৈবেদ্য সাজিয়ে পুজো করে চলেছি| আমরা শার্লক হোমস সাহেবের সেই বিখ্যাত উক্তিটাকে খুব পছন্দ করি – ‘পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে না সূর্য পৃথিবীর, তা জেনে রোজকার জীবনে আমার কিছু যায় আসেনা, তাই আমি ওসব মাথায় রাখিনা’ – আমরাও তাই – আমরা সবাই হিজবিজবিজ - আমাদের পৃথিবীর সীমানা ওই ছাব্বিশ ইঞ্চি দূরের জানলা অবধি – ব্যাস্‌, তার বাইরে আমরা কিছুই মাথায় রাখিনা| 

ঋতবাক| অর্থাৎ সত্য কথন| 

এ তো আবার মহা মুশকিলে পড়া গেলো| সত্য? সেটা আবার কী? খায় না মাথায় দেয়? একসময়ে সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে – এটা সত্য ছিলো| মিশরীয় বা মধ্যপ্রাচ্য সভ্যতার সময়ে অথবা পরবর্তীকালে বাইবেল রচনাকালে মানুষের কাছে চালু সত্য ছিলো - পৃথিবী সমুদ্রে ভাসমান একটি চ্যাপ্টা সমতল ক্ষেত্রবিশেষ| পরে পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতা দিয়ে বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে যে – সে সব ঘোর মিথ্যা| বরং উল্টোটাই সত্য| সতীদাহ প্রথা একসময়ে বাঙলায় সত্য ছিলো| বিধবা রমণীরা একসময়ে সত্যই সামাজিক গলগ্রহ হিসেবে গণ্য হতেন – পরবর্তী সময়ে যুগান্তকারী বিধবা বিবাহ প্রথা প্রকৃত সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলো| ‘প্রকৃত সত্য’ লিখতে মনে পড়ে গেলো - এই কিছুদিন আগে, নব্বই দশকে, সঠিক সন তারিখ মনে নেই, সম্ভবত পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর বার্ধক্যজনিত কারণে উপমুখ্যমন্ত্রী নিযুক্ত হলেন শ্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য| এই খবরটি লিখতে গিয়ে পরেরদিন একটি সংবাদপত্র বুদ্ধবাবু সম্পর্কে লিখলেন – ‘একজন প্রকৃত সৎ কমিউনিস্ট’| কয়েকদিন বাদে সেই সংবাদপত্রেই একটি চিঠি প্রকাশিত হলো, যার মধ্যে পত্রকার (নাম মনে নেই) লিখলেন – সাতের দশক অবধি ‘কমিউনিস্ট’ বললেই আমরা মানুষটির চরিত্র সম্পর্কে সম্যক ধারণা পেতাম, আশির দশকে শুধু কমিউনিস্ট বললে সম্পূর্ণ সত্যপ্রকাশ দুষ্কর হয়ে উঠলো, বলতে হলো – ‘সৎ কমিউনিস্ট’, নব্বই দশকে আবার সৎ শব্দটা নিয়েও ধন্দে পড়লাম, লিখতে হচ্ছে – ‘প্রকৃত সৎ কমিউনিস্ট’ – এরপর কী?

সত্য কি এমনি করেই ক্রমশঃ তরল হয়ে যায়? আজ যা সত্য সেটা কি কাল মিথ্যা হয়ে যাবে? তবে কি এখানে ‘সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই’? যে আদর্শটাকে মানুষের পক্ষে সবচেয়ে সত্য ও সুন্দর বলে বিশ্বাস করে পৃথিবীর ইতিহাসে সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্রের জন্ম হলো – এক শতাব্দীও পেরলোনা, ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেলো? যে বাঙলার বুকে ভূমিসংস্কার হলো, বর্গা অপারেশন হলো – মাত্র চৌঁত্রিশ বছরে সব মিথ্যা হয়ে গেলো? আর তার পরবর্তী এই চার বছর? সে তো আরো ভয়ঙ্কর! আরো সর্বনেশে!

আসলে, মানুষ নিজের অস্তিত্বের তাগিদে নির্মাণ করে একএকটি সত্যকে, আবার মানুষই সেই সত্যকে ধ্বংস করে| নিজ অস্তিত্বের তাগিদেই| নির্মাণও সত্য, ধ্বংসও সত্য| মানুষের নিজস্ব চিন্তন দর্শন কর্মের এই পরিবর্তন ও পরিণতিটাও তাহলে সত্য| মহত্বও সত্য, শয়তানিটাও সত্য| আলো সত্য, অন্ধকারও সত্য| 

এ সব নিয়ে আলোচনায় অসীম দার্শনিক সময় কেটে যাবে, উত্তর আবর্তিত হবে ধ্রুব কেন্দ্রের চারপাশে – ঘুরতেই থাকবে – ঘুরতেই থাকবে – বার্ট্রাণ্ড রাসেলের কথায় - Truth is a shining goddess, always veiled, always distant, never wholly approachable, but worthy of all the devotion of which the human spirit is capable. 

তাহলে ঋতবাকের ভবিষ্যৎ? কী করবে ঋতবাক? আমাদের কী আশা - কোন সত্য কথনে নিজেকে উদ্বুদ্ধ করবে ঋতবাক? অস্ট্রিয়ান স্থপতি-দার্শনিক রুডল্‌ফ স্টেইনার-র মতে - Truth is a free creation of the human spirit, that never would exist at all if we did not generate it ourselves. The task of understanding is not to replicate in conceptual form something that already exists, but rather to create a wholly new realm, that together with the world given to our senses constitutes the fullness of reality.

২৬শে ফেব্রুয়ারি ২০১৫| ঢাকা বাংলাদেশ| আলোকিত বইমেলা মাঠ ফেরৎ উন্মুক্ত রাস্তায় নৃশংসতমভাবে কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে অভিজিৎ রায়কে – আমরা ফেসবুকে রক্তাক্ত রাফিয়া আহমেদ বন্যাকে অভিজিতের লাশের পাশ থেকে উঠে দাঁড়াতে দেখেছি| চারপাশে নীরব বৃত্ত রচনা করেছিলো পুলিশ মিডিয়া ক্যামেরাসহ কয়েকশো মানুষ – একমাত্র একজন সাংবাদিক এগিয়ে গিয়ে দু’জনকেই স্থানীয় একটি হাসপাতালে পৌঁছিয়ে দিয়েছিলেন – আর কেউ এগিয়ে আসেনি সাহায্য করতে|

- ওই সাংবাদিকের নাম হোক ঋতবাক|


তোমার হাসিতে এতো সন্ত্রাস লেগে আছে কেন?
চুম্বন-নিঃশ্বাসে কেন এতো সুনামি সংকেত?
কামার্ত দৃষ্টিপথে শুয়ে আছে গাছের কাণ্ডেরা
পান্তাভাতে কেন এতো লঙ্কার অস্ত্রঝনঝন?

বিছানায় শুয়ে শুয়ে ‘গল্প বলো’ নাতি-আবদারে
ঠাকুরমার ঝুলি থেকে রাজপুত্র কোটালপুত্রেরা
ইদানিং মধ্যরাতে নেমে আসে গামছা-বাঁধা মুখে
রক্তে ভিজিয়ে দেয় শান্তিঘুমস্বপ্নের দালান

যে হাতে পেনসিল হয়ে স্বরবর্ণ আর ব্যাঞ্জনেরা
ভেবেছিলো বড়ো হয়ে কবিতা বা উপন্যাস হবে
এ কে সাতচল্লিশের ট্রিগারে সে হাতের তর্জনি
লাশ করে দিয়ে গেলো সমুদয় শিল্পসম্ভাবনা

‘কল্লোলিনী তিলোত্তমা হবে’ – এটা অবাস্তব জেনে
অথচ ভোরের স্বপ্নে জেগে উঠে আমরা ভেবেছি
ভাত পেলে অন্ততঃ ক্ষুধার সন্ত্রাস যাবে কমে
হয়তো দেরিই হলো – তবু এটা শুভ পদক্ষেপ

সন্ত্রাস ছিলোনা – কই, এমন তো বলিনি কখনো
ইস্পাত-শিলান্যাস ফিরপথে কিন্তু যার শুরু
সন্ত্রাসের বিকল্প কি উন্নততর সন্ত্রাস?
ভোররাতে সূর্য পোড়ে – পূর্বাকাশে রক্তের ছাই

সন্ত্রাস সন্ত্রাস খবরকাগজ শিরোনামে
দশম পাতার শেষ কলামেও লাশের পাহাড়
শিল্প গেলো, ভাত গেলো, গেলো বহু হাঁসদা সোরেন
হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো কি সত্যি সত্যি বদলে যাওয়া মাটি?

ঘাসের শিকড় থেকে বেরিয়েছে দৈত্য-কীটেরা 
মাঠে মাঠে ঢেলে দিচ্ছে চুপিসাড়ে বারুদ ও বিষ 
রক্তের রঙে আর গন্ধে বড়ো অ্যামোনিয়া ঝাঁঝ
আমরা কি সম্মোহিত হয়ে থাকবো বদল-ম্যাজিকে?

‘বদল’ ম্যাজিক নয় – নয় কোনো হনুমান লাফ
‘বদল’ বিদেশ থেকে আনা কোনো প্রযুক্তিও নয়
‘বদল-ফদল’ নয় – ‘ক্রমমুক্তি’ শব্দ সঠিক
আমার বাঁদিক-বুক সর্বাগ্রে ক্রমমুক্ত হোক 


ধর্ষিতা বাঙলার এই ক্রমমুক্তির সত্যবদ্ধ অঙ্গীকারে ক্রমাগত ‘উপভোগ’ নয় – মেরুদণ্ড উলম্ব রেখে সমস্ত অসত্যের চোখে চোখ রেখে ‘চীৎকার’ করে চলুক ঋতবাক| 



2 comments:

  1. সাবাস !! সাবাস !! সাবাস পল্লব !! অসাধারণ প্রচ্ছদ-নিবন্ধ !! ঋজু এবং কাব্যিক !!

    ReplyDelete
  2. দারুন লেখা! ঠিক যেরকমটা ঋতবাকের প্রয়োজন। আরও অনেক চাই, পল্লববাবু।

    ReplyDelete