0

ছোটগল্পঃ পলাশ কুমার পাল

Posted in












ছোটগল্প 



হ্যারিকেন
পলাশ কুমার পাল


ঘরের কোণে হ্যারিকেনের ক্ষীণ আলো জ্বলছে। কালি পরে আলোটা আরও ক্ষীণ হয়ে আসছে। রাত তখনও গভীর। বিভাদেবী আধখোলা চোখ ঝুলভরা ঘরের কোণে; টিকটিকির দিকে চেয়ে। মনে মনে ভাবছেন সাত-পাঁচ। বয়সের শেষপ্রান্তে এসে অন্ধকার ভবিষ্যৎ যেন গাঢ় হয়ে আসছে হ্যারিকেনের মতো। দুই ছেলের আজও দয়া হল না; তারা পারল না তাদের বৌয়ের আঁচল থেকে বেড়িয়ে আসতে। এইসব ভাবছে আর টিকটিকির ডাক শোনার জন্য অপেক্ষা করছে। সত্তরটা বছর পেরিয়েও অপেক্ষা? বাইরে দুয়ার থেকে আওয়াজ আসে, 'বৌমাআ! ও বৌমাআআ! অর্ক! অর্কঅঅ!' আশি বছরের বৃদ্ধ সুকান্ত দাসের গলার আওয়াজ। বয়সের ভারে জড়ানো কণ্ঠস্বর প্রায় সর্বদা ধ্বনিত হচ্ছে। বাড়ির সকলেই এই স্বর শুনে অভ্যস্থ। তাই শুনেও না শোনার ভাব করে থাকে। বৃদ্ধ সুকান্ত ক্লান্তিহীন গলা ফাটাতে থাকেন।

গত কয়েক দিন যাবৎ সুকান্তবাবু অসুস্থ। বয়সের পরিমাপ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গেই এই রোগ। দীর্ঘ জীবনের পর তিনি এখন শয্যাশায়ী। তাও দুয়ারে রাখা একটি জীর্ণ খাটে। সেই খাটে কিছু ছেঁড়া কাঁথার উপর একটি ময়লা চামটানি চাদর পাতা আর একটি তুলা বেড়ানো বালিশ। এইটুকুই তার শয্যার প্রাপ্তি। এর উপরেই একদিনের প্রতাপশালী সুকান্ত কঙ্কালের দশায় দৃশ্যমান। এই কঙ্কাল দশাটা কেবলই রোগে নয়, মানসিক টানাপোড়েনও অন্যতম কারণ। সুকান্তবাবু দুই ছেলেকে খুব যত্ন করে লালন পালন করেন। চাষে কঠোর পরিশ্রম করে পড়াশোনা ও সংসার খরচ চালিয়েছিলেন। পড়াশোনার কোনো ক্রুটিই তিনি রাখেননি। তবু বুদ্ধির ঘাটতি থাকার কারণে পড়াশোনায় খুব ভালোভাবে সফল হতে পারেনি কেউই। তবে জীবিকা ক্ষেত্রে দু'জনেই খুব সফল ছিল। বড় ছেলে বিমলের ধানের খটি এবং ছোটো ছেলে অমল শহরে একটি ঔষধের দোকান করেছে। দু'জনেরই মাসিক আয় খুবই ভালো। পাকা বাড়ি করেছে তারা। তবু সুকান্তবাবু ও ওনার স্ত্রী বিভাদেবী একখানি মাটির ভাঙাচোরা পুরানো ঘরে। পাকা ঘরে স্থান হয়নি তাঁদের। দুই বৌমা ও ছেলারা পরস্পর ঝগড়া করে যে যার আলাদা ঘর করে নিয়েছে। কেউ তাদের বাবা-মাকে সেবা করতে রাজী হয়নি। বরং শ্বশুর শাশুড়ির সঙ্গে ঝগড়া করে। বাড়ির জঞ্জালের মতোই দুই বৃদ্ধ একপাশে পরে থাকেন। এমনকি কোন বৌমা ভাত রান্না করে দিতে রাজী হয়নি। তাই সুকান্তবাবু ও বিভাদেবী আলাদাই খান। দু'ছেলে ভাগ করে জমি চাষ করে। আর তার থেকেই চাল দিয়ে দেয়। এবং মাসিক সামান্য কিছু টাকা দেয়। এইটুকু সম্বলে কোনোরকমে আস্বাদহীন সংসারে ক্ষুধা নিবৃত্ত হয়। রাত গভীর হয়। সুকান্তবাবুর হাঁকও বাড়ে। বিরক্ত হয়ে ছোটো বৌ রিতা বিছানায় পাশ ফিরতে ফিরতে বলে, 'বুড়োটার মরণও হয় না! জ্বালিয়ে মেরে দিল!'

-'ঘুমিয়ে পর।' - ঘুম জড়ানো গলায় অমল বলে।

-'ঘুমাব কি করে! তোমার বাবা কি ঘুমাতে দিচ্ছে!'

-'ছাড়ো না, বুড়ো মানুষ!'

-'বুড়ো হলে কি হবে! গিঁটে গিঁটে বদ বুদ্ধি।' -এই বলে রিতা অন্যপাশে ঘুরে শোয়। অমলও কথা বাড়ায় না। ঘুমঘোরে তারও আর ভালো লাগে না। প্রত্যহ রাতে এই ডাক অসহ্য হয়ে উঠেছে। বাবার উপরে অমলের রাগ হয়। তবু সে বাবাকে কিছু বলতে পারে না। এই করুণ মুখটার সামনে দাঁড়ালে সে যেন কোথায় হারিয়ে যায়। আজও হয়তো তার মধ্যে পুরো আধুনিক স্বার্থপরতা পুরোপুরি শাখা-প্রশাখা মেলে ধরতে পারেনি। অমল ঘুমিয়ে পরে।

পাখির ডাকে সকাল হয়। অমল সাংসারিক সকল কাজ সেরে দোকানে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়। ওদিকে বিমল 'মা, আসি' বলে বের হয়। অমল বেরোবার আগে নিত্যদিনের মতো মা ও বাবাকে প্রণাম করে। সংস্কৃতির এইটুকু তার মধ্যে আছে, বিমল যেটা করে না। অমল বাবার কোন ঔষধ লাগবে সেটা জেনে নেয়। বিমল কিন্তু অন্যরকম। সে মা-বাবার সম্বন্ধে কোন খোঁজ খবরই সেভাবে রাখে না। কেবল অমল কত কি খরচ করল তা জেনে নিজের ভাগের টাকাটা ফেলে দেয়। অমল বাবাকে প্রণাম করার সময় বলে- 'তুমি তোমার বৌমাকে একদম ডাকবে না! ও রাগ করে! ওকে ডাকো কেন?

-'বিড়ি খেতে ইচ্ছে করে খুব। ওকে ঐ প্যাকেট দেওয়ার জন্য ডাকি। তুই একটা বিড়ি এনে দেনা আমায়!'

-'না, বিড়ি একদম নয়! ডাক্তার মানা করেছে খেতে।'

-'মানা করুক। আমার বুক জ্বলে যাচ্ছে যে, সে খবর ডাক্তার রাখে? দে'না বাবা!'

-'না! আমি আসি!', বলে অমল বেরিয়ে যায়। গ্রামের হাতুড়ে ডাক্তার সত্যবাবু সুকান্তবাবুর চিকিৎসা করছে। টানের রোগ থাকায় তিনি সুকান্তবাবুকে বিড়ি খেতে নিষেধ করেছেন। 'অমল! অমল!' বলে বৃদ্ধ চিৎকার করে ওঠে। তাঁর আপ্রাণ চেষ্টা অমলকে থামাতে পারে না। কাল রাত থেকেই এই জন্য সে বৌমা'কে ডাকছিল। 

'বেরুবার সময় কি পিছু না ডাকলেই নয়! বয়সের সঙ্গে সঙ্গে দেখছি জ্ঞানটাও হারিয়েছেন।', রিতা খেঁকিয়ে ওঠে। অমল শুনতে পায়। তবো সে কিছু না বলেই নীরবেই শহরের পথ ধরে।

আবারও ডাক 'বৌমা! ও বৌমা! বৌমা...' ছোটো বৌমাকেই সুকান্তবাবু ডাকেন। মুখ ঝামটানি দিলেও বৌমাদের মধ্যে রিতাই একটু নজর রাখে। বড় বৌমা জয়া ডাকার জন্য একদিন মেরেছিল। তাই মনের দুঃখে আর বড় বৌমাকে ডাকে না। বিমলও জয়াকে আসতে মানা করে দেয়। 

-'কি? হয়েছেটা কি?', রিতা ঝাঁট দিতে দিতে ঝাঁটা হাতে ছুটে আসে। ঝাঁটা মারবে নাকি? অবশ্য ঝাঁটার ধুলোর যোগ্যও সুকান্তবাবু নয়। ধুলোর যোগ্য হলে তো ঝাঁটার গায়ে লেগে থেকে গৃহের একটি স্থানে আশ্রয় পেত। বৃষ্টিতে ছেঁদা চাল থেকে জল গায়ে পরত না।

-'একটা বিড়ি দাও না, বৌমা!' দম নিতে নিতে সুকান্তবাবু বলেন, 'আজ আমার শরীরটা ভালো লাগছে না! বিড়ি খেলে হয়তো ভালো লাগবে!'

-'আপনার শরীর গেল কি থাকল, তা আমি কি করব! আপনার ছেলে দিতে মানা করেছে। দেব না। তাছাড়া অত বিড়ি কিসের? ইনকাম তো করেন না।'

-'আমি উঠতে পারছি না বলে বলছি। ঐ তাকে আছে একটা বিড়ির প্যাকেট। দাও না! ঐ, ঐঐ যে!', সুকান্তবাবু কাঁপা কাঁপা তর্জনী তুলে দুয়ারে তাকে রাখা বিড়ির প্যাকেট নির্দেশ করেন। রিতা মুখ বেঁকিয়ে চলে যায়। কাপড় শুকাতে দিতে দিতে বিভাদেবী চিত্কার শুরু করে দেয়, 'তোমারও মরণও হয়নে! তোমায় বিড়ি খেতে মানা করেছে, তুমি বৌমার কাছে চাইছ!' বিভাদেবী রিতাকে সমীহ করে। আর সেই বিভাদেবীই বিড়িটা ওখানে রেখেছিল। তাই তিনি চেঁচিয়ে ওঠেন। রিতা বলে, 'আপনি বিড়ির প্যাকেটটা কিনে এনেছেন কেন?' এইভাবে চিৎকার চেঁচামিচির মধ্য দিয়ে বাড়ি মুখর হয় নিত্যদিনের মতো। যতদিন সুকান্তবাবু শয্যাশায়ী হয়েছেন ততদিন অশান্তি আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। সুকান্তবাবু চুপ করে যান। তিনি শুয়ে শুয়ে দেখেন শালিক পাখি কিছু উঠানে কিচিরমিচির করছে।

বেলা হয়। বিভাদেবী হাঁড়িতে করে ভাত চাপান। কুড়ানো কিছু শুকনো পাতা আর শুকনো কঞ্চি উনানে ভরে জ্বাল দিতে থাকেন। একদৃষ্টিতে দেখেন ভাতের ফেন ফুটতে ফুটতে কীভাবে হাঁড়ি থেকে গড়িয়ে হাঁড়ির গায়ের উষ্ণতাতেই পড়ে শুকিয়ে যাচ্ছে। অথচ আগুনে পুড়ছে না। কেবল মৃত সত্তার মতো বেঁচে থাকা। ভাত হয়ে গেলে বিভাদেবী ভিজে গামছা করে সুকান্তবাবুর গা মুছিয়ে দেন। তারপর ভাত চটকে ভাত খাওয়ান। ভাত খেতে খেতে সুকান্তবাবুর দিঠি থেকে জল গড়ায়। তাঁর হাতে গড়া এই সুলালিত সংসারে তিনিই আজ কুলেখাড়ার মতো আলপথে পরে আছেন। বেশী ভাত খেতে পারেন না। দু'চামচ ভাত খেয়েই তিনি মুখ ফেরান। বিভাদেবী উঠে হাত ধুয়ে ভাত বেড়ে খেতে বসেন। সুকান্তবাবুর সমস্ত সেবাযত্ন তিনি করেন। তিনি জানেন বৌমারা কেউ করবে না। তাঁরও খাওয়াতে রুচি নেই। বেগুন ভাজা, আলুভাতে, ভাত একঘেঁয়েমি হয়ে উঠেছে। তবু পেটের জ্বালায় খাওয়া। পাত থেকে মাছের বাস উঠছে। ধীরে ধীরে খাচ্ছিলেন যদি এক পিস দিয়ে যায় বৌমা। না দিয়ে গেল না। খাওয়া শেষে মেঝেতে জল দিয়ে হাত বুলিয়ে থালা মাজতে গেলেন। ঘাটে গিয়ে পাশের বাড়ির ছায়া-বৌয়ের সঙ্গে সাংসারিক গল্প করতে লাগলেন। এরই ফাঁকে নিজের দুঃখের কথাও বলেন। 'মা! মাআ!' বৌমার ডাকে বিভাদেবী গল্প মাঝপথে থামিয়ে চলে এলেন। ধোয়া বাসন রাখতে গিয়ে হাত থেকে বাটি আর গ্লাসটা পরে গিয়ে ঝন ঝন করে আওয়াজ হয়। 

-'কী বলছো বৌমা?' বাসনগুলো তুলতে তুলতে বলেন।

-'না, কিছু না!'

বিভাদেবী বুঝতে পারেন বৌমার ডাকার কারণ। তিনি কিছু না বলে ঘরে মেঝেত মাদুরি বিছিয়ে শুয়ে পরেন। সারাদিন পরিশ্রমের ফলে ক্লান্ত বিভাদেবী কখন ঘুমিয়ে পরেন। সন্ধ্যার সময় ঘুম ভাঙে। বৌমাই ডেকে তোলে সন্ধ্যার প্রদীপ দেখানোর জন্য। সন্ধ্যা দেখানো শেষ হলে হ্যারিকেনটা জ্বেলে সুকান্তবাবুর খাটের পাশে বসেন। সুকান্তবাবু তখন ঘুমাচ্ছিলেন। আর নাতি অর্কের পড়ার আওয়াজ শুনতে থাকেন। কাছে তো পাননি নাতিকে সেভাবে। অর্কের কণ্ঠস্বরের পাশাপাশি সিরিয়ালের সংলাপ শোনা যায়। এইভাবে সন্ধ্যা রাত হয়। বিমলের ঘরে ফেরার আওয়াজ পাওয়া যায়। একটু পর অমলও ফেরে। অমলের গলার আওয়াজ শুনতে পেয়ে সুকান্তবাবু আবার ক্ষীণ গলায় ডাকতে থাকেন- 'অমল! ও অমঅঅল! অমল!' আজ গলার স্বরটা অনেকটা দুর্বল শোনাচ্ছে। অনেক ডাকের পর অমল আসে- 'কি হয়েছে?'

সুকান্তবাবু কাঁদতে কাঁদতে বলেন, 'দেনা বাবা! দেনা একটা বিড়ি!'

-'বাজে বকবক না। তোমার খাওয়া হয়ছে?'

-'আমার খেতে রুচি হয় না রে। আর বাঁচব না। দেনা। এটাই শেষ! দেনা একটা বিড়ি!'

-'না!' বলে অমল চলে যেতে উদ্যত হয়।

-'শোননা রে!' বলে সুকান্তবাবু অমলের বাম হাতের আঙুলটা ধরে ফেলেন। তিনি মাথা তোলবার চেষ্টা করেন।

-'কি? আবার কি হল?'

-'আমি মরে গেলে মা'কে দেখিস রে!' অমলের হাতটা চেপে ধরেন। 'আর, অর্ককে একবার ডেকে দেনা। দেখব। অনেকদিন দেখিনি! যদি মরে যাই...'

-'আবার উল্টোপাল্টা বকছ!' বিরক্তির সুরে বলে, 'তাছাড়া এখানে যা গু-মুতের গন্ধ, ও'কে এই নোংরায় আনা যাবে না!' প্রায় জোড় করে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে অমল চলে যায়। এটা তার নিত্যদিনের শোনা কথা। যাওয়ার সময় খাটের পাশে রাখা হ্যারিকেনটা পা লেগে দপ দপ করে ওঠে।

-'পায়ে ছ্যাঁকা লাগল?' আঁতকে ওঠেন বিভাদেবী। কিছু না বলেই বিড়বিড় করতে করতে অমল চলে যায়। সুকান্তবাবু বিভাদেবীকে ডেকে বিমলকে ডেকে দিতে বলেন। বিভাদেবী বিরক্ত হয়ে ওঠে- 'ও, তোমার কত খোঁজ নেয়? যে ও'কে ডাকব!'

-'না গো, আমার গলাটা বুজে আসছে। আর বোধ হয়...'

-'তুমি প্রতিদিনই বল। ছাড় ও কথা! কিছু খাও দু'মুঠো।'

-'না, কিছু খেতে পারব না! তুমি একটু জল দাও শুধু।'

বিভাদেবী জল দেন। তিন চামচের বেশী জল খেলেনও না সুকান্তবাবু। ক'দিন তিনি আর কিছু খেতে পারছেন না। বিভাদেবী সুকান্তবাবুর মশারি খাটিয়ে দিয়ে নিজে খাওয়ার জন্য হাঁড়ি থেকে ভাত বাড়তে যান। ওবেলার ভাতে জল না ঢালার কারণে গন্ধ ছেড়ে গেছে। আর খাওয়া হয় না। তিনি মেঝেতে মাদুরি বিছিয়ে অভুক্ত অবস্থায় শুয়ে পরেন। বাইরে হ্যারিকেনের আবছা আলোয় ভাঙা খাট দেখা যায়। তিনি চেয়ে চেয়ে দেখেন একটা মানুষ সেখানে নড়ছে। কালো মূর্তির মতো। দেখতে পাওয়া যাচ্ছে তাকে। জীবন্ত সে। পাশে হ্যারিকেন ক্ষীণ শিখায় জ্বলছে। আলোর শিখায় কাঁচটায় কালি পরে যাচ্ছে। ক'দিন মোছা হয়নি ঐ হ্যারিকেন। কাল মুছতে হবে। এই ভাবতে ভাবতে বিভাদেবী ঘুমিয়ে পরেন।

মাঝরাতে আবারও সুকান্তবাবুর হাঁক- 'বৌমা! ও বৌমাআ!....অমল, অমঅল!' বিভাদেবী শোনেন। নিত্যদিনের ঘটনা ভেবে তিনি চুপ করে থাকেন। এরই মধ্যে কখন নিদ্রামগ্ন হয়ে পরেন। সুকান্তবাবু হেঁকেই যান- 'বৌমা! ও বৌমা! অর্ক, অর্ক! আয় না দাদুভাই! অর্ক! অমল! অমল! একটু জল দেনা বাবা! জল! বৌমা...'

ঘর থেকে গভীর রাতে অমল সব শুনতে পায়। সে বলে, 'কি হল বলত বাবার?'

রিতা বিরক্তির স্বরে বলে, 'ঢঙ!'

ওদিকে বিমলও সব শুনে বিরক্ত হয়ে এপাশ ওপাশ করতে করতে ঘুমিয়ে পরে। ভোরের দিকে বিভাদেবীর চিৎকারে ঘুম ভেঙে যায়- 'ওরে অমল, অমল! বিমল! তোর বাবার কি হল দেখ!' বিভাদেবী কাঁদতে থাকেন। রিতা পাশ ফিরতে ফিরতে বলে 'বিরক্তিকর! ভোরে আবার নাটক শুরু করেছে। ঘুমাতে দেবে না!'

'না গো! কিছু একটা হয়েছে!', বলে অমল উঠে যায়। দেখে বাবা আর নেই। যে মানুষটি তাকে পৃথিবীর আলো দেখিয়েছিলেন, পৃথিবী চিনিয়েছিলেন, তিনি আর পৃথিবীতে নেই। শেষ মূহূর্তে জল চেয়েও না পেয়ে চলে গেলেন। অমল নীরবে ফুঁপিয়ে ওঠে।

ধীরে ধীরে সকাল হয়। বিমল আসে। সে দূর থেকেই দেখে। সে অমলকে বলে, 'তুই সবাইকে খবর দে! আমি কাঠের ব্যবস্থা করে আসি। তাড়াতাড়ি সত্কার হলেই ভালো!' 

আস্তে আস্তে পাড়ার লোক দেখতে আসে। শেষ দেখা। সুকান্তবাবুর পরিবার কান্নায় ভেঙে পরে। এটা কি শোক? না সঙ? লোক দেখলেই রিতার কান্নার বেগ বেড়ে যায়। বড় বৌ জয়াও ডাক ছেড়ে কাঁদে। বিভাদেবী একদৃষ্টে স্থির হয়ে তাকিয়ে আছেন মৃত সুকান্তবাবুর মুখের দিকে চেয়ে। চোখের কোণ দিয়ে জল গড়িয়ে পরার আগেই কোথায় সে জল হারিয়ে যাচ্ছে। হ্যারিকেনটা নিভে গেছে কখন।

সৎকারের ব্যবস্থা হয়ে গেলে মরদেহ ওঠে। সৎকার শেষে সকলে বাড়ি ফেরে। ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নেমে আসে। সব আলো নিভে গেলে ঘরে ঘরে বাতি জ্বলে ওঠে। বিষণ্ণ মনে শৈশব থেকে আজ পর্যন্ত বাবার কথা ভাবতে ভাবতে বাবার শেষ কথাটি বারবার কানে বাজে- 'অমল! মাকে দেখিস বাবা!' অমল ঘর থেকে বেড়িয়ে বামদিকে সেই খাদিপাড়া মাটির ঘরে যায়। অন্ধকার, কোনো আলো জ্বলছে না দুয়ারে। হ্যারিকেনটা কোথায়? ঘর থেকে টর্চ আনে। টর্চের আলো জ্বেলে দেখে তার মা জীর্ণ খাটে শুয়ে আছে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে। খাটের তলায় হ্যারিকেনটা বসানো। কাঁচে কালি পরে কাঁচ কালো হয়ে গেছে। গতকাল হ্যারিকেনে পা লেগে ছ্যাঁকা লাগার কথা মনে পরে গেল। 'মা! মা! হ্যারিকেনটা জ্বালনি কেন?' বিভাদেবী কোনো উত্তর দেয় না । তাঁর অপলক দৃষ্টি ছেদা চালের উপরে। সাড়া না পেয়ে অমল নিজেই হ্যারিকেনটা জ্বালবে বলে হাতে তুলতে গিয়ে দেখে সেটাতে তেল নাই।

0 comments: