পথে প্রান্তরেঃ ত্রিভুবন জিৎ মুখার্জী
Posted in পথে প্রান্তরে
পথে প্রান্তরে
অর্ক ক্ষেত্র কোণার্ক
ত্রিভুবন জিৎ মুখার্জী
কোণার্ক সূর্য মন্দির এর অস্তিত্ব সম্পূর্ণ থাকলে সেটি সেভেন ওয়ান্ডার্স (সপ্ত আশ্চর্য) এর মধ্যে একটি হতো, বা তালিকাটি পরিবর্ধিত হয়ে এইট ওয়ান্ডার্স বলা হত এতে সন্দেহ নেই। সংস্কৃততে কোণ+অর্ক=কোণার্ক। কোণ অর্থাৎ কোণা বা সূর্যের বিভিন্ন কোণের অবস্থান, অর্ক অর্থাৎ সূর্য। এই মন্দিরটি সূর্যের বিভিন্ন অবস্থানে গুরুত্বপূর্ণ অর্থ বহন করে। এটি সূর্যের মন্দির ছিল। এখনও এর ভগ্নাবশেষ যা আছে, তা সমস্ত পর্যটক দের আকর্ষণের কেন্দ্র বিন্দু। পৃথিবীর সমস্ত প্রান্ত থেকে সারা বছর লক্ষ লক্ষ পর্যটক কোণার্ক সূর্য মন্দির দেখতে আসেন এর ভাস্কর্য ও কলা কীর্তি দেখার জন্য।
কোণার্কের সূর্য মন্দিরের ইতিহাসঃ-
এই মন্দিরের টানে প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক এখানে আসেন অপূর্ব ভাস্কর্য, প্রস্তরের উপর কারুকার্য এবং নৃত্যাঙ্গনাদের অপূর্ব শৈলীতে নৃত্যের প্রস্তর মূর্তি দেখতে। খজুরাহ এবং কোণার্ক দুটোই ভারতবর্ষের অপূর্ব সৃষ্টি। তবে কোণার্কের বৈচিত্র সম্পূর্ণ আলাদা। ১৩শ শতাব্দীর এই অদ্ভুত কীর্তিকে ইংরাজিতে Black Pagoda বলা হয়। ১২৫০ শতাব্দীতে পূর্ব গঙ্গ বংশের রাজা লাঙ্গুড়া নৃসিংহদেব এই মন্দির নির্মাণ করান। প্রবাদ আছে, ১২০০ প্রস্তর শিল্পী ওই সূর্য মন্দির নির্মানে নিযুক্ত হন রাজার দ্বারা। প্রধান মন্দিরটিতে ৭ টি ঘোড়ার উপর সূর্য মূর্তি নির্মিত হয়েছিল। এই সাতটি ঘোড়া সপ্তাহের সাতটি দিনের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত। মন্দির গর্ভগৃহে রাখা সূর্য দেবতার মুখে এসে পড়ত সূর্যর প্রথম কিরণ। বারো জোড়া ঘোড়ার উপর ওই মন্দির নির্মান হয়। প্রত্যেক চাকা এক একটি সূর্য ঘড়ি। অপূর্ব কলা কৌশলে তৈরি।
কোণার্ক মন্দির তৈরির ইতিহাস যেমন নিপুণ ভাস্কর্যের উদাহরণ, ঠিক তেমনি নৃশংস এক বলিদানের সাক্ষী। ১২০০ শিল্পীকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানর জন্য বলি দেওয়া হয় নাবালক প্রস্তর শিল্পী ধর্মপদকে। ১২ বছর বয়েসের ধর্মপদ ছিল অন্যতম প্রধান স্থপতি বিশু মহারাণার পুত্র। বারো বছর ধরে যে ১২০০ প্রস্তর শিল্পীকে বিশু মহারাণা নিয়োগ করেন কোণার্কের মন্দির নির্মাণের জন্য, তারা মন্দির নির্মাণের পর সূর্য মূর্তির চূড়ায় মুকুট স্থাপনে অসমর্থ হয়। রাজা নৃসিংহ দেব বিশু মহারাণাকে একদিনের সময় দেন ওই মুকুট স্থাপনের জন্য। কিন্তু মহারাণারা সকলে অকৃতকার্য হন। ধর্মপদ বাবার কাজ দেখতে আসে এবং অন্য সকল মহারাণাদের কাছে শোনে যে রাত পোহালে তাদের সকলের শিরশ্ছেদন সুনিশ্চিত। ধর্মপদ নিজে মন্দিরের চূড়ায় গিয়ে ওই মুকুট স্থাপন করে যা একটি চুম্বকীয় তত্ত্বের উপর নির্ভর করে। কোণার্কের সূর্য মূর্তি দুটি চুম্বকের মধ্যে ঝুলন্ত অবস্থায় স্থাপন করা হয়। আমরা জানি, চুম্বকীয় তত্ত্বে সম মেরু পরস্পরকে বিকর্ষণ করে (according to the laws of magnetism, like poles repel each other)। ওই তত্ত্ব অনুযায়ী দুটি সমান মেরুর, সমান আকারের এবং সমান ওজনের চুম্বকের মধ্যিখানে সূর্য মূর্তিটি ঝুলন্ত অবস্থায় স্থাপন করা এক বিশাল প্রযুক্তি জ্ঞানের প্রমাণ দেয়। এই অসম্ভব কার্য ধর্মপদের দ্বারা সুসম্পন্ন হয়। কিন্তু রাজার কানে ওই কথা পৌঁছলে সমস্ত মহারাণার মস্তকচ্ছেদন সুনিশ্চিত ছিল। তাই ১২০০ মহারাণা (প্রস্তর শিল্পী) বিশু মহারানাকে তার পুত্রকে অপসারণের জন্য তাকে হত্যা করার কথা বলে। ১২০০ মহারাণার জীবন রক্ষা করে ওই নাবালক ধর্মপদ। নিজে ধর্মপদ ওই কাজ সম্পাদনের পর মন্দির চূড়া থেকে আত্মাহুতি দেয় সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে, যার করুণ ইতিহাস কোণার্কের মন্দির গাত্রে প্রতিধ্বনিত। এই করুণ গাথা সকল শিল্পীকে স্তম্ভিত করে। কিন্তু কেউ কিছু বলে না। রাজা মহারাণাদের কাজে সন্তুষ্ট হয়ে পুরস্কার দেন। ধর্মপদের আত্মবলির কথা চিরকালের জন্য নেপথ্যে থেকে যায়। তারই অভিশাপে হয়তো কোণার্কের ভাস্কর্য অতুলনীয় হয়েও পৃথিবীতে তার সঠিক মূল্যায়ন হয়নি, এবং মূল সূর্য মূর্তি ধ্বংস হয়ে যায়।
মন্দিরের বেদী থেকে শুরু করে চূড়া পর্যন্ত প্রতি ইঞ্চি জায়গায় পাথরের ভাস্কর্য ও কারুকার্য রয়েছে। দেবতা, অপ্সরা, কিন্নর, যক্ষ, গন্ধর্ব, নাগ, মানুষ, বিভিন্ন প্রাণী, পৌরাণিক বিভিন্ন ঘটনার প্রতিরূপ, নৃত্যরত নরনারী, প্রেমিক যুগল, রাজদরবারের বিভিন্ন দৃশ্য, শিকারের দৃশ্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে পাথরের বুকে।মূর্তিগুলোর মানবিক আবেদন, নিখুঁত গড়ন, লীলায়িত ভঙ্গী শিল্পকলার চরম উৎকর্ষের নিদর্শন। কলিঙ্গ রীতিতে নির্মিত মন্দিরের চূড়াগুলো পিরামিড আকৃতির। মন্দিরের সামনে রয়েছে নাট্ নাটমণ্ডপ। এখানে একসময় দেবদাসীরা দেবতার উদ্দেশ্যে পূজানৃত্য পরিবেশন করতেন। মন্দিরের ভিতরে রয়েছে নাট্যমন্দির, ভোগমন্দির ও গর্ভগৃহ। মন্দিরটির উচ্চতা প্রায় ৮৫৭ ফুট। তবে মন্দিরের অনেক অংশ এখন বালিতে দেবে গেছে। মন্দিরের দেউল এখনো ২০০ ফুট উঁচু। মন্দিরে সূর্যদেবতার যে বিশাল বিগ্রহ ছিল তা এখন নেই। কালের করাল গ্রাসে স্থাপত্যের অনেকটাই আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত। বাংলার সুলতান সুলেমান খান এর সেনাপতি কালাপাহাড়ের আক্রমণে কোণার্ক মন্দির প্রথম ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। উড়িষ্যার ইতিহাস অনুযায়ী কালাপাহাড় ১৫০৮ সালে কোণার্ক আক্রমণ করে। ১৬২৬ সালে খুরদার তৎকালীন রাজা পুরুষোত্তম দেবের পুত্র নরসিংহ দেব সূর্যদেবের বিগ্রহটি পুরীর জগন্নাথের মন্দিরে নিয়ে যান। তিনি কোণার্ক মন্দির থেকে কারুকার্য করা অনেক পাথর পুরীর মন্দিরে নিয়ে যান। মারাঠা শাসনামলে কোণার্ক মন্দির থেকে অনেক ভাস্কর্য ও প্রস্তরখন্ড পুরীতে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৭৭৯ সালে কোণার্ক থেকে অরুণ স্তম্ভ নামে বিশাল একটি স্তম্ভ নিয়ে পুরীর সিংহদ্বারের সামনে স্থাপন করা হয়। ওই স্তম্ভটি এখনও বিদ্যমান. এবং এটি একটি গ্রানাইট পাথরের তৈরি। এই সময় মারাঠা প্রশাসন কোনার্কের নাটমণ্ডপটি অপ্রয়োজনীয় মনে করে ভেঙ্গে ফেলে।
সূর্যদেবের বিগ্রহ অপসারণের পর কোনার্কে পূজা ও আরতি বন্ধ হয়ে যায়। পর্তুগীজ জলদস্যুদের ক্রমাগত আক্রমণের ফলে কোণার্ক বন্দর বন্ধ করে দেওয়া হয়।
আঠারশ' শতক নাগাদ কোণার্ক মন্দির তার সকল গৌরব হারিয়ে পরিত্যাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকে। মন্দিরের অনেক অংশ বালির নিচে চাপা পড়ে যায়।মন্দির চত্বর ও এর আশেপাশের এলাকা ধীরে ধীরে ঘন অরণ্যে ছেয়ে যায়। বন্য জন্তুরা বাসা বাঁধে মন্দিরের ভিতর। জলদস্যু ও ডাকাতের আস্তানায় পরিণত হয় কোণার্ক মন্দির। সেসময় দিনের আলোতেও সাধারণ মানুষ ভয়ে এর ত্রিসীমানায় যেত না। বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে প্রত্নতত্ববিদরা কোণার্ক মন্দির পুনরাবিষ্কার করেন। খননের ফলে লোকচক্ষুর সামনে উন্মোচিত হয় কোণার্ক মন্দিরের অপূর্ব স্থাপত্য শৈলী, বিস্ময়কর ভাস্কর্যকীর্তি ও অনন্য শিল্প সম্ভার।কোণার্ক মন্দিরের অনেক শিল্প কীর্তি এখন সূর্য মন্দির জাদুঘর ও উড়িষ্যার জাতীয় জাদুঘরে রয়েছে। প্রতিদিন শত শত দর্শনার্থী কোনার্কের সূর্য মন্দির দেখতে আসেন। প্রাচীন ভারতীয় স্থপতি ও ভাস্করদের শিল্পনৈপুণ্য ও সৃষ্টিশীলতা আজও মানুষকে বিস্ময় বিমুগ্ধ করে।
কোণার্ক সূর্য মন্দির এখন Archaeological Survey of India (ASI)র অধীনে। পর্তুগীজ জলদস্যুদের দস্যুবৃত্তি করতে অসুবিধা হওয়ার জন্য তারা মন্দিরের মাথায় অবস্থিত অতি শক্তিশালী চুম্বকটিকে নষ্ট করে দেয়। এখনকার কোণার্ক সূর্য মন্দিরের ভিতরে বালি দিয়ে ভরা। প্রবেশ নিষেধ। মন্দিরের পাশে ঘুরতে হয়।
এই মন্দিরের পরিসীমার ভিতর অনেকগুলি ছোট ছোট মন্দির আছে। মন্দিরের কিছু দূরে প্রত্নতাত্বিক মিউজিয়াম আছে যা শুক্রবার বন্ধ থাকে। ইতিহাস বলে, কালাপাহাড়ের আক্রমণে প্রধান মন্দির ধ্বংস হয়ে যায়। এখন যেটি আছে সেটি মুখ-শালা বা সিংহদ্বার। এই মন্দিরটি UNESCO থেকে World Heritage Site ঘোষিত হয়েছে। ভারতের ৭ টি আশ্চর্য দর্শনীয় স্থানের মধ্যে কোণার্ক একটি (এন ডি টিভির মতে)।
চন্দ্রভাগাঃ-
কোনার্কের কাছে সমুদ্র সৈকত ‘চন্দ্রভাগা’ নামে পরিচিত। এটি একটি তীর্থ স্থানে পরিণত হয় মাঘী সপ্তমীর দিন। ওই দিন এখানে লক্ষ লক্ষ তীর্থযাত্রী আসেন চন্দ্রভাগাতে ডুব দেওয়ার জন্য। কোণার্কের সমুদ্র সৈকতের সৌন্দর্য অপরূপ। কোণার্ক থেকে ঢ়িল ছোঁড়া দূরত্বে এই সমুদ্র সৈকত না দেখলে কোণার্ক দেখা সম্পূর্ণ হয় না। পরিষ্কার বালি এবং ঘূর্ণায়মান ঢেউ। শীতল নীল সমুদ্র সৈকত দীর্ঘ প্রসারিত। সঙ্গে সৈকতের নিজস্ব সুদৃশ্য নির্মলতা আছে। এখানে আন্তর্জাতিক ইয়টিং (Yachting) প্রতিযোগিতা হয়। দেশ বিদেশ থেকে বহু প্রতিযোগী আসেন এই প্রতিযোগিতায় ভাগ নিতে।
কোণার্ক মুক্তাঙ্গন নৃত্য উৎসবঃ-
কোণার্কের সূর্য মন্দির একটি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। প্রত্যেক বছর এখানে কোণার্ক মুক্তাঙ্গন নৃত্য উৎসব (Open Air Auditorium for Konarak Dance Festival) ডিসেম্বর মাসে হয়। ১লা ডিসেম্বর থেকে ৫ই ডিসেম্বর পর্যন্ত কোণার্ক নৃত্য উৎসব চলে। সারা ভারতবর্ষ থেকে এখানে বহু শিল্পী আসেন নৃত্য পরিবেশন করতে। সারা রাত এই অনুষ্ঠান হয় ফ্লাড লাইট জ্বালিয়ে। সারা রাত ওড়িশি, কুচিপুড়ি, কথাকলি, ভারতনাট্যম, মোহিনী আট্যম, কত্থক, মনিপুরী, ইত্যাদি প্রায় প্রত্যেক প্রদেশের নৃত্য প্রদর্শিত হয়। এখানে প্রসিদ্ধ নৃত্য শিল্পী বিরজু মহারাজ, কেলু চরণ মহাপাত্র, সোনাল মান সিংহ, সুধা চন্দ্রন, পদ্মা সুভ্র্যমন্যম, হেমা মালিনী, মল্লিকা সারাভাই, প্রমুখ নৃত্য জগতের প্রসিদ্ধ শিল্পীরা তাঁদের নৃত্যকলা প্রদর্শন করে দর্শককে মুগ্ধ করেন। এ ছাড়া বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পীরাও আসেন, যেমন পৃথিবী বিখ্যাত শরদ শিল্পী ওস্তাদ আমজাদ আলী খাঁ, বংশীবাদক পণ্ডিত হরি প্রসাদ চৌরসিয়া, তবলা শিল্পী ওস্তাদ জাকির হোসেন, সন্তুরশিল্পী পণ্ডিত শিব কুমার শর্মা প্রমুখ।
কি করে কোণার্ক যাবেনঃ-
বলা বাহুল্য ভবঘুরে বাঙালী পুরী-কোণার্ক না ঘুরেছে এরকম বোধ হয় কেউ নেই। পুরী এবং ভুবনেশ্বর থেকে বাস কোণার্ক যায়। এ ছাড়া মেরু ট্যাক্সি এবং অন্য ট্র্যাভেল এজেন্সি ট্যাক্সি ভাড়া দেন টুরিস্টদের। এখানে রাত্রে থাকার ব্যবস্থাও আছে। ভুবনেশ্বর থেকে ৫৮ কিলোমিটার এবং পুরী থেকে মাত্র ৩৬ কিলো মিটার যাত্রা করলেই কোণার্ক পৌঁছে যাবেন অনায়াসে। ভুবনেশ্বর থেকে ছয় লেনের সুন্দর রাস্তা পিপিলি বাইপাস দিয়ে যাওয়া যায়। প্রায় ১ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট লাগে প্রাইভেট কারে গেলে। এছাড়া অটো, ট্রেকার, টাটা এস আছে তবে ওগুলো সুবিধের নয়। কোণার্কের এস.টী.ডি কোড ০৬৭৫৮। এখানে থাকার জন্য প্রচুর হোটেল আছে। উড়িষ্যা রাজ্য সরকারে পরিচালনায় ও টি ডি সি র পান্থনিবাস। চন্দ্রভাগার কাছে ৩ স্টার “লোটাস হোটেল” খুব সুন্দর। ওখানে সুন্দর কটেজ আছে সমুদ্র সৈকতে। বোটিং এর সুবিধে আছে। আমরা ওখানে স্বপরিবারে এক দিন কাটিয়েছি।
0 comments: