3

প্রাচীন কথাঃ অমৃত অধিকারী

Posted in


প্রাচীন কথা 




কাব্যোত্তর – ২
অমৃত অধিকারী



সূর্য অস্তমিত। শিবিরের সর্বত্র অগ্নিমুখ উল্কা প্রজ্জ্বলিত। তাদের কম্পমান আলোকসম্পাতে ইতস্তত প্রক্ষিপ্ত ছায়াগুলি সঞ্চরণশীল অশরীরীর মতন প্রতিভাত হচ্ছে। রক্ষীরা যথাসম্ভব প্রচ্ছন্ন ভাবে অবস্থান করার চেষ্টা করছে। নিতান্ত প্রয়োজন না হলে কেউ পদক্ষেপ পর্যন্ত করছে না।

শিবির মধ্যস্থিত উন্মুক্ত ভূমিতে ঘনসন্নিবিষ্টাবস্থায় দণ্ডায়মান কয়েকজন পুরুষ। তাঁরা এখনও রণসজ্জা উন্মোচন করেননি। একটু নিকটবর্তী হলে এখনও তাঁদের দীর্ঘশ্বাস শোনা যাচ্ছে। তাঁদের মধ্যে যিনি সর্বাপেক্ষা বৃহদাকায়, সেই শালপ্রাংশু পুরুষ নিজের সুবিশাল দক্ষিণ বাহুদ্বারা আরেক মহাকায় পুরুষের স্কন্ধবেষ্টন করে আছেন। বাকিরাও অবনত মস্তক। যে ক্ষতি তাঁদের আজ যুদ্ধক্ষেত্রে হয়ে গেছে, তা অপূরণীয় তো বটেই, প্রায় অভাবনীয়।

সৌভদ্র অভিমন্যু আজ দ্রোণাচার্যের রণযজ্ঞের বলি হয়েছেন। দ্রোণবিন্যস্ত কৌরবসৈন্য ভেদ করে সেই বালকবীর একাকী প্রবেশ করেছিলেন চক্রব্যূহের জঠরে। নিষ্ক্রমণের কৌশল অবগত না থাকায় আর বাইরে আসতে পারেননি। তাঁর পৃষ্ঠরক্ষক ধৃষ্টদ্যূম্ন, সাত্যকি, ভীমসেনাদিকে আশ্চর্য একক পরাক্রমে আজ ব্যূহদ্বারে প্রতিহত করেছেন ধৃতরাষ্ট্রের জামাতা সিন্ধুসৌবীররাজ বার্দ্ধক্ষত্র জয়দ্রথ... আর ব্যূহের অভ্যন্তরে একাকী বালক অভিমন্যুকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছেন কৌরবপক্ষীয় সাত মহারথ, যাঁদের মধ্যে কর্ণ, দুর্যোধন, দুঃশাসনরা ছাড়াও ছিলেন দ্রোণাচার্য ও কৃপাচর্যের মতন গুরুস্থানীয়েরা!

ঘটনাটির বিষয়ে অর্জুন অবগত হয়েছেন যুদ্ধশেষে শিবিরে প্রত্যাগমন করার পর। তিনি আজ সমস্ত দিন সংশপ্তকদের সঙ্গে যুদ্ধে ব্যস্ত ছিলেন। বস্তুত, সেইটিই ছিলো চতুর দ্রোণাচার্যের পরিকল্পনা। অর্জুনকে অন্যত্র ব্যস্ত রেখে চক্রব্যূহের দুর্ভেদ্য আবেষ্টনীতে পাণ্ডবপক্ষের যথাসম্ভব ক্ষতিসাধন করা। সে কার্যে তিনি আজ সম্পূর্ণ সফল হয়েছেন। কুমার অভিমন্যুর অপ্রত্যাশিত মৃত্যুতে আজ পাণ্ডবশিবিরে যে হৃদয়বিদারক শোকের ছায়া ঘণীভূত হয়েছে, তা থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে আগামী কাল পূর্ণশক্তিতে যুদ্ধ করা কার্যত অসম্ভব মনে হচ্ছে। বিশেষ করে পাণ্ডবপক্ষের প্রধান যোদ্ধা অর্জুনের পক্ষে। তাঁর হৃদয়প্রতিম পুত্র, কৃষ্ণের প্রিয়তম ভাগিনেয় এভাবে মৃত্যুবরণ করলেন, এবং উভয়েই যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত থেকেও তাঁকে ন্যূনতম সাহায্যটিও করতে পারলেন না, এ পশ্চাত্তাপ অর্জুনকে কিছুতেই সুস্থির হতে দিচ্ছে না।

আপাতত তিনি ভীমসেনের স্কন্ধে মস্তকস্থাপন করে মূহ্যমান হয়ে আছেন। ভীমের সবল বাহু যদি তাঁর স্কন্ধ ধারণ করে না থাকতো, তবে সম্ভবত তিনি এতক্ষণে ভূমির উপর উপবিষ্ট হতেন। কিয়ৎকাল পূর্বে রণক্ষেত্র থেকে ফিরে তিনি যুধিষ্ঠিরের মুখে যুদ্ধের পূর্ণ বিবরণ শুনেছেন। শুনেছেন, জয়দ্রথের বিক্রমে আজ পাণ্ডবপক্ষের মহারথরা কেউ দ্রোণের চক্রব্যূহে প্রবেশ করে পারেননি। সেই জয়দ্রথ, বনবাসকালীন দ্রৌপদীকে হরণ করতে গিয়ে ভীমের হাতে যাঁর চূড়ান্ত হেনস্থা হয়েছিলো... এবং অর্জুন সেখানে উপস্থিত না থাকলে যিনি আজ আর যুদ্ধ করার জন্য জীবিত থাকতেন না! বারকয়েক ‘‘জয়দ্রথ... ওহ! জয়দ্রথ’’ ছাড়া অর্জুনের আর বিশেষ বাঙ্নিষ্পত্তি হয়নি।

সংবাদ পেয়ে কৃষ্ণও স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন। পাণ্ডবরা হস্তিনাপুরের কুখ্যাত দ্যূতক্রীড়ায় পরাজিত হয়ে বনগমন করার পর থেকে শিশু অভিমন্যু তাঁরই তত্ত্বাবধানে দ্বারকায় বড় হয়েছেন। প্রিয়সখা ও পরম আদরের ভগিনীর একমাত্র সন্তান সেই পুত্রপ্রতিম ভাগিনেয়ের মৃত্যুতে শোকটুকু প্রকাশ করারও সময় পাননি রণক্লান্ত বাসুদেব। অর্জুনকে খানিকটা প্রবোধ দিয়েই ছুটেছেন শিবিরাভ্যন্তরে। অভিমন্যুর কিশোরী স্ত্রী উত্তরার মানসিক অবস্থার কথা চিন্তা করে তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন। ব্যাকুল হয়েছেন ভগিনী সুভদ্রার শোকের কথা ভেবে... এবং সন্ত্রস্ত হয়েছেন সেই আলোকসামান্যা অথচ হতভাগিনী নারীর সন্তাপের কথা ভেবে, যাঁর স্নেহরসে তাঁর নিজের পঞ্চপুত্রের থেকেও বেশি সিক্ত ছিলেন কুমার অভিমন্যু। উত্তরা, সুভদ্রা এবং শেষ পর্যন্ত দ্রৌপদীকেও সান্ত্বনা দিয়েছেন মধুসূদন। তাঁদের বলেছেন চক্রব্যূহের অভ্যন্তরে একাকী অভিমন্যুর অলৌকিক পরাক্রমের কথা। বলেছেন, প্রত্যেক ক্ষত্রিয় যোদ্ধার যা পরম কাঙ্খিত, রণক্ষেত্রে অভিমন্যুর সেই বীরগতি লাভের কথা। কৃষ্ণের বাক্যে কিঞ্চিৎ শান্ত হয়েছেন তিন নারী। ঈষৎ প্রশমিত হয়েছে তাঁদের ক্রন্দনের বেগ। এবার কৃষ্ণকে অর্জুনের কাছে যেতে হবে।

বাইরে যুধিষ্ঠির, ভীম, সাত্যকি, নকুল, সহদেব, ধৃষ্টদ্যূম্নাদি যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন অর্জুনকে শান্ত করতে। পারছেন না। গাণ্ডীবধন্বা সব্যসাচী শোকের চাইতেও অনেক বেশি নিজের অসহায়তায় সন্তপ্ত, ক্রুদ্ধ। তাঁর উষ্ণ নিশ্বাসে পাণ্ডবশিবিরের বাতাস উত্তপ্ত হয়ে উঠছে...

ঠিক এই সময় শিবিরাভ্যন্তর থেকে নির্গত হয়ে আসলেন কৃষ্ণ। তাঁর মুখমণ্ডলে ক্ষত্রিয়ের প্রতিজ্ঞার কাঠিন্য, দুই চক্ষে যোগীর নির্লিপ্ততা। দৃঢ় পদক্ষেপে এসে তিনি দাঁড়ালেন অর্জুনের সম্মুখে। অর্জুন একবার শুধু অবরুদ্ধ কন্ঠে বললেন, ‘‘মাধব! এ কি হলো? আমরা দু’জনেই তো রণক্ষেত্রে উপস্থিত...’’

অর্জুনের বাক্য সম্পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই তাঁর স্কন্ধের উপর কৃষ্ণ তাঁর দক্ষিণ হস্তখানি স্থাপন করলেন। অত্যন্ত অর্থপূর্ণ স্বরে বললেন, ‘‘একবার এসো আমার সঙ্গে। প্রয়োজনীয় কথা আছে।’’

অর্জুনের সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত সকলে চমকিত হলেন। এই পরিস্থিতিতে সান্ত্বনার থেকেও প্রয়োজনীয় কি কথা থাকতে পারে? অন্য কেউ বললে হয়তো সে কথা বাতুলতা বলে গণ্য হতো। কিন্তু একথা স্বয়ং বাসুদেব বলছেন! তাঁর চাইতে বড় হিতাকাঙ্খী অন্তত অর্জুনের যে আর কেউ নেই, সে বিষয়ে দু’জনের শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে নিঃসন্দেহ।

তাই হতবাক, বিহ্বল অবস্থাতেও অর্জুন চললেন কৃষ্ণের সঙ্গে। বিস্ময়দৃষ্টিতে তাঁদের দিকে চেয়ে থাকা মানুষগুলির শ্রবণ পরিধির বাইরে গিয়ে কৃষ্ণ দাঁড়ালেন। অর্জুনও সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তাঁর মুখের দিকে। পূর্ণ দৃষ্টিতে প্রিয় বন্ধুর দিকে চেয়ে হ্রস্ব অথচ গভীর স্বরে বাসুদেব বললেন... ‘‘একটি প্রতিজ্ঞা করতে হবে।’’

অর্জুনের বাক্যস্ফূর্তি হচ্ছে না। তিনি বিস্ময়াভিভূত হয়ে চেয়ে আছেন কৃষ্ণের দিকে।

‘‘কৃষ্ণাকে চূড়ান্ত অপমান করা সত্ত্বেও শুধুমাত্র মহারাজ যুধিষ্ঠিরের নির্দেশে যার প্রাণ তুমি ভিক্ষা দিয়েছিলে, সেই মহাপাপী জয়দ্রথ আজ তোমার প্রিয়তম সন্তানের অসহায়, অকারণ মৃত্যুর প্রধান নিমিত্ত রূপে রণক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়েছে।’’

অর্জুন এখনও নির্বাক। তাঁর চক্ষে ধীরে ধীরে শোণিতসঞ্চার হচ্ছে...

‘‘প্রতিজ্ঞা করো, কাল সূর্যাস্তের পূর্বে তুমি পাপিষ্ঠ জয়দ্রথকে বধ করবে। যদি করতে না পারো, স্বয়ং অগ্নিপ্রবেশ করবে।’’

এই অকস্মাৎ প্রস্তাব, বাসুদেবের এই অমোঘ নির্দেশ মুহূর্তের জন্য অর্জুনকে পুত্রশোক বিস্মরণ করিয়ে দিলো। অবিশ্বাসপূর্ণ চক্ষে বিহ্বল কন্ঠে তিনি বললেন... ‘‘কিন্তু তা কি করে সম্ভব? দ্রোণ, অশ্বত্থামা, কর্ণ, শল্যরা তাকে যথাশক্তি রক্ষা করবেন...’’

‘‘নিজের অস্ত্র ক্ষমতার উপর আস্থা রাখো, ধনঞ্জয়’’... নিজের দক্ষিণ হস্ত পুনরায় অর্জুনের বাম স্কন্ধের উপর স্থাপন করে মন্দ্রকন্ঠে বললেন অচ্যূত... ‘‘বিশ্বাস রাখো আমার উপর। সোচ্চারে প্রতিজ্ঞা করো জয়দ্রথ বধের... যেন তার প্রতিধ্বনি বিপক্ষ শিবিরেও পৌঁছয়!’’

.................................................................................................................................


দুন্দুভি-দামামা-বিষাণ ধ্বনিত হচ্ছে। দু’পক্ষের সৈন্য সমাবিষ্ট। কৌরববাহিনী আজ দুর্ভেদ্য চক্রশকট ব্যূহে বিন্যস্ত। ব্যূহমুখে স্বয়ং দ্রোণাচর্য বিরাজমান। ব্যূহের আভ্যন্তরীণ পশ্চাদ্ভাগে পদ্ম নামক এক গর্ভব্যূহ। সে ব্যূহের রক্ষণভাগে কর্ণ, অশ্বত্থামা, শল্য, ভূরিশ্রবা, কৃপাচার্য প্রমুখ মহারথরা। তারও অভ্যন্তরে এক সূ্চীব্যূহ। সে ব্যূহের সম্মুখে সসৈন্য যাদববীর কৃতবর্মা, এবং তার জঠরে অগণিত সৈন্য পরিবেষ্টিত জয়দ্রথ।

চরমুখে অর্জুনের প্রতিজ্ঞার সংবাদ কৌরবশিবিরে পৌঁছেছিলো গত রাত্রেই, এবং সে সংবাদ শ্রবণমাত্র প্রাণভয়ে ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলেন জয়দ্রথ। কাম্যক বনে দ্রৌপদী হরণের প্রচেষ্টাকালীন ক্রোশাধিক দূরত্ব থেকে সব্যসাচীর বাণক্ষেপণে সারথি-অশ্ব সমেত তাঁর রথ বিনষ্ট হওয়ার স্মৃতি পুনর্জাগরিত হয়েছিলো তাঁর মনে। রণভূমি ত্যাগ করে পলায়ন করতে চেয়েছিলেন তিনি স্বরাজ্য সিন্ধুদেশে। দুর্যোধন ও দ্রোণাচার্যের অভয়বাণীতে কথঞ্চিৎ আশ্বস্ত হয়ে তিনি আজ যুদ্ধ করতে সম্মত হয়েছেন, এবং তাঁর প্রাণরক্ষায় সর্বশক্তি নিযুক্ত করতে যত্নবান হয়েছেন কৌরবপক্ষের সব মহারথী। বস্তুত, সবাই অত্যুৎসাহিত। কারণ, সূর্যাস্তের পূর্বে জয়দ্রথকে বধ করতে না পারলে অর্জুন অগ্নিপ্রবেশ করবেন, এবং অর্জুনের মৃত্যুর অর্থই যে পাণ্ডবপক্ষের তৎক্ষণাৎ পরাজয়, তাই নিয়ে কারও কোনও দ্বিমত নেই।

যুদ্ধারম্ভেই অর্জুনের রথ সবেগে ধাবিত হলো কৌরবব্যূহ অভিমুখে। দুঃশাসন ও আরেক ধার্তরাষ্ট্র দুর্মর্ষণ ব্যূহের অগ্রভাগে অর্জুনের গতিরোধ করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু অতি অল্প সময়ের মধ্যেই অর্জুনের শরধারায় বিপর্যস্ত হয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হলেন দ্রোণাচর্যের পশ্চাতে।

অর্জুন দ্রোণের সম্মুখীন হয়ে তাঁকে প্রণাম করলেন... ‘‘আচার্যদেব, আমার দুর্গতি বিষয়ে আপনি সম্যক অবগত, এবং তার জন্য কিঞ্চিৎ দায়ীও। আমার প্রতিজ্ঞার কথাও নিশ্চয়ই আপনার শ্রূতিগোচর হয়েছে। অনুরোধ করছি, আমার প্রতিজ্ঞারক্ষায় বাধা দেবেন না।’’

ইষদ্হাস্যে বৃদ্ধ অস্ত্রাচার্য বললেন... ‘‘আমিও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, পার্থ। কুরুরাজের স্বার্থরক্ষার প্রতিজ্ঞা। তাই আমাকে অতিক্রম না করে তুমি ব্যূহে প্রবেশ করতে পারবে না।’’

শুরু হলো গুরুশিষ্যের তুমুল যুদ্ধ। সমগ্র আর্যাবর্তের দুই শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধরের দ্বৈরথ। আপাতদৃষ্টিতে অসম... কারণ দ্রোণাচার্যের বয়স সাতাশি বছর, এবং অর্জুন সদ্য পঞ্চাশোর্ধ। কিন্ত সেই অসাম্যের পরিপূরক অর্জুনের প্রগাঢ় যত্ন আচার্যের শরীরে অস্ত্রাঘাত না করার। তাই দু’জনের শরজালে আকাশ আচ্ছন্ন হলেও কারও বিশেষ ক্ষতি হলো না। 

দু’পক্ষের সৈন্যরা এবং অন্যান্য নিকটবর্তী রথীরা অবাক বিস্ময়ে দেখতে লাগলেন দুই মহারথের অবিশ্বাস্য অস্ত্রক্ষমতা। অস্ত্রাভ্যাস ও প্রশিক্ষণ প্রদানেই দ্রোণাচার্যের অশীতিপর জীবন অতিবাহিত হয়েছে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ প্রকৃত অর্থে তাঁর প্রথম মহাযুদ্ধ। কিন্তু তাঁর ভয়ংকর পরাক্রমে সে কথা স্মরণে থাকে না কারও। অর্জুনের বিরামহীন বাণবর্ষণকে কি অসামান্য দক্ষতায় প্রতিহত করছেন বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ! তাঁর প্রত্যাক্রমণ প্রতিরোধ করতে সর্বোচ্চ পর্যায়ের কৌশল অবলম্বন করতে হচ্ছে অর্জুনকে। 

কিছুক্ষণ যুদ্ধ চলার পর কৃষ্ণ বুঝলেন, বৃথা কালক্ষেপ হচ্ছে। সুকৌশলে কপিধ্বজকে দ্রোণের ক্ষেপণপথ থেকে কিছু দূরে অপসারিত করে তিনি অর্জুনকে বললেন... ‘‘আচার্যের সঙ্গে যুদ্ধে অকারণ কালক্ষেপ কোরো না, পার্থ। তোমার প্রতিজ্ঞার কথা বিস্মৃত হয়ো না।’’

পরিস্থিতি স্মরণে এলো দ্বৈরথে সম্পূর্ণ নিয়োজিতচেতন একাগ্র অর্জুনের। তিনি বাণবর্ষণ করতে করতে কৃষ্ণকে নির্দেশ দিলেন আচার্যের রথকে প্রদক্ষিণ করার। তৎক্ষণাৎ অশ্বচতুষ্টয়কে সেই মর্মে পরিচালিত করলেন বাসুদেব।

বিস্মিত দ্রোণাচার্য দেখলেন, অর্জুন তাঁর সঙ্গে যুদ্ধ অসমাপ্ত রেখেই তাঁকে অতিক্রম করে ব্যূহাভ্যন্তরে প্রবেশ করছেন। তিনি উচ্চকন্ঠে বললেন... ‘‘একি, অর্জুন? তুমি তো শত্রুজয় না করে যুদ্ধে বিরত হও না! কোথায় যাচ্ছো তুমি?’’

দ্রোণাচার্যের রথচক্রের সমীপে দু’খানি নারাচ ভূমিতে প্রোথিত করে সব্যসাচী বললেন... ‘‘আপনি আমার শত্রু নন, গুরুদেব। আপনাকে জয় করি এমন আমার সাধ্য কোথায়? প্রণাম...’’

কপিধ্বজ বিদ্যুদ্বেগে ব্যূহে প্রবেশ করলো। দ্রোণ বুঝলেন, পশ্চাদ্ধাবন করে লাভ নেই। তাঁর রথ গতিতে অর্জুনের রথকে পরাস্ত করতে পারবে না। তিনি স্মিতহাস্যে সারথিকে আদেশ দিলেন পুনরায় ব্যূহমুখে রথস্থাপন করতে।

ব্যূহে প্রবেশ করে অর্জুনের রথ সবেগে ধাবিত হলো জয়দ্রথের উদ্দেশ্যে। সর্বাগ্রে তাঁর গতিরোধ করতে এলো শ্রুতায়ু, সুদক্ষিণ ও অচ্যূতায়ু নামক তিন রাজপুত্রের নেতৃত্বাধীন কম্বোজবাহিনী। অতি অল্প সময়ের মধ্যে গাণ্ডীবনির্গত অবিশ্রান্ত শরধারায় ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলেন তাঁরা। একে একে নিহত হলেন তিনজন। 

এঁদের সঙ্গে অর্জুনকে যুদ্ধরত দেখে বরুণপুত্র নামে খ্যাত দক্ষিণদেশীয় নরপতি শ্রুতায়ুধ অরক্ষিত কৃষ্ণের উদ্দেশ্যে একটি গদা নিক্ষেপ করলেন। সকলকে হতবাক করে দিয়ে কৃষ্ণ শরীরকে নমিত করে সেই গদার গতিপথ থেকে নিজেকে অপসারিত করলেন, এবং প্রায় অলৌকিক কৌশলে গদাটিকে ধারণ করলেন আপন হস্তে। তারপর কংসারির বিশাল বাহুর তাড়নায় সে গদা নিমেষমধ্যে প্রতিনিক্ষিপ্ত হলো শ্রুতায়ুধের উদ্দেশ্যে। বিভীষিকাগ্রস্ত কৌরববাহিনী দেখলো, শ্রুতায়ুধের নিজের গদা তাঁরই মস্তক চূর্ণ করে সশব্দে ভূমিতে পতিত হলো!

অর্জুনের রথ দুর্নিবার গতিতে অগ্রসর হলো সূচীব্যূহের মধ্যস্থিত জয়দ্রথের অভিমুখে। ম্লেচ্ছ ও যবন জাতীয় সৈন্যেরা বাধা দিতে এসে ধ্বংস হলো অগণিত সংখ্যায়। দুর্যোধন প্রমাদ গণলেন! সবেগে দ্রোণের সমীপে উপস্থিত হলেন তিনি। ত্রস্তস্বরে বললেন... ‘‘গুরুদেব, অর্জুন কি করে আপনাকে অতিক্রম করলেন? আপনি স্বয়ং তাঁকে অব্যহতি না দিলে তিনি কিছুতেই যেতে সক্ষম হতেন না! আপনারই আশ্বাসবাণীর উপর আস্থা রেখে আমি জয়দ্রথকে রণক্ষেত্র ত্যাগ করা থেকে নিবৃত্ত করেছিলাম। এখন মনে হচ্ছে, তাঁকে যেতে দেওয়াই উচিত কার্য হতো। আপনি আমাদের পক্ষে যুদ্ধ করেও বস্তুত পাণ্ডবদেরই হিত সাধনে রত! এ তো বিশ্বাসঘাতেরই...’’

দুর্যোধন স্তব্ধ হলেন। দ্রোণাচার্যের কপালে গভীর ভ্রূকুটি দেখা দিয়েছে। বিপর্যস্ত দুর্যোধন অনুধাবন করলেন, এ বিপন্ন কালে আচার্য যুদ্ধে পরাঙ্মুখ হলে সমূহ বিপদ। তিনি করুণ মুখে সত্বর বললেন... ‘‘আমায় ক্ষমা করুন, আচার্যদেব! আমি আর্ত হয়ে প্রলাপ বকছি! দয়া করে ক্রুদ্ধ হবেন না। জয়দ্রথ বিপন্ন। সে আপনার শরণাগত। তাকে রক্ষা করুন।’’

ইষৎ বিলম্বে ক্ষুণ্ণ স্বরে দ্রোণাচার্য বললেন... ‘‘তুমি আমাকে বড় অপমান করো, রাজা। বোঝো না, আমার বয়স হয়েছে। অর্জুন ত্রিভুবনের শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর। কৃষ্ণও সারথিশ্রেষ্ঠ। অত্যল্প পরিসর দিয়ে তিনি রথ সঞ্চালন করতে পারেন। অর্জুনের রথাশ্বগুলিও অত্যুৎকৃষ্ট। কপিধ্বজের পশ্চাদ্ধাবন করতে পারে এমন রথ সমগ্র কুরুক্ষেত্রে আর কোথায়?’’

দুর্যোধনের অসহায়াবস্থা দেখে দ্রোণাচার্য বললেন... ‘‘ভয় পেও না, ভারত। তুমিও বীর, কৃতি। এ শত্রুতা তোমারই শত্রুতা। এ যুদ্ধও তোমার যুদ্ধ। যাও, বীরের মতন যুদ্ধ করো অর্জুনের সঙ্গে।’’

বিস্মিত, বিপর্যস্ত দুর্যোধন বললেন... ‘‘অর্জুনের গতি আপনি রোধ করতে পারলেন না! আমি কি করে তার সঙ্গে যুদ্ধ করবো?’’

মৃদুহাস্যে দ্রোণ বললেন... ‘‘মাভৈঃ! আমি তোমার শরীরে অভেদ্য দৈব কবচ বন্ধন করে দিচ্ছি। ইন্দ্রদত্ত এ কবচ আমি লাভ করেছিলাম আমার গুরু ঋষি অগ্নিবেশের কাছ থেকে। এ কবচ ভেদ করার শক্তি অর্জুন কেন, স্বয়ং মহাদেবেরও নেই। এসো।’’

দ্রোণ বহু মন্ত্রোচ্চারণ করে দুর্যোধনের দেহে কবচবন্ধন করলেন। তারপর তাঁকে আশীর্বাদ করে প্রেরণ করলেন অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে। বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের সূক্ষ্ম কৌতুকটুকু না বুঝে অতিদর্পী দুর্যোধন নবোৎসাহে চললেন অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে।

ততক্ষণে মধ্যাহ্ন অতিক্রান্তপ্রায়। অর্জুনের রথ তখনও জয়দ্রথের উদ্দেশ্যে ধাবমান। অবন্তীদেশীয় দুই রাজা বিন্দ ও অনুবিন্দ এলেন তাঁকে বাধা দিতে এবং নিহত হলেন তাঁর শরাঘাতে। ক্লান্ত, আহত অশ্বগুলিকে কিঞ্চিৎ পরিচর্যা করে কৃষ্ণার্জুন পুনরায় ধাবিত হলেন জয়দ্রথের উদ্দেশ্যে।

এই সময়ে দুর্যোধন এসে উপস্থিত হলেন অর্জুনের সামনে। অর্জুন বৃষ্টিধারার মতন বাণবর্ষণ করতে লাগলেন তাঁর উপর। কিন্তু দ্রোণের কবচ সে সব বাণকে বিফল করে দিলো। কৃষ্ণ বিস্মিত হলেন। বিষয়টি অনুধাবন করে অর্জুন ইষদ্হাস্যে বললেন... ‘‘আচার্যদেবের ওই কবচবন্ধন কৌশল আমি সম্পূ্র্ণ অবগত। দুর্যোধন যতই ওই কবচের আড়ালে লুকিয়ে থাকুন, আজ ওঁর নিস্তার নেই!’’

অতঃপর অর্জুনের বাণে নিমেষমধ্যে দুর্যোধনের সারথি ও রথাশ্বগুলি নিহত হলো। চ্ছিন্ন হলো তাঁর ধনু ও হস্তাবরণ। কর্ণ, কৃপ, শল্য, ভূরিশ্রবা প্রভৃতি বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত দুর্যোধনের রক্ষার্থে এগিয়ে এলেন এবং সসৈন্য অর্জুনের রথকে বেষ্টন করলেন। তখন কৃষ্ণ পাঞ্চজন্য ধ্বনিত করে এবং অর্জুন গাণ্ডীবে বারবার টঙ্কার দিয়ে পাণ্ডবদের আহ্বান করলেন তাঁর সাহায্যার্থে।

সে ধ্বনির সঙ্গে কৌরবদের সিংহনাদ কর্ণগোচর হতে চিন্তিত যুধিষ্ঠির সাত্যকিকে অর্জুনের সাহায্যকল্পে প্রেরণ করলেন। সাত্যকির প্রবল পরাক্রমে কৌরবপক্ষের বহু সৈন্য নিপাতিত হলো। সাত্যকি সবেগে কৃষ্ণার্জুনের অভিমুখে চললেন। ইতোমধ্যে যুধিষ্ঠির ভীমকেও প্রেরণ করেছেন অর্জুনের সাহায্যে। ভীম গদাঘাতে সারথি ও অশ্ব সমেত দ্রোণের রথ বিনষ্ট করে সবেগে ব্যূহাভ্যন্তরে প্রবেশ করলেন।

দুর্যোধনের একত্রিশজন ভ্রাতাকে একাদিক্রমে হত্যা করে ভীম কর্ণের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হলেন। কর্ণের প্রবল আক্রমণে ভীমের সারথি, অশ্ব ও রথ ধ্বংস হলো। ভীম খড়্গ ও চর্ম নিয়ে কর্ণকে আক্রমণ করলেন। কর্ণের বাণে সেগুলিও বিনষ্ট হলো। নিরস্ত্র ভীম হস্তিযূথের মৃতদেহ ও ভগ্ন রথের আড়ালে আশ্রয় নিয়ে হস্তীর দেহাংশ, রথচক্র, ইত্যাদি নিক্ষেপ করে আত্মরক্ষা করতে লাগলেন। এক সময়ে কর্ণের শরাঘাতে তিনি মূর্ছিতপ্রায় হলেন। কর্ণ তখন কুন্তীকে দত্ত বাক্যের কথা স্মরণ করে ভীমকে অব্যহতি দিলেন ও ভর্ৎসনা করে তাঁকে বললেন রণক্ষেত্র ত্যাগ করে বনগমন করতে।

ভীমকে দুর্গত দেখে অর্জুন কর্ণের উপর বাণবর্ষণ করতে লাগলেন। আহত, পরিশ্রান্ত কর্ণ তখন ভীমকে ছেড়ে দুর্যোধনাদির দিকে অগ্রসর হলেন। সাত্যকি এসে ভীমকে নিজের রথে আরোহণ করিয়ে নিরাপদ দূরত্বে নিয়ে গেলেন।

এই সময়ে সোমদত্ততনয় মহাবীর ভূরিশ্রবা এসে সাত্যকিকে আক্রমণ করলেন। দু’জনের ঘোর যুদ্ধ হলো কিছুক্ষণ। তারপর ভূরিশ্রবার অস্ত্রাঘাতে সাত্যকি মূর্ছিত ও নিপাতিত হলেন। ভূরিশ্রবা তখন খড়্গহস্তে রথ থেকে অবতরণ করে এসে সাত্যকিকে পদাঘাত করলেন এবং মুণ্ডচ্ছেদনের অভিপ্রায়ে তাঁর কেশ ধারণ করলেন।

সাত্যকি-ভূরিশ্রবার যুদ্ধ কৃষ্ণার্জুন দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করছিলেন। সাত্যকির মহাবিপদ দেখে কৃষ্ণ অর্জুনকে নির্দেশ দিলেন তাঁকে পরিত্রাণ করার। অর্জুন তখন ভূরিশ্রবার খড়্গধৃত দক্ষিণহস্তটি এক তীক্ষ্ণাগ্র অর্ধচন্দ্র বাণে চ্ছেদন করলেন।

বিস্মিত, ব্যথিত ভূরিশ্রবা অর্জুন ও কৃষ্ণকে এই অবীরোচিত কাজের জন্য কঠোর ভাষায় ভর্ৎসনা করলেন এবং নিজের বামহস্ত দ্বারা কর্তিত দক্ষিণহস্তটি তাঁদের দিকে নিক্ষেপ করে যোগাবলম্বন করলেন। ইত্যবসরে সাত্যকি সংজ্ঞা ফিরে পেয়ে উঠে কৃষ্ণার্জুনসহ সকলের নিষেধ অগ্রাহ্য করে যোগযুক্ত ভূরিশ্রবার মুণ্ডচ্ছেদ করলেন।

সূর্য তখন অস্তাচলগামী। কুরুসৈন্য আলোড়ন করতে করতে অর্জুনের রথ চলেছে জয়দ্রথের অভিমুখে। ভীমসেন ও সাত্যকি তাঁর পৃষ্ঠরক্ষা করছেন। দুর্যোধন বুঝলেন, যুদ্ধজয়ের সুবর্ণসুযোগ তাঁর সামনে উপস্থিত। সূর্যাস্ত অবধি অর্জুনকে শুধু নিবারণ করে রাখতে হবে জয়দ্রথবধ থেকে। তাহলেই প্রতিজ্ঞাবশত অর্জুনকে অগ্নিপ্রবেশ করতে হবে, এবং তাঁর মৃত্যু হলে পাণ্ডবরা অবিলম্বে আত্মসমর্পণ করবেন। তিনি কর্ণ, দুঃশাসন, কৃপ, শল্য, অশ্বত্থামাদের সে কথা বললেন, এবং সকলে একযোগে আর্জুনকে আক্রমণ করলেন।

কিন্তু অর্জুনের অবিশ্রান্ত বাণবর্ষণের সম্মুখে কেউই খুব বেশিক্ষণ থাকতে পারলেন না। বার বার পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে অবশেষে সকলে মিলে গিয়ে জয়দ্রথকে চারপাশ থেকে বেষ্টন করলেন। জয়দ্রথও বিপদ বুঝে এঁদের অবরোধের অন্তরালে নিজের রথের অভ্যন্তরে আত্মগোপন করলেন। অর্জুনের বাণে তাঁর সারথির মুণ্ড ও রথের ধ্বজ ভূপাতিত হলো। কিন্তু তা সত্ত্বেও ছয় মহারথের আবেষ্টনীতে রক্ষিত জয়দ্রথকে প্রহার করা অর্জুনের পক্ষে অসম্ভব প্রতিভাত হলো। 

এই সময় কৃষ্ণ পশ্চিমাকাশে অস্তমান সূর্যের দিকে দৃষ্টিপাত করলেন। তাঁর ওষ্ঠে মৃদু হাস্যাভাস হলো। তিনি অর্জুনকে বললেন... ‘‘পার্থ, দেখো, সূর্যের উপর ছায়া ঘণায়মান। আর কিছু মুহূর্তের মধ্যে দিবাকর আচ্ছ্বাদিত হবেন। সকলে ভাববে, সূর্যাস্ত হয়েছে। জয়দ্রথও আর আত্মগোপন করা প্রয়োজন মনে করবেন না। এই সুযোগ! অভিনিবেশ করো।’’

অর্জুনও মুখ তুলে সূর্যের দিকে তাকালেন। অস্তরবির উপর রাহুর ধূসর ছায়া ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হচ্ছে। কেশব গতরাত্রে তাঁকে সঙ্গোপনে বলেছিলেন আজকের সূর্যগ্রহণের কথা। প্রতিজ্ঞা উচ্চারণ সোচ্চার ছিলো, যাতে চরমুখে সে সংবাদ বিপক্ষশিবিরে পৌঁছয়, এবং কৌরবরা উল্লসিত হন কোনওক্রমে সূর্যাস্ত পর্যন্ত জয়দ্রথকে রক্ষা করতে পারলেই অর্জুনের আত্মহত্যার আশায়। গ্রহণতিথি স্মরণ রাখার মতন একমাত্র যে মানুষটি কৌরবপক্ষে ছিলেন, তিনি এখন শরশয্যায় শয়ান। বাসুদেব নিশ্চিত ছিলেন, সায়াহ্নের ঠিক পূর্বে রাহুর পূর্ণগ্রাস সবার মনে সূর্যাস্তের বিভ্রম জাগাবে।

হলোও তাই। সহসা সূর্যগ্রহণ হয়ে চতুর্দিক অন্ধকারাচ্ছ্বন্ন হলো। কৌরবপক্ষীয়রা মনে করলেন, সূর্যাস্ত হয়েছে। তাঁরা প্রবল হর্ষধ্বনি করে উঠলেন। জয়দ্রথও ভাবলেন, তাঁর বিপদ অপসারিত। তিনি মস্তক উত্থিত করে সূর্যকে দেখতে গেলেন।

ঠিক এই সময় অর্জুন আরম্ভ করলেন প্রবল বাণবর্ষণ। ধূলা ও অন্ধকারে চারিদিক সমাচ্ছ্বন্ন হওয়ায় সৈন্যরা দৃষ্টিরহিত হয়ে অর্জুনের বাণাঘাতে আকুল হয়ে উঠলো। দুর্যোধন, কর্ণ, কৃপ, শল্যরাও সেই আকস্মিক আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়লেন। সেই সুযোগে তাঁদের রথগুলিকে অতিক্রম করে কপিধ্বজ বিদ্যুদ্গতিতে জয়দ্রথের সমীপে উপস্থিত হলো। জয়দ্রথ সভয়ে দেখলেন, অর্জুন গাণ্ডীবে এক ভয়ালদর্শন বাণ যোজনা করেছেন। কন্ঠ থেকে আর্তনাদ নির্গত হওয়ার পূর্বেই তাঁর মস্তক স্কন্ধচ্যূত হয়ে তাঁর বিখ্যাত পিতা রাজর্ষি বৃদ্ধক্ষত্র প্রদত্ত মন্ত্রপূতঃ বরাহধ্বজ রথের আসনের উপর পতিত হলো। পরমুহূ্র্তে ক্রুদ্ধ অর্জুনের বজ্রবাণে সে রথ শতধা বিদীর্ণ হলো, এবং তার ভগ্নাংশগুলি ছড়িয়ে পড়লো চতুর্দিকে।

কৌরবপক্ষীয় যোদ্ধারা মহাবিস্ময়ে দেখলেন, আকাশের অন্ধকার দূরীভূত হয়েছে! অস্তগামী সূর্যের অর্ধাংশ এখনও দিকচক্রবালের উপর দৃশ্যমান। কৃষ্ণের পাঞ্চজন্য, অর্জুনের দেবদত্ত, ভীমের পৌন্ড্র এবং সাত্যকির শঙ্খ একসঙ্গে ধ্বনিত হলো। যুদ্ধক্ষেত্রের অপর প্রান্তে যুধিষ্ঠির সে ধ্বনি শ্রবণে নিশ্চিন্ত হলেন।



3 comments:

  1. মনোজ্ঞ উপস্থাপনা। প্রাচীন কথা বিভাগটির শ্রী-বৃদ্ধি দেখে ভালো লাগলো !!

    ReplyDelete
  2. মনোজ্ঞ উপস্থাপনা। প্রাচীন কথা বিভাগটির শ্রী-বৃদ্ধি দেখে ভালো লাগলো !!

    ReplyDelete