3

ছো্টগল্পঃ সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in

ছোটগল্প



বিবর্তন
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়



প্রাসাদশীর্ষে দাঁড়িয়ে অদূরে অশান্ত সমুদ্রের উত্তুঙ্গ তরঙ্গমালার দিকে তাকিয়ে ছিলেন মহাপ্রশাসক মাহাদেনকার্ষপ। অস্তগামী সূর্যের লোহিতাভা দিকচক্রবালের কাছে সমুদ্রের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছিলো। রক্তাক্ত করে তুলছিলো জলকে।

মাহাদেনকার্ষপের মুখ চিন্তাক্লিষ্ট। তাঁর ডানপাশে দাঁড়িয়ে প্রধান সচিব বারুন্দরেখ। তাঁরও কপালে গভীর ভ্রুকূটি। সমুদ্রের জল বাড়ছে। কথাটা এক বছর আগে প্রথম প্রশাসন পরিষদে বলেছিলেন অর্ণবাচার্য আন্তরীশ। তাঁর সংস্থার পর্যবেক্ষণে ধরা পড়েছিলো, উত্তরদিক থেকে জল ঢুকছে অতলান্ত সাগরে। হিমশীতল জল। মৎস্যজীবীদের সাক্ষ্যেও সে দাবি সত্য প্রতিপন্ন হয়েছিলো। সামুদ্রিক প্রাণীরা বিপুল সংখ্যায় প্রাণ হারাচ্ছে প্রতিদিন। হু হু করে কমে যাচ্ছে জলের তাপমাত্রা। বাড়ছে জল।

প্রশাসন পরিষদে দীর্ঘ, বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে এই বিষয়ে দিনের পর দিন। বৈজ্ঞানিকদের সঙ্গে প্রহরের পর প্রহর কাটিয়েছেন মাহাদেনকার্ষপ, বারুন্দরেখ সহ সব সচিব ও উপদেষ্টা। প্রাথমিক পর্যায়ে বিশ্লেষণ করে দেখা হয়েছে, এ জল কোথা থেকে এবং কেন আসছে। আন্তরীশ ও তাঁর অধীনস্থ গবেষকের দলের পর্যবেক্ষণ বলেছে, অতলান্ত সাগরের সুদূর উত্তরে যে চির তুষারাচ্ছ্বাদিত দেশ, কোনও কারণে সেখানকার তুষার গলতে আরম্ভ করেছে। সেই তুষার-গলা জল এসে মিশছে সমুদ্রে। তাই অতলান্ত সাগরের জল বাড়ছে, এবং যত দিন যাবে, এই বাড়ার গতি আরও বৃদ্ধি পাবে।

দ্বিতীয় পর্যায়ে শুরু হয়েছে এর প্রতিকার বিষয়ে আলোচনা। সেই সব আলোচনায় কিরামিশ, মার্হবিনকদের মতন কারিগরি প্রযুক্তিবিদদের সঙ্গে সঙ্গে যোগদান করেছেন অহমির্ষন, ক্রম্বুদ, প্রমকির্ণাদের মতন কবি, শিল্পীরাও। মাহাদেনকার্ষপের ব্যক্তিগত আমন্ত্রণে এসেছেন শিল্পমন্দিরের অধ্যক্ষা দ্বীপরাষ্ট্রের শিল্পীশ্রেষ্ঠা বিন্দমীণা। দ্বীপবাসীরা সবাই জানে মাহাদেনকার্ষপ ও বিন্দমীণার ঘনিষ্ঠতার কথা। প্রজ্ঞানিকেতনে সহপাঠী ছিলেন দু’জন। প্রাশাসনিক বিষয়ে মাঝে মাঝেই বিন্দমীণার পরামর্শ গ্রহণ করেন মাহাদেনকার্ষপ।

দ্বীপরাষ্ট্রের সব চিন্তাবিদ সম্মিলিত হয়ে উপলব্ধি করেছেন, স্থানান্তরন ছাড়া আর কোনও উপায় নেই এই বিপর্যয় থেকে দ্বীপবাসী ও তাদের সম্পত্তি-সংস্থান রক্ষা করার। স্থানান্তরন, অর্থাৎ অন্য ভূখণ্ডের উদ্দেশ্যে সমুদ্রযাত্রা। দ্বীপরাষ্ট্রের বিপুল জনসংখ্যাকে নিয়ে একসঙ্গে এক জায়গায় গিয়ে উপস্থিত হওয়া যাবে না। তাতে সেখানকার প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হবে। তাই পৃথক ভাগে যেতে হবে একাধিক দিকে। উপনিবেশ স্থাপন করতে হবে বিভিন্ন ভূখণ্ডে। 

অতলান্তের পূর্ব উপকূলে যে বর্বর শ্বেতাঙ্গ জাতি অধ্যুষিত দেশ, সেখানে যাবে একটি নৌবহর। সে দেশের দক্ষিণে যে অরণ্যসঙ্কুল বিশাল ভূখণ্ড, যেখানে প্রাচীন কৃষ্ণাঙ্গ জনজাতিদের বাস, সেখানে যাবে এক দল অর্ণবপোত। সেই ভূখণ্ডের দক্ষিণ উপকূল পরিক্রমণ করে আরও সুদূর পুবে যাবে আরেক বাহিনী জলযান। অতলান্তের পশ্চিমদিকে যাত্রা করবে আরও দু’টি দল। উত্তরের জনবিরল হিমের দেশে যাবে একাংশ, আর দক্ষিণের শ্যামল উপকূলে উপনীত হবে শেষ দলটি। এই পাঁচ ভাগে সমুদ্রযাত্রার জন্য প্রয়োজন হবে পাঁচ হাজার বৃহৎ ও শক্তিশালী জলযানের। আন্তরীশ ও যানপ্রযুক্তির বিশেষজ্ঞ মার্হবিনকের তত্ত্বাবধানে আরম্ভ হয়ে গেছে জলযান নির্মাণকার্য। সমুদ্রবিজ্ঞানীদের গণনা বলছে, দ্বীপরাষ্ট্র সম্পূর্ণ জলমগ্ন হতে আরও বৎসরাধিক কাল লাগবে। তার আগেই নির্মাণকার্য নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়ে যাবে।

দ্বীপবাসীদের সব কথা জানানো হয়েছে। তাদের ইচ্ছা, সক্ষমতা ও সংস্থানের উপর ভিত্তি করে কে কোন দলে যাবে, সেই সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়ে গেছে। সবাইকে সেই অনুযায়ী প্রস্তুত হতে বলা হয়েছে। সঞ্চয় করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে খাদ্যশস্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য। বর্জন করতে বলা হয়েছে অপ্রয়োজনীয় তৈজস, পোষাক, ইত্যাদি।

দ্বীপবাসীদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে। বয়োঃবৃদ্ধের দল স্বভাবতই বিচলিত, উৎকন্ঠিত। অল্পবয়স্করা উত্তেজিত। কিন্তু ভবিতব্যতা মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। পাঁচ হাজার বছরের উপনিবেশ ছেড়ে আবার বেরিয়ে পড়ার সময় এসেছে। সেই মতন প্রস্তুতি নিচ্ছে সবাই।

শুধু বিন্দমীণার চোখে একটু সংশয়, একটু অনিশ্চয়তা দেখেছেন মাহাদেনকার্ষপ। স্থানান্তরন যে অবশ্যম্ভাবী, তাই নিয়ে শিল্পীশ্রেষ্ঠারও কোনও দ্বিমত নেই। কিন্তু জলযান নির্মাণ সংক্রান্ত আলোচনা গুলিতে বিন্দমীণা একটু যেন অন্যমনস্ক, একটু অনবহিত ছিলেন। মাহাদেনকার্ষপ পরে একান্তে জিজ্ঞেসও করেছিলেন তাঁকে। বিন্দমীণা উত্তর দেননি। শুধু বলেছেন, ‘‘আরেকটু চিন্তা করতে দাও।’’ একটু থেমে বলেছেন, ‘‘ধ্যানমন্দিরে যাওয়া প্রয়োজন।’’

তারপর থেকে আলোচনা সভাগুলিতে আর আসেননি বিন্দমীণা। মাহাদেনকার্ষপও ভেবেছেন ধ্যানমন্দিরে যাওয়ার কথা। ব্যবস্থাপনার ব্যস্ততায় সময় হয়ে ওঠেনি। গতকাল যান নির্মাণ পরিদর্শন করে এসে কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়েছেন মহাপ্রশাসক। আজ প্রাসাদশীর্ষে দাঁড়িয়ে অপরাহ্নবেলার সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে তাঁর স্মরণে এসেছে বিন্দমীণার কথা, ধ্যানমন্দিরে যাওয়ার কথা।

‘‘শিল্পীশ্রেষ্ঠার সংবাদ কি? অনেকদিন আসেন না তিনি...’’ অন্যমনস্ক ভাবে জিজ্ঞেস করেছেন বারুন্দরেখকে।

‘‘সংবাদ পেয়েছি, তিনি আজকাল অধিকাংশ সময় ধ্যানমন্দিরে অতিবাহিত করছেন।’’ বলেছেন প্রধান সচিব। প্রজ্ঞানিকেতনে ইনিও সহপাঠী ছিলেন মাহাদেনকার্ষপ, বিন্দমীণার।

‘‘হুঁ। আমাকেও যেতে হবে ওখানে।’’




মোমবাতিগুলি নিবাত নিষ্কম্প হয়ে জ্বলছে দীর্ঘ অলিন্দের দু’ধারে। অলিন্দপথে একা হেঁটে যাচ্ছেন মাহাদেনকার্ষপ। 

পাঁচ হাজার বছরের পুরনোধ্যানমন্দির। বহুবার সংস্কার হয়েছে, ভিতরে, বাইরে। আদতে কি উপাদান ব্যবহৃত হয়েছিলো এই বিশাল মৎস্যাকৃতি স্থাপত্যটি নির্মাণ করার জন্য, এখন আর বোঝা যায় না। সারা গায়ে সূক্ষাতিসূক্ষ, জটিল কারুকার্য নিয়ে দ্বীপরাষ্ট্রের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছে সুবিশাল ধ্যানমন্দির। মৎস্যের মুখবিবর এর প্রবেশদ্বার। প্রবেশদ্বারের সামনে দাঁড়ালে দোখা যায়, উপরে মাছের কপাল জুড়ে স্ফটিক জাতীয় কোনও বস্তু নির্মিত একটি অচ্ছাভ আবরণ। তার পিছনে কি আছে, বাইরে থেকে বোঝা যায় না। ঢুকে দু’পাশে দু’ধাপ সিঁড়ি উঠে গেছে উপরে, আর সমুখে দীর্ঘ অলিন্দ চলে গেছে মাছের উদর অভিমুখে। অলিন্দের দু’পাশে সারি সারি প্রকোষ্ঠ। পাঁচ হাজার বছর আগে এগুলি অভিযাত্রীদের থাকার ঘর ছিলো...

অলিন্দ পার হয়ে মাহাদেনকার্ষপ উপস্থিত হলেন এক সুবিশাল গর্ভগৃহে। হঠাৎ দেখলে মনে হয় কোনও অতিবৃহৎ প্রেক্ষাগৃহ। কক্ষের অপরপ্রান্তে যে বিস্তৃত বেদী, তার উপর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে পাঁচটি বিশালকায় মূর্তি। ভাস্কর্যের উপাদান বোঝা যায় না। ধাতু ও প্রস্তরের মধ্যবর্তী কোনও বস্তু। তিনজন পুরুষ ও দু’জন নারী। ধ্যানগম্ভীর প্রশান্ত মূর্তি। দ্বীপরাষ্ট্রের পাঁচ প্রতিষ্ঠাতা...

বেদী থেকে কিছু দূরে ভূমির উপর উপবিষ্টা বিন্দমীণা। মাহাদেনকার্ষপ নিঃশব্দ পদক্ষেপে গিয়ে দাঁড়ালেন তাঁর পাশে। দেখলেন বিন্দমীণাকে। গভীর ধ্যানমগ্না। সম্পূর্ণ আত্মস্থা। এই নারীকে বিগত বহু বছর যাবত দেখছেন মাহাদেনকার্ষপ। তবু আজও পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারেননি। শান্ত, সমাহিত চরিত্রের এই নারী যেন কোনও সুদূর লোকের বাসিন্দা... 

প্রজ্ঞানিকেতনের দুই শ্রেষ্ঠ ছাত্রছাত্রী ছিলেন মাহাদেনকার্ষপ ও বিন্দমীণা। বস্তুত, বিন্দমীণা অধিক মেধাবিনী ছিলেন। কিন্তু শিক্ষান্তে যখন তাঁকে প্রশাসন সচিবের পদ গ্রহণ করার প্রস্তাব দেওয়া হলো, তিনি স্বভাবজ নম্রতার সঙ্গে সে পদ প্রত্যাখ্যান করে গ্রহণ করলেন শিল্পমন্দিরের সহাধ্যক্ষার পদ।

তারপর বহু বছর অতিবাহিত হয়েছে। বিন্দমীণা এখন শিল্পমন্দিরের অধ্যক্ষা, এবং সেদিনের সহকারী প্রশাসন সচিব মাহাদেনকার্ষপ আজ মহাপ্রশাসক। দু’জনের বন্ধুত্ব আজও অটুট আছে। দু’জনের কেউই পরিবারবৃদ্ধির প্রচেষ্টা করেননি। একাগ্রভাবে অভিনিবিষ্ট হয়ে নিজেদের কর্তব্য সম্পাদন করে গেছেন। আজ, দ্বীপরাষ্ট্রের এই বিপর্যয়ের দিনে মাহাদেনকার্ষপের সব থেকে বেশি প্রয়োজন বিন্দমীণাকে, তাঁর অনন্ত প্রজ্ঞাকে।

বিন্দমীণার ধ্যানভঙ্গ হলো। চোখ খুলে দেখলেন, মহাপ্রশাসক তাঁর পাশে দণ্ডায়মান। উঠে দাঁড়িয়ে স্নিগ্ধ হেসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘এত চিন্তাক্লিষ্ট কেন, কার্ষপ? ব্যবস্থাপনা তো সুষ্ঠুভাবেই চলছে বলে জানি।’’

একটু বিলম্বে মাহাদেনকার্ষপ বললেন, ‘‘হ্যাঁ, ব্যবস্থায় ত্রুটি নেই। আশা করা যায় স্থানান্তরন নিরাপদে, নির্বিঘ্নেই হবে।’’

তাঁকে বেদীর দিকে তাকিয়ে চুপ করে থাকতে দেখে বিন্দমীণা আবার প্রশ্ন করলেন, ‘‘তাহলে তুমি এত চিন্তান্বিত কেন?’’

মাহাদেনকার্ষপের মুখে একটি বিষন্ন হাসির উদ্ভাস হলো। তিনি বিন্দমীণার দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে চেয়ে বললেন, ‘‘আমি কেন চিন্তিত, সে কথা কি তুমি জানো না, মীণা?’’

বিন্দমীণাও হাসলেন। বললেন, ‘‘জানি। তাই তো ভাবছি। মনঃসংযোগ করার জন্য প্রতিদিন আসছি এখানে।’’

খানিকক্ষণ নীরবতার পর মাহাদেনকার্ষপ যেন আত্মগতভাবে বলতে আরম্ভ করলেন... ‘‘একদিন সময় আসবে, জানতাম। ছড়িয়ে পড়তে হবে, মিশে যেতে হবে মানুষের সঙ্গে। প্রতিষ্ঠাতাদের ভবিষ্যদ্বাণী সেইরকমই ছিলো। কিন্তু এভাবে, এত অপ্রস্তুতভাবে চলে যেতে হবে, ভাবিনি কখনও। এই পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ার পর, আবার নতুন করে শুরু করার পর আমরা আর কতদিন ধরে রাখতে পারবো আমাদের বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, দর্শন, শিল্প, ন্যায়, নীতির সুমহান ঐতিহ্য? আদৌ পারবো কি? কিছুই যে প্রস্তুতি নেওয়া হলো না!’’

‘‘পারবো না।’’ মাহাদেনকার্ষপ নীরব হবার কয়েক মুহূর্ত পরে ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন বিন্দমীণা। তারপর মহাপ্রশাসকের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘কিন্তু কি আসে যায়, যদি না-ই পারি তো?’’

বিস্মিত দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকালেন মাহাদেনকার্ষপ। ‘‘কিছু আসে যায় না? এতদিনের অর্জিত এই বিপুল জ্ঞানভাণ্ডার নষ্ট হয়ে গেলে আসে যায় না কিছু?’’

‘‘না।’’ আবার মাথা নাড়লেন বিন্দমীণা। ‘‘প্রতিষ্ঠাতারা আমাদের পূর্বভূমি থেকে যে অতুল প্রজ্ঞা নিয়ে এসেছিলেন, তার কতটুকুই বা আমরা ধরে রাখতে পেরেছি, কার্ষপ? এই যানের পরিচালনকৌশল অবধি আমরা সম্পূর্ণ বিস্মৃত। বিগত চার হাজার বছর ধরে আমরা একে শুধুমাত্র ধ্যানমন্দির রূপে ব্যবহার করছি। আমরা বিস্মৃত সেই অত্যাশ্চর্য বস্তুবিদ্যা, যার সাহায্যে নির্মিত হয়েছিলো এই যান, এর যন্ত্রাংশ, প্রতিষ্ঠাতাদের মূর্তিগুলি এবং আরও অনেক কিছু।’’

একটু থামলেন বিন্দমীণা। তারপর বললেন, ‘‘কেন আমরা সে সব বিদ্যা ভুলে গেছি জানো? কারণ এখানে সেগুলির আর প্রয়োজন হবে না কোনওদিন। আমাদের পূর্বভূমি বহু পূর্বেই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। এই যান আর কোনওদিন প্রত্যাবর্তন করবে না সেখানে। প্রয়োজন হবে না বস্তুসংশ্লেষের। কারণ, প্রযুক্তিবিদ্যাকে এগিযে নিয়ে যাওয়ার জন্য যে উপাদানরাজির প্রয়োজন, এই আশ্চর্য গ্রহে সেই সব উপাদানের প্রাচুর্য। কার্ষপ, এ আলোচনা আমরা আগেও করেছি। এই গ্রহ, এর সভ্যতাকে তার নিজস্ব গতিপথ ধরে অগ্রসর হতে হবে। আমাদের বিজ্ঞান, আমাদের প্রযুক্তি, আমাদের দর্শন এদের অতি দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাবে সভ্যতার পথে, সে কথা সত্য। কিন্তু তাতে এদের অবস্থা হবে শৈশব থেকে সোজা পূ্র্ণযৌবনে উপনীত হওয়ার মতন। সে যে সুস্থ অগ্রগতি নয়, তা নিয়ে তো আমাদের কোনওদিন কোনও দ্বন্দ্ব ছিলো না!’’

‘‘না, ছিলো না।’’ ধীরে ধীরে বললেন মাহাদেনকার্ষপ। ‘‘সেই কারণেই বিগত পাঁচ হাজার বছর আমরা সংযত থেকেছি, নিজেদের বিজ্ঞানকে সীমাবদ্ধ রেখেছি এই দ্বীপরাষ্ট্রের মধ্যে। কিন্তু মীণা, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির কথা যদি ছেড়েও দিই, এত হাজার বছর ধরে অর্জিত আমাদের এই সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির চেতনা, এ চেতনাও যে নষ্ট হয়ে যাবে!’’ মাহাদেনকার্ষপের কন্ঠে আর্তি... ‘‘সভ্যতার প্রাক কালে পূর্বভূমির রক্তাক্ত ইতিহাস কি তুমি ভুলে গেছো?’’

‘‘না কার্ষপ, আমি কিছুই ভুলিনি।’’ মাথা নাড়লেন বিন্দমীণা। ‘‘এই গ্রহ ও তার সভ্যতাকেও সেই সংঘাত, সেই রক্তাক্ত ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করতে হবে। সেটাই এর ভবিতব্য। আমাদের উত্তরপ্রজন্মেরা, যারা তাদের শোণিতস্রোতে এই সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির চেতনা বহন করবে, তারা হয়তো চেষ্টা করবে হিংসা, দ্বেষ রোধ করার। তারপর একদিন, হয়তো কয়েক হাজার বছর পরে, তাদের সে প্রচেষ্টা সফল হবে। এই গ্রহের মানবজাতি হিংসাপ্রবৃত্তি জয় করে অগ্রসর হবে আলোকপ্রাপ্তির পথে...’’

বিন্দমীণা থামলেন। কোন সুদূর ভবিষ্যতে তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ...। মাহাদেনকার্ষপ বেদনাতুর চোখে চেয়ে আছেন তাঁর দিকে। বিন্দমীণা তাকালেন তাঁর প্রিয় বন্ধুর দিকে। হাসলেন। বড় রহস্যময় সে হাসি। তারপর গভীর স্বরে বললেন, ‘‘জানো কার্ষপ, আমাদের পূর্বভূমিতে এই গ্রহের মতন এত প্রাণবৈচিত্র ছিলো না। সে গ্রহ এই পৃথিবীর তুলনায় আকারে ক্ষুদ্রকায় ছিলো। মাধ্যাকর্ষণের টান কম হবার কারণে সেখানকার প্রাণীরাও বৃহদাকায় ছিলো। যেমন ছিলেন প্রতিষ্ঠাতারা।’’ বিন্দমীণার দৃষ্টি বেদীর উপর মূর্তিগুলির দিকে নির্দেশ করলো। ‘‘এই সিক্ত, শ্যামল, বিশাল গ্রহ আমাদের পূর্বভূমির মতন নয়। এ গ্রহ প্রাণপ্রাচুর্যে পূর্ণ। সরল, নিষ্পাপ, আনন্দময় প্রাণ।’’

মাহাদেনকার্ষপ একাগ্রচক্ষে তাকিয়ে আছেন এই রহস্যময়ী নারীর দিকে। বোঝার চেষ্টা করছেন, বিন্দমীণা কি বলতে চাইছেন।

‘‘চিন্তাবিদদের এখানে ডাকো, কার্ষপ। দ্বীপরাষ্ট্রের সব শিল্পী, সব সাহিত্যিক, সব দার্শনিক, সব বিজ্ঞানীকে ডাকো। আমি জানি তুমি, তোমরা সবাই ব্যস্ত। তবু এ আলোচনা প্রয়োজনীয়, অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।’’


জল বাড়ছে হু হু করে। সগর্জনে, সরোষে সমুদ্র প্রবেশ করছে দ্বীপে। এক মাস আগে পাঁচ হাজার জলযান পাঁচ ভাগে বিভক্ত হয়ে নিরাপদে পাড়ি দিয়েছে নির্দিষ্ট গন্তব্য অভিমুখে। যাননি শুধু মাহাদেনকার্ষপ, বিন্দমীণা, আন্তরীশ, অহমির্ষন, প্রমকির্ণাদের সঙ্গে সঙ্গে দ্বীপরাষ্ট্রের ন্যূনাধিক দু’শোজন চিন্তাবিদ... কবি, শিল্পী, দার্শনিক, বিজ্ঞানী। এঁরা সকলে স্বেচ্ছায় থেকে গেছেন। ধ্যানমন্দিরের সমাবেশে আহুত দ্বীপরাষ্ট্রের সহস্রাধিক চিন্তাবিদকে বিন্দমীণা বলেছিলেন তাঁর ভাবনার কথা, সিদ্ধান্তের কথা। তাঁদের মধ্যে এই ক’জন সে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। প্রাণনাশের ঝুঁকি থেকেছে সে সিদ্ধান্তে। কিন্তু তার সাফল্যের সম্ভাবনায় বিশ্বাস করেছেন এঁরা। উদ্বেল হয়েছেন সে সাফল্যের পরবর্তীকালীন অনাবিল আনন্দের কথা ভেবে।

তাঁরা সবাই এখন ধ্যানমন্দিরের বিশাল গর্ভগৃহে সমাবিষ্ট। প্রায়ান্ধকার গর্ভগৃহের বেদীর সম্মুখস্থ ভূমির উপর বিশটি সারিতে উপবিষ্ট প্রত্যেকটি দেহের মেরুদণ্ড ঋজু। প্রত্যেকটি শরীর সম্পূর্ণ আবরণমুক্ত। প্রত্যেকে গভীর ধ্যানমগ্ন। 

এই ধ্যান আরম্ভ হয়েছে তিন দিন পূর্বে, দ্বীপে জল ঢুকতে আরম্ভ করেছে যেদিন থেকে। সকলে একযোগে প্রবেশ করেছেন ধ্যানমন্দিরে। উন্মুক্ত করে দিয়েছেন প্রতিটি দ্বার, প্রত্যেকটি গবাক্ষ। তারপর সমবেত হয়েছেন গর্ভগৃহে। এই মহাকাশযান একদিন বহুদূরস্থিত এক ধ্বংসোন্মুখ গ্রহ থেকে এঁদের পূর্বজদের নিয়ে এসে উপস্থিত হয়েছিলো এ গ্রহে, এই দ্বীপে। সেই পূর্বজরা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এই দ্বীপরাষ্ট্রের। তারপর অতিবাহিত হয়েছে পাঁচ হাজার বছর। আজ আবার সময় উপস্থিত স্থানান্তরনের।

গর্ভগৃহের অন্ধকারে কোনওকিছুই স্পষ্টত দৃশ্যমান নয়। তবু যেন মনে হয়, উপবিষ্ট শরীরগুলির মধ্যে কিসের এক স্পন্দন চলছে! কি যেন একটা পরিবর্তন ঘটছে তাদের...

বাইরে সর্বগ্রাসী অতলান্তের জল ঢুকে আসছে প্রচণ্ড বেগে। সে মহাপ্রলয়ের রোষে খড়কুটোর মতন ভেসে যাচ্ছে দ্বীপরাষ্ট্রের পরিত্যক্ত বাড়িঘর, হর্ম্যপ্রাসাদ। কৃষ্ণকায় তরল দানবের মতন সে জল প্রবল গর্জনে চারদিক থেকে ছুটে আসছে দ্বীপের কেন্দ্রাবস্থিত ধ্যানমন্দিরের দিকে...

গর্ভগৃহের অন্ধকারে কিসের যেন আলোড়ন শুরু হয়েছে... শরীরগুলি অতি দ্রুত স্পন্দিত হচ্ছে... কাঁপছে থর থর করে, যেন কোন অসহ্য বেদনার বিস্ফোরক সুখানুভূতিতে... তাদের আকৃতি পরিবর্তিত হচ্ছে ধীরে ধীরে... সে পরিবর্তনের গতি ক্রমবর্ধমান...

মধ্যরাতের অন্ধকারে তরল দৈত্য ধেয়ে এলো ধ্যানমন্দিরকে গ্রাস করতে। প্রতি দ্বার, প্রতি বাতায়ন, প্রত্যেক রন্ধ্রপথে লবনজল প্রবেশ করলো গ্রহান্তরের মহাকাশযানের অভ্যন্তরে। ধেয়ে চললো গর্ভগৃহের দিকে...

সেখানে উপবিষ্ট শরীরগুলিকে এখন আর চেনা যায় না... দু’পা সংযুক্ত হয়ে অন্তভাগে বিস্তৃত হয়ে গেছে দু’পাশে... দু’হাতের আঙুল অদৃশ্য হয়ে হাতগুলি সংকুচিত হয়ে গেছে... পৃষ্ঠদেশে দেখা দিয়েছে পক্ষাকৃতি একেকটি প্রসারিত প্রত্যঙ্গ... মাথাগুলি সম্মুখদিকে দীর্ঘায়িত হয়ে নাক চঞ্চুর আকার ধারণ করেছে... সমগ্র শরীর হয়ে উঠেছে বর্তুল, প্রলম্বিত...

প্রচণ্ড গর্জনে গর্ভগৃহে প্রবেশ করলো জল! তার তোড়ে ভেঙে পড়লো চারপাশের কারুকার্যখচিত প্রাচীর! ভেঙে পড়লো প্রতিষ্ঠাতাদের মূর্তিগুলি! মুহূর্তের মধ্যে সম্পূ্র্ণ জলমগ্ন হলো সমগ্র ধ্যানমন্দির... আর ঠিক সেই মুহূর্তে সব ক’টি ধ্যানমগ্ন শরীর জেগে উঠলো একসঙ্গে! তারা এখন সম্পূর্ণ পরিবর্তিত... মৎস্যাকৃতি প্রাণী! সাবলীল সন্তরণে তারা নির্গত হলো ধ্যানমন্দিরের বাতায়ন পথে। মিশে গেলো গভীর রাতের অতলান্ত সাগরে...

অতলান্তিক দ্বীপরাষ্ট্র যে মুহূর্তে সম্পূর্ণ নিমজ্জিত হলো অতলান্ত মহাসাগরের জলে, সেই মুহূর্তে ঘটে গেলো এক অত্যাশ্চর্য বিবর্তন... জন্ম নিলো এই গ্রহের আশ্চর্যতম প্রাণী... ডলফিন!

3 comments:

  1. বাঃ !! অপূর্ব !! কিন্তু অভিযোগ সম্পাদিকার কাছে। এটিকে কিছুতেই ছোটো গল্পের পরিধিতে বাঁধা যায়না।

    ReplyDelete
  2. তাহলে কি বলা যায় একে? :)

    ReplyDelete