1

ছোটগল্পঃ বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়

Posted in


ছোটগল্প 



রবিবার অথবা আশ্রয়
বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায় 



বুকে হাত রাখতে গিয়ে হঠাৎ শূন্যতা অনুভব করে অরিত্র। ঠিক তখনই মনখারাপের হলুদ বিষণ্ণতা ছুঁয়ে যায় চারপাশ। মাথার উপর আকাশ আদিগন্ত নীল। সাদা মেঘ হেঁটে যাচ্ছে। স্কুল ড্রেস পরা ছাত্র ছাত্রীদের লম্বা লাইন, ব্যস্ত গাড়ির হর্ন। রিক্সার দামাল দৌড়। রাস্তা জুড়ে মানুষের মিছিল -এইসব দেখতে দেখতে মনে হয় আজ সোমবার। হ্যাঁ সোমবারই তো। এখনও ছটা দিন। তারপর দেখা হবে মৌমিতার সঙ্গে। এই ছ দিন যেন দীর্ঘ ঘুমহীন প্রহর। ভাবতে ভাবতে মন আরও শীতল হয়ে যায়।

ইলেকট্রিক অফিসের সামনেও লম্বা লাইন। শনি, রবি দুদিন বিল নেওয়া হয়নি। আজ তাই ভিড় অনেক বেশি। এত ভিড়ে দাঁড়িয়ে বিল দিতে দিতে বেলা গড়িয়ে পড়বে। সামনে শম্ভুকে দেখতে পেয়ে খুশি হল অরিত্র – শম্ভু, আমার একটা উপকার করে দে ভাই। খুব বিপদে পড়ে গেছি।

কেন ? আবার কি হল অরিত্রদা ? 

আর বলিস না, আমাকে এক্ষুনি একটা আর্জেন্ট কাজে বাঁকুড়া যেতে হবে।

কি করতে হবে আমাকে ? 

তুই আমার বিলটা জমা করে দিবি ভাই ? খুব উপকার হয়

নিশ্চয়ই। দাও 

অরিত্র ভাবল বাঁচা গেল। এই ভিড় ও সমাবেশ থেকে নির্জন অনেক ভাল। সে শম্ভুকে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ল রাস্তায়। তার তো বাঁকুড়া যাওয়ার নেই। কিন্তু কোথায় যাবে সে এখন? এলোমেলো দিশাহীন ভাবে বিপর্যস্ত রাস্তা খুঁজতে থাকে অরিত্র। আর ভাবে এখনও ছদিন কিভাবে কাটবে ? এই প্রতীক্ষা ক্লান্তিময়। এক নির্মেঘ দুপুরে বাস স্টপে নির্দিষ্ট বাসের জন্য অপেক্ষার মত বিরক্তিকর। একঘেয়ে এই দিনগুলো একদিন শেষ হবে অরিত্র জানে। একটা আশ্রয়, একটা ছোট ঘর, বেঁচে থাকা এবং জীবনযাপনের গল্প একদিন শুরু হবে। সেই দিনের জন্য অপেক্ষা জমানো কষ্ট আর মনখারাপ থাক আপাতত বুকে। তবু সপ্তাহে একদিন মৌমিতাকে সামনে পেলে সমস্ত ব্যথার উৎস ভুলে গিয়ে অপরিসীম নির্মল করে নিতে পারে নিজেকে। এই প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা নিয়েই প্রতিটি রবিবার আসে তার জীবনে।

গতকাল ছিল এরকমই এক রবিবার। কিছুকথা আর কিছু নীরবতা অহংকার হয়ে আছে আজ। সেই সংলাপ আর দৃশ্যপটের মধ্যে ক্রমশ ডুবে যেতে থাকে অরিত্র।

কাল রাতে একটি স্বপ্ন দেখলাম। মৌমিতা বলে ওঠে একসময়।

তাই ? কি স্বপ্ন ? বলো না। অরিত্র কৌতূহলী হয়ে ওঠে 

একটা ছোট বাড়ি। তোমার আর আমার ...।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে অরিত্র। ভাবে – এ জীবনে বোধহয় নয়। কোনো এক জন্মান্তরের ভেতর সে ঢুকে পড়ে।

কতকিছুই বাকি থেকে যায়। কত চাওয়া পাওয়া। এই অতৃপ্তি গুলো জুড়তে জুড়তে জীবন এগিয়ে চলে। আর মানুষ সেলাই করতে থাকে একটার পর একটা স্বপ্ন।

মৌমিতার চোখের দিকে তাকিয়ে তার মনে হয় বড় অদ্ভুত এই মেয়েটা এখনও স্বপ্ন দেখে।

কথা বলছ না কেন ? মৌমিতা জিজ্ঞেস করে।

ভাবছিলাম।

কি ?

আকাশ –

আকাশ ?

কত নীল তাই না ? কত রঙ। কত ছবি।

ছবির মধ্যে জড়িয়ে পড়ে নীরবতা। মৌমিতার কোলে মাথা রেখে তার চোখের দিকে তাকায় অরিত্র। পরম মমতায় তাকে দেখে। এলোমেলো দীর্ঘ কালো চুল সারা পিঠ জুড়ে। চিবুকের নীচে সেই তিল যা তাকে প্রতিদিন আরও সুন্দরী করে তোলে। নীরবতা ভেঙে মৌমিতা একসময় বলে- কিছু বলছ না কেন, অরি ? 

কি বলব ? 

তুমি স্বপ্ন দেখ না ?

না।

কেন ?

ভা লো লা গে না। টেনে টেনে ক্লান্তি জড়ানো গলায় বলে অরিত্র। দ্রুত হয়ে আসে নিঃশ্বাসের গতি। বিমর্ষভাবে আকাশের দিকে অদ্ভূত চেয়ে থাকে সে।আঙুলটা মুখে পুরে নখ কাটার নিঃস্পৃহ কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে আর ভাবতে থাকে – এই সেই মৌমিতা সান্যাল, বি এন সি র ক্লাসে ‘উইমেন্’স লিব’ নিয়ে আলোচনায় যে কাঁপিয়ে দিয়েছিল সারা ক্লাস। যার আবৃত্তি বা সুরেলা গানে ভরে উঠত সারা আকাশ। ক্রমশ খ্রিস্টান কলেজের ক্যাম্পাস অদৃশ্য হয়ে যেতে থাকে চোখের উপর দিয়ে। অরিত্র ভাবে আর আকাশ দেখা নয়। এবার মৌমিতার দিকে দৃষ্টি মেলে তাকানো উচিৎ। সপ্তাহে মাত্র একটি দিন – রবিবার।

তুমি আর কবিতা লেখ না মৌ ?

সে সোনার মাছি তো কবেই খুন করে ফেলেছি।

কেন ?

হয়না অরিত্র। এই বিরুদ্ধতার মধ্যে কবিতা আসেনা।

আসবে, ঠিক তোমার স্বপ্নের মতই আসবে।

তাই না কি ?

একটু আগে বললে না- একটা সুন্দর বাড়ির কথা।

হ্যাঁ। ও তো ভোর রাতের স্বপ্ন।

ভোরের স্বপ্নই তো সত্যি হয়।

গলার স্বরে বিহ্বলতা, চোখ আর্দ্র হয়ে আসে। অরিত্র অনুভব করে তার সমগ্র শরীর জুড়ে অস্তিত্বের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে কিছু কথা। ভাষাহীন নির্বাক অথচ তাৎপর্যময়। কি করবে বুঝতে না পেরে মৌমিতার এলোমেলো চুলগুলোকে বিন্যস্ত করতে গিয়ে আকস্মিক ভাবে বলে ফেলে – তুমি কত রোগা হয়ে গেছ মৌ। খুব চিন্তায় জড়িয়ে পড়েছ আজকাল। বিরাট নৈঃশব্দ, নীরবতা যেন এক চরিত্র দুজনের মাঝখানে। এই শব্দহীন অভিঘাত ছুঁয়ে অরিত্র ভাবে কত বদলে গেছে মৌমিতা, পরিবর্তন কিভাবে স্পর্শরেখা এঁকে দিয়েছে দিনের পর দিন। শব্দে আর শব্দহীনতায় রৌদ্র আর বৃষ্টির সংস্পর্শ জনিত সুখে একদিন মৌমিতাকে কাছে পেতে ইচ্ছে করেছিল তার। মৌমিতার চিবুক ছুঁয়ে নেমে আসা নরম গলা আর বুকের উপত্যকার স্পর্শ এলোমেলো করে দিয়েছিল নিঃশ্বাস। অসহিষ্ণুতা সামলে নিতে না পেরে মৌমিতার গালে, কপালে, ঠোঁটে মদির স্পর্শ এঁকেছিল সেদিন। হারিয়ে যাওয়া অনুভব থেকে জেগে উঠেছিল মৌমিতা -অ্যাই কি করছ ? 

আকস্মিক প্রশ্নে স্মৃতিও অনিশ্চিত। লজ্জায় মাথা নামিয়ে নিয়েছিল অরিত্র। সারা বিকেল তুলতে পারেনি মুখ। 

সরি। এক্সট্রিমলি সরি।

সেদিন স্পর্শ যা দিয়েছিল আজকের নীরবতা তার চেয়ে অনেক বেশি দিতে পারে। মনের মধ্যে অদ্ভুত স্বাদ। ভাবনায় ঢুকে পড়ছে পেলবতা।

-কি ভাবছ ? অরিত্রর চিবুক ছুঁয়ে মৌমিতা জিজ্ঞেস করল একসময়।

কই কিছু না তো।

মৌ কে কি আজ বলে ফেলবে সব কথা। অরিত্র ভাবে আজ নয়, অন্য কোনো একদিন, অন্য কোনো এক রবিবারে বলা যেতে পারে। আজ কোনভাবেই নয়। কিছু কথা বুকের ভেতর রাখা ভাল। জমাট বাঁধা কষ্টের মধ্যে ওই কথাগুলো ধরে সাঁতার কাটা যায় অনেকক্ষণ। এক দুঃখ বিলাসী ভাবনার মধ্যে তলিয়ে যেতে যেতে ভাবে – এভাবে দূরে দূরে আর কতদিন থাকা যায় মৌমিতা। শুধু স্বপ্ন দেখতে আর কতদিন ভাল লাগবে। নিঃসঙ্গতা আর নির্জনতা নিয়ে মাথার উপর সীমানাহীন আকাশ । কেবল রোদ্দুর ছুঁড়ে মারে। পাশে দাঁড়াও, হাত ধরো। একটা আশ্রয় তৈরি করতেই হবে। এই কথাগুলো কোনোদিন বলা হবেনা। বললেই মৌমিতা হয়তো বলবে – একটা ছোট চাকরি। কতদিক সামলাবো বল, মেজ বোনের বিয়েটা দিই, তারপর ঠিক তোমার হাত ধরবো। ততদিনে তুমিও নিশ্চিত একটা চাকরি জোগাড় করে নেবে। তারপর শুধু আনন্দ আর আনন্দ। এসব বলতে বলতে কেঁদে ফেলবে মৌমিতা। শ্রাবণের মেঘের মত ঘন হয়ে আসবে মুখ। ক্লান্ত হয়ে আসে স্নায়ু। চোখের উপর তৈরি হয় বহু আলোক বর্ষ দূরের এক চিত্র কোলাজ - রাঙা রাস্তা ছুঁয়ে চিতিয়ে পড়ে থাকা এক বিশাল মাঠ। মাঠ পেরিয়ে শাল আর মহুয়ার জঙ্গল। মধ্যিখানে ছোট এক রেলওয়ে স্টেশন। সেই রেল স্টেশনের বাঁ দিকে রাস্তার উপর একটি বাড়ি। সাদা রঙের। নিকানো উঠোন, তুলসি মঞ্চ। যত্ন আর মমতায় সাজানো বাগান।অফিস থেকে ফিরে এসে মৌমিতা দেখবে – অরিত্র বসে আছে বাগানে। এক চিলতে আলো এসে পড়ছে তার গায়ে। স্টেশনের ওপার থেকে ভেসে আসছে ট্রেনের হুইসল। বাথরুম থেকে গা ধুয়ে এসে সিঁথিতে সিঁদুর কপালে উজ্জ্বল টিপ পরে মৌমিতা বলবে – এখনও আমার জন্য অপেক্ষা করে আছ, কিছুই খাওনি ? 

মাথা নাড়বে অরিত্র। এসব অনিবার্য ভাবে ভেবে চলে সে। চোখের পাতার উপর দমবন্ধ বাতাস। জানে সব কথাই কোনো একদিন বলবে মৌমিতাকে। কোনো এক রবিবার। কিন্তু কোন রবিবার ? সে জানেনা। স্বপ্নপাখির মত এক অনন্ত রাত্রিরেখা ছুঁয়ে জেগে থাকে অরিত্র। একটি সোম, মঙ্গল ... শনিবার তাকে প্রতীক্ষার ভাষা শেখায়। আশ্রয়ের স্বপ্নে মৌমিতার শূন্য ছবি তাকে মাঝে মাঝে একটি করে রবিবার উপহার দেয় সান্ত্বনা পুরস্কারের মত। উষ্ণ উসর মরুভূমির মত তার নিরুদ্ভিদ জীবন জলের প্রত্যাশায় শুকিয়ে যায়। আকীর্ণ ধূসর পাণ্ডুলিপি জুড়ে ধুলো জমে। হতাশার গান তো সকলের মধ্যেই বাজে। বিষাদের ছায়া সবাইকেই ছুঁয়ে থাকে কোনো এক সময়। জজ, ব্যারিস্টার থেকে শুরু করে ঐ যে লোকটা প্রতিদিন রাস্তায় বাঁশি বাজায় - সবাই সবাই ... কখনও না কখনও এক বিপন্নতার ভেতর দিয়ে হেঁটে আসে। আসতেই হয় । তবু ওরা কতকিছু পেয়েছে – আশ্রয়, এক নিভৃত আস্তানা। মুখোমুখি অবসর। আর ভালোবাসায় বড় হয়ে ওঠা শিশু। সব ব্যথা ঢেকে দেওয়ার এক সুন্দর ঐশ্বর্য। ওদের জীবনে কত রবিবার। সংখ্যাহীন, অগুনতি।ওদের জীবনে অনেক বিকেল। নরম আর মিষ্টি আলোয় ভরা। এক অনন্ত দুপুরে জেগে আছে অরিত্র। ইচ্ছে করলে মৌমিতাকে সব খুলে বলা যায়। অথচ পারেনা। মৌয়ের বাড়িতে অসুস্থ বাবা, বিছানায় শয্যাশায়ী মা, দুটো বেকার ভাই। এক অবিবাহিতা দিদি। দুটো বোন। সবার কথা ভাবতে হয় তাকে। অরিত্রকেও। শুধু নিজেদের কথাগুলো বুকের আড়ালে লুকিয়ে রাখতে হয়।

রবিবারে এই পর্যন্ত ভেবেছিল অরিত্র। কোনো কথা বলতে পারেনি। বলবে ভেবেছে। খুব দরকারি কথাটা জিভের ডগায় এসেও আটকে গেছে। যেমন ভাবে চাকরির আশায় আশায় আটকে গেছে তার জীবন। এক দুরন্ত প্রতীক্ষায় বন্দি হয়ে আছে তার স্বপ্নসফলতা।

আজ সোমবার। এখনও ছ টা দিন। সিগারেট ধরাল অরিত্র। মেঘলা আকাশ। বৃষ্টি আসবে কি ? আসুক । সে আজ ভিজবে। দারুণ ভিজবে।কোথায় দাঁড়াবে সে ? সামনে কোনো গাছতলা নেই ।ছাতা কবেই হারিয়ে গেছে। কোনো আশ্রয়ের ঠিকানা তার জানা নেই। কিভাবে চাইতে হয় নিরাপদ আস্তানা সে ভাষাও সে জানে না। শুধু জানে – একটি রবিবার চলে গেলেও আরেকটি রবিবার আসবে। বৃষ্টি শেষ হবে একসময়। তারপর ...। জ্বলন্ত সিগারেট টা ছুঁড়ে দিয়ে অরিত্র দৌড়োতে থাকে পরবর্তী রবিবারের দিকে।

1 comment:

  1. গল্পটি সমাজ জীবনের দর্পণ হয়ে গেছে । লেখকের বর্ণনায় আরও জমাট হয়েছে অনুভব । পাঠক কখন যেন নিজেই চরিত্র গুলির সাথে মিশে যায় , বুঝতেই পারে না । অনন্য সুন্দর অভিব্যক্তি ।

    ReplyDelete