2

প্রবন্ধঃ অরূপ জ্যোতি ভট্টাচার্য

Posted in


প্রবন্ধ


প্রসঙ্গ ডাকঘর - একটু অন্য চোখে বিশ্লেষণ 
অরূপ জ্যোতি ভট্টাচার্য 



সালটা 1945, 2 মে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ পর্যায়। হিটলার আত্মহত্যা করার প্রাক্‌ মুহূর্ত। সোভিয়েত সেনাবাহিনীর সাথে জার্মান সেনার রাস্তায় মুখোমুখি যুদ্ধ হচ্ছে। সেই সময় শোনা যায়, রবীন্দ্রনাথের "ডাকঘর' পথনাটক করা হয়েছিল জার্মানির রাস্তায়। WIkipedia জানাচ্ছে "It had a successful run in Germany with 105 performances and its themes of liberation from captivity and zest for life resonated in its performances in concentration camps where it was staged during World War II." from "Tagore for today". The Hindu. August 30, 201।.

এর থেকে একটা সিদ্ধান্ত করা যেতে পারে যে রবীন্দ্রনাথের ডাকঘর অনেক বিদগ্ধ মনীষীর মনেই দাগ কেটেছিল। ভারতীয় নাট্যকারদের মধ্যে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র শম্ভু মিত্র। তাঁর নির্দেশনায় 'ডাকঘর' একটা নতুন ভাষা পেয়েছে। পাতার কার্বন থেকে জ্বলন্ত পাবক। নাটক মনের সাথে অনেক বেশী নিবিড় সংযোগ স্থাপন করে।

আজকের ফেসবুক আর ই-মেইল এর যুগে ডাকঘরে প্রায় যেতেই হয় না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের 'ডাকঘর', একবার নতুন করে পড়ার জন্য আহ্বান করলো। নতুন চোখে পড়তে গিয়ে 'ডাকঘর' আবার নতুন করে ভাবতে চেনালো। অমল কি সত্যি মারা গেছিল? নাটকের শেষ সংলাপে পরিষ্কার তো লেখা নেই। আছে ব্যঞ্জনা। আর ব্যঞ্জনার মধ্যে দিয়ে একটা নাম এলো সুধা। সুধা মানে অমৃত। যা মানুষকে অমর করে। তাহলে অমলকে ফুল দিতে সুধা কেন এসেছিল। এত সুন্দর নামের ভিড়ে রবীন্দ্রনাথ সুধা নামটাই বা কেন পছন্দ করলেন? প্রশ্নটা মনকে নাড়া দিল বার বার।

নাটকের সংলাপ পড়তে গিয়ে কিছু প্রশ্ন মনে জেগেই রইলো। 

'অমল। আমি জানি নে। আমি তো কিচ্ছু পড়ি নি, তাই আমি জানি নে আমার কী হয়েছে। দইওআলা,' 

অমল জানেই না যে তার কি হয়েছে। সে শুধু জানে যে বৈদ্য তাকে ঘরের বাইরে যেতে মানা করেছে। কারণ তার অসুখ করেছে। নাটকের এক জায়গায় কবিগুরু লিখেছেন অসুখ "করতে পারে"। সেটা অমলের কাকার সংলাপ।কাকা, অমল কে দত্তক নিয়েছিল (adopted uncle)। করতে পারে - এটা ভবিষ্যত কাল। বর্তমান কালে অমলের কি অসুখ সেটা তো অমল জানেই না।বৈদ্য ডায়াগনসিস করেছে যে 'বাত, পিত্ত আর কফ'। বৈদ্য যে ঠিক নির্ণয় করেছে সেটা বলা কঠিন। কারণ বৈদ্যের ডাক্তারি বিদ্যার যে নাটকীয় ব্যঙ্গ রবীন্দ্রনাথ লেখনীতে মিশিয়েছেন, তাতে বৈদ্যের পুঁথিগত জ্ঞান কতটা সঠিক সেটা বিচার্য। যে দুর্বোধ সংস্কৃত লেখা রয়েছে, আর তার যা অর্থ বৈদ্য করেছে, সেটা দুর্বোধ শব্দটির-ই মত। ব্যুৎপত্তি বা শব্দের জন্ম পদ্ধতি বিচারে দুর্বোধ সঠিক শব্দ। যদিও দুর্বোধ্য কথাটা বাংলায় বহুল প্রচলিত। তবে ওই য ফলা ব্যাকরণ বিচারে শুদ্ধ বলা যায় না। সেরকমই লেখকের হাস্যরস বৈদ্যের বিদ্যা নিয়ে সংশয় রেখেই দেয়। সেই সাথে অমলের রোগ যতটা না কঠিন ছিল, তার থেকেও ছিল কঠিন স্নেহ। যেটা বাংলা প্রবচন কে মনে করিয়ে দেয় - স্নেহ অতি বিষম বস্তু। 

বৈদ্যের চিকিৎসা যে ভুল ছিল তার প্রমাণ রাজবৈদ্যের প্রবেশ। বৈদ্য ছিল কবিরাজ। ডাকঘরের রচনাকাল 1912। সেই সময় ভারতীয় চিকিৎসাতে অ্যালোপ্যাথি প্রবেশ করেছে। প্রাচীন কবিরাজি চিকিৎসাতে সঠিক বিদ্যার অভাবে নিয়ম ছিল রোগীকে ঘরে বন্ধ করে রাখা। কিন্তু অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসা শিখিয়েছে, উন্মুক্ত বাতাস, খোলা আকাশ, সূর্যের আলো আরোগ্য লাভের প্রাথমিক প্রয়োজন। রাজবৈদ্য সেই আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে পারদর্শী। সহজ কথায় অ্যালোপ্যাথ ডাক্তার। অমল নাটকের শেষ দৃশ্যে ঘুমিয়ে পড়েছিল।সেই ঘুম আর ভেঙ্গেছিল কিনা সেটা বলা যায়না। কারণ নাটকে স্পষ্ট করে সেটা বলা নেই।

ডাকঘরে, রবীন্দ্রনাথ অমলকে প্রকৃত মারতে চেয়েছিলেন কিনা সেটা বলা শক্ত। নাটক মঞ্চস্থ করতে গেলে একটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এফেক্ট (effect) হলো ট্র্যাজেডি। ট্র্যাজেডি বেশী করে মনকে নাড়া দেয়। সেই কারণে নাটকের স্বার্থে কবিগুরু অমলের মৃত্যু বার্তাটা রহস্য জালে মুড়ে রেখেছেন। নাটকের আলোতে বিচার করলে শ্রদ্ধেয় শম্ভু মিত্র সার্থক।

তবে “ডাকঘর” সমাজের কাছে এক নতুন বার্তা নিয়ে এসেছে। সেটা মৃত্যু নয়।জীবনের বার্তা। পরিবর্তনের বার্তা। আধুনিক শিক্ষার বার্তা। কুসংস্কার মুক্ত মনের বার্তা। যাকে পরিভাষায় বলা যায় কান্তা সম্মিত বাণী, যা আত্মিক লোকে সর্ব মানব চিত্তের মহাদেশে বিরাজ করে। 1917 সালে বীন্দ্রনাথ প্রথম যখন ডাকঘর নাটক মঞ্চস্থ করেন,তখন তিনি কিছু গান নাটকে প্রয়োগ করেন। যদিও মূল নাটকে কোন গান নেই। তার মধ্যে একটা গান হলো - ভেঙ্গে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে। এই গান জীবনের গান। মৃত্যুর গান নয়। অমল যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখন তার জন্য ফুল এনেছিল সুধা। সুধা নামের ভাব লক্ষ্যণ গত অর্থে জীবনের জয়গান গায়। বিদেশী লেখকের চোখে ডাকঘর নবজাগরণের বার্তা আনে। তাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানিকে নতুন আলোতে জাগাতে 105 বার ডাকঘর নাটক মঞ্চস্থ করা হয়েছে। যেখানে বন্দী জীবন থেকে মুক্তির আনন্দ ফোটানো হয়েছে।

উপসংহারে শেষ প্রশ্নটা থেকে গেল। অমলকে দেখতে যে রাজা আসার কথা ছিল তিনি কোন রাজা ? সেই উত্তর খোঁজার জন্য মন সন্ধান করলো শব্দের চতুর্বিধা শক্তিকে। সেটা হলো তাৎপর্য। মম্মটভট্টের টীকাতে, তাৎপর্যকে চতুর্বিধা শক্তি বলা হয়েছে। এখানে রাজার আগমনের তাৎপর্য হলো রেনেসাঁ বা নবজাগরণের বার্তা। পরিবর্তনের বার্তা। ডাকঘর নাটকে রাজা হলো রেনেসাঁ বা নবজাগরণ।



2 comments:

  1. সুন্দর বিশ্লেষণ !!

    ReplyDelete
  2. খুব সুন্দর বিশ্লেষণ করেছেন । শ্রদ্ধা জানাই।

    ReplyDelete