ছোটগল্পঃ মৌসুমী ঘোষ দাস
Posted in ছোটগল্প
ছোটগল্প
ভ্রান্তি-বিনাশ
মৌসুমী ঘোষ দাস
খানিক আগে একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। আরও হবে বলে মনে হচ্ছে। ঘন কালো মেঘে আকাশ ঢেকে রয়েছে। থেকে থেকে আকাশের বুক চিরে তীব্র আলোর ঝলকানি আর প্রচণ্ড শব্দে মেঘের ডাক। কিন্তু তাতে কি? আড্ডা তো আর বাদ দেওয়া যায় না! সারাদিন অফিস করে সন্ধ্যায় বন্ধুদের সাথে জমিয়ে এই আড্ডাটুকু না দিলে যে মেজাজ ঠিক থাকে না। অবশ্য বাড়ি ফিরে এর জন্য গিন্নীর হাঁড়ি মুখ দেখতে হয়। তা দেখি, কিন্তু তা বলে আড্ডা দেবো না ভাবলে গায়ে জ্বর চলে আসে। আমাদের আড্ডায় বিভিন্ন রকম হালকা-ভারী আলোচনার সাথে চলে জমিয়ে চা পান আর মাঝে মধ্যে আড়চোখে মেয়ে দেখা। তাই বলে বাজে ছেলেদের মত আমরা মেয়েদের কখনও টিটকিরি করি না। এ ব্যাপারে যথেষ্ট সুনাম আছে আমাদের।
প্রতিদিনের মতো বাজারের পাশে বুড়ো বটতলায় নিরঞ্জনের চায়ের দোকানে সবাই আড্ডায় বসেছি। আড্ডাও বেশ জমে উঠেছে। বৃষ্টির কারণে নাকি জানি না আজ রাস্তায় লোকজন বেশ কম। আসেপাশের দোকানগুলোতে ভিড় নেই বললেই চলে। হঠাৎ দেখি আমাদের বনিক বাবুর মেজো মেয়ে কেমন হনহন করে হেঁটে চলে আসছে। মেয়েটির একটু মানসিক সমস্যা আছে বলেই জানি। মনে হয় কাউকে না বলেই বাড়ি থেকে বেরিয়েছে। মাঝে মধ্যে এরকম রাস্তায় একা একা হেঁটে বেড়ায়। তারপর বাড়ির লোক এসে ধরে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাড়ি নিয়ে যায়। একমাথা উস্ক খুস্ক কোঁকড়ানো চুল পেছনে টেনে বাঁধা, পরনে একটি রঙ্গিন সালোয়ার কামিজ, এলোমেলো ওড়না। চোখের দৃষ্টি উদাস। রাস্তার ধারের নোংরা আবর্জনা কিছুই যেন চোখে পড়ছে না। সে সবের ওপর দিয়েই হাওয়াই চপ্পল পরে হনহন করে হেঁটে চলেছে।
তা সে হেঁটে আসছে তা নিয়ে আমাদের ভাবার কিছু নেই। জানি খানিক বাদে সে নিজেই, নয়তো বাড়ির কেউ এসে ওকে নিয়ে যাবে। কিন্তু ভাবনার কারণটা আলাদা। দেখি ঠিক পেছন পেছন একজন ষাট কি পঁয়ষট্টি বছরের মোটামুটি ভদ্রস্থ দেখতে ব্যক্তি ওকে হাঁ করে দেখতে দেখতে প্রায় ওর গা ঘেঁসে ঘেঁসে চলে আসছে। লোকটির হাবভাব দেখেই মনে হচ্ছে ভদ্রলোকের একটু ইয়ের দোষ আছে। মেয়েটি কিন্তু তা খেয়ালও করছে না। ভদ্রলোক যে মেয়েটির পূর্ব পরিচিত নয় তা হাবে ভাবে বেশ বোঝা যাচ্ছে। লোকটিকে এই এলাকাতে এই প্রথম দেখছি। মেয়েটি রাস্তার যেদিকে যায়, ভদ্রলোকটিও সময় নষ্ট না করে সেদিকে যায়। আমরা সবাই এই দৃষ্টিকটু ব্যাপারটা কৌতূহলী হয়ে লক্ষ্য করতে লাগলাম।
একে তো রাস্তাঘাটে লোক জন কম, তার ওপর বাদলা দিন। যখন তখন ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামতে পারে। আর এই ধরনের স্বভাব দোষে দুষ্ট লোকেরা তো এখন সংখ্যায় বেশি। একা মেয়ে দেখলেই শুধু সুযোগ খোঁজে। এদের জন্য যারা সত্যিকারের ভাল চরিত্রের লোক তাদেরও মানুষ আর বিশ্বাস করতে চায় না। এখন যে কেবল ছেলে ছোকরারাই মেয়েদের সাথে অসভ্যতা করে তা নয়, এই বয়সী লোকেরাও বাদ যায় না। এমনকি শিশুরাও এদের হাত থেকে রেহাই পায় না, সে খবর তো কাগজে রোজই পাওয়া যায়। খোঁজ নিয়ে দেখলে দেখা যাবে, এই মেয়েটির বয়সী নাতনি হয়তো ওনার বাড়িতে আছে। তবুও কথায় আছে না মানুষের ‘স্বভাব যায় না ম’লে’।
এবার দেখি ভদ্রলোকটি মেয়েটির সাথে প্রায় গায়ে পড়েই গল্প জুড়ে দিল। মেয়েটিও দেখি মাঝে মাঝে অনিচ্ছাকৃতভাবে দু একটি কথার উত্তর দিচ্ছে। ওরা গল্পে এতই মশগুল যে, আমরা যে চায়ের দোকান থেকে ওদের লক্ষ্য করছি তা খেয়ালই করছে না। তার কিছু পরেই লোকটি মেয়েটিকে নিয়ে প্রায় জোর করেই পবনের মিষ্টির দোকানে ঢুকল। লোকটির এ হেন গায়ে পড়া ভাব দেখে আমরা বেশ বিরক্ত হয়ে কয়েকজন উঠে মিষ্টির দোকানের কাছে গেলাম। দেখলাম ভদ্রলোক যত্ন করে মেয়েটিকে বসিয়ে মিষ্টি খাওয়াচ্ছেন। আমরা দোকানের বাইরে একটু আড়াল থেকে ওদের বেরোনোর অপেক্ষা করছি।
মেয়েটির মিষ্টি খাওয়া হলে, ভদ্রলোক দাম দিতে গেলেন আর অমনি মেয়েটি হনহন করে হাঁটা লাগালো। তিনিও দাম মিটিয়ে দিয়েই উর্দ্ধশ্বাসে মেয়েটির পিছু নিলেন। যেন মুহূর্তের জন্যও মেয়েটিকে কাছছাড়া করতে চান না। নাঃ! ব্যাপারটা তো ভাল ঠেকছে না। কৌতূহল আরও বেড়ে গেল। এবার আমরাও তাদের সাথে সমান তালে তাল রেখে এগিয়ে গিয়ে ওদের থামালাম। আমাদের বন্ধু রবিনের আবার মুখ খুব খারাপ। সে খুব কর্কশ ভাবে বললে, ‘‘ব্যাপার কি মেসমশাই, তখন থেকে দেখছি আপনি মেয়েটির পিছু কিছুতেই ছাড়ছেন না! আপনার মতলব টা কি? আপনি কি একে চেনেন নাকি?’’
ভদ্রলোক কিছু বলার আগেই আমাদের আরেক বন্ধু টুবুল মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করল,
‘‘এই মেয়ে, তুমি এভাবে একা বেড়িয়েছ কেন? বাড়িতে বলে এসেছ? এই লোকটিকে তুমি চেন? অচেনা লোকের সাথে কোথায় চলেছ হনহন করে?’’
একসঙ্গে এতগুলো কড়া প্রশ্ন শুনে থতমত খেতে মেয়েটি মাথা নেড়ে বলল না ভদ্রলোককে সে চেনে না। আর বলল, ‘‘আমি তো ওনার সাথে যাচ্ছি না! ইনিই সেই তখন থেকে আমার পিছু নিয়েছেন।’’
‘‘মেয়েটিকে চেনেন না অথচ পিছন ছাড়ছেন না! অদ্ভুত লোক তো আপনি! বয়স তো কম হল না! কোথায় এই বয়সে ঠাকুর দেবতার নাম করে কাটাবেন, তা নয়, নাতনির বয়সী মেয়ে দেখে ছোঁকছোঁকানি!’’
‘‘এসব কি বলছ বাবা? আমি তো মেয়েটিকে...’’
‘‘কি বলছি মানে? তখন থেকে যা দেখছি তাই বলছি। কিছু বুঝি না ভেবেছেন? আমরা কি ঘাসে মুখ দিয়ে চলি?’’
‘‘না বাবা, এর কাছে ওর নাম ঠিকানা জানার চেষ্টা করছিলাম। আর...’’
‘‘ঢপ মারার জায়গা পেলেন না? এর নাম ঠিকানা দিয়ে আপনি কি করবেন মশাই?’’
এক-কথা দু-কথা হতে হতে আমাদের ঘিরে কিছু উৎসাহী লোক জমা হয়ে গেল। তাদের মধ্যেই অত্যুৎসাহী একজন জামার হাতা গুটিয়ে ‘‘এইভাবে কথা বের করতে হয়’’ বলে আচমকা ভদ্রলোকের গালে সপাটে এক চড় কষিয়ে দিল। তিনি হুমড়ি খেয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন। চশমাটা ছিটকে বহুদূরে পড়ে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে চোখের নীচটা লাল হয়ে ফুলে উঠল। তিনি এবার হাউ মাউ করে কিছু বলার চেষ্টা করতে গেলেন, কিন্ত কেউ তার কথা শুনল না। সবারই যেন ওনার কথা না শুনে হাতের সুখ করার ইচ্ছে। আমরা যতই বলি এভাবে মারধোর না করে ওঁকে আগে বলতে দাও। কিন্তু কেউ কিছুতেই কারো কথা শুনতে চাইল না। চড়-চাপাটি চলতেই থাকলো।
সেদিন ঘটনা অনেকদূর ঘটতে পারত। কিন্তু ঘটলো না। ভাগ্যক্রমে সেই সময় রিক্সা করে সেখান দিয়ে এ পাড়ায় নতুন বাড়ি করে আসা মণিদীপা দিদিমণি যাচ্ছিলেন। তিনি কি হয়েছে দেখার জন্য নিতান্ত কৌতূহলে এগিয়ে এসে ‘‘একি বাবা! তুমি এখানে এভাবে পরে পরে মার খাচ্ছ!’’ বলেই তাড়াতাড়ি ভদ্রলোককে মাটি থেকে তুলে জড়িয়ে ধরলেন। দেখি ভদ্রলোকের মুখে, চোখে, গলায় বেশ খানিকটা কালশিটে পরে গেছে। সবাই কেমন হতভম্ব হয়ে সরে দাঁড়ালো। তারপর দিদিমণিকে সব ঘটনা বলা হলে তিনি কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘‘ইনি আমার বাবা, ভাইয়ের বাড়ি থেকে কাল আমার বাড়ি বেড়াতে নিয়ে এসেছি। এই মেয়েটির বয়সী আমার একটি ছোট বোন ছিল। একদিন বাবা তাকে কোন কারণে খুব বকাবকি করে একটি চড় মেরেছিলেন। বোন খুব অভিমানী ছিল। সেই দিন না খেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। অনেক খোঁজা খুঁজির পর থানা পুলিশ করেও তাকে আর পাওয়া যায় নি। সাত দিন পরে দূরের একটি খালের জলে ওর বিবস্ত্র পচা গলা দেহ ভেসে ওঠে। আমার বাবা তারপর থেকে মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। দীর্ঘকাল ওঁর চিকিৎসা চলে। কিন্তু পুরোপুরি সেরে ওঠেননি। তখন থেকে কোন অল্প বয়সী মেয়েকে একা ঘুরে বেড়াতে দেখলেই সেই মেয়েটির পিছু নেন। ভাবেন ওঁর নিজের ছোট মেয়ের মত সেও বুঝি রাগ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারও বুঝি আমার বোনের মত দশা হবে। উপযাচক হয়ে তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাড়ি পাঠাতে চান। আমরা বাবাকে একা বাড়ির বাইরে কখনো বেরোতে দিই না। কিন্তু আজ আমার অনুপস্থিতির সুযোগে কখন যে বাবা একা বেরিয়ে গেছেন! আর আপনারা ওঁকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে এভাবে পশুর মতো রাস্তায় ফেলে মারলেন! আপনারা কি মানুষ! একজন বুড়ো অসহায় মানুষকে এভাবে পড়ে পড়ে মার খেতে দিলেন! এটুকু ভাবলেন না যে, বুড়ো মানুষটির কথাও শোনা দরকার। তাছাড়া জগতের সবাই তো খারাপ হয়ে যায়নি এখনো!’’
কথাগুলো এক নিশ্বাসে বলে আমাদের সবাই কে বাকরূদ্ধ করে দিয়ে দিদিমণি তাঁর বৃদ্ধ বাবাকে একটি রিক্সায় বসিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। আর তখনি ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলো। কে জানে! হয়তো আমাদের থমথমে মনের ভেতরটাও তোলপাড় করে দিয়ে বৃষ্টি নামলো!
সুন্দর !!
ReplyDelete