1

প্রাচীন কথাঃ সৌরেন চট্টোপাধ্যায়

Posted in

প্রাচীন কথা



উত্তরাপথের পথে 
সৌরেন চট্টোপাধ্যায় 



= ৩য় পর্ব =

স্বতঃপ্রবাহিণী গঙ্গা-যমুনার দোআব অঞ্চলে কান্যকুব্জ বা কনৌজ নগরী। গতায়ু কনৌজরাজ অবন্তিবর্মার পুত্র মৌখরি বংশের কুলতিলক বর্তমান মহারাজ গ্রহবর্মার জন্মতিথি উপলক্ষে কান্যকুব্জে গত এক পক্ষকাল ধরে উৎসব চলছে। দেশ-দেশান্তর থেকে কত যে মানুষ সে উৎসবে সামিল হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। বিচিত্র তাদের পেশা ও বেশ-বাস। নানা দেশের নানা পেশার পশারীরা তাদের বাণিজ্যসম্ভার নিয়ে ইতিমধ্যেই কনৌজের উপান্তে দোয়াবের বিস্তীর্ণ তটভূমিতে এসে ভিড় জমিয়েছে। হস্তিনাপুর, অবন্তি, গৌড়, প্রাগজ্যোতিষপুর, মালব, শ্রাবস্তী, কোশল, পুরুষপুর ইত্যাদি কোন জনপদই বাকি নেই। সারি সারি অস্থায়ী বিপণি ও পট্টবাসে বহু মানুষের ভিড়ে সমস্ত অঞ্চল জুড়ে যেন মেলা বসেছে। একদিকে ভিক্ষাজীবী বৈষ্ণব ব্রাহ্মণ, শৈব, শাক্ত, জৈন, বৌদ্ধ প্রভৃতি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসীদের আখড়া। এরই মাঝে গৌড়েশ্বর শশাঙ্কদেব অতি সাধারণ এক শৈব সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশে তাঁর অতি বিশ্বস্ত ও ক্ষিপ্রকর্মা কয়েকজন রক্ষী ও অনুচরকে নিয়ে নির্দিষ্ট লগ্নে কূটঘাত–এর জন্য সাগ্রহে কালাতিপাত করছেন। তাঁর ইঙ্গিত পাওয়া মাত্র মালবের সুশিক্ষিত কূটঘাতি-বাহিনী এই অমানিশায় চুপিসারে কনৌজ আক্রমণ করবে। ওদিকে মালবরাজ দেবগুপ্তও সসৈন্যে কনৌজের সীমান্তে পৌঁছে যমুনা তীর থেকে অনেক দূরে একটি ছোট্ট টিলার পিছনে বিস্তীর্ণ জনহীন প্রান্তরে তাঁর শিবির স্থাপন করেছেন। 

রাজপুরীর শাল কাঠের তৈরী বিরাট তোরণ-দ্বার একটু আগেই বন্ধ হয়েছে; সিংহদ্বারের উপর নহবতখানায় সানাই-এর সুর এখন স্তব্ধ। তোরণের ভিতর দিকে দুই পাশে প্রহরীদের জন্য একদিক উন্মুক্ত ছোট ছোট ইষ্টকনির্মিত খুপরি ঘর, সেখানে কয়েকশো রক্ষী বিশ্রামে রত; এবং জাগ্রত প্রহরীরা কৃপাণ ও বর্শা হাতে পালা করে রাজপুরীর বিশাল চত্বরে পাহারা দিচ্ছে। কর্মচঞ্চল সুরম্য কনৌজ নগরীর বাসিন্দারা উত্তরভারতের প্রবল শৈত্য-প্রবাহে পীড়িত হয়ে অনেক আগেই ঘরে ফিরে গিয়েছে। বানিজ্য-চবুতরের স্থায়ী বিপণিগুলির ব্যবসায়ীরাও সারাদিন পরিশ্রমের পর ঝাঁপ বন্ধ করে ঘরে ফিরেছে। রাজপুরীর বাইরে অনতিদূরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ভিনরাজ্যের অনেকগুলি অস্থায়ী পশারী তাদের নিজের নিজের পশরাগুলি ধীরে-সুস্থে গুছিয়ে রাখছে এবং তাদের দলের কেউ কেউ রন্ধনকার্যের উদ্যোগ করতে ব্যস্ত। অন্য দিন সন্ধ্যার মধ্যেই তাদের সব কাজ সারা হয়ে যায়, কিন্তু আজ যেন একটু বেশিই বিলম্ব! কিছু দূর অন্তর অন্তর একই সঙ্গে বেশ কয়েকটি চুল্লি থেকে কাঁচা কাঠের আগুন থেকে ধূম্রজাল ঘন কুয়াশার মত ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে রাজপুরী-সংলগ্ন বাইরের চারিপাশ আরো বেশি দুর্নিরীক্ষ করে তুলছে। বেতনভূক চৌকিদারেরা সবে মাত্র নিদ্রার আলস্য ভেঙে এখনও তাদের নিয়মিত টহল শুরু করেনি। রাজপথের ধারে ধারে প্রজ্জ্বলিত মশালগুলির দীপ্তি ইতিমধ্যে অনেক কমে এসেছে; জনবিরল নিস্তব্ধ রাস্তায় শুধু কিছু অপোষ্য সারমেয়। 

অন্ধকার ক্রমশঃ গভীরতর হচ্ছে। কয়েকটি বিশেষ অস্থায়ী বিপণী থেকে মোটা কম্বলে সর্বাঙ্গ ঢেকে কয়েকজন বলশালী পুরুষ নিশাচর শ্বাপদের মত লঘু পায়ে নিঃশব্দ পদে বেরিয়ে এলো। তারা রাজপুরীর সিংহদ্বারের কিছুদূরে চতুষ্পথির অনতিদূরে কিছুটা দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে যেন কোন নির্দেশের জন্য প্রতীক্ষা করছে, ঘন ধোঁয়ার আড়ালে তারা প্রেতমূর্তির মতই দাঁড়িয়ে পড়ল। 

গৌড়েশ্বর শশাঙ্ক ভূয়োদর্শী। তাঁর পরিকল্পনায় ও পরামর্শে মালবরাজ সৈন্যাধ্যক্ষ সুরথ গত শরৎকালের আগেই বিশজন চতুর গুপ্তচরকে নুনিয়া, কংসবণিক ও রত্নজীবী বণিকদের সঙ্গে ছদ্মবেশে কনৌজে প্রেরণ করেছেন। তারা ইতিমধ্যেই চাতুর্যের সঙ্গে তাদের কর্তব্য সম্পাদন করে রেখেছে। তারা কৌশলে প্রধান পুররক্ষক ও তার অনুচরদের প্রচুর উৎকোচে বশীভূত করেছে, সেই সঙ্গে রাজ-অন্তঃপুরের কয়েকজন কঞ্চুকী এবং যামচেটিকেও আশাতীত ধন-রত্ন দিয়ে দলভুক্ত করে নিজেদের কার্যকালে ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দিয়ে প্রস্তুত করে রেখেছে। পূর্বপরিকল্পনা মত প্রধান পুররক্ষ এইরাত্রে তার অনুগামী অনুচরদের রাজপুরীর তোরণদ্বারের কাছাকাছি সংস্থাপন করে রেখেছে। তারা রাজপুরীর তোরণদ্বার যথাসময়ে পরিঘমুক্ত করে বাইরে অপেক্ষারত সৈন্যদের বিনা বাধায় প্রবেশের পথ সুগম করে দেবে; এবং এই মুহূর্তে রাজপুরীর বাইরে অন্ততঃ সাতশত সশস্ত্র শত্রু-সৈনিক তাদের সেনানায়কের ইঙ্গিতে চরম আঘাত হানার জন্য প্রচ্ছন্নভাবে অবস্থান করছে। 

কৃষ্ণা-একাদশীর ঘন তমসাবৃত হিমেল রাত্রি দ্বিতীয় যামে পৌঁছালো, গম্বুজের ঘন্টাধ্বনি রাত্রির দ্বিতীয় প্রহর সূচিত করল। রাজঅন্তঃপুরের ভিতরে মহারাজাধিরাজ গ্রহবর্মা সবে মাত্র নৈশাহার শেষ করে তাঁর ত্রিতলের কক্ষ-সংলগ্ন অলিন্দ-বাগিচায় সুখাসনে গা এলিয়ে দিয়েছেন। কনৌজ-রাজ গ্রহবর্মা অত্যন্ত রূপবান ও বিদ্বান। এই মুহূর্তে তিনি একটি প্রাচীন কাব্য-পুঁথিতে মনোনিবেশ করার চেষ্টা করছেন, কিন্তু পুঁথির একটি বর্ণও তাঁর হৃদয়ঙ্গম হচ্ছে না। প্রিয়তমা মহিষী স্থান্বীশ্বর-কুমারী রাজ্যশ্রীর জন্য বারংবার প্রবেশ পথের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করছেন। পাটরানী রাজ্যশ্রী প্রতি রাত্রেই একটু বিলম্বে নৈশাহার সমাপন করে এখানে আসেন। তাঁর এই বিলম্বে মহারাজ গ্রহবর্মা খুবই অসহিষ্ণু হয়ে ওঠেন, কিন্তু উপায় নেই, রাজ্যশ্রী কোনদিনই সকল অন্তঃপুরনারীদের আহার সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত আসেন না। মহারাজ পুঁথি রেখে গাত্রোত্থান করে এক রূপসী তাম্বুলকরঙ্ক-বাহিনীর হাত থেকে একটি সুরভিত তাম্বুল নিয়ে পরম তৃপ্তিতে চর্বন ও মনোরম অলিন্দ-উদ্যানে পাদচারণা করতে করতে প্রিয়তমা নারীর সান্নিধ্যে আসন্ন রাত্রির সুখ-স্বপ্নে বিভোর।

মহারাজ গ্রহবর্মা নিজের চিন্তায় ও কল্পনালোকে এমনই বিভোর ছিলেন যে, কখন সেই অলিন্দ-কাননে তাঁর নিজস্ব দেহরক্ষীদের জায়গায় একই ধরণের পোশাক পরিহিত ভিন্ন মানুষ তাঁকে ঘিরে ফেলছে তিনি জানতেই পারেন নি। 

ওদিকে মহারাণী রাজ্যশ্রী আহারের পর পোশাক পরিবর্তন করে উজ্জ্বল দীপালোকে মুকুরের সামনে বসে মৃদু স্বরে গুনগুন করতে করতে হালকা প্রসাধন শেষ করলেন। এখন তিনি তাঁর কন্দর্পকান্তি পতির সুখ-সঙ্গলাভের জন্য উন্মুখ। পরিণয়ের পর থেকেই এই গন্ধর্বসদৃশ দম্পতী রাত্রির এই সময়টিতে একান্তে কাব্য-গীতাদি ললিতকলার চর্চা করতে ভালোবাসেন, এবং শেষ পর্যন্ত দুটি মিলনোন্মুখ নর-নারীর প্রেম শৃঙ্গার পর্বে গিয়ে শেষ হয়। রাজ্যশ্রী কক্ষের বাইরে যেতে গিয়ে দেখলেন কবাট বাইরে থেকে অর্গলরূদ্ধ। তিনি তাঁর বিশস্ত যামচেটিদের নাম ধরে বেশ কয়েকবার ডাকলেন, কিন্তু তাদের কাউকেই আশেপাশে কোথাও দেখতে পেলেন না। বিস্ময়ে ও এক অজানা আতঙ্কে আতঙ্কিতা তরুণী রাজবধূ শয্যার এক কোণে বসে নীরবে অশ্রুমোচন করতে লাগলেন। 

গম্বুজের ঘন্টাধ্বনি শেষ হওয়া মাত্র গঙ্গাতীরে একটি জনশূন্য সন্ন্যাসীর কুটিরে অগ্নি সংযোজিত করা হল। পাট, শন ও পর্ণনির্মিত কুটিরটিতে আগে থেকেই ঘৃত, তৈল, গন্ধক ইত্যাদি সহজদাহ্য পদার্থ সঞ্চিত রাখা ছিল। মুহূর্তকালেই নদীতীরের প্রবল উত্তরের হিমেল বাতাসে আগুন উজ্জ্বলতর হয়ে পারিপার্শ্বিক অন্ধকার ও আকাশকে রাঙিয়ে তুলল। তার অল্পক্ষণের মধ্যেই রাজপুরীর ভিতরে উত্তর-পশ্চিম কোণের প্রাকারের পাশে পিলখানা থেকে নালিবাহকদের গগনভেদী আর্ত চীৎকারের সঙ্গে হস্তীযূথের বৃংহণ ধ্বনিতে দিগ্বিদিক কম্পিত হতে লাগল। দেখা গেল, পিলখানার তৃণ-পত্র নির্মিত আচ্ছাদন থেকে অকস্মাৎ আগুনের শিখা আর ধোঁয়া নির্গত হচ্ছে। অল্পক্ষণের মধ্যেই প্রবল উত্তরের হিমেল বাতাসে আগুনের সর্বগ্রাসী জিহ্বা লকলক করে যেন এককালে সব কিছু ভস্মীভূত করতে চায়। শতাধিক মহাকায় রাজহস্তী বিপদের আভাষে প্রাণভয়ে আলান-স্তম্ভে বাঁধা শিকলগুলি থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য আকুলিবিকুলি করছে। 

হাতি ও নালিবাহকদের আর্ত চীৎকার শুনে মহারাজ গ্রহবর্মা সচকিত হয়ে অলিন্দ থেকে ঝুঁকে নীচের চত্বরের দিকে দৃ্ষ্টিপাত করে মশালচীদের দেখতে পেলেন না, আগুনের লাল আভা ও ধোঁয়ার কটূগন্ধের মধ্যে শুধু মানুষের জটলা। মহারাজ ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকালেন, দেখলেন তাঁর নিজস্ব দেহরক্ষীর পোশাকে তিনজন অচেনা ভিন্ন প্রদেশের মানুষ প্রস্তর-কঠিন মুখে উন্মুক্ত কৃপাণ হাতে দাঁড়িয়ে আছে, তাদের পিছনে অলিন্দের বাইরে আরও কত জন সারিবদ্ধ ভাবে ব্যুহ রচনা করে রেখেছে। তিনি কাপুরুষ বা ভিতু নন, কিন্তু ঘটনার আকস্মিকতায় এই মুহূর্তে তিনি কিংকর্তব্যবিমূঢ় ও নিতান্ত অসহায়। 

অভূতপূর্ব অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় হতবুদ্ধি পুররক্ষীরা কর্তব্যরহিত হয়ে ইতস্ততঃ ছোটাছুটি করছে, তাদের দলপতিরাও সেই সময় যেন তাদের নির্দেশ দিতে ভুলে গিয়েছে। সকলেরই দৃষ্টি এখন সেই এক কোণের পিলখানার বাত্যাহত অগ্ন্যুৎসবের দিকে। ইত্যাবসরে ষড়যন্ত্রকারী ঘরশত্রু পুররক্ষীরা সকলের অলক্ষ্যে রাজপুরীর তোরণদ্বার উন্মুক্ত করে দিতেই বাইরের অপেক্ষারত মালবসেনানী ছদ্মবেশ মুক্ত হয়ে স্বমূর্তি ধারণ করে ভিতরে প্রবেশ করল। কনৌজের সদাবিশ্বস্ত রক্ষী-সৈনিকেরা প্রাসাদ-চবুতরে এমন অকস্মাৎ অগ্নিকাণ্ড ও বহির্শত্রুর আক্রমণের জন্য প্রস্তুত না থাকায় নিসূদকরা অতি সহজেই তাদের পর্যুদস্ত করে নির্বিচারে হত্যা করতে লাগল। 

অন্যদিকে বাইরে মালবের সৈন্যাধ্যক্ষ সুরথের পরিচালনায় মালব-সেনানী কনৌজের মহামাত্য সহ পাত্র-মিত্র, সেনাপতি ইত্যাদি প্রায় সকলকেই তাঁদের নিজস্ব অট্টালিকায় গৃহবন্দী করে রেখে সমস্ত কান্যকুব্জ নগরীর প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল অল্প আয়াসেই করায়ত্ত করে নিল। 

মহারাজ গ্রহবর্মা বুঝলেন তিনি এবং তাঁর রাজপুরী কোন শত্রুরাজ্যের দ্বারা আক্রান্ত, হয়তো বা এতক্ষণে সমস্ত রাজধানীই আগন্তুক শত্রুসৈন্যের করতলগত হয়েছে! প্রিয়তমা পত্নী রাজ্যশ্রীর কথা মনে পড়ল, তিনি এই সময় কি অবস্থায় আছেন! তিনি ও পুরনারীরাও কি শত্রুর হস্তে নিপীড়িতা হচ্ছেন! এই সব জানার জন্য মহারাজ অত্যন্ত ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। তাঁর মনে ক্ষীণ আশা --- বিশ্বস্ত প্রবীণ মহামাত্র, মন্ত্রী, অমাত্যরা ও সেনাপতি এতক্ষণে এদের হাতে বন্দী না হয়ে থাকলে অবশ্যই তাঁকে এবং রাজপুরনারীদের রক্ষা করতে নিশ্চয়ই সংবাদ পাওয়ামাত্র সসৈন্যে ছুটে আসবেন। সশস্ত্র প্রহরীবেষ্টিত বন্দী মহারাজ একান্ত নিরুপায় হয়ে উদ্বিঘ্নচিত্তে পার্শ্ববর্তী আসনে বসে আনতমস্তকে নিজের ইষ্ট দেবতা ভগবান শঙ্করের পাদপদ্ম স্মরণ করে নানাবিধ চিন্তা করতে করতে পরবর্তী ঘটনার জন্য প্রতীক্ষা করতে লাগলেন। 

প্রহর উত্তীর্ণ হয়ে চলল। এক সময় প্রহরীদের মৃদু গুঞ্জনধ্বনি ও লঘু পদশব্দে তাঁর চিন্তা ব্যহত হল। মুখ তুলে দেখলেন তাঁর সামনে গৈরিক বেশধারী এক সৌম্যকান্তি সন্ন্যাসী, সঙ্গে একই পোশাক পরিহিত তাঁর কয়েকজন অনুগামী; প্রহরারত সৈনিকরা সস্মভ্রমে একটু দূরে সরে দাঁড়িয়েছে। এক অসম্ভব আশায় তাঁর শরীরে শিহরণ জাগল। তবে কি দেবাদিদেবের কোন অলৌকিক মায়ায় তিনি বিপন্মুক্ত হতে চলেছেন! 

গ্রহবর্মা আভূমি নত হয়ে সন্ন্যাসীকে প্রণাম করলে তিনি কল্যাণ-আশীর্বাদ না করে মৃদু হাসলেন মাত্র। 

--- দয়া করে আসন গ্রহণ করুন, প্রভু? মহারাজ ভক্তি গদগদ কণ্ঠে বললেন, আমার রাজধানী কোন অজ্ঞাত শত্রুর হাতে আক্রান্ত, এই ঘোর দুঃসময়ে আপনি কি করে শত্রুপরিবৃত রাজপুরীতে প্রবেশ করলেন ভেবে পাচ্ছি না! আপনি কি আমার পরম ইষ্টদেব... 

--- না, আমি তোমার ভগবান শঙ্কর নই, আমি গৌড়াধিপতি শশাঙ্ক, গ্রহবর্মাকে থামিয়ে দিয়ে মেঘমন্দ্র গলায় বললেন সন্ন্যাসী, তোমার রাজ্য, রাজধানী, রাজপুরী এবং তোমার অপরূপা সুন্দরী স্ত্রী ও অন্য পুরনারীরা, সবই এখন গৌড় এবং মালবের অধিকারে, তুমি এখন আমাদের বন্দী। 

--- এ আপনি কি বললেন গৌড়রাজ! বিষাদাচ্ছন্ন কন্ঠে গ্রহবর্মা বললেন, শুনেছি আপনি বীর ও বিদ্বান! সম্মুখ যুদ্ধ না করে কূটযুদ্ধে আমার রাজ্য জয় করেছেন মেনে নিলাম, কিন্তু অন্তঃপুরের নারী ও শিশুদের কোন ক্ষতি নিশ্চয়ই আপনি করবেন না! 

--- “মাতুলো যস্য গোবিন্দঃ পিতা যস্য ধনঞ্জয়ঃ,
সোভিহমন্যুঃ রণে শেতে নিয়তিঃ কেন বাধ্যতে।” 

(শ্রীকৃষ্ণ যার মাতুল, অর্জুন যার পিতা, সেই অভিমন্যুকেও যুদ্ধে নিহত হতে হয়েছিল। নিয়তিকে কে বাধা দিতে পারে? -–চাণক্য) 

গ্রহবর্মার কথার উত্তর না দিয়ে শশাঙ্ক বললেন, এই যুদ্ধে পরাজয় তোমার নিয়তি ছিল রাজা, আমি নিমিত্ত মাত্র। 

গৌড়রাজের কথা শুনে কনৌজরাজ গভীর হতাশায় বাকরুদ্ধ হয়ে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। 

শশাঙ্ক আর কথা না বাড়িয়ে ভ্রুসংকেত করতেই মালবের রক্ষীরা দ্রুত হাতে নিরস্ত্র গ্রহবর্মাকে শৃঙ্খলিত করে সাধারণ বন্দীর মত টেনে নিয়ে চলল। 

সেনাপতি সুরথের আজ্ঞাধীন সৈনিকেরা কনৌজের নগর ও রাজপুরী সম্পূর্ণ অধিকার করার পর মালবরাজ দেবগুপ্ত সদম্ভে রাজদরবারে প্রবেশ করেছেন। তাঁর আদেশে দরবারের সব আলো জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। দেবগুপ্ত পাত্র মিত্র নিয়ে শূন্য রাজসিংহাসনে বসলে সেনাপতি একে একে বন্দী কনৌজের মহামাত্য, মন্ত্রী, অমাত্য প্রভৃতিদের নিয়ে এলেন। মালবরাজ তাদের সঙ্গে সঙ্গে কারাগারে নিক্ষেপ করার আদেশ দিলেন।

চারিদিকে প্রচণ্ড বিশৃঙ্খলা আর মৃত্যু-কাতর চীৎকার ধ্বনির মধ্যে দিয়ে মহারাজ শশাঙ্ক নির্বিকারচিত্তে ধীর পদক্ষেপে তাঁর সন্ন্যাসী বেশী অনুচরদের সমভিব্যাহারে রাজঅন্তঃপুরের দিকে এগিয়ে গেলেন। তাঁর লক্ষ্য মহারাণীর নিবাস কক্ষ। একজন বিশ্বাসঘাতিনী যামচেটি তাঁকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল। দুপাশের দেওয়ালের ভিত্তিস্থ গহ্বরে রাখা আলোকবর্তিকার আলোকে নাতিপ্রশস্থ অলিন্দ-পথটি রহস্যময় আলোছায়ায় ঢাকা। দুই দিকেই সারি সারি অসংখ্য ছোট বড় কক্ষ। প্রতিটি কক্ষেই তখন নারকীয় দৃশ্যের অবতারণা চলছে। যুদ্ধবিজয়ী সৈনিকরা নির্লজ্জ পশুর মত বীর-বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়েছে অন্তঃপুরের নিঃসহায় শতাধিক নারীর ওপর। এটাই যেন তাদের যুদ্ধজয়ের অতিরিক্ত পুরস্কার, আর এ ব্যাপারে সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ কুমারী থেকে ষাটোর্ধ প্রৌঢ়া –- কোন কিছুতেই তাদের অরুচি নেই। কোন কোন কক্ষে দুইজন বলশালী পুরুষ মৃতদেহ ভক্ষণকারী হায়নার বা বন্য কুক্কুরের মতই নারীমাংস পেয়ে উল্লসিত। 

যামচেটি মহারাণী রাজ্যশ্রীর কক্ষদ্বার উন্মুক্ত করলে শশাঙ্ক হাতের ইশারায় অনুচর দেহরক্ষীদের বাইরে অপেক্ষা করতে বলে একাকী ভিতরে প্রবেশ করলেন। ভূলুন্ঠিতা রাজেন্দ্রাণী সন্ন্যাসীবেশী শশাঙ্ককে দেখে একই ভুল করলেন। তিনি অশ্রুসজল নয়নে তাঁকে প্রণাম করে উঠে দাঁড়ালেন। শশাঙ্ক আশীর্বাদের ভঙ্গীতে দক্ষিণ হস্ত সামান্য উত্তোলিত করে বললেন, 

--- হে কল্যাণী, সমগ্র রাজ্য জুড়ে ঘোর দুঃসময়। রাজধানী ও রাজপুরী শত্রু কবলিত হয়েছে। 

--- আপনি কে প্রভু? আর শত্রু অধিকৃত এই পুরীতে আপনিই বা প্রবেশ করলেন কি ভাবে? কৌতূহলী রাজ্যশ্রী না শুধিয়ে পারলেন না। 

--- আমি যোগসিদ্ধ সন্ন্যাসী, কনৌজের হিতৈষী, আমার অগম্য কোন স্থান নেই। 
--- আর আমাদের মহারাজ! তিনি কোথায়? 

--- মহারাজ গ্রহবর্মা শত্রুর হাতে বন্দী, যে কোন মুহূর্তে তারা এখানে পৌঁছে যেতে পারে। 

রাজ্যশ্রী এই সংবাদে বিষাদে-বিস্ময়ে কম্পিত হলেন। তাঁর আঁখিদুটি কজ্জ্বল-কৃষ্ণ দীর্ঘিকার মত অশ্রুজলে ভরে উঠল।

--- এখন রোদনের সময় নেই, দয়া করে গাত্রোত্থান করুন দেবী। শশাঙ্ক স্নেহ-কোমল গলায় বললেন, সম্ভ্রম ও নিজেকে রক্ষা করতে হলে আর এক লহমাও বিলম্ব না করে এই পুরী থেকে প্রস্থান করতে হবে। 

--- কোথায় যাব প্রভু? আমি যে রাজঅন্তঃপুরের বাইরের জগৎ সম্বন্ধে নিতান্তই অজ্ঞ!

--- আমার ওপর ভরসা রাখুন মহারাণী, রাজপুরীর দুজন দাসীকেও আপনার পরিচর্যার জন্য না হয় সঙ্গে নেব। আমার ওই শিষ্যরা আপনাদের নিরাপদে যথাস্থানে অবশ্যই পৌঁছে দেবে। মহারাজও যথাসময়ে বিপন্মুক্ত হয়ে আপনার সঙ্গে মিলিত হবেন, চলুন। 

নিরুপায় রাজ্যশ্রী সন্ন্যাসীবেশী শশাঙ্কের কথায় আর দ্বিরুক্তি না করে তাঁর অনুগামিনী হলেন। 

বন্দীদের বিচারের পর কনৌজ বিজয়ের আনন্দোৎসবের পরিপূর্ণ স্বাদ নিতে দেবগুপ্ত এলেন জলসা ঘরে। তাঁর বশংবদ অনুচরেরা মহারাজের শখের ব্যাপারে যথেষ্ট যত্নবান। এরই মধ্যে তারা রাজঅন্তঃপুরের সদ্য বন্দিণী তিনজন সদ্যযুবতী কুমারীকে বেছে নিয়ে এসেছে তাঁর সম্ভোগের জন্য। মৈথুন-ভীত কিশোরী নারীকন্ঠের আর্তস্বর তাঁকে সর্বদাই কিছু বিশেষ তৃপ্তি দেয়। 

মধ্যরাত্রে যথেচ্ছ সুরা সহযোগে নিজের লালসা চরিতার্থ করে রতিতৃপ্ত মালবরাজ দেবগুপ্ত গ্রহবর্মার বন্দী-কক্ষটিতে প্রবেশ করলেন। তাঁর হাতে উন্মুক্ত কৃপাণ। তাঁর দুইচক্ষু ঘোর রক্তবর্ণ, মুখ মণ্ডল সুরাপানে ও হিংস্রতায় রক্তিম, পুরু ঠোঁটের কোন থেকে গাঢ় রক্তধারার মত তাম্বুলরস গড়িয়ে পড়ছে। তাঁর সেই ভীষণ দানবীয় রূপ দেখে প্রহরারত সৈনিকদেরও হৃৎকম্প হল। 

গ্রহবর্মার হাতদুটি শৃঙ্খলাবদ্ধ, দুজন অসুরাকৃতি সৈনিক তাকে বজ্র-কঠিন বাহুপাশে ধরে রেখেছে। দেবগুপ্ত সামনে এসে দাঁড়ালে গ্রহবর্মা তাঁর চোখের মণিতে সাক্ষাৎ মৃত্যুর প্রতিবিম্ব প্রত্যক্ষ করলেন। অসহায় নিরস্ত্র কনৌজরাজ চোখ বুজে পিতৃমাতৃ পাদপদ্ম স্মরণ করলেন, বন্ধ আঁখির সামনে ভেসে উঠল প্রিয়তমা পত্নী রাজ্যশ্রীর প্রেমময়ী মুখখানি।

মালবরাজ দেবগুপ্তর তাম্বুলরঞ্জিত দাঁতের ফাঁকে নির্মম হাসি খেলে গেল, তিনি অত্যন্ত নির্দয়তায় হাতের উন্মুক্ত কৃপাণ আমূল বসিয়ে দিলেন গ্রহবর্মার বুকে। কর্তিত সর্জবৃক্ষের মত পাষাণ মেঝেতে হাঁটু ভেঙ্গে পড়ে গেল কনৌজরাজের দেবকান্তি শরীর। প্রাসাদের প্রস্তরে প্রস্তরে ধ্বনিত হতে লাগল তাঁর অন্তিম আর্ত চীৎকার আর দেবগুপ্তের খলখল নিষ্ঠুর হাসি। 

*******************************************************************************************

কনৌজের রাজপ্রাসাদ থেকে বহু দূরে একটি অতি সাধারণ দ্বিতল কাঠের অট্টালিকা। চারিদিক ঘিরে দু-মানুষ সমান উঁচু প্রাচীর। দ্বিতলে একটি কক্ষ-সংলগ্ন অলিন্দে দাঁড়িয়ে আছেন কান্যকুব্জের একদা মহারাণী রাজ্যশ্রী। তাঁর মুখে বিষাদের গাঢ় প্রলেপ, অবিরাম অশ্রুপাতে চোখদুটিও রক্তাভ। শূন্য দৃষ্টি মেলে তিনি চেয়ে আছেন দূরের ধূসর নাতিউচ্চ পাহাড়শ্রেণীর দিকে। সেখানে ক্লান্ত সূর্য দিনশেষের রঙের খেলা শেষ করে রাত্রির আশ্রয়ে যাবার পথে। 

গত সপ্তাহকাল ধরে রাজ্যশ্রী প্রতিদিনই এই সময়ে এখানে এসে দাঁড়ান। স্বল্প পরিসর এই অলিন্দটি ছাড়া অন্য কোথাও যাবার সাধ্যও তাঁর নেই। কক্ষের একটি মাত্র প্রবেশপথের কপাট সারাদিনই অর্গলরুদ্ধ থাকে। একজন মাত্র মধ্য বয়স্কা পরিচারিকা দিনে কয়েকবার আসে, সে বেশ বলশালিনী এবং তার গম্ভীর মুখে সব সময় এক রূক্ষ কাঠিন্য ফুটে থাকে। আজ অবধি তার সঙ্গে একটিও বাক্য বিনিময় হয়নি রাজ্যশ্রীর। 

পাহাড়ের পিছনে সূর্য মুখ লুকালেও তার রক্তিম আভা তখনও ছড়িয়ে রয়েছে পশ্চিম আকাশ জুড়ে; সেদিকে দেখতে দেখতে রাজ্যশ্রী দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ওই দিকেই কনৌজ। তাঁর স্বামী মৌখরিরাজ গ্রহবর্মার রাজ্য ও রাজধানী, আর তিনি সেই রাজ্যের পাটরাণী। কিন্তু হায়! আজ তিনি একজন সামান্যা বন্দিনী মাত্র। 

অলিন্দের নিচে অনেকখানি জায়গা জুড়ে ফুলের বাগান, প্রাচীরের ধারে ধারে সারিবদ্ধ অনেকগুলি গুবাক ও দেবদারু গাছ। রাজ্যশ্রী দৃষ্টি নামিয়ে সেদিকে তাকালেন। নীচে মখমলের মত সবুজ ঘাসে ঢাকা প্রাঙ্গণ, বাগিচায় অজস্র ফুলের সমারোহ, আকাশ পথে নীড়ে ফেরা বলাকার কলকাকলি --- কিছুই তাঁর মনে রেখাপাত করছে না, অশ্রুভেজা আয়ত চোখদুটি কাতরভাবে অন্য কিছুর অন্বেষণ করছে। 

নগরী থেকে বিচ্ছিন্ন এই বাড়িটিতে বন্দিনী হয়ে আসার পর থেকেই একটি শ্যামলা রঙের যুবককে দেখছেন তিনি। সে সারাদিনই বাগানের গাছগুলির পরিচর্যায় ব্যস্ত থাকে। সন্ধ্যার আগে রাজ্যশ্রী অলিন্দে এসে দাঁড়ালে শ্রমক্লান্ত যুবকটি নীচে থেকে নীরবে একটু হাসে, তার হাসিটিও বাগিচার ফুলগুলির মতই নিষ্পাপ। বন্দিনী অথচ রাজকীয় এই রমণীকে সে ভয় বা লজ্জা পায় না। দিনান্তে ঘরে ফেরার সময় একটি রক্তগোলাপ ছুঁড়ে দিয়ে যায়। রাজ্যশ্রীর বন্দী জীবনে সেই ফুলটি সামান্য কিছু মুহূর্তের জন্য হলেও এই নিষ্ঠুর পৃথিবীর প্রতি ভালবাসা উদ্রেক করে। আসন্ন রাত্রির অন্ধকার ধীরে ধীরে সমস্ত চরাচর গ্রাস করছে, কিন্তু আজ আর সেই মালঞ্চের মালাকারকে দেখতে পেলেন না রাজ্যশ্রী। দূরের রাজদেবালয় থেকে সন্ধ্যারতির শঙ্খ-ঘন্টাধ্বনি ভেসে এল, রাজ্যশ্রী কক্ষে ফিরে এলেন। তখনও পরিচারিকা এসে কক্ষের দীপাধারে দীপগুলি জ্বেলে দিয়ে যায়নি। আর একটি কৃষ্ণপক্ষের রাত্রির সূচনা হল রাজ্যশ্রীর তমসাচ্ছন্ন জীবনে। 

কপাট খোলার শব্দ হল। পরিচারিকা এসে কক্ষের বাতিদানের আলোকবর্তিকাগুলি জ্বেলে দিল। রাজ্যশ্রী লক্ষ্য করলেন আজ তার সঙ্গে অন্য আর একটি প্রায় তাঁরই সমবয়সী মেয়ে রয়েছে। তার হাতে একটি তামার রেকাবীতে মহার্ঘ পোশাক ও অলঙ্কারের স্তুপ। বয়স্কা পরিচারিকাটি তার স্বভাবসিদ্ধ যান্ত্রিক গলায় বলল, --- মহারাণী, মহারাজ দেবগুপ্ত আপনাকে অভিবাদন জানিয়ে এই উপহারগুলি পাঠিয়েছেন, আপনি এগুলি গ্রহণ করলে মহারাজ সন্তুষ্ট হবেন। আজ রাত্রির দ্বিতীয় প্রহরে তিনি আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসবেন; হয়ত রাত্রিযাপনও করবেন। দয়া করে এই পোশাক ও অলঙ্কারে নিজেকে রাজদর্শনের উপযুক্ত করে সাজিয়ে তুলুন। আমরা তাঁর নির্দেশ মত আপনাকে সাজিয়ে দিয়ে যাব। 

রাজ্যশ্রী একটুও বিস্মিত হলেন না। তাঁর নিষ্কলঙ্ক জীবনে এই কলঙ্কময় রাত্রি যে একদিন আসবেই তা তিনি জানতেন। মুখে ঈষৎ ব্যাঙ্গের হাসি ফুটিয়ে বললেন, --- আমি আর মহারাণী নই, মালবরাজের হাতে বন্দিনী সামান্যা এক নারী মাত্র। শুনেছি রাজধানী উজ্জয়িনীর রাজপ্রাসাদে কয়েকশো সুন্দরী আছে, তাদের যে কোন কাউকে এই পোশাক ও অলঙ্কারে সাজিয়ে তোমাদের মহারাজ এগুলির শিল্প সুষমা উপভোগ করতে পারতেন! আমার ওপর তাঁর এই অযাচিত অনুগ্রহ না থাকলেই খুশি হতাম। 

--- দেবী, আমরা দাসী মাত্র, পরিচারিকাটি আগের মতই সসম্ভ্রমে বলল, রাজার আদেশ পালন করাই আমাদের একমাত্র কাজ। তাছাড়া আপনি তো ভাল করেই জানেন, রাজ-অন্তঃপুরের কোন নারী বা বন্দিনীর ইচ্ছা বা অনিচ্ছার কোন মূল্যই নেই। 

সামান্যা এক পরিচারিকার মুখে এমন চরম সত্য শুনে রাজ্যশ্রী স্তব্ধ হয়ে তাঁর মতি-দন্তে অধর দংশন করে অতি কষ্টে উদ্গত অশ্রু সংবরণ করে বললেন, --- তা ঠিক, পুত্তলিকার তো শরীর বা মন থাকতে নেই, সে তো ক্রীড়কের হাতে একটি ক্রীড়ণক বই কিছু নয়! তাছাড়া রাজার ইচ্ছাই তাঁর আদেশ। ঠিক আছে, তোমরা তোমাদের মহারাজের পছন্দ মত আমাকে যেমন খুশি সাজাতে পার, আমি প্রস্তুত। 

রাজ্যশ্রী ধীর পদক্ষেপে কক্ষ-সংলগ্ন স্নানাগারের দিকে এগিয়ে গেলেন। স্নানান্তে ফিরে এলে দাসীরা এক দণ্ড ধরে সুগন্ধি ধূপের ধোঁয়ায় তাঁর নিশীথের জলপ্রপাতের মত আনিতম্ব কেশরাশি সুগন্ধিত করল, তারপর কস্তুরী, চন্দন ইত্যাদি নানা উপাচারে তাঁর বরতনু প্রসাধিত করে নূতন পোশাকে ও অলঙ্কারে সাজিয়ে তুলল। এতক্ষণ তিনি একটি প্রস্তর মূর্তির মত নিজেকে তাদের হাতে সমর্পণ করে চুপ করে বসে রইলেন। লক্ষ্য করলেন তাঁর পরণের পোশাকগুলি রত্নখচিত অত্যন্ত মিহি মসলিনের নেত্রবাস, সেগুলি যেমন সংক্ষিপ্ত তেমনই কামনা উদ্রেককারী। তবুও তিনি কিছুই বললেন না। প্রসাধনচর্চিতা ও বহুমূল্য পোশাক-অলঙ্কারে শোভিতা আলোকসামান্যা নারীটির রূপ যেন শতগুণে বর্ধিত হল। 

রাজ্যশ্রীর সজ্জা শেষ হলে যুবতী পরিচারিকাকে প্রসাধন দ্রব্য, পরিত্যক্ত পোশাক প্রভৃতি গুছিয়ে নেবার নির্দেশ দিয়ে বয়স্কা পরিচারিকা বেরিয়ে গেল। এই মেয়েটি এতক্ষণ কোন কথা বলেনি। হঠাৎ সে অত্যন্ত সপ্রতিভ ভঙ্গিতে দ্রুত বাইরেটা দেখে এসে চাপা স্বরে বলল,

--- মহারাণী আমি অন্তরা। আজকের রাত্রির তৃতীয় প্রহর অবধি যে ভাবেই হোক মহারাজের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করবেন, আর চতুর্থ প্রহরে সজাগ থাকবেন। একটা কথা মনে রাখবেন, মালবরাজ অত্যন্ত সুরাপ্রিয়, কিন্তু অত্যধিক মাত্রায় পান করলে জ্ঞানহীন হয়ে পড়েন, তখন আর কোন ক্ষমতাই অবশিষ্ট থাকেনা তাঁর। 

ওর এই আকস্মিক আচরণে ও কথায় স্তম্ভিত হয়ে শুধু মাথা নাড়লেন। কক্ষের বাইরে কাঠের সোপানে পদশব্দ শোনা গেল; অন্তরা দূরে সরে গিয়ে নির্বিকার মুখে কক্ষটির মার্জনায় ও সজ্জা-সামগ্রী গোছাতে মনোনিবেশ করল। বয়স্কা পরিচারিকাটি প্রচুর ফুলের স্তবক, মালা, সুগন্ধি দ্রব্য ইত্যাদি নিয়ে আবার ফিরে এলো, তারপর সেগুলি দিয়ে দুজনে রাজ্যশ্রীর কারাগার-কক্ষটিকে সুন্দর করে সাজিয়ে সুগন্ধি ধূপ জ্বেলে দিয়ে বিদায় নিল। অন্তরার চোখের ইশারা রাজ্যশ্রীর নজর এড়ালো না। ওরা যাবার আগে কক্ষটিকে অর্গলরুদ্ধ করতে ভুলল না। সালঙ্কারা রাজ্যশ্রী পাথর-প্রতিমার মত পালঙ্কের বাজুতে হেলান দিয়ে বসে আসন্ন নিদারুণ সময়টির জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। 




(ক্রমশঃ প্রকাশ্য) 











1 comment:

  1. Bhison bhalo lagche porte porte sei somoe pouche gechi chhobir maton sab kichu chokher samne dekhte pachhi upolobdhi korte parchi apurbo agami sankhar jonyo adhir agrohe apekhae roilam.

    ReplyDelete