5

প্রাচীন কথাঃ সুস্মিতা বসু সিং

Posted in

প্রাচীন কথা


সুরগর্ভা 
সুস্মিতা বসু সিং


রাজা কুন্তিভোজের প্রাসাদে আতিথ্য গ্রহণ করলেন প্রখরস্বভাব মুনিপ্রবর দুর্বাসা। উগ্রচণ্ডা, হঠাৎক্রোধী, অভিশাপপ্রবণ এই মুনির আতিথেয়তার গুরু দায়িত্ব পড়ল পালিতা কন্যা পৃথার উপর। রাজা কন্যাকে সতর্ক করলেন - কন্যার কোমল অথচ কর্তব্যনিষ্ঠ স্বভাবের বর্ণনা করার পরে তিনি কুন্তীর জন্ম পরিচয় উল্লেখ করে তাঁকে অনেক প্রশংসা করলেন। কিন্তু অবশেষে একথা স্মরণ করিয়ে দিতেও ভুললেন না যে, শূরনন্দিনী পৃথার হাতেই এখন রাজা কুন্তিভোজের সম্মান রক্ষার দায়িত্ব। লক্ষণীয়, এক্ষণে রাজা কুন্তীকে ‘শূরনন্দিনী পৃথা’ নামে সম্বোধন করেছেন। অর্থাৎ, অগৌরবের কারণ যদি কিছু ঘটে, তবে তা মহারাজ শূরকেও স্পর্শ করবে। এ যেন পিতার সতর্কীকরণ নয়, রাজার আদেশ ।। 

কে এই পৃথা বা কুন্তী? কি তাঁর জন্ম পরিচয়? পৃথা জন্মসূত্রে যাদবী, মহারাজ শূরের প্রথমা কন্যা, মহামতি বসুদেবের ভগিনী, সেই সূত্রে কৃষ্ণের পিতৃস্বসা। মহাভারত মতে, রাজা শূরের আপন পিসতুত ভাই ছিলেন মহারাজ কুন্তিভোজ। যদিও হরিবংশে এর কোনও উল্লেখ নেই। হরিবংশ মতে, মহারাজ শূরের প্রথম সন্তান ছিলেন কৃষ্ণপিতা বসুদেব। অথচ মহাভারত বলছে - প্রৌঢ়, নিঃসন্তান রাজা কুন্তিভোজকে নিজের প্রথম সন্তানকে দান করবেন – এই মর্মে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন মহারাজ শূর। এই প্রতিজ্ঞা অবশ্য নিঃসন্তান রাজার মনঃকষ্ট মোচনের হেতু-প্রসূত বলেই অনুমিত হয়। এদিকে, মহাভারতেরই উদ্‌যোগ পর্বে বৃষ্ণিবংশাবতংস জনার্দ্দন কৃষ্ণের কাছে নিজের ভাগ্যের প্রতি দোষারোপ করে পৃথা বলেছেন, অতিশয় ধনবান ব্যক্তি যেমন ধন দান করে তৃপ্তি লাভ করেন, পর্যাপ্ত সন্তান-ধনে ধনী মহারাজ শূর-ও তেমনই পুতুল খেলার বয়সেই কন্যাকে দান করেছিলেন, দাতা হিসাবে খ্যাতি অর্জনের অভিলাষেই। অর্থাৎ, প্রথম সন্তান বা প্রথম কন্যা সন্তান - পৃথা যাই হোন না কেন, একেবারে জন্ম-মুহূর্তেই তাঁকে দান করা হয় নি। 

যদি হরিবংশ মানি, চিন্তার অবকাশ ঠিক এইখানেই। মহারাজ শূরের পর্যাপ্ত সন্তান কুলের মধ্যে বসুদেব ছাড়াও একাধিক পুত্র সন্তানও ছিলেন। তবে দানের বেলায় কন্যা সন্তান কেন? উত্তরটা পৃথা নিজেই দিয়েছেন। সেই যুগেও টাকা পয়সার মতনই কন্যা সন্তানকেও সম্পত্তি বলেই গণ্য করা হতো। উল্লেখ্য, আজ থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগে প্রকাশ্যে পৃথার এই অসন্তোষ প্রকাশ তাঁকে যুগপৎ প্রবল মর্যাদাময়ী, আত্মসচেতন ও অত্যন্ত আধুনিক এক চরিত্রের গৌরব প্রদান করে, সন্দেহ নেই। 

এই শূরনন্দিনী পৃথা কুন্তিভোজের রাজাঅন্তঃপুরে এসে কুন্তী নামে পরিচিতা হলেন। এখানে কুন্তী যে আপন মর্যাদায় এবং বিশেষত নিজের জন্মদাতা পিতার প্রতি অভিমানে কিছুটা একান্তচারিণী এবং অবশ্যই রাজপরিবারের রমণীকুল পরিবৃতা ছিলেন না, তার প্রমাণ ভবিষ্যতেও পাওয়া যায়। 

পরিস্থিতি যাই হোক, রাজাজ্ঞা পালিত হলো অক্ষরে অক্ষরে। মহর্ষি দুর্বাসা সন্তুষ্ট হলেন। অলোকসামান্যা রূপবতী কুমারী কুন্তীকে ইচ্ছামত দেব-সঙ্গমের মন্ত্র বর দিলেন মুনিশ্রেষ্ঠ। এখানেই আবার প্রশ্নের ঝড় ওঠে। যে কাজে প্রতি মুহূর্তে স্খলনের সম্ভাবনা, অভিশম্পাত আর মর্যাদাহানির শঙ্কা, সে কাজে কোমলমতি, অনভিজ্ঞা, কুমারী কন্যা কুন্তীই কেন? রাজ অন্তঃপুরে কি আর কেউ ছিলেন না, যাঁকে এই দুরূহ দায়িত্ব দেওয়া যেত? রাজার নিজের সন্তান হলেও কি এ দায়িত্ব কুন্তীকেই পালন করতে হতো? রাজার সম্মান রক্ষার্থে দুর্বাসাকে ঠিক কিভাবে এবং কতটা সন্তুষ্ট করেছিলেন কুন্তী? দুর্বাসাই বা এমন অদ্ভুত বর দিতে গেলেন কেন? 

কুন্তীর সেবায় সন্তুষ্ট দুর্বাসা বর দান করে চলে গেলেন। বিপত্তির সূত্রপাত এখানেই। দুর্বাসা দেব-সঙ্গমের রহস্যমন্ত্র সদ্য যৌবনবতী কুন্তীকে শিখিয়ে দিয়ে চলে যেতেই কুন্তীর কুমারী হৃদয়ের অজ্ঞতা, চঞ্চলতা ও কৌতূহলপ্রিয়তা তাঁকে অস্থির করে তুলল। তিনি কিছুতেই সম্বরণ করতে পারলেন না মন্ত্রের বলাবল পরখ করার প্রবল বাসনা। 

বালখিল্য চপলতায়, একদিন প্রত্যুষে রাজান্তঃপুরের পুষ্প শয্যায় শায়িতা পুষ্পবতী কুন্তী নবোদিত কোমল কিরণময় ত্বিষাম্পতি সূর্যকে আহ্বান করলেন মন্ত্রবলে। মুহূর্তে মূর্তমান হলেন আদিত্যদেব। নম্র সম্ভাষণে কুন্তীর আনুগত্য স্বীকার করলেন, মন্ত্রের শর্ত অনুযায়ী। কিন্তু এই অনুগতভাব তিরোহিত হলো, যখন কুন্তী তাঁকে ফিরে যেতে বললেন। 

দেবপুরুষ হাতের কাছে কৃশকটি, অলসগমন, মধুর হাস্যময়ী, সদ্য যৌবনবতী, সুন্দরী কুন্তীকে পেয়ে অস্থির হয়ে উঠলেন। আসলে সূর্যও নিরুপায়। মন্ত্রের শর্ত অনুযায়ীই একবার মন্ত্রবলে কোনও দেবপুরুষ আহূত হলে পরবর্তী পর্যায়ে সঙ্গম এবং পুত্রলাভও ছিল নিতান্তই অনিবার্য, বর প্রদান কালে মহামুনি দুর্বাসা এ বিষয়ে সতর্কও করেছিলেন কুন্তীকে। সেই কারণেই, কুন্তীর শত অনুনয় উপেক্ষা করে এক দীর্ঘ বচসার পর নিজেকে আর দমিত রাখতে পারলেন না সূর্য। স্পষ্টতঃই তিনি কুন্তীকে লোকলজ্জা ও অভিশাপ প্রদানের ভয় প্রদর্শন করে কুন্তীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে সঙ্গমে প্রবৃত্ত হলেন, স্পর্শ করলেন কুন্তীর নাভিদেশ।। 

প্রবল পুরুষের মৈথুন মুখরতায় যৌবন শোভার আধার কুন্তী মোহাবিষ্টা লতার মতন সংজ্ঞা হারিয়েছেন। আর দুর্ধর্ষ সূর্য সঙ্গম সম্পন্ন করে অচৈতন্য কুন্তীকে ফেলে রেখে ফিরে গেছেন। জন্ম হয়েছে কর্ণের।। 

কে এই সূর্য? দেবতা? সে যুগে দেবতা বলতে কাদের বোঝান হতো? দুর্বাসার শেখানো কুন্তীর মন্ত্রটাই বা কি ছিল? সূর্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে মহাভারতের কবি প্রবল পরাক্রমী কন্দর্পকান্তি প্রখর তেজস্বী এক পুরুষের কথাই বলেছেন। সূর্য সম্ভবত পৃথিবীর প্রত্যন্ত উত্তর মহাদেশীয় উন্নততর সভ্য জনজাতি বা সুমেরু সভ্যতা নামে যে সভ্যতা পরিচিত - সেই সভ্যতার, অথবা মধ্য এশিয়া থেকে আগত কোনও সুসভ্য জনগোষ্ঠির প্রতিনিধি হতে পারেন। অথবা প্রখ্যাত সুইস অথার এরিখ ভন দানিকেন-এর মত মেনে নিলে, এঁরাই সেই বহির্বিশ্ব থেকে আগত অতি মানবেরা, যাঁরা ছিলেন প্রযুক্তিগতভাবে উন্নততর, আকৃতিগত ভাবে বৃহদাকায় এবং প্রথাগতভাবে সুদর্শন। এই জনগোষ্ঠি সম্ভবত হিমালয়ের আশেপাশে বা অপর প্রান্তের কোনও প্রত্যন্ত অঞ্চলে উপনিবেশ স্থাপন করে বসবাস করতেন, পরিব্রাজক মুনিশ্রেষ্ঠ দুর্বাসা তাঁর প্রব্রজ্যাকালে যাঁদের সংস্পর্শে এসেছিলেন, এবং অবশ্যই কুন্তীর ‘সেবা’য় সন্তুষ্ট হয়ে এঁদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের সহজতর, উন্নততর কোনও পদ্ধতি তিনি কুন্তীকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন। পরবর্তী কালে এঁদের সঙ্গেই একাধিক বার সঙ্গমে লিপ্ত হয়েছেন কুন্তী, তখন অবশ্য সকলের অজ্ঞাতে নয়। আর এই ঘটনা থেকেই সম্ভবত অনুমান করা যায়, কুন্তীর ঠিক কোন জাতীয় ‘সেবা’য় কোপনস্বভাব মুনিবর ঠিক কতটা সন্তুষ্ট হয়েছিলেন। 

প্রসঙ্গত লক্ষণীয়, রাজকন্যা কুন্তী রাজঅন্তঃপুরের অভ্যন্তরেই বহিরাগত এক বৈদেশিক পুরুষদ্বারা উপগতা হলেন, গর্ভধারণও করলেন এবং অবশেষে এক পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়ে তাকে নদীর জলে ভাসিয়ে দিলেন একমাত্র এক ধাত্রীর সহায়তায়। আর এই সমগ্র প্রক্রিয়াটিই ঘটে গেল লোকচক্ষুর সম্পূর্ণ অন্তরালে, যা অবশ্যই রাজঅন্তঃপুরে কুন্তীর অভিভাবক স্থানীয়া নারী সঙ্গ-বিবর্জিতা নির্জনচারিণী তত্ত্বকেই সুপ্রতিষ্ঠিতও করে বটে। আসলে মহারাজ কুন্তিভোজ পৃথাকে দত্তক নিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু তাঁকে সমগ্ররূপে আত্মীকরণ করতে পারেন নি।

অন্যদিকে তখন এই বিশেষ ‘বর’প্রাপ্তা যাদবী কন্যাটির কথাই ঋষিশ্রেষ্ঠ ব্যাসদেব কুরুকুলপতি ভীষ্মকে অবগত করেছেন, নিজের সন্তান-উৎপাদন-ক্ষমতা-রহিত মধ্যম পুত্রটির প্রতি মমত্ববোধেই সম্ভবত। যার অবশ্যম্ভাবী ফল স্বরূপ কিছুদিনের মধ্যেই এক খেলা খেলা স্বয়ংবরে পাণ্ডুকে বিবাহ করে কুরুকুলবধূ হিসাবে হস্তিনাপুরে এসেছেন কুন্তী। কিন্তু স্বামীর ঔরসবীজ ব্যতিরেকেই যে রমণী সন্তান লাভে সক্ষম, তাঁর অহঙ্কারকে নিয়ন্ত্রণে রাখার উদ্দেশ্যেই মদ্রদেশ থেকে কন্যাপণ দিয়ে অপার সুন্দরী মাদ্রীকে পাণ্ডুর দ্বিতীয়া স্ত্রী হিসাবে নিয়ে এসেছেন কুরুকুলশ্রেষ্ঠ মহামতি ভীষ্ম প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। ভীষ্মের এই গূঢ় মনস্তত্ত্ব বুঝতে ভুল হয়নি কুন্তীর, এবং এই ঘটনাকে অন্যায় বলে চিহ্নিত করে তিনি তাঁর ক্ষোভ প্রকাশও করেছেন পার্থসারথি বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণের কাছে, সেই উদ্‌যোগ পর্বে কথোপকথন কালে।

বিবাহিত জীবনেও কুন্তী শান্তি লাভ করেন নি। মাদ্রীর সঙ্গেও তাঁর সম্পর্ক কখনই খুব সহজ ছিল না। অধিক সুন্দরী কনিষ্ঠা পত্নীর প্রতি পাণ্ডুর পক্ষপাতই দুই সপত্নীর সম্পর্ককে সহজ হতে দেয়নি কোনও দিনই। কিন্তু জ্যেষ্ঠা সপত্নী হিসাবে ব্যক্তিত্বময়ী কুন্তীর কনিষ্ঠার প্রতি যে সখীত্বভাব বজায় রাখা দস্তুর ছিল, তারও ব্যত্যয় হয়নি কখনও। অন্য দিকে, দুই সদ্য বিবাহিতা সুন্দরী, যৌবনবতী পত্নীর সঙ্গে মাত্র তিরিশটি বিহার-রজনী অতিবাহিত করার পরই পাণ্ডুর দীর্ঘ দিনের জন্য দিগ্বিজয়ে চলে যাওয়া, সেখান থেকে ফিরে এসেই পত্নীদের সঙ্গে নিয়েই বনবাসের ইচ্ছা প্রকাশ করা এবং সেখানে গিয়ে অধিক সময় মৃগয়ায় ব্যস্ত থাকা - এ সমস্তই আসলে স্ত্রীদের কাছ থেকে তাঁর আপন অক্ষমতা গোপন করার প্রয়াস-প্রসূত, এবং অবশেষে মৃগ মুনি কিন্দমের অভিশাপই যে প্রকারান্তরে বর হিসাবে তাঁকে এই আত্মগ্লানি থেকে মুক্তি দিয়েছে, এ কথা বুঝতে অসুবিধে হয় না। 

মৃগ মুনি কিন্দমের অভিশাপে পাণ্ডু সত্যিই স্বস্তি লাভ করেছিলেন। সহধর্মচারী দুই পত্নীকে সঙ্গে নিয়ে হোম-যজ্ঞ, তপস্যা ও বনচারী ঋষিদের সঙ্গে শাস্ত্র এবং ধর্মালোচনা করে সসম্মানেই দিন কাটছিল তাঁর। জ্যেষ্ঠা পত্নী কুন্তী স্বামীর জীবন রক্ষার দায়িত্বে পক্ষী মাতার মতন সতর্ক ও যত্নশীলা। এতটুকু স্খলন সেখানে সম্ভব ছিল না। কিন্তু পাণ্ডুর অচরিতার্থ সম্ভোগেচ্ছা এক মুহূর্তে সমস্ত প্রেক্ষাপটই বদলে দিয়েছে। কুন্তীর বদান্যতায় ও দেবতাকুলের অনুগ্রহে পাঁচ সন্তান লাভের পর একদিন যখন শতশৃঙ্গ পর্বতে চৈত্রশেষের নিদারুণ প্রহরে বসন্তের বাতাস উঠল প্রবল হয়ে, কামাসক্ত পাণ্ডুর দুর্নিবার মৈথুন-লিপ্সা উত্তাল হলো তাঁর শোণিত স্রোতে। এবং অভিশাপের শর্ত অনুযায়ী সঙ্গম-মুহূর্তেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করলেন তিনি। নিমিত্ত হয়ে রইলেন কনিষ্ঠা পত্নী মাদ্রী। 

জ্যেষ্ঠা পত্নী হিসাবে কুন্তী সহমরণে যাওয়ার দাবী রাখলেন। যদিও সহমরণ বলতে যে বীভৎসতার স্মৃতিতে চিত্ত আতঙ্কিত হয়, তেমন সহমরণের কোনও প্রামাণ্য মহাভারতে নেই। অজস্র বচসার পর অবশেষে সে অধিকার স্বেচ্ছায় ত্যাগ করেছেন কুন্তী মাত্র দুটি কারণে। বচসাকালে কথা প্রসঙ্গে মাদ্রী কুন্তীকে জানান তিনি কখনই সপত্নীসন্তানদের সমদৃষ্টিতে দেখতে পারবেন না। প্রখর বাস্তববুদ্ধিসম্পন্না ব্যক্তিত্বময়ী নারী কুন্তী মুহূর্তে স্থির করেন তাঁর আশু ভবিষ্যৎ কর্তব্য। পরিত্যাগ করেন সহমরণের ইচ্ছা, পরিবর্তে সন্তানদের প্রতিপালন করার দায়িত্বই বেছে নেন তিনি। এটিই প্রথম ও প্রধান কারণ। আর দ্বিতীয় কারণটি অবশ্যই কুন্তীর মানসিক অন্তর্দ্বন্দ্ব জাত। বিবাহের পরে কখনই তিনি স্বামীকে একা পান নি, স্বামীও কনিষ্ঠা পত্নীকেই আজীবন অধিক প্রশ্রয়ই দিয়েছেন। স্বামীকে ভালবাসার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন তিনি, তবে শুষ্ক কর্তব্যের তাড়নাই ছিল সেখানে অধিক। কিন্তু আজ সেই কর্তব্যের তাড়নাতেও আপন সন্তানদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মূল্যে সম্ভোগ-রসিক এই স্বামীর জন্য প্রাণ বিসর্জন দেওয়াকে অপ্রয়োজনীয় মনে করেছেন কুন্তী। 

স্বামী ও সপত্নীর মৃত্যুর পর কুন্তী পাঁচ পিতৃহারা পুত্রকে নিয়ে ফিরে এসেছেন রাজধানী হস্তিনাপুরে। সেখানে ধৃতরাষ্ট্র নিজের কনিষ্ঠ ভ্রাতা, মহারাজ পাণ্ডু ও তাঁর সহমৃতা কনিষ্ঠা পত্নী মাদ্রীর পারলৌকিক আদ্যশ্রাদ্ধ সুসম্পন্ন করেছেন মহা সমারোহেই, কিন্তু কুন্তী ও তাঁর সন্তানদের রাজকীয় মর্যাদায় পুনঃপ্রতিষ্ঠা দেননি কোনও মতেই। পদে পদে তাঁর কিশোর পঞ্চ পুত্র আক্রান্ত হয়েছে বারংবার, যার চরম সীমায় ভীমসেনকে বিষ প্রয়োগের মতন ঘটনাও সংঘটিত হয়েছে সেই শত্রুপুরীতে। এই বিপদের দিনে এহেন পরবাসের প্রতিকূল পরিস্থিতিতে মহামতি বিদুরের মধ্যে কুন্তী খুঁজে পেয়েছেন তাঁর একমাত্র হিতাকাঙ্খী পরম বন্ধুটিকে। অচিরেই দুই মনস্বী নরনারীর মধ্যে গড়ে উঠেছে পারস্পরিক নিবিড় শ্রদ্ধা ও পরম নির্ভরতার এক নিটোল সম্পর্ক, মাধুর্যে ও সৌকর্যে যা রসোত্তীর্ণতা লাভ করেছে অবলীলায়। 

মনস্বিনী কুন্তীর জীবনের স্মরণীয় ঘটনাগুলির মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য ঘটনাটি ঘটে গিয়েছে এরই কিছুদিনের মধ্যে। রাজপুত্রদের অস্ত্রপরীক্ষার দিন তিনি আকস্মিক ভাবেই পুনরায় আবিষ্কার করেছেন তাঁর প্রথমজন্মা কানীন পুত্র বসুষেণ কর্ণকে। সেখানে কর্ণকে অঙ্গরাজ্যে অভিষিক্ত করে একই সঙ্গে মাতা-পুত্র দুজনকেই চির কৃতজ্ঞতা-পাশে আবদ্ধ করেছেন রাজপুত্র দুর্যোধন। কুন্তীর অন্তরের গভীর অন্তঃস্থল থেকে স্বতোঃৎসারিত অজস্র স্নেহাশিস ধারায় সিক্ত স্নাত হয়েছেন তিনি। হোক পাণ্ডবদের পরম শত্রু, তবুও তো তাঁরই আয়োজনে কুন্তীর অনাকাঙ্খিত বঞ্চিত প্রথম পুত্রটিই রাজপুত্রদের মধ্যে সকলের আগে রাজা হয়েছেন! -দুর্যোধনের এই অবদান কুন্তীর কাছে অপরিশোধযোগ্য, যা তিনি কৃতজ্ঞচিত্তে সম্পূর্ণ জীবন স্মরণে রেখেছেন। এবং যার অবশ্যম্ভাবী ফলস্বরূপ সমগ্র মহাভারতে সমস্ত গর্হিত অপরাধের মূল নায়ক জানা সত্ত্বেও দুর্যোধনের বিরুদ্ধে একটিও সোচ্চার কটূক্তি করতে কখনও দেখা যায় নি কুন্তীকে। 

এরপর এই মহীয়সী নারীর জীবনে যে ঘটনাগুলি ঘটেছে, তার মধ্যে বারণাবতের জতুগৃহ কাণ্ড এবং কুন্তীর সংসারে হিড়িম্বা ও কৃষ্ণা দ্রৌপদীর সংযোজনই মাত্র বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই ঘটনাগুলির সমকালীন সময়ে মহাভারতের সুবিশাল পরিসরে অজস্র ছোটো-বড়, গুরুত্বপূর্ণ- গুরুত্বহীন ঘটনার স্রোতপ্রবাহ বয়ে গিয়েছে; কখনও একই সঙ্গে অনেকগুলি, কখনও বা একটার পর একটা। কিছুতেই যেন সেগুলি কুন্তীকে স্পর্শ করতে পারে নি। 

কিন্তু কুরুরাজসভায় দ্রৌপদীর চরম লাঞ্ছনার পর সন্তানদের বনবাস যাত্রা কালে এই প্রথম আমরা কুন্তীকে প্রকাশ্যে এত বিচলিত হয়ে সোচ্চারে বিলাপ করতে দেখি। অবিশ্রান্ত ধারায় অশ্রু বিসর্জন করেছেন সন্তানদের, বিশেষ করে পুত্রবধূ দ্রৌপদীর, দুর্ভাগ্যের কথা উল্লেখ করে। বারংবার পুত্রদের অনুগমন করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। এই সময় মহামতি বিদুর কুন্তীর কাছে অত্যন্ত নম্র অথচ দৃঢ় এবং সশ্রদ্ধ আমন্ত্রণ পেশ করে ভ্রাতষ্পুত্রদের জানিয়ে দিয়েছেন, এখন থেকে কুন্তী তাঁর তত্ত্বাবধানে তাঁরই প্রাসাদে সসম্মানে অবস্থান করবেন। এ যেন নিতান্ত অনুরোধ বা সাধারণ বিজ্ঞপ্তি নয়, এ যেন অপরিবর্তনীয় অমোঘ এক অনুজ্ঞা। যা লঙ্ঘন করার কোনও যুক্তি পুত্রদের তো নেই-ই, স্বয়ং কুন্তীরও নেই। জন্মের পর থেকে সুখে-দুঃখে, আপদে-বিপদে কুন্তী কোনও সময় সন্তানদের একা ছাড়েন নি। কিন্তু আজ তাঁকে থামতে হলো। কি অসীম এই অধিকারবোধ, কি অপার মাধুর্য সম্পর্কের এই রহস্যলীলায়, একমাত্র এক সুবিশাল মহাকাব্যের উদার হৃদয়ের পরিসরেই যা এমন অপূর্ব সৌন্দর্যমণ্ডিত হয়ে প্রতিভাত হতে পারে।

এরপর আগামী তের বছর মহাকাব্যের কবি কুন্তীর আর কোনও সংবাদ দেননি আমাদের। যেন সন্তানদের জন্য সমস্ত উদ্বেগ সত্ত্বেও তিনি এক পরম নিশ্চিন্তির নিবিড় আশ্রয়ে অসীম ধৈর্যে প্রহর যাপন করেছেন। আবার তিনি স্বমহিমায় প্রকট হয়েছেন উদ্‌যোগ পর্বে, যখন আপন ভ্রাতুষ্পুত্র, যদুকুলমণি বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণ বিদুরের প্রাসাদে এসেছেন পিতৃস্বসা পৃথার দর্শন প্রার্থী হয়ে। বিবাহের এতগুলি বছর পর পিতৃকুলের পরম আত্মীয় কৃষ্ণকে এই চরম জটিলতার দিনে একান্তে পেয়ে প্রথমেই কুন্তী হর্ষে-বিষাদে আপ্লুত হয়েছেন। দীর্ঘ দিনের সমস্ত জমা ক্ষোভ একইসঙ্গে উৎসারিত হতে চেয়েছে প্রবলবেগে। জন্মদাতা পিতা থেকে শুরু করে শ্বশ্রূকুলে শ্বশুর ভাশুর সকলের প্রতি তাঁর সযৌক্তিক সুতীব্র অভিযোগ। সন্তানদের কথা ভেবে তিনি উদ্বিগ্ন হয়েছেন। বিশেষত, পুত্রবধূ কৃষ্ণা দ্রৌপদীর চূড়ান্ত দুর্দশা ও অবমাননার কথা স্মরণ করে ক্ষত্রিয়া নারী কুন্তীর ধমনীতে রক্তোচ্ছ্বাস প্রবল হয়েছে। অত্যন্ত তীব্র ভাষায় পুত্র যুধিষ্ঠিরের শান্তিপ্রিয় যুদ্ধবিরোধী মনোভাবের সমালোচনা করে পাণ্ডবদের কার্যত যুদ্ধে প্ররোচিত করতে সচেষ্ট হয়েছেন তিনি। অবশ্য, শেষ পর্যন্ত সর্বতাপহরণ শ্রীমধুসূদনের সুশীতল হৃদয়বেত্তার স্নিগ্ধতার ছায়ায় শান্ত হয়ে স্বমহিমায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছেন এই মহীয়সী নারী। 

মহারাজ শূর যেদিন পৃথাকে রাজা কুন্তিভোজের হাতে তুলে দিলেন, সেদিন থেকেই পৃথা নিজেকে কুন্তী নামক এক নিশ্ছিদ্র আবরণের অন্তরালে ঢেকে ফেলেছেন। সেদিন থেকেই পৃথা নির্জনচারিণী। কুন্তী তাঁর অঙ্গসহচরী বটে, কিন্তু মর্মসঙ্গী নন। অন্যদিকে, কি কঠোর শুষ্ক কর্তব্যনিষ্ঠা এই কুন্তীর। বয়ঃসন্ধির যে দুরূহ ক্ষণে এক সদ্য উদ্ভিন্নযৌবনা কিশোরীর সর্বাধিক প্রয়োজন হয় নিবিড় মাতৃস্নেহের স্নিগ্ধ অঞ্চলছায়ার নিরাপদ ও নিশ্চিন্ত আশ্রয়, ঠিক সেই সময় রাজা কুন্তীভোজের অন্তঃপুরে এসে পৃথা একা হয়ে পড়েছেন; যার অবশ্যম্ভাবী ফলস্বরূপ পৃথা আরও অন্তর্মুখী হয়ে উঠেছেন, দুরন্ত অভিমানে বিবশ হয়েছেন। কিন্তু পৃথার এই হৃদয়াবেগ কোনও ভাবেই কুন্তীর কঠোর কর্তব্যবোধকে প্রভাবিত করতে পারেনি। পালক পিতার আদেশে মহামুনি দুর্বাসাকে সন্তুষ্ট করেছেন প্রবল নিষ্ঠায়। বিবাহের পরেও কুন্তী স্বামীর একাধিপত্য থেকে বঞ্চিত হয়েছেন ভীষ্মের আয়োজনে। তবুও শ্বশ্রূকুলের প্রতি, স্বামীর প্রতি কর্তব্যে তিনি কোনও দিন এতটুকুও অবহেলা করেননি। কনিষ্ঠা পত্নীর প্রতি স্বামীর পক্ষপাতিত্বের কথা জানা সত্ত্বেও স্বামীকে ভালবাসার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন, অভিশাপ থেকে রক্ষা করার জন্য মাতার মতন সতর্ক ও যত্নশীলা হয়েছেন। সপত্নীর প্রতিও কোনওরকম বৈরীভাব প্রকট করেননি। উপরন্তু, মৃত্যুর পর নেহাতই শিশু দুই পুত্রের পরিবর্তে মাদ্রীর মুখাগ্নি করেছেন কুন্তী। এতটাই প্রখর তাঁর কর্তব্যবোধ।

এই কর্তব্যনিষ্ঠ নারী কিন্তু একাধারে কোমলমতি স্নেহশীলা জননীও। পরম মমতায় তিনি বুকে টেনে নিয়েছেন পিতৃ-মাতৃহীন দুই কনিষ্ঠ পাণ্ডবকে। এক মুহূর্তের জন্যও আপন সন্তানদের তুলনায় পৃথক দৃষ্টিতে দেখা তো দূরের কথা, বরঞ্চ কোনও কোনও ক্ষেত্রে তাদের, বিশেষ করে কনিষ্ঠতমটিকে, অধিক প্রশ্রয়ই দিয়েছেন। অসীম তিতিক্ষায় পঞ্চ পাণ্ডবকে তিনি কুরু বংশের সুযোগ্য উত্তর পুরুষ হিসাবে গড়ে তুলেছেন। জন্মের পর থেকে সমস্ত বিপদে আপদে কুন্তী একমুহূর্তের জন্যও সন্তানদের একা ছাড়েননি। প্রত্যেক সন্তানের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রেও তিনি পৃথক পৃথক ভাবে যত্নশীলা ছিলেন। জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব যুধিষ্ঠির। পিতৃহীন কনিষ্ঠ ভ্রাতাদের কাছে তিনি জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা অপেক্ষা অনেক বেশী পরিবারের অভিভাবক ছিলেন, আর কুন্তীও তাঁর এই পুত্রটির এই অবস্থান সসম্মানেই মেনে নিয়েছেন সারা জীবন। মধ্যম পাণ্ডব বৃকোদর ভীমসেন ছিলেন পরিবারের সেই উপযুক্ত পুত্র, পরিবারের আর সকলের সঙ্গে তিনিও যাঁর কাছে সাদরে গ্রাহ্য হবে জেনেই সমস্ত আবদার পেশ করতে পারতেন। চির অভিমানী বীরশ্রেষ্ঠ কনিষ্ঠ কৌন্তেয় সব্যসাচী অর্জুনের উপর ছিল তাঁর অগাধ আস্থা। তিনি জানতেন তাঁর এই পুত্রটি আর ভীমসেন যত দিন একসঙ্গে রয়েছেন, তত দিন ত্রিভুবনে তাঁর পরিবার সম্পূর্ণরূপে সুরক্ষিত। কনিষ্ঠ পাণ্ডুপুত্রদ্বয়ের প্রতি তাঁর স্নেহাধিক্যের মনোভাবে তো এমন কি তিনি দ্রৌপদীকেও প্রভাবিত করেছিলেন। 

জতুগৃহ কাণ্ডের পর বনবাস কালে অসাধারণ সুপুরুষ ভীমসেনের প্রতি অনার্যা রমণী হিড়িম্বার সপ্রতিভ অসঙ্কোচ প্রেম তিনি অনুমোদন করেছেন চরম আধুনিকতায়। দ্রৌপদীর সঙ্গেও তাঁর এক আশ্চর্য মধুর সম্পর্ক। শ্বশ্রূকুলে কুরুকুলবধূ দ্রৌপদীর লাঞ্ছনা বার বার তাঁকে এই পরিবারে তাঁর নিজের লাঞ্ছনার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। দ্রৌপদীর এত লাঞ্ছনার পরেও যে তিনি কুরুকুলের প্রতি, পাণ্ডবদের প্রতি নিষ্ঠাবতী থেকেছেন, তার জন্য কুন্তী দ্রৌপদীকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। স্নেহশীলা মাতা পুত্রবধূটির দুর্দশা মোচনের জন্য এতটাই ব্যকুল হয়েছেন যে, উদ্‌যোগ পর্বের কথোপকথন কালে মহাভারতের মহানিয়ামক শ্রীকৃষ্ণকে কুন্তী অনুরোধ করেছেন, দ্রৌপদী যেভাবে চান, যা চান, তাই যেন পান - কৃষ্ণ যেন সেই ব্যবস্থাই করে দেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আপন ভ্রাতুষ্পুত্রটির সঙ্গে পুত্রবধূর যে এক নিবিড় সখ্যতার সম্পর্ক ছিল, সেটিও তিনি অত্যন্ত প্রশ্রয়ের চোখেই অনুমোদন করেছেন অসীম উদারতায় ও আধুনিক মননশীলতায়। 

এক নারী। মননশীলা। কর্তব্যনিষ্ঠ। স্নেহশীলা। ব্যক্তিত্বময়ী। বাস্তববুদ্ধিসম্পন্না। ধৈর্যশীলা। উদারচিত্ত। আধুনিকমনস্কা। সম্পূর্ণা হতে গেলে আর কী গুণ চাই?

তবুও তিনি মানবী। ভুল তিনিও করেছেন। আর তাঁর এই ভুল বারংবার আবর্তিত হয়েছে তাঁরই প্রথমজন্মা সন্তানটিকে কেন্দ্র করে। বালখিল্য কৌতূহলপ্রিয়তায় বরপ্রাপ্ত মন্ত্রের বলাবল পরীক্ষার জন্য সূর্যকে আহ্বান করেছেন। বিস্মৃত হয়েছেন দুর্বাসার সতর্ক বাণী। অনিবার্যভাবে জন্ম হয়েছে কর্ণের। জীবনের প্রথম ভুল। পরবর্তীকালে এই ভুল সংশোধণের সুযোগও তিনি পেয়েছেন। কিন্তু সে সুযোগের সদ্ব্যবহার তিনি করতে পারেননি অদ্ভুত এক যুক্তিতে। পুত্রার্থে অস্থির নিঃসন্তান মহারাজ পাণ্ডু যখন কুন্তীর কোনও কানীন পুত্র থাকলে, তারও পরিচয় পেতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন, তখনও তিনি তাঁর প্রথমজাত সন্তানটির কথা প্রকাশ করতে পারেন নি। যুক্তি হিসাবে মহাভারতের কবি জানিয়েছেন, পাণ্ডুর অজ্ঞাতে ও বিনা অনুমতিতে জন্মানো পুত্রের কথা জানিয়ে কুন্তী পাণ্ডুর আত্মশ্লাঘায় আঘাত করতে চাননি। কিন্তু বাস্তব যুক্তি দিয়ে বিচার করলে মনে হয়, বিয়ের এতদিন পর, এই প্রথম কুন্তী কনিষ্ঠা সপত্নী মাদ্রীকে পরাভূত করে পাণ্ডুর জীবনে এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান নিয়ে তাঁর এবং কুরুবংশের ভবিষ্যৎ নিয়ামকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। ঠিক এই মুহূর্তে আত্মমর্যাদাহানিকর বালখিল্য চপলতা, অজ্ঞতা এবং বিশেষত লজ্জার ইতিহাস উন্মুক্ত করে তিনি সে সুযোগ হারাতে চাননি। 

এ এক আশ্চর্য মানসিক জটিলতা। যে সন্তানকে তিনি জন্মমুহূর্তে অপরিচয়ের অন্ধকারে ঠেলে দিতে বাধ্য হয়ে সারা জীবন দগ্ধ হয়েছেন, স্বামীর জীবনে ভালবাসাহীন দাবীর অধিকারে সে সুযোগ তাঁকে হারাতে হলো। এর চেয়ে মর্মান্তিক আত্মবঞ্চনা বুঝি আর কিছুই হয় না। আরও একবার তিনি তাঁর আত্মবিশ্বাসের উপর অধিক আস্থা রেখে প্রত্যাখ্যাতা হয়েছেন, আহত হয়েছেন... সেও সেই প্রথম সন্তানটির কারণেই। মহাভারতের ভারতযুদ্ধ সূচনার প্রাক্‌মুহূর্তে শঙ্কিতা মাতা জ্যেষ্ঠ পুত্রের কাছে ছুটে গেছেন, প্রকৃত জন্মপরিচয় দিয়ে তাঁকে ফিরিয়ে আনতে, একমাত্র মাতৃস্নেহকে সম্বল করেই। কঠোর প্রত্যাখ্যানে আহত হয়ে ফিরতে হয়েছে তাঁকে। এ সিদ্ধান্তও তাঁর সঠিক ছিল কিনা, তা প্রশ্নাতীত নয়।

এরপর একদিন যুদ্ধ শেষ হয়েছে। পাণ্ডবরা কর্ণের আসল পরিচয় জেনেছেন। যুধিষ্ঠির সসাগরা ধরণীর একচ্ছত্র সম্রাট হয়েছেন। পাণ্ডুর পুত্ররা ধর্মরাজ্যে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়ে সুখে জীবনধারণ করছেন। সারা জীবন কুন্তী অজস্র অসম্মান ও বঞ্চনা সহ্য করেছেন। আজ সব হিসাব মিলে গেছে। ক্ষত্রিয়া নারী তো এই দিনটির জন্যই পুত্রসন্তান প্রসব করেন। আজ তিনি সিদ্ধকাম, আত্মতুষ্টির পরিপূর্ণতায় স্বয়ংসম্পূর্ণা।

আর তাই সম্ভবত রাজমাতা কুন্তী যুধিষ্ঠিরের অশ্বমেধ যজ্ঞের পরে ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী এবং বিদুরের সঙ্গে বানপ্রস্থে যাওয়াই মনস্থ করেছেন। পুত্র-পুত্রবধূদের শত অনুনয় তাঁর এই সিদ্ধান্ত থেকে তাঁকে বিচ্যূত করতে পারে নি। কিন্তু সত্যিই কি তিনি আজ সিদ্ধকাম? জীবনের সমস্ত স্বপ্নই কি তাঁর চরিতার্থতা লাভ করেছে? না। একটি স্বপ্ন তাঁর এখনও অধরাই রয়ে গিয়েছে। কিন্তু মহাভারতের কবির হৃদয় মহাভারতের মতনই সুবিশাল। সমগ্র মহাকাব্য জুড়ে তিনি তাঁর এই চরিত্রটিকে অজস্র বিড়ম্বনায় জর্জরিত করেছেন। তবুও শেষ পর্যন্ত তিনি কুন্তীর পরম কাঙ্খিত স্বপ্নটিকে সফল করে কুন্তীকে আত্মতৃপ্তির চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে দিয়েছেন। 

পারাসর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস দৈববলে, কিম্বা বলা ভাল, কোনও এক ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতায় ভাগীরথী তীরে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে মৃত সমস্ত আত্মীয় পরিজনদের আহ্বান করেছেন। সেখানে তাঁরা সশরীরে প্রকটিত হয়ে তাঁদের জীবিত আত্মীয়দের সঙ্গে মিলিত হয়েছেন। সেখানে কর্ণও এসেছেন। ঈর্ষা-গ্লানি-ক্রোধহীন এক অভূতপূর্ব রাজকীয় মর্যাদায় জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা হিসাবে সেখানে তিনি মিলিত হয়েছেন আপন পঞ্চ ভ্রাতার সঙ্গে। সে এক অপূর্ব দৃশ্য। কুন্তীর সারা জীবনের ইপ্সিত এ কামনা আজ পূরণ হয়েছে ব্যাসদেবের দাক্ষিণ্যে। এত দিনে তিনি সত্যিই পরিপূর্ণা। 

পরিপূর্ণা? অগৌরবের পুত্র আজ সর্বজনে স্বীকৃত, সমাদৃত। পাণ্ডুপুত্ররাও আজ হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারে সক্ষম। হ্যাঁ, কুন্তী যুদ্ধ চেয়েছিলেন। কারণ, মহারাজ পাণ্ডুর পুত্রদের পরাশ্রয়জীবী দীন অবস্থা তিনি মেনে নিতে পারছিলেন না। যুধিষ্ঠির ও ভীমসেনের প্রশ্নের উত্তরে একথা তিনি নিজেই জানিয়েছেন বানপ্রস্থ যাত্রা কালে। যুদ্ধ চেয়েছিলেন, কিন্তু তার পরিণাম সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অবগত হয়েই কি? মাত্র আঠারো দিনের যুদ্ধের কি ভয়ানক ফল! সমগ্র আর্যাবর্তের আকাশে বাতাসে একদিন যেখানে ধ্বনিত হতো বিজয়গাথা, আজ সেখানে অবিরত ক্রন্দিত হয়ে চলেছে সকরুণ বীরগাথা। সে ক্রন্দন কিশোরী যুবতী প্রৌঢ়া বৃদ্ধা সদ্য বিগতধবা পত্নীর, সন্তানহারা জননীর। সে ক্রন্দনকে শতসহস্রগুণে মর্মান্তিক করে তুলেছে রক্তলোলুপ গৃধ্র-শৃগালের বীভৎস চীৎকার। 

যেদিকে চোখ যায় কেবল মৃত শবের স্তূপ আর শোকাকুলা রমণীর বক্ষদাহী হুতাশন। কুন্তীর নিজের পৌত্রদের মধ্যেও একমাত্র চৈত্রাঙ্গদ বভ্রুবাহন ছাড়া আর কেউ জীবিত নেই। বৃকোদর ভীমসেনের পুত্র মহাবল ঘটোৎকচ। কুন্তীর প্রথম পৌত্র। পরম সেই স্নেহের ধন আজ রণক্ষেত্রে মৃত্যুর অঙ্কশায়ী। গাণ্ডীবধন্বা অর্জুনের উপযুক্ত বীরপুত্র তরুণ অভিমন্যু। যুধিষ্ঠিরের পরে সমগ্র আর্যাবর্তের একচ্ছত্র রাজচক্রবর্তী সম্রাট হওয়ার সমস্ত লক্ষণ যার মধ্যে ছিল সমুজ্জ্বল, আজ সে মাতা সুভদ্রার অঙ্ক শূন্য করে, নিতান্তই কিশোরী পত্নী উত্তরার হৃদয় বিদীর্ণ করে পরলোকের অধিবাসী। বীরভোগ্যা বসুন্ধরা আজ প্রায় বীরশূন্যা। পুত্রদের পুনঃপ্রতিষ্ঠার মূল্যে কি এই পরিণামই প্রত্যাশা করেছিলেন কুন্তী? কি করে তিনি সম্পূর্ণ সফল মনোরথ হতে পারেন? 

আসলে কুন্তী এই নিদারুণ মর্মান্তিক ঘোর যুদ্ধফল কল্পনাও করতে পারেননি। মাত্র আঠারো দিন পূর্বেও শৌর্যে-বীর্যে যে আর্যাবর্ত ছিল সম্ভবত সসাগরা ধরণীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক শক্তির আধার, আজ সেই উত্তরাপথ জুড়ে কেবল সন্তানহারা জননীর হাহাকার, প্রয়াতভর্তৃকা রমণীর ক্রন্দন। এ বিপুল বিপর্যয়ের দায় তিনি এড়াবেন কি করে? দুর্যোধনদের এত সাহস এবং আস্ফালন – সে তো কেবলমাত্র তাঁরই প্রথম সন্তানটির উপর পূর্ণ আস্থা রেখেই! আজ কি একটিবারের জন্যও কুন্তীর মনে পড়ে না সেই সে দিনটির কথা? পুত্রার্থে ব্যাকুল মহারাজ পাণ্ডু যেদিন কুন্তীর এমনকি কোনও কানীন পুত্রের খোঁজও করেছিলেন, সেদিন যদি কর্ণের জন্মপরিচয় উন্মোচন করতেন, তবে কি কুরুবংশের ইতিহাস অন্যতর পথে প্রবাহিত হতো না? প্রত্যাশিতভাবেই আহত হয়েছেন তিনি। আর এই আঘাতই তাঁকে মুহূর্তে সমস্ত জগৎ সংসার সম্বন্ধে নির্বিন্ন করে তুলেছে। তাই আজ তিনি রাজমাতা হয়েও সমস্ত ভোগ-ব্যসন ত্যাগ করে গান্ধারী ও ধৃতরাষ্টের সেবায় আত্মনিয়োগ করেছেন। প্রথম সুযোগেই বানপ্রস্থ গমনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। 

আর অন্য দিকে, মাত্র আঠারো দিনের যুদ্ধের ফলস্বরূপ সমগ্র আর্যাবর্তের ললাটে তখন লিপিবদ্ধ হয়েছে আগামী সহস্রাধিক বৎসরের এক ভয়াবহ বীর্যখরা, ভারতবর্ষের পরবর্তী কালের ইতিহাস যার প্রত্যক্ষ প্রামাণ্য সাক্ষ্য বহন করে, সেই প্রসঙ্গ আলোচনার উপযুক্ত পরিসর এই রচনায় নেই। এ রচনা নিতান্তই দেবপ্রিয়া সুররম্যা পৃথার জীবন কেন্দ্রিক। 

মহাভারতের মূল পর্বে মহাকবি ব্যাসদেবের এই চরিত্র শোকে দুঃখে, করুণায়, ক্ষমায়, বিক্ষোভে, প্রশান্তিতে প্রতিনিয়ত ক্ষরিত, বিবর্তিত, সম্পৃক্ত হয়ে পূর্ণাঙ্গ মানবীরূপে উন্নীত হয়েছেন। জীবনযুদ্ধের ঘাত প্রতিঘাতে প্রতিনিয়ত দগ্ধ হয়ে বিশুদ্ধ হয়েছেন। কিন্তু মরাল গ্রীবা শ্বেত শুভ্র রাজহংসীর মতনই জাগতিক কোনও কিছুই যেন তাঁকে সেই ভাবে কখনওই স্পর্শ করেনি। আর এই চারিত্রিক বিশিষ্টতাই মহারাণী কুন্তী, রাজমাতা কুন্তী, সর্বোপরি সুরগর্ভা কুন্তীকে মহাকাব্যের বিশাল পরিসরের অজস্র চরিত্রের ভীড়ে স্বমহিমায় স্বতন্ত্র করেছে সন্দেহাতীত ভাবে। 



কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ- 
                             কালীপ্রসন্ন সিংহ  
                             নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী
                         

5 comments:

  1. যথারীতি স্বচ্ছন্দ এবং সাবলীল লেখা। আধুনিকা এক রমণীর দৃষ্টিভঙ্গীতে ধরা দিলেন এক পৌরাণিক নারী চরিত্র !!

    ReplyDelete
  2. Ghor lege gelo jeno prithar jonno kosto,sroddha sob mile megher buke subhro boker pakhar moto jege roilo,ekta chobi, sudhu ki chobi? Ki jani.likhe jao sompadika themo na.

    ReplyDelete
  3. সুবিশাল লেখাটি পড়লাম আজ সকালে। মাইথোলজিক্যাল ঘটনাতে তুমি যে ভাবে কল্পনা দিয়ে যুক্তির পরিসর সৃষ্টি করেছ,তা অসাধারন। মাইথোলজিক্যাল বিষয়ে তোমার ব্যুৎপত্তি দেখে ভাল লাগল বেশ।

    ReplyDelete
  4. ছন্দে গতিতে ভীষণ সাবলীল লেখা... ভালো লাগল খুব

    ReplyDelete