1

স্মৃতির সরণীঃ সুপ্রভাত লাহিড়ী

Posted in

স্মৃতির সরণী




ক্যাক্টাসের ফুল
সুপ্রভাত লাহিড়ী


গতকাল রাত থেকেই মনটা বেশ ভারাক্রান্ত ছিল। ভেবেছিলাম অশান্তির ঘুমটা একটু গাঢ় হলেই বোধ হয় মনটা হাল্কা হবে। কিন্তু কই হাল্কা হলাম না তো? আমার এই মনটাই করে যত গোলমাল। দুনিয়াশুদ্ধ্ব লোককে জ্ঞান দিয়ে চলেছি ‘সুখ তোমার জানলায় উঁকি দেবে না। ঘরের দরজা হাট করে খুলে ওকে জোর জবরদস্তি পাকড়াও করতে হবে। ওর তো অসম্ভব অহমিকা....।’ কিন্তু নিজের বেলা সেই প্রয়াস কোথায়? মুখের হাসি দেখে ভিতরের মানুষটকে কিন্তু বোঝবার জো নেই! এ ব্যাপারে তার জুড়ি মেলাব ভার। শুধু রোমন্থন আর রোমন্থন! আর তার রেশ চলেও বেশ কয়েক দিন.....।

যাই হোক, এই রকম এক মনের কারবারি চলেছে চেতলার রাস্তা ধরে দক্ষিণে-বাড়ির উদ্দেশ্যে। চেতলা ব্রীজে ওঠার মুখে বাঁ দিকে দৃষ্টি গেল। সাহিত্যিক বিমল মিত্রের সেই লাল রঙের সাবেকী বাড়ি। এখন সেটি একটি প্রতিষ্ঠান। ট্রাফিক জ্যামের কারণে সেই মুহূর্তে গাড়ি দাঁড়িয়ে। বাঁ দিকের কাঁচ খুলে বেশ খানিকটা গলা বাড়িয়ে বাঁ দিকের কোনাকুনি ঘরটা নজর করলাম। জানলা বন্ধ। কিন্তু আমার দৃষ্টি অর্গল ভেদ করে সেই ঘরে প্রবেশ করে ফেলেছে। ঘষ্টা ওঠা কাঁচের ভারী চশমা। গায়ে গেঞ্জি, পরনে লুঙ্গি। সামনে উপবিষ্ট আমি আর সেই দুই বন্ধুর একজন, যাদের ব্যাখ্যান ‘লাইব্রেরী’ প্রসঙ্গে উল্লিখিত হয়েছে। ওর সঙ্গে সাহিত্যিকের অল্প আলাপের সূত্রেই আমার প্রবেশাধিকার এবং ওঁর মতন সাহিত্যিকের সঙ্গে বাচালপনা করবার দুঃসাহস হয়েছিল। আমরা দুজনেই তখন দুজনের কথা বলায় ব্যস্ত আর তিনি তখন আমাদের দুজনের আনীত পাণ্ডুলিপির পাতা ওলটাতে মগ্ন। তারপর একসময় আমার দিকে দৃষ্টি মেলতেই আমার ভিতরটা উথালপাথাল করতে শুরু করে দিল। বুকের একটু কাছে কানটা নিয়ে গেলে নির্ঘাত সেই আওয়াজ মালুম হত। ওই অবস্থাতেই সেই মেঘমেদুর স্বর,‘‘এমনিতে তো সব ঠিকই আছে। তবে শেষটা নিয়ে একটু ভাব।’’ আবার আমার বাচালপনা,‘‘কেন ঠিক হয়নি, কি ভাবে ভাল করা যায়?’’ ভুরু কুঁচকে উত্তর দিলেন,‘‘এটা তো তোমার লেখা গল্প, আমি তার শেষ করি কিভাবে? তুমিই ভাব। লেখা হয়ে গেলে দিয়ে যেও।’’ অত্যন্ত ভগ্ন মনোরথে আমি উঠে দাঁড়িযে ছিলাম। সেই দেখে আমার সেই বন্ধুটিও ওর লেখার বিষয়ে কোন মন্তব্য না শুনেই বলে ওঠে, ‘‘আমরা তাহলে আসি?’’ উনিও ঘাড় নেড়ে সায় দিয়েছিলেন।

ওনার ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে আমি বেশ রুষ্ট হয়েই বলে উঠি, ‘‘কোন রকম সাহায্য করার নাম নেই শুধু উপদেশ। যাক, আমি শেষটুকু নিয়ে ভাবব। যদি কোন পরিবর্তন মাথায় আসে তাহলে সেটা করে তোর হাত দিয়ে পাঠিয়ে দেব। তখন তুই তোরটার চান্স নিস।’’

সেদিন সাহিত্যিকের বাড়ি থেকে আসা ইস্তক দুদিন শুধু ভেবেছি, কেন উনি শেষটুকু ভাবতে বললেন? কি ভাবে গল্পটার ইতি টানবো? আর যতবার ভেবেছি ততবারই বিভিন্ন ভাবে গল্পটার শেষটা আমার মাথায় এসে এসে চলে যাচ্ছিল। যাই হোক, গল্পের শেষটুকু আমি আমার মতন করে পরিবর্তন করে অল্প বয়সের জোশে, অত্যন্ত অভদ্রভাবে বন্ধুর হাত দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। পরবর্তীতে সেই গল্পটি ‘কালি ও কলম’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল কিনা তার খোঁজও করিনি। অথচ তখন পরম শ্রদ্ধেয় বিমল মিত্রের সম্পাদনায় ‘কালি ও কলম’ ছিল গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, আলোচনায় সমৃদ্ধ এক উঁচু মানের সংকলন। কিন্তু তখন ওই বয়সে... বললাম না?

কর্মজীবনের মধ্য পর্যায়ে, এক মধ্য রাতে অফিসের এক সহকর্মী বন্ধুর মোবাইলের কণ্ঠস্বর আমাকে নাড়িয়ে দিয়েছিল, ‘‘ওফ্ বস্! বাবার লাইব্রেরীর প্রকোষ্ঠে সযত্নে রক্ষিত বাঁধানো ‘কালি ও কলম’ সমগ্রের মধ্যে তোমার লেখা গল্প ‘ফেরারী মন’ পড়লাম। আমি অভিভূত! গুরু, বিমল মিত্র সম্পাদিত পত্রিকাতেও ওই বয়সে তোমার লেখা স্থান পেয়েছে!’’ আমি যেন তড়িদাহত হলাম। মোবাইলের ওপার থেকে সুদীপের ‘‘বস্ কি হ’ল, কি হ’ল’’ আমাকে সম্বিত ফিরিয়ে দিল। আমি আমার মোবাইল মুখের সামনে এনে চিত্‍কার করে বলে উঠেছিলাম, ‘প্লিজ সুদীপ কাল অফিসে এনে দেখাও, প্লিজ।’

পরদিন সুদীপ শুধু সেটি অফিসে আনেই নি, ‘কালি ও কলম’ সমগ্রটি আমাকে উপহারও দেয়।







1 comment:

  1. খুব সুন্দর। তবে এটা আমি আগেই কোথাও পড়েছি। লেখাটা সুপ্রভাত লাহিড়ির সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ। কিন্তু, এটার প্রকাশ এখানেই প্রথম নয় বলে মনে হল !!

    ReplyDelete