0

ছোটগল্পঃ পিয়ালী বসু

Posted in



ছোটগল্প



আশ্রয় 

পিয়ালী বসু 





(১) 

“এক্সিউজ মি , উল্টোডাঙার বাসটা কি এখান থেকে পাবো” ? গোলাপি সালোয়ার পরা বিশ বাইশের একটি মেয়ে এসে দাঁড়ায় তৃষার সামনে । “আমি আসলে এদিকটা ঠিক... অহহ হ্যাঁ । এখান থেকেই পাবে । উল্টোডাঙার বাস”।অন্যমনস্কতা ঝেড়ে ফেলতে ব্যস্ত হয় তৃষা ।

ইস্‌ , নটা বেজে গেল ! আজ একটা বকুনি বাঁধা । গতরাত থেকেই বুবুন টার জ্বর। সেই সকালে ডাক্তার এনে মেয়েকে দেখিয়ে তবে রওনা হয়েছে আজ । সত্যি কথাটা বললে নিশ্চয়ই স্যর রাগ করবেন না। 


এলোমেলো ভাবনায় ইতি টানে তৃষা । 


(২)

সল্ট লেকের সেক্টর ফাইভে এসে যখন পৌঁছয় তৃষা, সাদা লেদার ব্যান্ড টাইটানের ঘড়িটায় তখন ঠিক সকাল সাড়ে নটা । মাত্র তিরিশ মিনিট দেরী, স্যর নিশ্চয়ই বুঝবেন । 

কাচের রিভলভিং ডোর ঠেলে তড়িঘড়ি অফিসে ঢোকে তৃষা। তাদের এই মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির এখন সে অন্যতম সিনিয়ার মার্কেটিং ম্যানেজার । তবুও নিজেকে এখনও ততটা confident ভাবতে পারেনা সে। অবশ্য তারই বা দোষ কি । ঋজু তো তাকে একরকম ঘরবন্দী করেই রাখতে চেয়েছিল। 

“ May I come in Sir” ? স্বরটা যতটা সম্ভব low volume এ রাখতে চেষ্টা করে তৃষা। নিজের টেবিলের ঠিক ডান কোণে টাঙ্গানো ঘড়ির দিকে তৃষাকে দেখিয়ে দেখিয়েই তাকান মিস্টার সিন্‌হা। মিস্টার রণজয় সিন্‌হা । এই কোম্পানির এম ডি । 

“কি ব্যাপার ? এত বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে কেন তোমায় ? Is everything all right?

ঠিক এই reaction টারই কি প্রত্যাশা করছিলো সে ? বোধহয় না । আজ স্যর 
একদম অন্য মুডে । কারণটা কি ? অনুমান করার চেষ্টা করে তৃষা । তাহলে কি Murray & Tubro র ডিলটা ফাইনাল হল ? “আসলে” ...গলাটা ঝেড়ে নেয় তৃষা, গুছিয়ে বসে, মুখোমুখি চেয়ারটায় “গত রাত থেকেই বুবুনের জ্বর । তাই আজ সকালে ডাক্তার কল করেছিলাম, উনি এসে দেখে যাওয়ার পরই আমি বেরোই, তাই দেরী হয়ে গেল” । 


“What ? আর এই কথাটা তুমি এখন বলছো আমায় ? you should have ring me before . অতটুকু মেয়েকে একা রেখে আসা উচিৎ হয়নি তোমার । তুমি এখুনি একটা ট্যাক্সি নিয়ে বাড়ি ফিরে যাও”। 

“কিন্তু স্যর” ...তৃষার কথা কানেই তোলেন না রণজয় । “নাহহ I am not that inhuman . তুমি এস এখন” । 


(৩)

প্রায় কুড়ি মিনিট । হ্যাঁ প্রায় কুড়ি মিনিট হতে চলল অথচ একটাও ট্যাক্সির পাত্তা নেই । কি করা যায় ? এদিক ওদিক দৃষ্টি প্রসারিত করে তৃষা । আশ্চর্য ! মালতী মাসীকে একটা ফোন করে দেখবে ? বুবুনের জ্বরটা কমেছে তো ? বুকের মধ্যে টেনশনে হাপর পিটতে থাকে । 

“এইইইইই অটো ...এইইইইই যে দাঁড়ান দাঁড়ান” । এগিয়ে আসা অটোটার সামনে রাস্তা জুড়ে দাঁড়ায় তৃষা । “আমার বড্ড তাড়া, প্লিজ চলুন দাদা” । উত্তরের তোয়াক্কা না করেই অটোতে উঠে বসে তৃষা, আর ...... 


(৪)

দু বছর পর আবার দেখা । এখানে এভাবে যে দেখা হবে তা কি ভাবতে পেরেছিল সে ? মা বলতেন, জীবনের অন্য নাম চমক, তা আরও একবার প্রমাণিত হল। 

“তাড়াতাড়ি উঠে পড়ুন দিদি, প্যাসেঞ্জার ভর্তি অটো! বেকার টাইম নষ্ট করাবেন না আমার । পরের খেপ মারতে দেরী হয়ে যাবে । আরে !! উঠুন উঠুন” । 

সম্বিত ফেরে তৃষার । অটোতে ওঠে সে এবং ঋজুর পাশে গিয়েই বসে । 

টানা দু বছর । দিন আর মাসের হিসেব করলে সময়টা নেহাত কম নয় কিন্তু । দমদমের শ্বশুরবাড়ী ছেড়ে যেদিন শেষবারের মত বেরিয়ে এসেছিলো সে, ন' বছরের বুবুন কে নিয়ে, সেদিন থেকেই তো ঋজু তার জীবনে মৃত । নাইবা হল কাগজের ডিভোর্স, মনের ডিভোর্স তো সেই কবেই ...। 

গরমটা বড্ড বেড়েছে । সকালে তাপমাত্রা ৪০ ছোঁয় । সাদা শাড়ী ছাড়া এসময়ে আর কিছু পরেনা তৃষা । অন্য রঙ গুলো যেন এই প্রবল গরমে গিলতে আসে । একবার মালতী মাসিকে ফোনটা করে ফেলা যাক । মনের কোণে তিরতির করছে বুবুনের চিন্তাটা । 

“আরে দাদা । দেখে চালাবেন তো ? আর একটু হলেই এনার কপালটা কেটে রক্তারক্তি হয়ে যেত ! কারা যে আপনাদের লাইসেন্স ইস্যু করেন !! জঘন্য” ! 

হঠাৎ প্রবল হোঁচট খায় অটোটা । তৃষার কপালটা ধাক্কা লেগে কালশিটে আর ঋজুর মেজাজ হারানো , একের পর এক ধারানুক্রমিক ভাবে ঘটতে থাকে । 

“নেমে এস, আস্তে । তৃষা কে ধরে অটো থেকে নামায় ঋজু । একটা ট্যাক্সি ধরি চল”। 

“Thanks! আমি পারবো”। ফরমাল হবার আপ্রাণ চেষ্টা করেও বিফল হয় সে। মাথাটা ঘুরছে কেন? 


(৫)

বালিগঞ্জ প্লেসের এই ফ্ল্যাটটায় বুবুন আর মালতী মাসিকে নিয়ে মাত্র এক বছর হল move in করেছে তৃষা । বাবা, মা চলে যাবার পর সিঁথির পৈত্রিক বাড়িটা ওকে দিয়ে দিল দাদা । নিজেরা চলে গেল যাদবপুরে সুলেখার কাছে, আর তৃষা এল এখানে। বুবুনের স্কুলটা খুব কাছে । ঋজুর থেকে সরে আসার পর একটা চাকরীর জন্য হন্যে হয়ে ঘুরেছিল সে । পায়নি । শেষে ছোট মামার স্কুলের বন্ধু রণজয় সিন্‌হা চাকরীটা দেন তাকে। সেও প্রায় আট মাস ! তার confidence যখন তলানিতে এসে ঠেকেছে, সেই সময় স্যার এগিয়ে আসেন দেবতার মত ! আট মাসের চাকরী তে receptionist থেকে senior marketing ম্যানেজার হওয়ার সিঁড়িটা সহজ না হলেও জয় করতে পেরেছে তৃষা ।

“একি দিদিমণি ? কি হয়েছে গো তোমার” ? দরজা খুলে উদগ্রীব মালতী মাসি দাঁড়িয়ে । নিজেকে সামলে নেয় তৃষা । priority এখন সে নয়, বুবুন ।

“আমি ঠিক আছি , তুমি আমাকে দাদা বাবুকে এক গ্লাস জল খাওয়াও তো” । সোফায় বসে নিজেকে সামলায় সে । মাথাটা এখনও অল্প ঘুরছে ।“ বুবুনের জ্বর টা কমেছে তো” ? 

“হ । বুবুন চুপটি করে নিজের ঘরে শুয়ে গান শুনতাসে । খাড়াও আমি জল আনতাসি”। 

“মাম্মা তুমি কখন” ...বলতে থাকা কথাটা মাঝপথেই গিলে নেয় বুবুন। অবাক হয়ে সে তখন ঋজুর দিকে । “বাবাই তুমি” ? ঋজু উঠে জড়িয়ে ধরে মেয়েকে । তুলতুলে নরম সেই মেয়ে। তার বড় প্রিয়, আগলে রাখে মেয়ে। 

“হ্যাঁ রে মা, তুই তো এখন পুরো লেডী। এবার কি তবে তোকে মিস দামিনী দাশগুপ্ত বলে ডাকবো” ? খুনসুটি করতে করতে বাবা মেয়ে তখন প্যাসেজ পেরিয়ে বেডরুমের দিকে । 


কি করবে এখন সে ? দিশেহারা হয়ে পড়ে তৃষা, তবুও বুকের নিভৃত কোণে কেন এখনও ...! 


(৬)

যাদবপুরের বাংলা প্রথম বর্ষ তৃষার সাথে তিন বছরের সিনিয়ার ঋজুর আলাপ সংস্কৃতিতে । তৃষা তখন রবীন্দ্র নৃত্যনাট্যের লিড করছে , আর প্লে ব্যাকে ঋজু। ফরমাল আলাপটা ঘনিষ্ঠতায় বদলাতে সময় নিয়েছিল মাত্র এক মাস ! তৃষা তখন উড়ছে । ঋজুর সাথে কখনও কফি হাউস কখনও বা গঙ্গার ঘাট পেরিয়ে মাঝে সাঝে তখন ডায়মন্ড হারবারের সস্তা love den এও । সেরকমই এক ঘন দুপুরে শরীর সুখ শেষে ঋজুর ঘোষণা, “এবার বিয়ে করে ফেলা যাক” । 

কি বলবে তৃষা ? তার শরীর আর মন জুড়ে তখন শুধুই ঋজু । 

একমাসের মধ্যেই সিঁথির পৈতৃক বাড়ী ছেড়ে তৃষা উঠে এল দমদমের দেবীনিবাসের বাড়ীতে ... ঋজুর স্ত্রীর পরিচয়ে ।


পরিপূর্ণ তৃষা তখন অন্তর্বর্তী ভাঙনটা বুঝে উঠতে পারে নি । যখন বুঝতে পারলো, তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে । বুবুন তখন খুব ছোট । কিছুদিন শুধু পাগলের মত কেঁদেছিল সে । তারপর ঘুরে দাঁড়িয়েছে, ঐ বুবুন টার মুখের দিকে তাকিয়ে । কি করে বলবে সে সবাই কে ? পিসতুতো ননদ ঝুমা আর তার ঋজুর অবৈধ সম্পর্কের কথা ? 


(৭)

তারপর টানা এক বছর যুদ্ধ করে আজ তৃষা এই জায়গায় । তিলে তিলে গড়ে তোলা তার সাজানো কোণে আজ কেনই বা ঋজুর আগমন ? কেন ? 

“তোমার সাথে আমার কিছু কথা ছিল” । রাতে ডিনারের পর বেডরুমে গমনোদ্যত তৃষার দিকে কথার ঢিলটা ছুঁড়ে দেয় ঋজু ।

কথা ? কথা তো আমাদের শেষ হয়ে গেছে বহুদিন । নিজেকে বোঝায় তৃষা । তাহলে কি ভুলটা শুধরাতে চায় ? আশার একটা ক্ষীণ আলো খেলে যায় তৃষার শরীরে। 

“আমি কি” ...নিজেকে একবার সামলে নেয় ঋজু । আমি কি আজ রাত টা থাকতে পারি এখানে ? কাল সকাল হলেই চলে যাব । 

পায়ের তলায় মাটি সরছে । মা বলতেন জীবনটা চমক । আজ এক রাতের জন্য আশ্রয় চেয়ে তা আরও একবার প্রমাণ করে দিল ঋজু...

0 comments: