0

অণুগল্পঃ সপ্তর্ষি মাজি

Posted in








অণুগল্প



খোলাচিঠি
সপ্তর্ষি মাজি



প্রিয় পার্থ,
আজ তোমার ঘরে আমি চুপিচুপি ঢুকেছিলাম। তুমি জানতেও পারোনি। ঢুকেই দেখলাম তোমার সারাটা ঘর জুড়ে বইপত্র ছড়ানো ছিটানো। আমার ক্ষমতা থাকলে আমি ঠিকই গুছিয়ে দিতাম। কিন্তু গুছিয়ে দিইনি। তোমাকে আমার অগোছালো দেখতেই বেশী ভালো লাগে। তোমার মাথার অগোছালো চুল, গাল ভরা দাড়ি, শার্টের উপরের বোতাম খোলা...এসবই আমার বেশী ভালো লাগে। তোমার সারাক্ষণ উদাসী দৃষ্টি, আচ্ছা কী ভাবো বলতো এত?

আজ অনেকদিন পর তোমার ঘরে ঢুকলাম। কেমন অদ্ভুত বেমানান লাগছিল নিজেকে। আসলে এরকমভাবে কোনোদিন ঢুকিনি তো। ঢুকেই দেখলাম তুমি গীটার বাজিয়ে সেই গানটা ধরেছ। আমার কী অদ্ভুত ভালো লাগছিল বলে বোঝাতে পারব না। মনে হচ্ছিল সেই আগের দিনের মত আমি আমার পড়ার টেবিলে গিয়ে বসি, জানলা খুলে দেখতে থাকি তোমায়। বিকেলের কমলা রোদ ঝকঝক করতে থাকুক গীটারের রিডগুলোতে। সেই আগের মত তোমার মাথা নাড়ানো, ঝাঁকড়া চুল উড়তে থাকা হাওয়ায়...মনে হচ্ছিল সব আবার আগের মত হয়ে যাক। কিন্তু তা আর সম্ভব নয়। মনে হচ্ছিল ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরি তোমায়। জড়িয়ে ধরে বলি, 'এইতো আমি। এইতো তোমার কাছে।'

মাকে একদিন তোমার কথা বলেছিলাম। মা বলেছিল, 'একদিন গিয়ে বলব নাকি?' শুনে আমি লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছিলাম। এখন সন্ধ্যেবেলায় মা যখন প্রদীপ জ্বালায়, মনে হয় এক ফুঁয়ে নিভিয়ে দিই। ছুট্টে গিয়ে মাকে বলি, 'যাও মা। আজই বল গিয়ে।' আমার মধ্যে কারা যেন কাঁদতে থাকে। মোমবাতি থেকে গলে যাওয়া মোম গড়িয়ে পড়তে থাকে আমার চোখের জলের মত। একরাশ অন্ধকার ভিড় করে আমাকে তোমার থেকে দূরে আরও অন্ধকারে নিয়ে যেতে থাকে।

সেদিন আমি তোমার বাড়িতেই যাচ্ছিলাম। রাস্তায় ওই লোকগুলো আমায় ধাওয়া করলো। তারপর আস্তে আস্তে ভেঙে দিল বরপুতুল-কনেপুতুলের বিয়ে, রান্নাবাটি, খেলার ঘর সব। আমি তখন শুধু তোমার কথাই ভাবছিলাম। ওরা ফাঁকা পেপসির ক্যানের মত আমায় দুমড়েমুচড়ে দিচ্ছিল আর আমি আবছা দৃষ্টিতে দেখছিলাম তোমার ঘরের জানলাটাকে। তারপর আমি যখন ন্যাকড়া হয়ে গেলাম ওরা মশলামুড়ির ঠোঙার মত ছুঁড়ে ফেলে দিল আমায়।

জ্ঞান ফিরতে দেখি আমার দেহটা ঘিরে একদল লোক। সেদিন তোমার চোখের দিকে দেখেছিলাম আমি। অন্য সবার থেকে তুমি আলাদা। সবার চোখে ছিল আমার ছেঁড়া জামাকাপড় ভেদ করে শরীরের অলিগলি দেখার প্রচেষ্টা। তোমার তা ছিল না। একবার মনে হল তোমার কানে কানে বলি, 'একবার হাতের আঙুলটা ছুঁয়ে দেখ। এখনো ভালবাসা লেগে আছে ওতে।' তারপর যখন আমার শরীরটা পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছিল, আমি উঁচু ডালে বসে দেখছিলাম, মা কাঁদছিল, বাবা কাঁদছিল; তুমিও কাঁদছিলে কি?

আমার খুব মনে পড়ে, মা ছোটবেলায় ঘুম পাড়িয়ে দিত, ছড়া কাটতো আয় ঘুম যায় ঘুম। তুমি আরেকদিন মাঝরাতে ব্যাল্কনিতে বসে ওই গানটা আরেকবার গাইবে তো,- তখন চাঁদের আলো থাকবে, গীটারের রিডগুলো থেকে ঝরে পড়বে গলন্ত জ্যোৎস্না, তুমি সেইরকম ভাবে গান গাইবে, সেইরকম ভাবে মাথা নাড়াবে, টুপটাপ শিশির পরবে...তারপর তুমি আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়বে। আমি তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেব, তারপর তোমায় জড়িয়ে ধরে চুপটি করে তোমার বুকের উপর শুয়ে পড়বো। চাঁদ থাকবে আকাশে, আর আমি গান করব, 'আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে...'

তারপর আবার একটা সূর্য উঠবে, আবার তুমি গীটার বাজিয়ে গান করবে, আবার বিকেলের কমলা রোদ ঝকঝক করবে গীটারের রিডগুলোতে। কিন্তু তোমার গান শুনতে তখন আমি আর আসব না। সেইরাতেই তো তোমাকে আমার পাওয়া হয়ে গেছে...

ইতি
পরিনীতা

0 comments: