প্রাচীন-কথাঃ স্বপন দেব
Posted in প্রাচীন কথা
প্রাচীন-কথা
সেই রাতে
স্বপন দেব
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ সমাপ্ত। পাণ্ডবেরা বিজয়ী। ধার্তরাষ্ট্রেরা নিহত। শুধু আহত, পঙ্গু, প্রায় চলৎশক্তিহীন, শূন্য-অস্ত্র দুর্যোধনকে তাঁর নিজস্ব নিয়তির হাতে ছেড়ে দিয়েছেন – পাণ্ডবেরা। এই সেই নিশুতি রাত। ঘোষণা হয়েছে প্রশাসনিক প্রক্রিয়া শুরু হবে – পরবর্তী সূর্যোদয়ের সাথে। গণদাহকার্য হবে অগণিত লাশের। একদা যারা বীর ছিল, অন্তত সৈনিক। ঘোষণা হয়েছে, কেউ ইচ্ছা করলে, শনাক্ত করতে পারলে, ওই স্তূপ ঘেঁটে নিয়ে যেতে পারেন প্রিয়জনদের দেহ বা দেহাংশ – প্রথানুগ সৎকারের জন্য। সেই নিশুতি রাতে। এপারে কুরুক্ষেত্র প্রান্তরে, অথবা নির্লিপ্ত নদীস্রোত পেরিয়ে ওপারে, পাণ্ডবশিবিরে সব মশাল জ্বালানিহীন হয়ে অন্ধকার। সেই রাতে। কৌরব পক্ষের পরিচিত অথচ জীবিত, আহত তবুও সক্ষম শেষ তিন ব্যক্তি এক গোপন ষড়যন্ত্রে মিলিত হচ্ছেন। জীবিত বলেই সম্ভবত। কৃপাচার্য,কৃতবর্মা এবং অশ্বত্থামা। যুদ্ধশেষের পরে অশ্বত্থামা দূর্যোধনের কাছে জানতে চেয়েছিলেন তাঁর শেষ ইচ্ছার কথা। দুর্যোধন জানিয়েছিলেন, তাঁর শেষ ইচ্ছা তিনি পাণ্ডবদের মৃত দেখতে চান। নৌকো বেয়ে নদী পেরিয়ে পৌঁছিয়ে যাচ্ছেন তারা নিদ্রিত পাণ্ডবশিবিরে। অশ্বত্থামা ক্লান্তি ও নিশ্চিন্ততায় নিদ্রিত ছয় রাজপুরুষের শির দেহভাগ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছেন পঞ্চপাণ্ডব এবং তাদের সেনাপতি ধৃষ্টদ্যুম্ন ভেবে। সেই নিশুতি রাতে, অন্ধকারে ঘুমিয়ে থাকা, ধৃষ্টদ্যুম্নের ওই পাঁচ সাথী – প্রতিবিন্দ্য, শ্রুতসেন, শতাণীক, শ্রুতসোম ও শ্রুতকীর্তি। দ্রৌপদীর পাঁচ সন্তান। পাণ্ডবদের ঔরসজাত। নদী পেরিয়েপালিয়ে যাচ্ছেন অশ্বত্থামারা। দ্রৌপদীকে এই পৃথিবীতে সন্তান-বন্ধনহীন, ভ্রাতৃহীন ক’রে। ঊষার আলোয় জেগে উঠছে পাণ্ডব শিবির। আতঙ্কে। বিস্ময়ে ক্রোধে। কে বা কারা ? কারা ? কারা ? কে ? কে ? ওই কোলাহলই হয়ত,দ্রৌপদীকে জানিয়ে দিচ্ছে সংবাদ।
দ্রৌপদী, পাশাখেলার রাজসভার অপমানের বদলায় – যুদ্ধ জয়ে সদ্য তৃপ্ত দ্রৌপদী, রণসাজ খুলে পাঁচ দয়িতকে আবার আপন করে পাওয়ার স্বপ্নে নিদ্রিত দ্রৌপদী – ছুটে আসছেন অকুস্থলে।
পঞ্চ-পুত্রের মৃতদেহের সামনে দণ্ডায়মান দ্রৌপদী। আমি জানি আমাকে কী করতে হবে। আমার কী করা উচিত। আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার আর কোনও প্রয়োজন নেই, কৃষ্ণ। আমি সম্মতি দেব ওদের দেহ সৎকারের। দেব। শুধু একটা কাজ একটু করবে কৃষ্ণ? এই যে আমার পাঁচ সন্তানের দেহ অংশের সাথে ওদের ছিন্ন হয়ে যাওয়া শির তোমরা সাজিয়ে রেখেছ…ওগুলো যথাযথ সাজানো হয়নি। তোমার পঞ্চ সখাকে বলবে মুখাবয়ব দেখে…ওই বিচ্ছিন্ন মুণ্ডগুলোয় যা এখনো জেগে রয়েছে…সেই মুখাবয়ব দেখে ঠিক ঠিক মতো সাজিয়ে রাখতে…প্রতিবিন্ধ্যের দেহের সঙ্গে তাঁরটাই…শতানীক, শ্রুতসোম, শ্রুতকীর্তি, শ্রুতসেন…ওদের তো অন্তত এটুকু আকাঙ্খা থাকতেই পারে-শেষবার আগুনের কাছে ওরা স্বপূর্ণ নিজস্ব পরিচয়ে আশ্রয় নেবে। নিজের শরীরের সাথে নিজের…অবশ্য সম্পূর্ণ, নিটোল নিজস্ব পরিচয় ওরা জীবিত অবস্থাতেও পায়নি কখনো…। বলবে কৃষ্ণ, তোমার পাঁচ বন্ধুকে? হ্যাঁ! আমি জানি ওরা পারবেন না। কারণ ওঁরা কেউ চেনেন না এদের। শিশু শরীরে জন্মচিহ্নগুলো দেহের সাথে বাড়তে বাড়তে কী আকার, কী রং নিয়েছে জানেন না ওঁরা। এদের কাউকেই তো ওঁরা নিজের নিজের সন্তান বলে ভাবেননি কখনও। সব ভাই-এর মিলিত ধান্যক্ষেত্রে যেই বীজ সিঞ্চন করুন না কেন – ফসল যেমন সকলের – এরাও তেমনি।
ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির, পরাক্রমী ভীম, ধীরোদাত্ত অর্জুন, কন্দর্পপুত্র নকুল সহদেব – কেউই তো নিজের কাছে নিশ্চিত নন প্রতিবিন্ধ্য না শ্রুতসোম…না শতানীক…না শ্রুতকীর্তি…না শ্রুতসেন…ঠিক কে…কে ওঁর নিজস্ব সন্তান। হ্যাঁ মহর্ষি ব্যাস এদের এক একজনের লিখিত পরিচয় স্থির করেছিলেন-শ্রুতসেন যুথিষ্ঠিরের সন্তান…শ্রুতকীর্তি অর্জুনের ঔরসজাত…ব্যাস স্থির করেছিলেন…কিন্তু ওরা কেউই তো নিশ্চিত নয়…দ্রৌপদীও না। সে তো সবার সাথেই শয্যাগমন করে চলেছে ক্রমাগত। এরাও ওদের পাঁচজনকেই পিতা বলে সম্বোধন করে এসেছে। আমৃত্যু। তাই এরা শুধুই নিশ্চিতদ্রৌপদীর সন্তান। সম্পূর্ণ, নিটোল নিজস্ব পরিচয়…এরা জীবিত অবস্থাতেই পায়নি কখনো। আর শুধু ওই দ্রৌপদীর সন্তান বলেই যার কাছে আদর ছিল ওদের…হাতের তালুতে করে শৈশব থেকে কৈশোর পার করে যৌবনে পৌঁছে দিয়েছে…আমার ভাই…ধৃষ্টদ্যুম্ন সে তো মৃত্যুতেও সঙ্গী হয়েছে ওদের। সে চিনতো…দীর্ঘতম কেশের অধিকারী শতানীকের বাঁ পায়ের বুড়ো আঙুলে রথচক্রে পিষ্ট হওয়ার ক্ষত আছে…। চিনত…কৃষ্ণ। মনে পড়ছে তোমার কৃষ্ণ ? অভিমন্যুর মৃত্যুর পর প্রিয়তম অর্জুনের হাহাকার। কান্না। সুভদ্রাকে বুকে জড়িয়ে। তোমার সান্ত্বনাবাক্য ভেসে গিয়েছিল বন্যার খড়কুটোর মতো…মনে পড়ছে ঘটোৎকচের মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে ভীমসেনের তাণ্ডব…মনে পড়ছে? স্বাভাবিক ছিল। পুত্রের জন্য, নির্মমভাবে নিহত পুত্রের জন্য, তাদের পিতাদের ওই শোক। স্বাভাবিকই ছিল। আমার ভীষণ মনে পড়ছে কৃষ্ণ। মনে পড়তো না হয়তো…কিন্তু, তুমি আমাকে ঘিরে অথচ নিরাপদ দুরত্বে দাঁড়ানো ওই পাঁচজনের দিকে তাকাও কৃষ্ণ। ওই পাঁচজোড়া চোখে অসতর্ক পরাজয়ের লজ্জা, অপমান, ক্রোধ আছে। অপরাধ বোধ আছে ওই আনত মুখগুলোয়। কিন্তু সন্তান হারানো পিতার কান্না? কই?
উঠে দাঁড়ান দ্রৌপদী। শেষবারের মতো শায়িত মৃতদেহগুলির দিকে তাকিয়ে দূরে সরিয়ে নিতে থাকেন নিজেকে।
আমি স্বীকার করলাম। আমার ভাই ও সন্তানদের মৃত্যু। আপনারা ওদের মৃতদেহ ও মুণ্ডুগুলি সৎকারের জন্য নিয়ে যেতে পারেন।
চলে যান দ্রৌপদী তাঁকে ঘিরে থাকা ভিড় পেরিয়ে। দূরে। মৃতদেহগুলি সৎকারের জন্য নিয়ে যাওয়ার গুঞ্জন, আয়োজন শোনা যায়। দূর প্রান্ত থেকেই কথা বলেন দ্রৌপদী, না তাকিয়ে। কারণ শেষবারের মতো তিনি দেখে নিয়েছেন তাঁর সন্তানদের।
শোন কৃষ্ণ, পাণ্ডব সেনাপতি মহারথী ধৃষ্টদ্যুম্নের সৎকারের জন্য যদি উপযুক্ত কাউকে জীবিত না পাওয়া যায়, আমি নিজেই করবো।
সকলেই চলে গেছেন। সুভদ্রা এসে দাঁড়িয়েছেন দ্রৌপদীর পিছনটিতে।
তুমি যাও সুভদ্রা। আমি একটু একা থাকতে চাই। এখানে।
সুভদ্রাও চলে যান। তাই শূন্য প্রান্তরের মতো এ শূন্য মঞ্চেও দ্রৌপদী একাকী। এখন। তাঁর চোখে জল নেই তো! নিভন্ত দাবানলের মতো অপ্রত্যক্ষ আগুন আর পুড়ে কালো হয়ে যাওয়া বৃক্ষের বিষাদময় নির্লিপ্ততা। সময় নেন তিনি। তারপর সরাসরি কথা বলেন নিজের সাথে।
অশ্বত্থামার কপালে মণি বসানো আছে। তার আলোয় ওই চাঁদহীন রাতের জমাট অন্ধকারে সে পথ চিনে পৌঁছোতে পেরেছিল পাণ্ডব শিবিরে। খুন করেছিল ঘুমিয়ে থাকা আমার পাঁচ-পাঁচটা ছেলেকেই। অবশ্য পঞ্চপাণ্ডব আর তাদের পরামর্শদাতা কৃষ্ণ ভেবে। আমি এরপর মহারাজ যুধিষ্ঠিরের কাছে চাইব অশ্বত্থামার জীবন। সে নাকি অমর। সেক্ষেত্রে অন্তত তার মাথার ওই মণি। চাইব। আমার পাঁচ ছেলের অকাল মৃত্যুর বিনিময়ে। প্রতিশোধে। যুথিষ্ঠির তাঁর স্বভাব অনুযায়ী আমার প্রতিশোধ স্পৃহায় সম্মতি জানাতে দ্বিধাবোধ করবেন। ধর্মবোধ তাকে বাধা দেবে বৌ-এর ইচ্ছে পালনের জন্য আর কাউকে খুন করতে। যুদ্ধ শেষের পর। তাও ভাগের বউ। ভাগ! তখন আমি ভীমকে বলবো, আমার সন্তানদের মৃত্যুতে তোমাদের শোক না হতে পারে, কিন্তু তুমি যদি আমাকে ভালবেসে থাক, তাহলে অশ্বত্থামার মণি আমাকে উপহার দাও। এই একটা কথা, একটা প্রশ্ন, একটা সংশয়ের সামনে অমন তাগড়া ভীমের সব জারিজুরি শেষ। তাকে বারবার নিজের কাছে প্রমাণ দিতে হয় – সে-ই সবচেয়ে ভালবাসে দ্রৌপদীকে। ভালবাসে। যুথিষ্ঠিরের মতো ধর্ম মেনে নয়। অর্জুনের মতো নায়কোচিত দুরত্ব থেকে নয়। নকুল বা সহদেবের মতো শ্রদ্ধা-বিস্ময় মিশিয়ে নয়। ভালবাসে। প্রেমিকের মতো। আবেগতাড়িত পুরুষের মতো। তাই সে আবারও রওনা দেবে -অশ্বত্থামাকে খুঁজে বের করতে। আরও একজন মানুষ অবশ্য আছেন, যার প্রমাণ করার কোনও দায় নেই, কিন্তু এই কৃষ্ণা-দ্রৌপদীর যন্ত্রনা, আকাঙ্ক্ষাকে ছুঁয়ে দেখার মতো মন আছে। ইচ্ছে আছে। তাগিদ আছে। তিনি অর্জুনকে নির্দেশ দেবেন ভীমের সাথে যেতে। নির্দেশ দেবেন। আর, অর্জুনকে তো নির্দেশ দিতে হবে। নির্দেশ মানবে সে। না হলে একটা মেয়েছেলের শোক-সময়ের কামনাকে গুরুত্ব দেওয়ার মতো সাধারণ পুরুষ তো তিনি নন। তিনি অর্জুন। জরাসন্ধ, কর্ণকে মেরে ফেলার পর বীরের তালিকায় তিনি চোখ বন্ধ করে এক নম্বর। ভীম ছদ্মবেশে লুকিয়ে থাকা, ছাই দিয়ে মণি ঢেকে রাখা অশ্বত্থামাকে খুঁজে বের করবে। তার কপাল থেকে উপড়ে নেবে মণি। দুই হাতে করে আমার সামনে তুলে ধরবে – কৌরব পক্ষের শেষ সম্মানের প্রতীক। এবং এই প্রথম সে আমাকে হিসেব দেবে – আমাকে দেওয়া সব কথা সে কীভাবে পালন করেছে- দুর্যোধনকে খুন করে, দুঃশাসনের রক্ত পান করে, ধৃতরাষ্টের সব ছেলেগুলোর লাশ একের পর এক সাজিয়ে কুরুক্ষেত্রে…হিসেব দেবে। এই প্রথম। তার চোখে একটাই শুধু প্রশ্ন জেগে থাকবে, একটাই অনুরোধ তোমার পুত্রদের হত্যাকারী দ্রোণপুত্রের মাথার মণিও তোমায় এনে দিলাম – এরপরও কী তোমার প্রতিহিংসা বাকি রয়ে যাবে? এরপরও কী তুমি নিজের কাছে`যুদ্ধ শেষ’ ঘোষণা করতে পারবে না দ্রৌপদী?
অসাধারণ লেখা! মুগ্ধ হলাম!
ReplyDelete