প্রবন্ধঃ সুপ্রভাত লাহিড়ী
Posted in প্রবন্ধ
প্রবন্ধ
বিশ্বকবির আঁকা ছবি
সুপ্রভাত লাহিড়ী
রবীন্দ্র চিত্রকলা সম্বন্ধে আলোচনা করার আগে গঙ্গাজলে গঙ্গাপূজা করে নিলে, অর্থাত্ তাঁরই অঙ্কিত চিত্র সম্বন্ধে সম্যক জানতে হলে, তাঁরই বক্তব্য তুলে ধরলে এই আলোচনা ভূমিকা পর্বের পথ সুগম হয়ে যায়। চিত্রলিপির ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ বলেছেন:
People often ask me about the meaning of my pictures. I remain silent even as my pictures are. It is for them to express and not to explain. They have nothing ulterior behind their own appearance for the thoughts to explore and words to describe and if that appearance carries its ultimate worth then they remain, otherwise they are rejected and forgotten even though they may have some scientific truth or ethical justification. অর্থাত্:
লোকে প্রায়ই আমার আঁকা ছবির অর্থ কী তা আমায় জিজ্ঞাসা করে। আমিও আমার ছবির ন্যায় নীরব থাকি। ব্যক্ত করাই তো ওদের কাজ, ব্যাখ্যা করা নয়। পরিষ্ফুট রূপের পিছনে কী আছে যে চিন্তা দিয়ে আবিষ্কার করতে হবে, ভাষা দিয়ে বর্ণনা করতে হবে। সেই প্রস্ফুটন যদি যথার্থরূপে বর্ণিত হয়, তবেই তো ওরা রইল, নচেত্ ওরা পরিত্যক্ত এবং বিস্মৃত হতে বাধ্য; যতই তার মধ্যে নিহিত থাক বিজ্ঞানের কোনো তথ্য বা সত্য অথবা নৈতিক কোনো যুক্তি অথবা নৈতিক কোনো যুক্তিযুক্ততা।
ছবি আঁকার ব্যাপারে আগ্রহ ও কৌতুহল তরুণ বয়স থেকেই রবীন্দ্রনাথের ছিল। কিন্তু ছবি আঁকার ব্যাপারে তাঁর একাগ্রতা দেখা যায় প্রায় সত্তর বছর বয়সে। রবীন্দ্রনাথের ছবি আঁকার সূত্র নিহিত আছে কবিতার খাতায়, বর্জিত ছত্র এবং স্তবকগুলির মধ্যে। পাণ্ডুলিপির কাটাকুটি স্বতন্ত্র কিংবা সংযুক্তভাবে এক-একটা ছাঁদ নিয়ে গড়ে উঠেছে। শিল্পগুরু নন্দলাল বসুর ভাষায়, ‘……এখানে সেখানে আর-একটু কারিকুরি করলেই কোনোটি ফুল, কোনোটি পাখি, কোনোটা আবার অপরিচিত অদ্ভুত প্রাণী হেন সাকার শরীরী হয়ে উঠেছে-ঠিকটি না হয়ে ওঠা পর্যন্ত লেখক হিসাবে, লেখ শিল্পী হিসাবে তাঁরও কিছুতেই রেহাই নেই। ভাবের বাঙ্ময় প্রকাশ তাঁর সারা জীবনের সাধনা ও সিদ্ধি, এক্ষেত্রেও অপরিচ্ছন্ন অসম্পূর্ণতা তাঁর পক্ষে সহ্য করা কঠিন। ফলে স্বতঃ উদ্ভূত রূপের নিরুপণে ক্রমেই রবীন্দ্রনাথ আকৃষ্ট হলেন রঙ নিয়ে, তুলি নিয়ে, রীতিমত ছবি আঁকাও শুরু হয়ে গেল.....।’
নিছক কাটাকুটি করতে করতে যে সৃষ্টি তিনি করেছিলেন তা আমাদের শুধু অপার বিস্ময়েই অভিভূত করে না, সময়ে সময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে যায় তাঁর এই রূপ সৃষ্টির মাধ্যমের কথা ভাবলে!
রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবির প্রসংগে স্টেলা ক্রামরিশ এর মত হল, রবীন্দ্রনাথের হাতের লেখার ছাঁদেই নিহিত ছবির অঙ্কুর। ছবির রেখা এসেছিল হাতের লেখার ছন্দ থেকে। তাঁর মনে হয়েছিল যে কোনাচে খোঁচাওয়ালা রেখাসম্পাত ছিল ইচ্ছাকৃত।
পরিতোষ সেনও মনে করেছিলেন যে রবীন্দ্রনাথের ছবি, হাতের লেখা থেকেই উদগত হয়েছিল। তাঁর ভাষায় ‘রবীন্দ্রনাথের হস্তাক্ষরে এরকমই একটা সূক্ষ্ণ সম্পূর্ণতা আছে যা শ্রেষ্ঠ শিল্পকার্যে থাকে।’
স্টেলা ক্রামরিশ মনে করেছিলেন, রঙ ব্যাবহারের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ খানিকটা জাপানী ছবির দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন। অথচ রবীন্দ্রনাথের ছবির রঙ গাঢ় এবং তীব্র, পক্ষান্তরে জাপানী ছবির রঙ হালকা, স্বচ্ছ এবং অনুজ্জ্বল। বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ও এই মত পোষণ করেছিলেন যে রবীন্দ্রনাথের রুচি ছিল ভিন্ন।
দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরির মতে, ‘কবির ছবিকে কোনো ট্র্যাডিশান, স্টাইল, টেকনিক ইত্যাদির সংগে তুলনা করে ভালমন্দের মানদন্ডে চড়ানো চলে না। তাঁর ছবিতে তাঁর প্রকাশভঙ্গি বিচার করতে হলে আমাদের যুগের মানুষকে ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে হবে। চিত্রাঙ্কনের সাংস্কারিক রীতি মেনে শিল্পকে চলতি নিয়মের আশ্রয় নিতেই হবে এমন শর্ত সুন্দরের আইনে বাঁধা নেই।’
রবীন্দ্রনাথের ছবি সম্পর্কে অলোচনায় প্রথম লেখেন কোঁতেম এনা এলিসাবেং ব্লাঁকো হ্যা দ’ নোয়াই। ফরাসী ভাষায় লেখা এই আলোচনা, যা বাংলায় তর্জমা করলে দাঁড়ায় ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দৃশ্যমান স্বপ্ন।’ উনিশশো ত্রিশের ৪মে, প্যারির তেয়াতর পিগাল-এ উদ্বোধিত রবীন্দ্রনাথের ছবির প্রথম প্রদর্শনী পুস্তিকায় ছাপা হয়। এই আলোচনার ইংরাজী অনুবাদ ‘মডার্ন রিভিউ’ পত্রিকায় ছাপা হয়। কোঁতেম দ নোয়াই-এর এই লেখাটির সংগে শ্রীমতী আর॰এস॰মিলওয়ার্ট-এর লেখা একটি আলোচনাও ‘মডার্ন রিভিউ’ তে ছাপা হয়। ‘রুপম’ পত্রিকায় উনিশশো ত্রিশের এপ্রিল, অক্টোবর সংখ্যায় আনন্দ সংখ্যায় আনন্দ কোন্টিশ কুমার স্বামীর যে আলোচনা প্রকাশিত হয় সেটি ডিসেম্বরের ন্যুইয়ার্কে অনুষ্ঠিত রবীন্দ্রনাথের ছবির প্রদর্শনী পুস্তিকায় পুনর্মুদ্রিত হয়।
মস্কোর স্টেট ম্যুজিয়ামে কবির চিত্র প্রদর্শনীতে এত্রিয়াকোফ আর্ট গ্যালারীর অধ্যক্ষ অধ্যাপক ক্রিস্টি কবিকে স্বাগত জানিয়ে জনতার সামনে বলেছিলেন, ‘রবীন্দ্রনাথকে আমরা দার্শনিক, কবি বলেই জানতাম। আর তাঁর ছবি একটা খামখেয়ালী ব্যাপার বলেই জানা ছিল। কিন্তু আজ তাঁর ছবি দেখে বিস্মিত হয়েছি।’
কলকাতায় উনিশশো বত্রিশে রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবির প্রদর্শনী দেখে ডঃ সরসীলাল সরকার একটি মনোজ্ঞ আলোচনা লিখেছিলেন। বাংলা ভাষায় রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবি সম্পর্কে এটিই ছিল প্রথম আলোচনা। আবার বিরূপ মন্তব্যও হয়েছিল অনেক পত্রপত্রিকায়। ‘এজরা পাউন্ড’ এবং ‘রোঁমা রোঁলা’ রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলা সম্বন্ধে বিরূপ মন্তব্য করতে ছাড়েননি। রবীন্দ্রনাথ নাথ যে ‘রং কানা’ এটাও রোঁমা রোঁলার সেই আলোচনায় পাওয়া যায়। কোঁতেম এনা রবীন্দ্রনাথকে তাঁর ছবির প্রদর্শনীর বছর দশেক আগে দেখেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তখন তাঁর কাছে রহস্যবাদী সন্ন্যাসী কবি রূপেই পরিগণিত হয়েছিলেন। সেই কবির মায়াময় সুশোভন হস্ত থেকে প্রজ্বলিত ছবি তাঁকে অপার বিস্ময়ে নিমজ্জিত করেছিল। রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও ছবি যেন দাঁড়িয়ে আছে দুই প্রান্তসীমায়।
কুমার স্বামীর মতে, ‘এই ছবি অকৃত্রিমভাবে মৌলিক, এর অভিব্যক্তি অকৃত্রিম ও অকপট একজন প্রাজ্ঞ বৃদ্ধের মধ্যে এক অসাধারণ চিরযুগের উপস্থিতি এই ছবি ঘোষণা করেছে...এতে শিশুসুলভ সরলতা আছে, ছেলেমি নেই...কবিতা তাঁকে সামাজিক মর্যাদা দিলেও তাঁর ব্যক্তিপরিচয় কবিতায় নেই।’ কুমার স্বামীর কথায় উইলিউম ব্লেইক ও রবীন্দ্রনাথ দুজনেই ছবি আঁকিয়ে রহস্যবাদী কবি হলেও দুজনের মধ্যে একটি মৌলিক পার্থক্য ছিল। ব্লেইকের বিবরণধর্মী ছবির আশ্রয় কবিতার চৌহদ্দিতে আর পাণ্ডুলিপির কাটাকুটি থেকে রবীন্দ্রনাথের ছবি আঁকার ব্যাপার উদগত হলেও কবিতাকে ছেড়ে সে রূপ নিয়েছে এক অপূর্ব সৃষ্টিতে।
স্টক হোমস এক দৈনিকের আলোচনায় বলেছিলেন যে, ‘এই চিত্রকলা দেশ, কাল, পাত্র নিরপেক্ষতায় সর্বকালের বৈচিত্রকে তুলে ধরতে উত্সুক...প্রচলিত কোনো শিল্পনীতির ছকেই এই ছবিকে ফেলা যাবে না। এখানে আর এক রবীন্দ্রনাথকে দেখছি যিনি আমাদের কাছে সম্পুর্ণ নূতন।....মনে হয় এই রবীন্দ্রনাথ নিজের কাছেও সম্পূর্ণ পরিচিত নন। এ যেন ঠিক আদিম কালের সমুদ্র, আবহমানকাল থেকে সূর্য ও চন্দ্র কিরণের প্রতিবিম্ব যে আপনবক্ষে বহন করে চলেছে....অথচ সেই সমুদ্রই জানে না, কী তার পরিমাপ, কী তার গভীরতা!’
রবীন্দ্রনাথ এক চিঠিতে সরসীলালকে লিখেছিলেন, ‘ছবির কথা কিছুই বুঝি নে। ও গুলো স্বপনের ঝোঁক, ওদের ঝোঁক রঙিন নৃত্য....সৃষ্টি কেন হয় তার ব্যাখ্যা অসম্ভব।’
রবীন্দ্রনাথ তাঁর আঁকা ছবিতে নাম দিতেন না। কেন দিতেন না, তা স্পষ্ট করেই তিনি জানিয়ে ছিলেন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় এবং দিলীপ কুমার রায়কে। অথচ রবীন্দ্রনাথের ছবির নামকরণ প্রসঙ্গে রানী চন্দ ‘সব হতে আপন’এ লিখেছেন, ‘প্রতিটি ছবির নাম চাই। সব ছবি গুরুদেবের ঘরে আনা হল। বড়দারা সবাই আছেন। এক একটি করে ছবি এনে গুরুদেবের সামনে ধরি, গুরুদেব ছবির নামকরণ করেন।’ সংশয়ের সৃষ্টি সেখানেই। কারণ, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে লেখা রবীন্দ্রনাথের যে চিঠি ‘প্রবাসী’তে ছাপা হয়েছিল, তাতেই পরিষ্কার ভাবে তাঁর মত উদ্ধৃত ছিল, ‘ছবিতে নাম দেওয়া একেবারেই অসম্ভব।’ রবীম্দ্রনাথের ছবির নামকরণ সম্পর্কিত বক্তব্য সম্বন্ধে সংশয় থেকেই যায়, কারণ রানী চন্দ্রের ‘সব হতে আপন’ রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর দীর্ঘকাল পরে প্রকাশিত হয়েছিল।
রবীন্দ্রনাথের ছবি নিয়ে বিভিন্ন আর্ট ক্রিটিকরা বিভিন্নভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। এই স্বল্প পরিসরে এবং প্রতিবেদকের চিত্রকলা সম্বন্ধে সীমিত জ্ঞান নিমিত্ত, এ বিষয়ের আলোচনা আর প্রসারিত করা বোধহয় ঠিক হবে না। তবে রবীন্দ্রনাথের ছবির মধ্যে এমন একটা মৌলিকতা আছে, আছে এমন ছন্দোময় অখণ্ডতা, যা সহজেই সকলকে আকৃষ্ট করে। আকৃষ্ট করে খ্যাতনামা চিত্রকলাবিদদেরও। তাঁর ছবির ব্যাপ্তি, গভীরতা প্রমাণ দেয় তাঁর জীবন সম্বন্ধে অতল অভিজ্ঞতাপ্রসূত গভীর জ্ঞান। তাই শিল্পাচার্য অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, 'অতীতের বিশদ সঞ্চয়, অন্তরের অতি গভীর 'উষ্ণতা ও তাপ' রঙে রূপে, রবীন্দ্রনাথের ছবিতে প্রকাশ পেয়েছে....এত রঙ, এত রেখা, এত ভাব সঞ্চিত ছিল অন্তরের গুহায়, যা সাহিত্যে কুলোলো না, গানে হলো না....শেষে অগ্নিগিরির উদগীরণের মতো ছবিতেও ফুটে বের হতে হলো....। আর এই থেকে আর্টের পন্ডিতেরা কোনো আইন বের করে যে কাজে লাগাতে পারবে, আমার তা মনে হয় না।'
সংকেত সুত্র:
১)শ্রী নন্দলাল বসু- 'গুরুদেবের আঁকা ছবি(রবীন্দ্রায়ন:২য় খন্ড)
২)The meaning of Art, Rabindranath Tagore, Lalit Kala Academy, New Delhi॰
৩)Comtesse Qde Noailles 'Rabindranath Tagore's dreams made visible:
Rabindranath Tagore's Paintings: Modern Review-1930
৪)Ananda K॰ Coomaraswamy-'Drawings by Rabindranath Tagore:
Rupam, April-October,1930॰
৫)সরসীলাল সরকার; রবীন্দ্রনাথের চিত্রশিল্প; বিচিত্রা, পৌষ, ১৩৩৯।
৬) রানী চন্দ, ‘সব হতে আপন’ বিশ্বভারতী,১৩৯১।
৭) শোভন সোম, ‘রবীন্দ্র চিত্রকলা’-জন্মশতবর্ষ পরবর্তী আলোচনা’,
বিভাব (বিশেষ রবীন্দ্র সংখ্যা; ১৩৯৪)
৮) অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর; আর্ট প্রসংগ, বিশ্বভারতী, শ্রাবণ, ১৩৪৯।
ঋদ্ধ হলাম !!
ReplyDelete