0

রম্যরচনাঃ জয়া চৌধুরী

Posted in



রম্যরচনা



বুদ্ধু ভুতুম
জয়া চৌধুরী


এই এক ঝামেলায় পড়লাম। “খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে কাল হলো তার এঁড়ে গরু কিনে”। দিব্যি খাচ্ছিদাচ্ছি বাজার করছি শীতের ফুলকপি কড়াইশুঁটি নলেন গুড় জয়নগরের মোয়া এটসেট্রা এটসেট্রা, তার মধ্যে কি না বুদ্ধি টুদ্ধি নিয়ে বাকতাল্লা ঝাড়ার নেমন্তন্ন। আজকাল মহা সমস্যায় পড়া গেছি। যক্ষনি খবরের কাগজটা হাতে নিই রোজ দেখি আজ অমুক ভচ্চায কিম্বা তমুক সঈদ মশাই এ পক্ষীয় ও পক্ষীয় মিছিলে হেঁটেছেন... ভাবনায় পড়ে যাই। ...তবে কি বুদ্ধিজীবীরা হাঁটাহাঁটি করার সময় বুদ্ধি দিয়ে হাঁটেন? কিন্তু আমাদের বাড়ির সাহায্যকারিনী যখন বালিগঞ্জ ইস্টেশান থেকে সোজা কুড়ি মিনিট হন্টন করে আমার বাড়ি বাসন মাজা আর কড়াই ঘষার কাজে লাগে, তখন কি সে তার বুদ্ধিলোপ করে হাঁটে? কই তাকে তো কেউ বুদ্ধিজীবী বলে না। না কি হাঁটলে তার মাথা সাফ হয় এবং সে বাড়ি এসে গভীর মনোযোগ ও বুদ্ধি দিয়ে স্কচ ব্রাইট ঘষে পোড়া ডেকচি থেকে কালি ঝুলি তোলে। কিন্তু যেহেতু কলঙ্ক মোচিত হয় এবং তার ফলে তার কান দিয়ে বুদ্ধি ভুস করে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়, তাই তাকে আর কেউ বুদ্ধিজীবী বলার সাহস পায় না। নাকি বুদ্ধিজীবীরা প্রতি শ্বাসের সঙ্গে এক পাফ বুদ্ধি গুঁজে নেয় নাকে নস্যের মত, তাই তাকে বুদ্ধিজীবী বলা হয়। কিন্তু তাই যদি হবে, তা হলে তো তা সাময়িক। টেম্পো মাল দিয়ে দিলে খদ্দের তো তা ধরেই ফেলবে দুদিন যেতে না যেতেই। কই বুদ্ধিজীবীরা তো ধরা পড়েন না? বরং একবার গায়ে গড়ের মাঠের পাল পাল ভেড়ার মত রঙিন দাগে বুদ্ধিজীবী দাগালে তার আর কোন পরিবর্তন হয় না! তখন শুধু আম পিপলের কাজ তাদের ভজনা করা। “দাদা আজ বলেছেন বিকেল বা রাত শব্দের মানে নেই। ওটা হলো ভ্রম ওটা হলো মনের অসুখ। সকাল বিকেল রাত ... এই সব বিভেদ করা চলবে না। ২৪ ঘন্টা –র আবর্তন গতির পুরোটা জুড়েই শুধু সকাল। ঐক্য না থাকলে চলবে? দুনিয়ার ভেদাভেদ দূর হটো।”...দেখেচো!!! কি বুদ্ধি! কি বাক্‌ চাতুর্য্য! এর পরেও নিন্দুকেরা মনে মনে এঁদের নাম দেন “বুদ্ধির ঢেঁকি’ । 

আর হ্যাঁ আগেকার দিনে লোকেরা দুই ধরণের কামকাজ করতো। তাদের কেউ ছিলো বুদ্ধিজীবী কেউ বা বৃত্তিজীবী। বৃত্তি মানে ধরুন গে চাষ করা, মাছ ধরা, মড়া পোড়ানো, দোকানদারী করা, চুল কাঁটা, তাত বোনা...উফফফ হাঁফিয়ে গেলাম আরো কত কত রোজকার জীবন চালানোর কাজ... এই যে সব কাজের নাম করলুম তার কোনটা করতে বুদ্ধি না লাগে শুনি? বোকার মত মাটি কোপালেই রবি শস্য খরিফ শস্যে মাঠ ম ম করবে? না কি মড়া পোড়াতে গিয়ে শ্মশান যাত্রী পুড়িয়ে দিলে আত্মার সদ্গতি হবে! নয় তো তাঁত চালাতে গিয়ে চুল কেটে ফেললে পরনে লজ্জা বস্ত্র উঠবে? এইসব করতে যদি বুদ্ধিই না লাগবে তালে সব্বাই তো এগুলি করতে পারতো ...তাই না? তবু বাপু এরা বৃত্তিধারী। বেশ তাই না হয় মানলুম। তবে ঘাড় চুলকে এট্টা কথা মনে করে দিই বাবুমশায়দের । এই যে সব “ইয়ে” রা ...ওই মালোপাড়া কিংবা সোনাগাছিতে রঙ চং মেখে ম্যাগো কি ঢ্যামনামোই না করে... এদের কে কি বৃত্তিজীবী বলা যাবে? তাহলে কি বাকী বৃত্তিজীবীরা সমশ্রেণীর বলে আশ্বস্ত বোধ করবে? নিরামিষ প্রশ্নটি রেখে গেলাম বাবুমশায়রা আপুনাদের চরণে। এদের কাজও মূলতঃ গতর ঘামানো এবং একটু আধটু বুদ্ধি দিয়ে করলেই উতরোনো যায় এইসব কাজ। কিন্তু বুদ্ধিকে যারা জীবিকা নিতেন তাদেরই তো পুরোনো নিয়মে বুদ্ধিজীবী বলতো তাই না? তা বুদ্ধিজীবী মানে মূলতঃ শিক্ষক উকিল ডাক্তার ইত্যাদি শ্রেণীই নিশ্চয় বোঝাতো। যারা গতরের চেয়েও বেশি মগজ ঘামাতেন... কবে থেকে যেন সাহিত্যিকদের বুদ্ধিজীবী বলা চালু হলো। অর্থাৎ গায়ক যারা, নর্তক যারা, বাদক যারা, তাদের বাপু বুদ্ধি লাগে না...কিন্তু তারা তো গতরজীবীও নয় মুলতঃ! তাদেরকে তালে কোন মার্কায় দাগানো যায় বলুন তো? ও; থুড়ি এখন আবার এদেরও বদ্ধিজীবীই বলা হয়। রাজনীতির কারণে এরা মাঝে মধ্যে গলায় অঙ্গবস্ত্র পড়ে টিভি বাইট দেন আর তিন মিটার ব্যাপী মহা মিছিলে প্রায়শই হাঁটাহাঁটি করেন। ফুটবল ক্রিকেট হকির মত খেলায় জানতুম ক্যালি লাগে দারুণ। প্রতিভা আর প্র্যাকটিস আর দাদা ধরে টিমে ঢুকে তারা দর্শক সমর্থক মন মজাতে পারেন। তাদের এতদিন বুদ্ধি ছিলো বলে জানতাম না। এখন দেখি এরাও বুদ্ধিজীবীদের দলে। যাক বাবা এদের একটা গতি হলো । কারণ যাদের যাদের নামকরণ করা যায় নি ... এই যেমন ধরুন স্মাগলার, বেশ্যা, মেয়ে পাচারকারী, ছ্যাঁচড়া চোর ইত্যাদি বৃত্তিজীবী ও বুদ্ধিজীবীর বাইরে বিশেষজীবীদের দলে এই সব খেলোয়াড়েরাও না হলে ঢুকে পড়তেন। কি কেলেঙ্কারিয়াস আব্রাকাডাব্রা ব্যাপার হত তালে বলুন তো? 

আর একটা টাইপের কথা তো বলিই নি। এই সাধারণ লোক নামক অটল বিগ্রহ শ্রেনীটি... তাদের কোন ছাঁচে ছাঁচিকুমড়ো বানানো যায় বলুন দিকিনি? সাধারণেরা বাজার সদাই করে, মেয়ে কে ছেলেকে ইস্কুলে পৌঁছে‌ ব্যাঙ্কে যায়, বিয়েবাড়ি নেমন্তন্ন, ‌ দার্জিলি-লাদাখ-পেলিং মাঝে সাঝে ছবি তোলে, ফেসবুকে সাহিত্য মারায়, থুক্কু চর্চা করে, পুরোনো বউয়ের কাছে বিছানায় না ঘেঁষতে পেরে অবরে সবরে কলঘরে সানি লেওনের নামে দেওয়াল চুণকাম করে, তারা তালে কোন্‌ শ্রেণী? বিশেষজীবী বললে কিন্তু মহা বিপদ... সমশ্রেণীতে অন্য গুনধরেরাও আছেন যে! এই সব জটিল ই ইজ ইকুয়াল্টু এম সি স্কোয়্যার সমস্যায় জেরবার হয়ে গেলাম এক্কেবারে। সকাল থেকে কলম কামড়ে বসে কম্মো কাবার হবার দশা। নামকরণের জটিল বিষুববৃত্তীয় আবর্তনে এক্কেবারে কেঁচে গণ্ডূষ! এখন থেকে ভাবছি আমরা যারা সাধারণ মানুষ তারা অপশন বেছে নেবো সমাজে নিজের পরিচয় দেবার ক্যাটাগরিটি। আমরা যারা বুদ্ধিজীবী, বৃত্তিজীবী বা বিশেষজীবী নই, তাদের বরং ইচ্ছেজীবী নাম হোক। এই ধরুন সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে আমরা যাবতীয় বিষয়ে যখন নিজের মত বিতরণ করবো, থুক্কু জানাবো, তখন আমাদের বুদ্ধিজীবী বলা হবে। আবার যখন ধরুন প্রাইভেট ফার্মে মহারাজাধিরাজ বসমাণিক্য-এর সামনে কাছা কোঁচা এক করে থরথর করে নিজেদের যাবতীয় কুকম্মো বা নিকম্মো-র জন্য দাবড়ানি খাব, তখন আমাদের বৃত্তিজীবী বলা হবে। হ্যাঁ, আমরা তখন নিপীড়িত শ্রেণীর বৃত্তিজীবী বলেই অভিহিত হবো সমাজের কাছে। আহা “ কি ঘোর নিশীথ নীরব ধরা/ পথ যে কোথায় দেখা নাহি পাই...” সমিস্যে এট্টু হবে অন্য ক্ষেত্রে। যখন আমরা বকেয়া প্রভিডেন্ড ফান্ডের টাকা নেবার জন্য পুরোনো অফিসে যাব। যদি ডেস্কের ওধারে থাকি তালে আমরা বৃত্তিজীবী। আমরা সাধারণ কেরানী মাত্র... টেবিলে টেবিলে ফাইলের ফাঁসে তো আটকে রাখি নি দাদা। এসব সিস্টেমের দোষ। আমার টেবিলে ও ফাইল আসা মাত্রই আমি সিগনেচার করে দেবো। আগের মত তো আর কাজ পড়ে থাকে না আজকাল। সব অফিসে গাদাগুচ্ছের কম্পিউটার। টেবিলে টেবিলে কাজ আজকাল ঝড়ের বেগে হয়। (হয় বুঝি! কি জানি! আমি তো মেসো মশাইকে বারবার শুকনো মুখে পুরোনো অফিস থেকে ফিরতে দেখি প্রত্যেক মাসে নিয়ম করে।) । আর যদি ডেস্কের এধারে থাকি তালে আমরা তিক্ত অসহায় সাধারণ মানুষ। যতদিন টেবিলের ওধারে ছিলাম ক্ষমতা দেখিয়েছি দশহাত। আমাদের সুভাষ জ্যেঠু বা বিপিন কাকুর পেনশন ফাইলটা আটকে রেখেছিলাম পাক্কা ১০ টি বছর। কারণ আমাদের কো অর্ডিনেশন কমিটির সংগ্রামী মিটিং নিয়ে বড়ই ব্যস্ত থাকতাম তো! জ্যেঠুর বড় ছেলেটা ৪২ বছর পর্যন্ত চাকরী না পেয়ে শেষ মেষ গলায় দড়ি দিয়েছিলো অবশ্য। সত্যি এইসব লোকেরা এত দুর্বল হয়! 

...এই সব মন্দ কথা কিংবা সত্য কথার মধ্য দিয়ে আসল কথাটা না পিছলে যায়। কথাটা হলো তালে সাধারণ মানুষ কোন জীবী হয়ে সমাজের সামনে পরিচয় দেবে? আজ থেকে বরং তাদের নাম হোক “ইচ্ছেজীবী” । ইচ্ছে মত দল পাল্টাপাল্টি না করলে গণ ধোলাই বা ইভ টিজিং এর মজা মিস হয়ে যায় মশাই। আমরা ঝালেও থাকবো পিঠে পুলিতেও। আসল কথা মৌজ করা। আসল কথা গা বাঁচানো। আসল কথা সদসৎ গুলিয়ে দেওয়া। আসল কথা এলোমেলো করে দে মা লুটে পুটে খাই। জয় ইচ্ছে মানুষের জয়। জয় ইচ্ছেজীবীর জয়। জয় অমনুষ্যত্বের জয়। চালাও পানসি বেলঘরিয়া...

0 comments: