বিশেষ প্রতিবেদনঃ মনোজিৎকুমার দাস
Posted in বিশেষ প্রতিবেদন
বিশেষ প্রতিবেদন
শ্রদ্ধাঞ্জলিঃ সুচিত্রা ভট্টাচার্য
মধ্যবিত্ত বাঙালি জীবনের চালচিত্র অঙ্কনের নিপুন কথাশিল্পী
মনোজিৎকুমার দাস
সমকালীন মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজের নর নারীর ব্যক্তিগত সম্পর্কের টানাপোড়েন, বর্তমান যুগের নীতিবোধের ক্রমোবনতি, নৈতিক অবক্ষয়, নারীদের দুঃখ-যন্ত্রণার চালচিত্র বাংলা সাহিত্যে সুনিপুন ভাবে তুলে আনা কথাসাহিত্যিক সুচিত্রা ভট্টাচার্য ( ১০ জানুয়ারি ১৯৫০- ১২ মে ২০১৫) ৬৫ বছর বয়সে ২০১৫ সালের ১২ই মে স্থানীয় সময় রাত ১০ টা ৪৫ মিনিটে কলকাতার ঢাকুরিয়ার নিজ বাসভবনে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে লোকান্তরিত হলেন।
সুচিত্রা ভট্টাচার্য বিশ শতকের সত্তর দশক থেকে একুশ শতকের চলতি দশক পর্যন্ত নানা ক্ষেত্রে পরিবর্তনের বাস্তবচিত্র তাঁর ছোটগল্প ও উপন্যাসে তুলে ধরেছেন মেধা, মনন ও বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে। তিনি গত শতকের সত্তর দশক থেকে ছোটগল্প লিখতে শুরু করেন। আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে উপন্যাস রচনায় আত্মনিয়োগ করেন।
বাঙালি, বিশেষ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নর নারীর আটপৌরে জীবনের কাহিনী তিনি তুলে ধরেছেন তাঁর লেখা ছোটগল্প ও উপন্যাসগুলিতে। তাঁর লেখা উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলি হল: কাছের মানুষ, দহন, কাঁচের দেওয়াল, হেমন্তের পাখি, নীলঘূর্ণি, অলীক সুখ, গভীর অসুখ, উড়ো মেঘ, ছেঁড়া তার, আলোছায়া, অন্য বসন্ত, পরবাস, পালাবার পথ নেই, আমি রাইকিশোরী, রঙিন পৃথিবী, জলছবি, যখন যুদ্ধ ভাঙ্গন কাল, আয়নামহল ইত্যাদি।
সুচিত্রা ভট্টাচার্য এর ছোটগল্পের মধ্যে রয়েছে- মেঘপাহাড়, সুহেলি, ভালো মেয়ে খারাপ মেয়ে, দাগবসন্তি খেলা, আলোছায়া, তুতুল, ইত্যাদি।
অন্যদিকে, তাঁর শিশুতোষ গ্রন্থগুলি হল: তিন মিতিন, কেরালায় কিস্তিমাত, জনাথনের বাড়ির ভূত, জার্মান গনেশ, শুধু ভূত, ইত্যাদি।
তাছাড়া তাঁর অন্যান্য গ্রন্থগুলো হল: অচিন পাখি, অন্য বসন্ত, আঁধারবেলা, আছি, একা জীবন, এখন হৃদয়, গহীন হৃদয়, চেনামুখ অচেনা মুখ, জলছবি, দাবানলের দেশে, ধুসর বিষাদ, নীলঘূর্ণি, পরবাস, পালাবার পথ নেই, মন্থন, মাঝরাতের অতিথি, ময়নাতদন্ত, শুধু প্রেম, শূন্য থেকে শূন্য, শেষ বেলায়, শেষ শান্তিপুর লোকাল, সময় অসময়, সর্পরহস্য সুন্দরবনে, সুখ দুঃখ, হলুদগাঁদার বনে, ইত্যাদি।
সাহিত্যে অনন্য অবদানের জন্য তিনি বেশকিছু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। এর মধ্যে দহন উপন্যাসের জন্য কর্ণাটকের বেঙ্গালুরুর শাশ্বতী সংস্থা থেকে পেয়েছেন ননজনাগুড়ু থিরুমালাম্বা জাতীয় পুরস্কার (১৯৯৬)। এ ছাড়া উল্লেখযোগ্য পুরস্কারগুলি হলো- কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূবনমোহিনী মেডেল (২০০৪), কথা পুরস্কার (১৯৯৭), তারাশংকর পুরস্কার(২০০০), দ্বিজেন্দ্রলাল পুরস্কার (২০০১), শরৎ পুরস্কার (২০০২), ভারত নির্মাণ পুরস্কার, সাহিত্য সেতু পুরস্কার,শৈলজানন্দ স্মৃতি পুরস্কার। তার বহু উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। সুচিত্রা ভট্টাচার্যের সাহিত্যকর্ম নিয়ে আলোচনার আগে তাঁর ব্যক্তিজীবনের উপর স্বল্পপরিসরে তুলে ধরা যেতে পারে। সুচিত্রাভট্টাচার্য ১৯৫০ সালে ১০ই জানুয়ারি ভারতের বিহারের ভাগলপুরে মামারবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিত্রালয় মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুর শহরে। পড়াশোনা কলকাতার স্কুল ও কলেজে। তিনি কলকাতার যোগমায়া দেবী কলেজ থেকে স্নাতক হন।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষালাভের সময় তিনি বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন। বিভিন্ন স্থানে চাকরি করার পর তিনি সরকারী চাকরিতে যোগদান করেন। লেখিকা হিসেবে সম্পূ্র্ণ রূপে সময় দেওয়ার জন্য তিনি ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে তাঁর চাকরি থেকে ইস্তফা দেন।
বিশ্বায়ন ও মুক্তবাজার অর্থনীতির পরিপ্রক্ষিতে বাঙালির সমাজ জীবনের নারী পুরুষদের মধ্যে যে টালমালা অবস্থার সৃষ্টিহয়ে নানা ক্ষেত্রে যে ধরনের নৈতিক অবক্ষয় সৃষ্টি হয়, পরিবারে বিশেষ করে যৌথ পরিবারে নানা নারীদের দুঃখ-যন্ত্রণাতাঁর রচনাগুলির মূল উপজীব্য ছিল। প্রায় সাড়ে তিন দশক ধরে তিনি বহু ছোট গল্প ছাড়াও চব্বিশটি উপন্যাস রচনা করেছেন।
সুচিত্রা ভট্টাচার্য স্কুলে পড়াশোনা কাল থেকেই সাহিত্যে প্রতি অনুরক্ত হন। তিনি একবার বলেছিলেন যে ক্লাস সিক্সে পড়াকালে ‘ ফুলশয্যা ‘নামে একটি গল্প লিখে সকলকে বিস্মিত করেছিলেন। যদিও তিনি সত্তর দশকের শেষ দিক থেকে বাংলাসাহিত্য জগতে পুরোপুরি ভাবে সম্পৃক্ত হন। আগেই বলা হয়েছে তার লেখা গল্প ও উপন্যাসে আটপৌরে জীবনের কথা উঠেএসেছে। সুচিত্রা ভট্টাচার্য তাঁর নিজস্ব চিন্তাচেতার আলোকে শহুরে মধ্য বিত্ত নারী পুরুষের পোড় খাওয়া জীবনের কাহিনী অতি বাস্তবতার আলো চিত্রিত করেছেন বলেই গল্প ও উপন্যাস এতটা পাঠক প্রিয় হয়েছে।
সুচিত্রার লেখাতে বারবারই ঘুরে ফিরে এসেছে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের আত্মিক দিক ও নানা জটিলতা। নারীদের নিজস্ব জগতের যন্ত্রণা এবং সমস্যার কথাও ফুটে উঠেছে তার লেখায়।
তার বৃহত্তম উপন্যাস ‘কাছের মানুষ’ ছিল অত্যন্ত জীবন ঘনিষ্ঠ। দারুণ চরিত্রায়নের কারণে যা প্রশংসিত হয়েছিল। ‘কাছের মানুষ’ উপন্যাসটিকে তাঁর মাস্টার পিস হিসাবে বিবেচিত করা হয়ে থাকে। তাঁর গল্প ও উপন্যাসগুলো নিয়মিত কলকাতার দেশপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
মধ্যবিত্ত বাঙালি নর নারীর জীবনের চালচিত্র অঙ্কনের নিপুন শিল্পী সুচিত্রা ভট্টাচার্যের মহাপ্রয়াণে অনেক অনেক শ্রদ্ধাঞ্জলি। তিনি লোকান্তরিত হলেও তাঁর সাহিত্যকর্ম তাঁকে বাংলা সাহিত্যে চির ভাস্বর করে রাখবে।
0 comments: