অনুবাদ সাহিত্যঃ ইন্দ্রাণী ঘোষ
Posted in অনুবাদ সাহিত্যঅনুবাদ সাহিত্য
পিতামহীর প্রতিকৃতি
ইন্দ্রাণী ঘোষ
আমার ঠাকুমা আর পাঁচজন ঠাকুমার মতই সাধারণ ছিলেন। চামড়া কুঁচকে যাওয়া, বয়েসের ভারে ঝুঁকে যাওয়া এক সাধারণ মহিলা । আমার ঠাকুরদা আজানুলম্বিত দাড়ি গোঁফের মাঝে ছবিতে আটকে থাকা এক ছবি শুধু। তাঁর রক্তমাংসের অস্তিত্বের ছবি আমরা ।
কল্পনাতেও আনতে পারি নি, ঠাকুমার কুচকে যাওয়া চামড়াতে কোনদিন যে লাবণ্য ছিল বা কিশোরীর চপলতা তাঁর দেহপল্লবে কখন খেলা করেছে, আমার কাছে এ সমস্ত ঠাকুমার গল্পের মতই অলীক ।
ঠাকুমা একটি হাত কোমরে রেখে তাঁর স্থূলকায় ন্যুব্জ অস্তিত্বকে সামাল দিত, অন্য হাতে থাকত জপের মালা। চোখ ধাঁধান সুন্দরী নন, কিন্তু তিনি সুন্দরী ।শুভ্র কেশগুচ্ছ থোপা থোপা সাদা ফুলের মত তাঁর মুখমণ্ডলের চারিপাশ ঘিরে থাকত। মুখময় বলিরেখার কোথায় যে শেষ, কোথায় যে শুরু, বোঝা মুশকিল। বরফের পাহাড়ের শুভ্র দৃশ্যপটের মত, শান্তির প্রতীকের মত ছিলেন আমার ঠাকুমা ।
আমার ঠাকুমা আমার বন্ধু ছিলেন । আমায় সকালে ডেকে স্কুল পাঠানোর দায়িত্ব ছিল আমার ঠাকুমার । স্কুল যাওয়ার আগে আমায় স্নান করিয়ে জোরে জোরে মন্ত্র পাঠ করতেন ঠাকুমা । সেই মন্ত্র আমার কণ্ঠস্থ হয়ে যাক, এই তাঁর উদ্দেশ্য ছিল। তবে মন্ত্র শেখার কোন আগ্রহ আমার কোনদিন হয় নি । হাতে গড়া রুটি মাখন আর চিনি দিয়ে প্রাতঃরাশ সেরে আমি আর ঠাকুমা ইস্কুল যেতাম, কারণ ইস্কুল আর মন্দির গা লাগোয়া ছিল । আমরা বর্ণমালা শিখতাম আর ঠাকুমা মন্দিরের ভিতরকার ধর্মীয় লিপিগুলি পড়তেন ।
বাবা, মা শহরে পাকাপাকি বসবাস শুরু করলে, আমি আর ঠাকুমা তাদের সাথে থাকতে শুরু করলাম। এই সময় আমাদের ঠাকুমা নাতি সম্পর্ক নতুন বাঁক নিল। শহরের ইংরেজি মাধ্যম ইস্কুলের পড়া ঠাকুমার বুঝতেন না। পাশ্চাত্য বিজ্ঞান, ইংরেজি সাহিত্য তাঁর ধরা ছোঁয়ার বাইরে ছিল। এরপর যখন শুনলেন, ইস্কুলে গান শেখান হয়, আমার সাথে বাক্যালাপ পুরোপুরি বন্ধ করলেন। সঙ্গীত তাঁর কাছে নিম্নবর্গের মানুষদের নিকৃষ্ট অভ্যাস বলে পরিচিত ছিল । বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হওয়ার পর আমার আলাদা ঘর হল। একদম নিজস্ব ঘর। দূরত্ব আরও বাড়ল । ঠাকুমা তাঁর সাধের চরকা থেকে মুখ তুলতেন না । পথসারমেয়দের রুটি দিতেন নিজে হাতে রোজ সকালে। ক্রমে তাঁর চলাফেরা বন্ধ হল, শুধু চড়াইদের খেতে দিতেন দুপুরবেলা । গুড়ো গুড়ো রুটির টুকরো চড়াইদের বরাদ্দ ছিল । শুধু এই সময়টুকু চরকা থেকে মুখ তুলে চাইতেন, আর এই সময় শত সহস্র চড়াই তাঁর চারিদিকে জড়ো হত । এরমধ্যে কয়েকটি চড়াই ঠাকুমার কাঁধে, মাথায় চড়ে বসত । ঠাকুমা মৃদু হাসতেন কোনদিন তাদের উড়িয়ে দিতে দেখি নি ।
এরপর আমার বিদেশ যাত্রা । আমাকে স্টেশনে তুলে দিতে এলেন । চোখে একফোঁটা জল নেই । আবেগের কোন প্রকাশ নেই। শুধু কপালে চুমুর টিপ এঁকে দিলেন। পাঁচ বছর বাদে ফিরে এসে দেখলাম সেই ঠাকুমাই রয়ে গেছেন। সেদিনও চড়াইগুলি এসেছে । ওদের সাথেই ঠাকুমার সবচেয়ে সুখের মুহূর্ত কাটছে, ওই দুপুরগুলো কেটে যাচ্ছে নিজস্ব ছন্দে । সন্ধ্যের দিকটায় এক অদ্ভুত পরিবর্তন এল । প্রতিবেশী মহিলাদের ডেকে নিয়ে বাড়ীর পুরনো ঢোলটা বার করে গান গাইতে শুরু করলেন । সৈনিকদের ঘরে ফেরার গান। অনেক রাতে বুঝিয়ে সুঝিয়ে তাঁকে নিরস্ত করা হল । পরদিন সকাল থেকে জ্বরে পড়লেন ঠাকুমা ।
আমাদের ডেকে বললেন তাঁর শেষ আসন্ন, আমাদের সাথে কথা বলে সময় নষ্ট করবেন না, জীবনের শেষ কটা মুহূর্ত তিনি শুধু প্রার্থনা করবেন। আমাদের কোন কথা কানে না তুলে ঠাকুমা প্রার্থনা শুরু করলেন। জপের মালাটি আঙ্গুল থেকে খসে পড়ল। এক প্রশান্তি ছেয়ে গেল বৃদ্ধার মুখে । ঠাকুমা চলে গেলেন। শেষ ক্রিয়াকর্মে আমরা ব্যাস্ত হয়ে পড়লাম ।
বিকেলে ঠাকুমার ঘরে গিয়ে দেখি দিনান্তের রবি ঘরের দেয়াল, বারান্দা জুড়ে রঙের খেলায় মেতেছেন । সমস্ত ঘর বারান্দা সোনালি আলোয় মোড়া, আর ঠাকুমার ঘরের চারিদিকে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে শত সহস্র চড়াই পাখী । মায়া হল আমাদের। রুটির টুকরো ভেঙে ওদের দিতে গেলাম মা আর আমি, ওরা ফিরেও চাইল না । পরদিন সকালে রুটির টুকরোগুলি ঝাঁট দিয়ে ফেলে দেওয়া হল ।
(খুসবন্ত সিং-এর "দ্য পোর্টরেট অফ আ লেডী" গল্প অবলম্বনে অনুবাদ গল্প )
0 comments: