ধারাবাহিকঃ নন্দিনী সেনগুপ্ত
Posted in ধারাবাহিক
ধারাবাহিক
ছুটি কথা ৯
নন্দিনী সেনগুপ্ত
আগের পর্বেই লিখেছিলাম যে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে আচ্ছন্ন হয়ে ছিলাম সেই শিশুকাল থেকে। কবিতা মানেই রবীন্দ্রনাথ, গান মানেও তিনি, গল্প তো শিশুবেলায় পড়িনি, তাই টের পাইনি। বাড়িতে একখানা নয়, দু-দুখানা ছবি। একটা মায়ের ঘরে, আর একটা ঠাম্মার ঘরে। মায়ের ঘরে পরিণতবয়স্ক দাড়িওয়ালা মুখের ছবি আর ঠাম্মার ঘরে জোব্বা-পরিহিত তরুণ। বাবা বিশাল বিশাল এলপি রেকর্ড কিনে আনে, হয় ইংরেজি গান, নয় রবীন্দ্রসঙ্গীত বা রবীন্দ্র-গীতিনাট্য। ঠাম্মার ঘরে রেকর্ডপ্লেয়ার। রাত্রে দক্ষিণের ঐ ঘরের জানালায় উড়ে যাচ্ছে মণিপুরী নীল পর্দায় রুপোলী কারুকাজ। রেকর্ডে বাজছে ‘মায়ার খেলা’য় মায়াকুমারীদের গান। আমি ভাতের থালা নিয়ে একছুটে রান্নাঘর থেকে চলে যাচ্ছি ঠাম্মার ঘরে। ‘গান শুনতে শুনতে খাব’ মাকে বলে যাই। ঠাম্মা আধশোয়া হয়ে বিছানায় শুয়ে গান শুনছে। কোনও মতে খাওয়া শেষ করে শুয়ে পড়ছি ঠাম্মার পাশে। সত্যি কি সেই রূপকথার মায়াজাল বিছানো আছে জলে স্থলে? গান শুনতে শুনতে তাকিয়ে আছি জানালা দিয়ে তারা-ভরা একটা অদ্ভুত নীল রাতের আকাশে। জানালা দিয়ে দক্ষিণ হাওয়ায় ভেসে আসছে পাশের বাড়ির শিউলিগাছের ফুলের সুগন্ধ। এত মায়া, এত সৌন্দর্য ছড়িয়ে আছে আকাশে বাতাসে এই গান না শুনলে কি জানতে পারতাম?
ঠাম্মার ঘরে থরে থরে সাজানো আছে রেকর্ডগুলি। যারা রবীন্দ্রসঙ্গীত করেন, তাদের ছবিসহ সেই রেকর্ডের রঙচঙে মলাটগুলি দেখি, বানান করে পড়ি নাম... কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। আরে- এ-এ, আমাদেরও তো পদবী বন্দ্যোপাধ্যায়, হুমম, এইবার বুঝলাম কেন ঠাম্মা এনারই গান শুনতে এত ভালবাসে। বাবা রেকর্ড চড়ালেই ঠাম্মা একগালে একটা পান গুঁজে বলে,... ‘রান্টু, কণিকা!’ একদিন বাবাকে বলতে শুনলাম ‘কি যে তোমার এই মৃত্যুর গানটা এত পছন্দ!’ ঠাম্মা আকাশের তারার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে... ‘আরে, এই মৃত্যুর মত অমোঘ আর কিছু নাই’ ! আচ্ছা ‘অমোঘ’ শব্দটার মানে কি? মঘাই পানের সঙ্গে কি এর কোন সম্পর্ক আছে? নাহ, এটা তাতু মানে আমার কাকাকে জিজ্ঞাসা করতে হবে। তাতু মাঝে মাঝে ঠাম্মার জন্যে স্পেশাল মঘাই পান নিয়ে আসে। এটার উত্তর একমাত্র তাতুই দিতে পারবে। অতএব, একদিন সন্ধ্যাবেলায় তাতু পান কিনে নিয়ে আসলো, আর আমি আমার প্রশ্নটা রাখলাম যে অমোঘ কি একধরনের পান নাকি অন্য কিছু? আর সেটা খেয়ে কি মানুষের মৃত্যু অবধি হতে পারে? তাতু তো কিছুই বোঝেনা, বলে, ‘কি যে নাই কথা কস!’ সেরেছে, ‘নাই কথা’ আবার কি? এটার মানে জানতে তো আবার ঠাম্মার কাছে যেতে হবে। গেলাম। ঠাম্মা একবারে বলে দিল যে কথার মানে হয়না, সে কথাই ‘নাই কথা’। বোঝো কাণ্ড, তার মানে ‘অমোঘ’ শব্দের কোনও মানে হয়না! দুত্তোর, বড়দের কাণ্ড-কারখানা মাঝে মাঝে বোঝা ভারী মুস্কিল। আমি বুঝলাম যে ঠাম্মা নিজেই আসলে ‘নাই কথা’ বলে।
শিশুবেলায় আমার নিজের বেশী ভালো লাগত দেবব্রত বিশ্বাস। গমগমে গলা, আর গাইতে শুরু করলে মনে হয় মানুষটা বোধহয় রেকর্ডের মধ্যে থেকেই ভারী হাসিখুশি মেজাজে গাইছেন। চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে আকাশভরা আনন্দ। বাবা বলে, জর্জদার গান। ব্যস, একবার যদি ঐ প্রসঙ্গ ওঠে তো বাবাকে থামায় কে? জর্জদা এই, জর্জদা সেই, প্রশংসার একেবারে বান ডাকে, সর্বোপরি গুণ, ‘এক্কেরে কি কমু, আমাগো মত বাঙাল ভাষায় কথা কয়, কিন্তু গান যখন গায়, দেখসো নি, কোনও বাঙাল টান নাই’! বাবা প্রায়ই ঐ জর্জদার বাসায় যায়। রবিবারে সকালে বাবা বাড়ি নেই মানে দেশপ্রিয় পার্কে।
আমার মা কিন্তু রবীন্দ্রসঙ্গীত একজনের গলাতেই শুনতে সবচেয়ে বেশী ভালবাসে। না, কোনও রেকর্ডের গান নয়। হ্যাঁ, বাবা যখন হারমোনিয়াম নামিয়ে বসে একের পর এক গান গায়, বেশীর ভাগই আমি জানি যে মা মাঝে মাঝেই রান্নাঘর থেকে এসে বলে দিয়ে যায় কোনটা বাবা গাইবে। এই তো সেদিন বাবার গান ছিল রেডিওতে, বাবা গেয়েছিল ‘ও জোনাকি, কি সুখে ঐ ডানা দুটি মেলেছো!’ এই গানটা মায়ের ভীষণ পছন্দের। মা আগের দিন বিকেলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল সোদপুরে খবর পাঠাবে বলে যে রেডিওতে বাবার গান আছে। বাবার কলেজে কাজ করে যে নেপালকাকু সে সোদপুরে আমার মামাবাড়ির কাছেই থাকে। নেপালকাকু বিকেলে আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়েই গিয়ে ট্রেনে ওঠে। বাবা তো আর নিজে থেকে কাউকে বলবে না যে রেডিওতে গান আছে। তাই মা সারা বিকেল বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল; যাক, নেপালকাকুকে মা বলে দিয়েছে। আমি জানি আমাদের বাড়ির মত সোদপুরে মামাবাড়িতেও রেডিওতে বাবার গান সব্বাই শুনেছিল, খবর চুঁচুড়াতে মাসির বাড়ি অবধি পৌঁছেছিল। সেখানেও সবাই শুনেছিল, বুবাই ও। তার পরেই তো পূজার ছুটিতে মামাবাড়িতে বুবাইএর সঙ্গে দেখা হল আর বুবাই ঐ কথাটা বলল।
আমার তো শুনে শুনেই রবীন্দ্রনাথের অনেক গান আর কবিতা মুখস্থ। আমার সামনে মা বলে তো মাঝে মাঝেই ‘সঞ্চয়িতা’ খুলে বসে আর বাবাও তো প্রচুর গান করে বাড়িতে থাকলেই। মামাবাড়িতে সব বাচ্চারা নাচ-গান করছে। আমিও গাইলাম, শ্যামা থেকে অনেকগুলো গান। কিছুদিন আগেই আমরা দেখেছি রবীন্দ্রসদনে সাধন গুহ আর পলি গুহের নাচ। কি অদ্ভুত সুন্দর স্টেজের উপর সেই নৃত্যভঙ্গিমা আর আলোছায়ার খেলা। শ্যামার রেকর্ড ও বাড়িতে আছে। অতএব, শ্যামা তখন সদ্য শেখা। সব্বাই ভারী ধন্য ধন্য করলে। বুবাইও আবৃত্তি করল। রবীন্দ্রনাথ নয় । সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। সেটাও খুব সুন্দর কবিতা। ‘ছিপখান তিনদাঁড়’ । আহা, কি ভাল ছন্দের চলন। কিন্তু তারপরে বিকেলে ছাদে গিয়ে বুবাই ঐ কথাটা না বললেও পারতো। বুবাই বলল, ‘এই যে রঞ্জনা, কি এত ড়বীন্দ্রনাথ, ড়বীন্দ্রনাথ করিস? জানিস তোর রবীন্দ্রনাথ একটা বুর্জোয়া কবি?’ না, না, না... আমি জানি না, আমি দুদ্দাড় দৌড়ে নেমে আসি ছাদের সিঁড়ি বেয়ে, কিচ্ছু জানি না, ‘বুর্জোয়া’ শব্দটার মানেই জানি না। কিন্তু বুবাই যেভাবে বলল, আমি জানি, স্থিরভাবে জানি, ওটা নিশ্চয়ই একটা খারাপ কথা। ওটা নিশ্চয়ই একটা গালাগালি। আমি এখুনি বাড়ি যাবো, আমার সোদপুরের আকাশ-পুকুর-বাগান কিচ্ছু, কিচ্ছু ভালো লাগছে না। আমি এখুনি বাড়ি গিয়ে অন্ধকার ঘরে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে কাঁদবো। না কাঁদলে আমি শান্ত হবো না। এখানে কোথাও একলা কোনও কোণ নেই, যেখানে আমি কাঁদতে পারি। আমি ঠিকমত খেলামও না সেদিন।
তারপর বেশ কিছুদিন মনমরা হয়ে ছিলাম। বাবা লক্ষ্য করেছে ঠিক, মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘মামনি, তোমার কি কিছু হয়েছে? মন খারাপ?’... আর কি না বলে পারা যায়? ঝরঝর কান্নার সঙ্গে বেরিয়ে এলো, ‘জানো বাবি? বুবাই রবীন্দ্রনাথকে একটা খারাপ কথা বলেছে। বল বাবি, ও কি এটা ভাল করলো?’ বাবা গম্ভীর হয়ে যায়, বলে ‘খারাপ কথা? কি খারাপ কথা?’ আমি বলে উঠি, ‘ও বলেছে বুর্জোয়া। এটা একটা খারাপ কথা। তাই না?’ এবার বাবা ঘর ফাটিয়ে হাহাহাহাহা করে হেসে উঠলো, ‘না রে মামনি, ওটা গালাগালি নয়, আমি তোকে বলছি। আর বুবাই যে বলেছে, ও তো না বুঝেই বলেছে। কোথা থেকে শুনে হয়তো বলেছে। আর তুই কিনা, তাই নিয়ে খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে আছিস? পাগলী একটা!’ কিন্তু আমি বাবার সঙ্গে সঙ্গে হেসেও উঠতে পারি না, আমার কষ্টটা তো অমনি কমে যাচ্ছে না। আমি আবার প্রশ্ন করি, ‘তাহলে বুর্জোয়া শব্দের মানে কি?’ বাবা এবার মুচকি হেসে বলে, ‘আমি যদি এখন তোকে, মানে একটা ক্লাস টুএর বাচ্চাকে ‘বুর্জোয়া’ শব্দের মানে বোঝাতে বসি, তাহলে তোর মা আর আমার মা দুজনে মিলে আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেবে। তবে নিশ্চিন্ত থাক, ওটা গালাগালি নয়। একদম না। বড় হলে তুই ঠিক বুঝবি’।
উফফ, কত কি যে বুঝবো বড় হলে, জানিনা। রবীন্দ্রনাথ ‘বুর্জোয়া’ কি না সেটা বুঝবো, নাকি যে অনেক গান, কবিতা যেগুলোর অর্থ আমি বুঝতে পারি না, সেগুলো বুঝবো। এই জীবনটা বোধহয় খুব ছোট এইসব, স-অ-অ-ব কিছু বোঝবার জন্য।
0 comments: