ছোটগল্পঃ ডঃ সুজিত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
Posted in ছোটগল্প
ছোটগল্প
আকাশের তারায় রক্ত জমা ঘাম
ডঃ সুজিত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
রামজীবন বাবু যেদিন অফিস থেকে অবসর গ্রহন করলেন, সেদিন রামজীবন বাবুর বিদায় সভায় প্রায় প্রত্যেক বক্তাই অকপটে স্বীকার করেছিলেন, রামজীবন বাবুর মত সময়নিষ্ট, সৎ এবং কোম্পানী অন্তঃপ্রাণ কর্মচারী আজকের যুগে প্রায় নেই বললেই চলে।
বিভিন্ন বক্তার কাছ থেকে যেটুকু জানা গেল, তা’ থেকে রামজীবন বাবু সম্পর্কে একটা পরিস্কার ছবিও পাওয়া যায় । মাত্র ষোল বছর বয়সে রামজীবন বাবু তাঁর কাকার সুপারিশে এই কোম্পানীতে অদক্ষ শ্রমিক হিসাবে ঢুকেছিলেন । বিদ্যার দৌড় ছিল কোন রকমে টেনেটুনে নয় ক্লাস পাশ । অল্প বয়সে (ছয় বছর যখন বয়স) পিতৃহীন । বিধবা মা, জ্ঞাতিদের দাক্ষিণ্যে শ্বশুরের ভিটেতে থাকবার অনুমতি, সংসারের পঁচাত্তর শতাংশ কাজ করার অলিখিত শর্তের পরিবর্তে, এক ছেলে সহ, পেয়েছিলেন । এইভাবে প্রায় নয় বছর কাটাবার পর ছোট দেওর, করুণা বশতঃ ছেলে রামুকে একটা কারখানায় কাজ জুটিয়ে দেন । অস্থায়ী অদক্ষ রামু বছর দুই / তিন হাড় ভাঙ্গা খাটুনির পরিবর্তে তিনটি জিনিষ লাভ করেছিল । প্রথমতঃ, স্থায়ী হেল্পারের স্বীকৃতি, মাস মাহিনা হয় আটত্রিশ টাকা বারো আনা । তখনও দেশ স্বাধীন হয় নি । কারখানার বড় কর্তাদের ‘সাহেব’ বলে ডাকতে হত । তারা ছিলও সাহেব । অবশ্য কেউ কেউ সাহেব ছিল না’ও বটে, কিন্তু তাদেরকেও সাহেব-ই বলতে হত । অভ্যাসটা তখন থেকেই গেঁথে যায় জিবের ডগায় । তাই শেষ দিন পর্যন্ত রামজীবন বাবু (সেদিনকার রামু) উপরের লোকদের সাহেব ছাড়া অন্য কিছু বলতে পারেন নি ।
দ্বিতীয়তঃ, কারখানার লাগোয়া মেজ সাহেবের কোয়ার্টারে থাকার জায়গা । পরিবর্তে রোজ সকালে মেজ সাহেবের কোয়ার্টারের লাগোয়া বাগানের গাছ গুলোতে জল দেওয়ার বাড়তি দায়িত্ব বর্তায় । এখন রামজীবন বাবু ভাল করেই জানেন (যদিও তখনকার রামু অতটা ঠিক জানত না) ঐ সব কোয়ার্টারগুলোকে বলা হত “সারভেন্ট কোয়ার্টার” । এখন অবশ্য কারখানার মধ্যেকার ঐ সব কোয়ার্টর গুলোকে, দারোয়ান, নাইটগার্ডদের কোয়ার্টার করে দেওয়া হয়েছে । আর কিছু জায়গা ভেঙ্গে কারখানার জায়গা বাড়ানো হয়েছে । নতুন ‘শপ’ করা হয়েছে । সে যাই হোক, ওই সময় থেকেই গাছ, বাগান ইত্যাদি গুলোও রামজীবনবাবুর অভ্যাসের তালিকা ভুক্ত হয়ে গেছে । অনেক পরে রামজীবনবাবু নিজে বাড়ী তৈরী করেছেন । শহর থেকে একটু দূরে বা বাইরে । কারখানায় আসতে যেতে ঘণ্টা খানেক সময় লাগে । বেশ ছিম-ছাম তিন-কামড়ার বাড়ী । সামনে আধ কাঠার থেকে একটু কম জায়গায় তৈরী করেছেন সেই সাহেবের বাগানের মত বাগান । নিজে হাতে রোজ ডিউটি থেকে বাড়ী ফিরে কিংবা ডিউটিতে যাওয়ার আগে (নাইট ডিঊটি থাকলে) গাছে জল দেন, যত্ন করেন । বড় গাছ কাটা কাঁচি দিয়ে গাছ ছাঁটেন । মাঝখানে একটুকরো জায়গায় নার্সারি থেকে দূর্বা ঘাসের বীজ এনে চাষ করেছেন । দূর থেকে দেখলে বা তাকালে মনে হয় যেন মখমলের জাজিম বিছানো আছে । কেঊ জিজ্ঞাসা করলে বলেন , “এইটুকুই ত’ আমার জন্য বরাদ্দ”। সময় পেলেই রামজীবনবাবু তাঁর বরাদ্দ জায়গার ওপর বসে থাকেন, কোন কোন সময় শুয়ে আকাশের তারার দিকে তাকিয়ে থাকেন । বিশেষ করে গরম কালের সন্ধ্যের আকাশের তলায় । ওপর দিকে তাকিয়ে ভাবেন, ওই সব তারা গুলোতে তাঁর মত কোন লোক আছে কি’না ! হয়তঃ তারাও তাকিয়ে আছে পৃথিবীর দিকে ।
রামজীবনবাবুর ছেলে, সৌমজীবন, ডাক্তার । সে বাবাকে বারণ করে ওভাবে শুয়ে থাকতে । রামজীবনবাবু বলেন, “আকাশের দিকে তাকালে পৃথিবীটাকে বিশাল মনে হয়”। আর তাতে না’কি তাঁর গর্ব হয় । এতবড় পৃথিবীর স্রষ্টাকে তাঁর আসনে বসে থাকতে দেখে তিনি এক নতুন আত্মতৃপ্তি পান । তাঁর মনে হয়, তিনি যেন এই সভ্যতার চালক । ছোট বয়সে মা’এর কাছে শুনেছিলেন, বিশ্বকর্মা এই পৃথিবীকে ছেণী হাতুড়ী দিয়ে কেটে কেটে যখন তৈরী করছিলেন, তখন স্রস্টা এখনকার মতোই বসে ছিলেন, তাঁর ওই আসনে । আসলে তিনি বিশ্বাস করতেন, বিশ্বকর্মা তাঁদের মতোই শ্রমিক ছিলেন ।
অনেকের কাছে রামজীবনবাবু গল্পের ছলে বলতেন, বিশ্বকর্মার সঙ্গে তাঁর এই মিল, তাঁকে কজের প্রেরণা যোগায় । তিনি নিজেকে বোঝাতেন বিশ্বকর্মার মত তাঁর সৃষ্টিও এক নতুন পৃথিবী সৃষ্টি করবে । রামজীবনবাবু যখন তাঁর শপের অধস্থনদের এই সব গল্পগুলো বলতেন, তখন তাঁর চোখেমুখে ফোরম্যান সুলভ অহংকারের পরিবর্তে শ্রমিক সুলভ গর্বটাই বেশী করে ফুটে ঊঠত । তাই তাঁর অধস্থনরা তাঁকে যত না বেশী ভয় করত, তার চেয়ে বেশী ভালবাসত । তারা জানত, তাদের কোন ভুল হলে তাদের পাশে স্যার – কাম-দাদাকে পাওয়া যাবে । রামজীবনবাবু বলতেন, “দ্যাখ, যা করবে, যতটুকু করবে, সবটাই শুধু মন দিয়ে করলে চলবে না, প্রাণ দিয়ে করতে হবে। কারণ মনে রেখ, তুমি যা তৈরী করছ, তা’ দিয়ে শিশুদের খেলনা তৈরী হবে । এই সব শিশুরাই আমাদের পৃথিবীটাকে বাঁচিয়ে রাখবে । তোমরা ত’ জান, এই চিন্তা আর ভালবাসাকে সামনে রেখে, একদিনের “সারভ্যান্ট কোয়ার্টারের” অদক্ষ রামু তার শপের ফোরম্যান, রামজীবনবাবু হয়েছে” ।
একবার তাঁর শপের নরেশ দত্ত, বল্টু কাটার সময় মাপের কিছু গণ্ডগোল করে । প্রোডাকশন ম্যানেজার ক্ষেপে আগুন । রামজীবনবাবুকে ডেকে হুকুম দিলেন “এক্ষুনি স্যাক হিম ফ্রম দ্য সারভিস” । কোনরকমে সাহেবকে ঠান্ডা করে, রামজীবনবাবু প্রায় ছত্রিশ ঘণ্টা একনাগাড়ে পরিশ্রম করে, নরেশ দত্তের ভুলের সংশোধন করে, “শপ কোটা” পূরণ করেছিলেন । অবশ্য অন্যকোন উপায়ও ছিল না । কারণ তাঁর “শপ কোটা” পূরণ না হলে, তাঁদের কোম্পানীর পুনে শাখার একটা ‘শপ’ প্রায় তিন / চারদিন বন্ধ করে রাখতে হত । হয়তঃ সেখানে ফার্নেস ‘শাট-ডাউন’ হয়ে যেত ।
বেশী পরিশ্রমের ফলে, রামজীবনবাবু অসুস্থ হয়ে প্রায় তিন দিন ছুটি নিতে বাধ্য হন । সেই সময় নরেশ দত্ত কুন্ঠিত পায়ে তাঁকে দেখতে গিয়েছিল । রামজীবনবাবু তাকে পাশে বসিয়ে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলে, “দ্যাখ নরেশ, এই সব সাহেবরা আজ না হয় কাল চলে যাবে । কিন্তু এই দেশ এই কারখানা – সবই ত’ আমাদের থাকবে । আমাদের শিশুরাই ত’ এইসব খেলনা ব্যবহার করবে । আর সে গুলোর মধ্যে কোন গলদ থাকলে ক্ষতি ত’ আমাদেরই হবে” ।
কথাগুলো নরেশ দত্ত রামজীবনবাবুর বিদায় সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে শুনিয়েছিলেন আমাদের ।
তৃতীয় যে লাভটা হয়েছিল, তা’ হল, রামজীবনবাবু দেশ থেকে মা-কে তাঁর নতুন পাওয়া কোয়ার্টারে, স্থায়ী হওয়ার পর, নিয়ে এসেছিলেন । এই গল্পটা শুনিয়েছিলেন রামজীবনবাবুর পাড়ার বন্ধু হিতেন স্যান্যাল । পেশায় শিক্ষক । অবসরের পর একসাথে রামজীবনবাবুকে বাড়ী নিয়ে যাবেন বলে বিশেষ অতিথি হিসাবে এসেছিলেন ।
রামজীবনবাবু বলেন তাঁর জীবনের গোড়াপত্তন না’কি তখন থেকেই শুরু হয় । তিনি না’কি তাঁর মা’কে দেখেই শিখেছিলেন, জীবনে কোন অবস্থাতেই পরাজয় স্বীকার করতে নেই । মাথা উচুঁ করে কাজ করলে আজ না হয় কাল তার ফল পাওয়া যাবেই । কথাটা রামজীবনবাবু অনেককেই অনেক বার বলেছেন । তবুও সবাই বলে, রামজীবনবাবুর জীবনে নাটকীয় উন্নতির কারণ, তাঁর সততা আর শেখার অদম্য উৎসাহ। রামজীবনবাবু কথাটা বিশ্বাস করতেন কি’না তা’ ঠিক বোঝা যেত না । কারণ সবকিছু শুনে তিনি মুচকি হেসে পাশ কাটিয়ে চলে যেতেন ।
হিতেন বাবুই বললেন, তার মানে কিন্তু এই নয় যে রামজবনবাবু কোন কিছু ভাবতেন না, অথবা, জীবন সম্পর্কে বা তার উত্থান পতন সম্পর্কে তাঁর কোন প্রতিক্রিয়া ছিল না । বরং বলা যায় উল্টোটা । তাঁকে খুব কাছ থেকে যাঁরা দেখেছেন বা জেনেছেন এবং বুঝেছেন, তাঁদের মধ্যে হিতেন বাবু একজন । তিনি বললেন, রামজীবনবাবুর না’কি একটা ভীষণ সংবেদনশীল মন ছিল । তিনি আদতে ছিলেন ভাবুক প্রকৃতির । একদিন তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “আচ্ছা রামু, তুমি এত ভাব কেন বলত ? তুমি ত’ চাকরী করছ, ডিউটির বিনিময়ে মালিক তোমায় মাইনে দিচ্ছে । কারখানায় কে কি তৈরী করছে, সে বিষয়ে তোমার ভাবারই বা’ কি’ আছে ? তোমায় জিজ্ঞাসা করে ত’ আর জিনিষ তৈরী হবে না । তা’ তোমার কারখানা নিয়ে অত স্বপ্নের কি আছে ?”
মাথা নেড়ে রামজীবনবাবু উত্তর দিতেন, “না হিতেন, এটা তুমি ঠিক বলছ না । তুমি ত’ মাস্টারী কর, তুমিই বল, আমার মত মূর্খ লোক, আজ এ’ জায়গায় পৌঁছালাম কি করে ? আমি যদি আমার কাজটাকে ভালই না বাসব, তাহলে কি আমার মধ্যে শেখার আগ্রহ জন্মাবে ? কাজে যোগ দেওয়ার পর যখন জানতে পারলাম, আমাদের কারখানায় ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের খেলনা তৈরী হয়, তখন থেকেই ভাবতে শুরু করলাম, আমি এমন একটা জিনিষ তৈরীর সাথে যুক্ত, যেটা নিয়ে শিশুরা প্রথম জগত চেনে, ঘাড় ঘুরিয়ে আকাশ দেখতে শেখে, আধো আধো ভঙ্গিতে প্রজাপতি ধরার জন্য হাত বাড়ায় । এত কিছুর জানা বোঝার পর, তুমি বল আমি কি করে নিজেকে সরিয়ে রাখব !
হাত নেড়ে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে হিতেন বাবু উত্তর দিয়েছিলেন, “তাতে কি ? তোমার খেলনা আর কতজনের মধ্যে যায় ! এসব ত’ বড়লোকেদের জন্যে” ।
রামজীবনবাবু বললেন, “ সেটা বড় কথা নয় । আসল কথা হল তুমি কি তৈরী করছ ! আর সেটা কি কাজে লাগছে । এই যে তুমি মাস্টারী কর । কতজন আর স্কুলের পর আরোও বেশী পড়ার সুযোগ পায় ? তবুও তুমি ভাবছ, তুমি কিছু মানুষকে শিক্ষিত করছ । যারা সমাজের মধ্যে অন্য এক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে । আর তাই রাস্তায় তোমায় যদি কেউ স্যার বলে ডাকে, তখনই তোমার চোখে ফুটে ওঠে সৃষ্টির অহংকার । আসলে কি জান, আমরা দেখতে চাই, সমাজকে কি দিলাম ! আমার কথাই ধর, আমরা তৈরী করছি যন্ত্র । জান হিতেন, কোথায় যেন পড়েছিলাম, আমরা শ্রমিকরা জন্ম নিয়েছি বিশ্বকর্মার ঘাম থেকে । পৃথিবী তৈরীর সময় ক্লান্ত বিশ্বকর্মা যতবার তাঁর কপালের ঘাম ঝেড়ে মাটিতে ফেলেছিলেন, ততবার ঘামের ফোঁটা থেকে সৃষ্টি হয়েছিল শ্রমিক । তাই শাস্ত্রে বলে, শ্রমিকের রক্ত হল ক্লান্ত স্রস্টা বিশ্বকর্মার ঘাম । আমরা তাই আমাদের সৃষ্টির মধ্যে খুঁজে পাই আমাদের পরিপূর্ণতা আমাদের আনন্দ । আর বিশ্বকর্মা আমাদের মধ্যে খুঁজে পান তাঁর আনন্দ ।
হিতেন বাবু বললেন, তিনি সেদিন অনুভব করেছিলেন ‘রামুর জীবনে স্বপ্নের গভীরতা । রামজীবন স্বপ্ন দেখতে পারে বলেই আজ সে ফোরম্যান হয়েছে । কই আমাদের জীবনে ত’ এ’রকম স্বপ্নিল উন্নতি ঘটে নি’ ।
এতক্ষণ তাঁর বিভিন্ন সহকর্মী স্মৃতিচারণ করার পর, এবার বড় সাহেবের পালা । তিনি প্রথমেই জানালেন, যে তিনি ভাল বক্তা একেবারেই নন, বরং কাজের লোক । যেমন ছিলেন রামজীবনবাবু । তিনি রামজীবনবাবুর কাজের কথা স্মরণ করে বললেন, এ’রকম লোক খুব কমই আছে যিনি অক্লেশে বলতে পারেন, যে দক্ষতায় তিনি এই শপ ঝাঁট দিয়ে মেশিন যেমন পরিস্কার করতে পারেন, সেই সমদক্ষতায় শপের প্রতিটি মেশিনের সামনে দাঁড়িয়ে উৎপাদন করতেও পারেন। তাই শেষ পর্যন্ত তিনিই হয়ে ওঠেন সেই “ব্যক্তি” যিনি সমস্ত মেশিনের চূড়ান্ত পরিচালক ও অন্যতম নির্ণায়ক ।
এই পর্যন্ত বলে বড় সাহেব থামলেন । পেছনের ফচকে অলক তার পাশের শ্যামলকে বলল, “ব্যাটা বেশ ভালই বলে”।
শ্যামল বলল, “ দেখছিস না হাতের মধ্যে কাগজ । আরে আমি ত’ জানি বড় কর্তাদের মধ্যে এই নিয়ে কথা হয়েছে”।
শ্যামলের আরেক পাশে বসা আবির কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “তাই না’কি ! কি কথা হয়েছে ? রামবাবুকে কি এক্সটেনশন দেওয়া হবে ?
অলক বলল, “নরেশ দার কপাল পুড়ল । বেচারী আর ফোরম্যান হতে পারবে না । জোড়া মানত বৃথা গেল”।
কিছুক্ষণ থেমে বড়সাহেব আবার বলতে শুরু করলেন, “ আপনাদের কাছে সত্যি কথা জানাই । রামজীবনবাবুর রিটায়ারমেন্টের বিষয়ে আমাদের সিদ্ধান্ত হয়েছিল, ওনাকে আরও কিছুদিন চাকরী করার অনুরোধ করা হবে”।
সামনে বসা নরেশের মুখটা কালো হয়ে গেল । ফাজিল অলক পেছনে আস্তে আস্তে বলল, “বেচারী” !! শ্যামল বলল, “রাম বাবুকে তোরা চিনিস না ?”
সামনের গ্লাসের জলে চুমুক দিয়ে বড় সাহেব বললেন, “কিন্তু কোন শর্তেই রামজীবনবাবুকে রাজী করান যায় নি । তাঁর কথা হল ‘আমি পদ আটকে রাখলে পরের জন শিখবে কি করে ?’ এ’ উদাহরণ সত্যি বিরল । আমরা তাঁকে এ’ পর্যন্ত অনুরোধ করেছিলাম, যাতে তিনি উপদেষ্টা হিসাবে কোম্পানীর সঙ্গে যুক্ত থাকেন । কিন্তু তিনি কোন সংযুক্তিই চান নি । তিনি সব বন্ধন থেকে মুক্ত হতে চান । তিনি জানিয়েছেন, অবসরকালে তাঁর নিজের হাতে তৈরী বাড়ির বাগান নিয়ে সময় কাটাবেন । তাঁর পাড়ার ছোট ছোট শিশুদের নিয়ে বাকী জীবনটা কাটিয়ে দেবেন । আমরা আর তাঁকে বাধা দিই নি, বা দিতে চাই নি । আমরা তাঁকে বলেছিলাম, ভাল ভাবে বাগান শিশুদের জন্যে করতে গেলে টাকা চাই । আমি বোর্ড এর তরফ থেকে ওনাকে অনুরোধ করেছিলা, তাঁর আর্থিক প্রয়োজনের পরিমান জানাতে । কোম্পানীর তরফ থেকে সেই অর্থ তাঁকে প্রদান করা হবে । আমি ফাঁকা চেক সংগে করে নিয়ে এসেছি । তিনি তাঁর প্রয়োজনের কথা বললে আমি তা’ বসিয়ে দেব ।
নিস্তব্ধ সভায় সবাই সপ্রশংস চোখে হতবাক । কোম্পানীর এই উদার চেহারা সবার কাছে অপরিচিত ছিল । মঞ্চের মাঝে বসে আছেন রামজীবনবাবু । মাথা নীচু করে । তাঁরও চোখেও জল চিক চিক করছে । পেছন থেকে শ্যামলই প্রথম হাততালি দিয়ে ঊঠল । তারপর হল ভরে ঊঠল করতালির শব্দে । কিছুটা আত্মপ্রশংসায় গর্বিত বড়সাহেব, মৃদু হেসে রামজীবনবাবুর দিকে তাকালেন । বললেন, “ বলুন রামজীবনবাবু, আপনার দিকে আমরা সবাই তাকিয়ে । এ’তে নিশ্চয়ই আপনার কোন আপত্তি থাকবে না । তাছাড়া ভাববেন না, এটা হবে সম্পূর্ণ ট্যাক্স ফ্রী”।
সামনের সারিতে বসে থাকা চিফ অ্যাকাঊনটেন্ট মিঃ চিত্তময় দরবার তাঁর টাক লাঞ্ছিত মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ৫৪ইএ/বি/সি অনুসারে বিষয়টা ফেলা হবে । আপনার কোন চিন্তা নেই ।
রামজীবনবাবু, চিত্তময় দরবারের দিকে তাকিয়ে, হাসলেন । সবার পীড়াপীড়িতে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আপনাদের সবাইকে আমার প্রণাম । এই কারখানা আমায় হাতে কলমে কাজ শিখিয়েছে । খেতে দিয়েছে । সমাজে সম্মান দিয়েছে । রামুকে রামজীবন কর্মকার করেছে । আমি গুছিয়ে কথা বলতে পারি না । খুব বেশী দূর পড়াশুনা আমি করিনি । শুধু কাজটা শিখেছি । ভাল করে, মন দিয়ে । আজ আপনাদের সামনে কিভাবে কথা বলতে হবে জানি না । আমার হয়ে বলার জন্যে তাই হিতেনকে বলেছিলাম । আপনাদের কথা শুনে আমার মনটা ভীষণ হালকা হয়ে গেছে । কাল থেকে আমার কেবলই বিশ্রাম ।আমি আমার বাগানের ঘাসের ওপর শুয়ে শুধুই আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকব। আমার চারপাশের বাচ্ছারা আকাশের তারার মত হাসতে হাসতে শুধু খেলা করবে । সাহেব, আমি সারা জীবন মন দিয়ে কাজ করেছি কেবল একটা কথা ভেবে । আমি ওই শিশুদের খেলনা তৈরী করি । কিন্তু শপে শুধুই খেলনার আনুষঙ্গিক অংশ তৈরী করে গেছি । পুরো খেলনাটা কোনদিন দেখতে পাই নি । সাহেব, পুরো খেলনা হাতে নেওয়ার আনন্দটা আমি কোনদিন পাই নি । আমি টাকা নিয়ে কি করব, তাই ভাবছি । বাগান ত’ আমার আছেই, নতুন করে আর কি করব ? কিন্তু আপনি আমায় কিছু দিতে চেয়েছেন । আপনার এই দয়া আমি কি করে ফেরাব ? আপনাদের জন্যেই ত’ আমার এই নতুন জীবন ।
নরেশ বাবুর চোখটা চক চক করে ঊঠল । যাক, তাহলে রামদা-ও আমাদের মত টাকায় মাটিতে মানুষ । নরেশবাবু ভাবলেন, দীপককে পরে একটা জুতসই জবাব দেবেন । তাঁর যে লোক চিনতে ভুল হয় না, একথাটা ভাল ভাবে বুঝিয়ে দেবেন ।
একটু দূরে বসে দীপকবাবু ভাবলেন, রাম দা যে তারা’দের গল্প বলত, সে গুলো কি সব মনগড়া !! দীপকবাবু বিমর্ষ হলেন । তারাপদ মাথাটা একটু নিচু করে, মুখে হাতের খৈনী ঢেলে নিয়ে, ভাবল, রাম দা নিশ্চয়ই পার্কের জন্য রেলিং, দোলনার অর্ডার দেবে । ওটা যেমন করে হোক ছেলের নামে বাগাতে হবে ।
রামজীবনবাবু বললেন, তবু সাহেব, টাকা নিয়ে আমি কি করব ? আমার ছেলে আপনাদের আশীর্বাদে ডাক্তার হয়েছে । আমার ঠিকই চলে যাবে । আপনি যখন আমায় কিছু দেবেন বলেছেন, তখন আমার প্রার্থনা, দয়া করে আমায় একটা সেই প্যাকিং বাক্সটা দিন, যার মধ্যে খেলনাটার পুরো যন্ত্র গুলো আছে । আমি জীবনে একবার পুরো খেলনাটা তৈরী করব । আর সেটা নিয়ে ওই ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলোর সাথে খেলব ।
সারা সভা নিস্তব্ধ । এ ছিল অপ্রত্যাশিত । হঠাৎ চমক ভেঙ্গে সারা সভায় ধন্য ধন্য রব ঊঠল । বিব্রত বড়সাহেবের সারা মুখ চিন্তায় আচ্ছন্ন হল । তাঁর মনে হল, সব কিছু হাতের বাইরে চলে গেছে । এবার তাকেই জবাবদিহি করতে হবে । এখন তাঁর বলার মত একটাই বিষয় আছে । হয় হ্যাঁ অথবা না । তাঁর মনে হল তিনিও রামজীবনকে ঠিক চিনতে পারেন নি । “না” বলা যাবে না । তাহলে অনেক প্রশ্ন ঊঠবে । কোম্পানী তার কর্মচারীর কাছে আস্থা হারাবে । আর “হ্যাঁ” বললে , ........
বড়সাহেব আস্তে আস্তে ঊঠে দাঁড়িয়ে নীচু গলায় বললেন, “রামজীবন বাবুর ইচ্ছা কোম্পানী স্বীকার করে নিল । কিন্তু প্যাকিংটা আসবে হেড অফিস থেকে । কিছু দিন পর পাওয়া যাবে”। এরপর সভা তড়িঘড়ি শেষ করে দেওয়া হল ।
প্রায় মাসখানেক পর, রামজীবনবাবুর বাড়িতে কোম্পানীর তরফে একটা বড় প্যাকিং বাক্স এল, পুনের ফ্যাক্টারী থেকে। ওপরে বড় করে লাল কালিতে লেখা, বিশেষ গোপনীয় । সাধারণের জন্য, বা প্রকাশ্য নয় । ইহা একটি অব্যবহার্য স্যাম্পাল মাত্র । প্রাপক ছাড়া কেঊ খুলতে বা ব্যবহার করতে পারবেন না অথবা উল্লিখিত ব্যক্তি ব্যাতিরেকে অন্য কাঊকে প্রদান করা যাবে না । প্রদানের পূর্বে ব্যক্তির পরিচয় সুনিশ্চিত করতে হবে । -- প্রতিরক্ষা দপ্তরের নির্দেশ মোতাবেক । রামজীবনবাবু কিছুক্ষণ অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন প্যাকেটটার দিকে । তারপর ক্যুরিয়রকে তাঁর পরিচয় পত্র দেখিয়ে তার কাছ থেকে স্বাক্ষর করে প্যাকিং বাক্সটি নিলেন । কিছুটা দ্বিধান্বিত এবং চিন্তিত । এত গোপনীয়তা কেন ! বিকেল হয়ে গেছে তাই ভাবলেন, কাল সকালেই খুলবেন । পাড়ার কচিগুলোকে তখন ডেকে আনবেন । তার আগে সবটা একবার দেখে নেওয়া দরকার ।
সব কিছু যেমন আছে তেমনি রেখে, তিনি শুধু প্যাকিং বাক্সের থেকে “নির্দেশিকা” পত্রটি বের করে নিলেন । ভাবলেন, প্রতিরক্ষা দপ্তর কেন ! তারা কি খেলনা তৈরী করে ? আগাম একবার পড়ে নেওয়া ভাল, তাহলে কাল সকালে খুলতে আর জোড়া লাগাতে সুবিধা হবে । কিন্তু এটা কি ধরনের খেলনা ? দেখা যাক । আজ পড়ে রাখলে কাল জুড়তে বেশী দেরী লাগবে না । পড়ন্ত বিকালের আলোয় রামজীবনবাবু পড়তে শুরু করলেন নির্দেশিকাটি ।
(২)
পরদিন সকাল সাতটাতেও রামজীবনবাবুর ঘুম ভাঙ্গেনি । মালতি দেবী আজ আর ডাকেন নি । ভেবেছিলেন, অনেক’কটা বছর ঘাম ঝরিয়েছে, আজ না হয় একটু বেশি ঘুমোক । একটু বেশী বিশ্রাম হবে । কিন্তু ঘড়ির কাঁটা আটটা ছুঁতেই তিনি আর অপেক্ষা করলেন না । ছেলে এবার বেরোবে । বাবাকে না বলে সে বেরোয় না । ঠেলা দিয়ে ডাকলেন, “কি গো ঊঠবে না, ছেলে যে ডাক্তারখানায় ........
ডঃ সৌমজীবন, গায়ে হাত দিয়েই শেষ নিদান তার মা কে জানিয়ে দিল । সৌমজীবনের বাঁ হাতে তখন বালিশের পাশে রাখা ক্যাম্পোসের খালি শিশি আর ডান হাতে বালিশের কোন থেকে টেনে বের করে আনা কাগজ , রামজীবনবাবুর স্ব- স্বাক্ষরিত শেষ জবানবন্দী ।
কাল সন্ধ্যেবেলায় নির্দেশিকা পড়লাম । জানতে পারলাম, সারাজীবন আমার পরিশ্রমে তৈরী হয়েছে, খেলনা নয়, মারণাস্ত্রের যন্ত্রাংশ ! কেন কিছুই জানতাম না ? আমার শ্রমের ঘামে শিশুরা হয়ে গেছে আকাশের লালচে তারা । এক একটি রক্ত জমা পিন্ড । চিন্তা করে দেখলাম, আমারও তাদের পাশে যাওয়া উচিৎ । বিশ্বকর্মার ঘামের মধ্যে যে রক্ত কণার সৃষ্টি হয়েছিল, তাকে না ঝরালে ঘাম শুদ্ধ হবে না । ইতি রামজীবন কর্মকার ।
চিঠি পড়া শেষ করে, সৌমজীবন তাকালো ওপর দিকে । মনে হল ওপরে কোন ছাদ নেই, শুধুই আকাশ । দিনের আলোতেও আকাশের তারা গুলো সব ঘাম জমা রক্ত নিয়ে জ্বল জ্বল করছে । ওখানেই তার বাবা শুয়ে আছে অনেক কষ্ট আর যন্ত্রণা বুকে নিয়ে । মধ্য পঞ্চাশের আকাশে তখন আভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ সূর্য তাঁর মাঝ গগনের পথে যাত্রা শুরু করেছেন ।
0 comments: