0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - সেবিকা ধর

Posted in




















দূর আকাশে আলো মাখা মেঘ বকের ডানা মেলে উড়ে যাচ্ছে। কোথাও নদীর বুকে ছায়া পড়েছে সেই নীলাঞ্জনময় আকাশের।আকাশ বড় রূপময়। নদী রূপময়ী।আকাশের নীল দর্পণ সমন্বিত আলো নদী- জলকে চুম্বন করছে।ত্রিপুরার কমলপুরের ভট্টাচার্য পাড়ার দুর্গাপুজোর কথা বলতে গিয়ে আমাদের মনে পড়ে যায় কত কী।শরৎ মানেই উজ্জ্বল নীল আকাশ।নদীর তীরে বালুকাবেলায় অজস্র কাশফুল।তাদের মাথায় মাথায় চিহ্নিত চাঁদের আলো।সেই জ্যোৎস্না দেখে মানুষ গান বাঁধেন।মানুষ কবিতা লেখেন।মানুষ দিগ্বিজয়ে যান।প্রাচীন কালে যখন রাজাদের রাজত্ব ছিল, তখন রাজারা এই শরতে, দিগ্বিজয়ে যেতেন।তাঁদের হাতি, ঘোড়া, লোক-লশকর, পাইক-বরকন্দাজ, তলোয়ার, বন্দুক,কামান নিয়ে তাঁরা দিগ্বিজয়ে বেরতেন।

আমরা ছেড়ে আসা সময়ের স্কুলপাঠ্য বাংলা রচনায়- শরৎকাল শিরোনামে পড়েছি- ভাদ্র-আশ্বিন দুই মাস শরৎকাল। আমরা লক্ষ্য করে দেখেছি,আশ্বিন-কার্তিক-এই দু মাস আরাধনার মাস।দুর্গা, লক্ষ্মী, কালী- সনাতনী বিশ্বাস অনুযায়ী মাতৃরূপের নানা প্রতিচ্ছবি এই আলোকধারায় প্রতিভাত হন। তখন নদীতে নতুন জল।বর্ষা অতিক্রান্ত সময়ে সেই বহতা স্রোত ক্রমশ কাচ যেন।তার ওপর রোদ্দুর পড়লে অজস্র হীরক- ঝিল্লি গড়ে ওঠে।মাঝিরা গান গাইতে গাইতে নৌকো নিয়ে চলে যান দূর থেকে দূরান্তে।

ভট্টাচার্য পাড়ার দুর্গাপুজো দেখলেই মনে হয় তেমন কোনো আড়ম্বর নেই।সাদামাটা, একটু যেন জৌলুশ ছাড়াই ওই পুজো। এই বংশানুক্রমিক পুজোর প্রচলন কবে হয়েছে সঠিকভাবে বলতে পারেন না ভট্টাচার্য পরিবারের জীবিত উত্তরপুরুষেরা।

দূরে কোথাও ঢাক বাজছে।পুরোহিত আরতি করছেন দেবী প্রতিমার।আঠারো প্রদীপের আলো ঠিকরে ঠিকরে পড়ছে দেবীর চোখে, মুখে, ঠোঁটে,গালে,দশ হাতে। তিনি দশপ্রহরণধারিণী, তিনি অসুরদলনী।তিনি দুর্গা।দুর্গামণ্ডপে যে মূর্তি তৈরি হচ্ছিল এতদিন,ধীরে ধীরে, তৈরি হচ্ছিল মূর্তির সাজ, খড় আর দড়িতে বাঁধা কাঠামোর ওপর কাদা-মাটির আস্তরণ ধীরে ধীরে রূপ পেয়েছে চক্ষু দানের মাধ্যমে দেবীর শরীরে।দেবীর মুখ প্রতিভাত হয়ে ওঠে মহালয়ার ভোরে,দেবীপক্ষের শুরু, পিতৃপক্ষের শেষে চক্ষুদানের মধ্য দিয়ে প্রতিমা- মুখ জীবন্ত হয়ে ওঠে মূর্তিকরের তুলির ছোঁয়ায়।

কমলপুরের ভট্টাচার্য পাড়ার যে দুর্গাপুজো ,তা প্রচলনের কথা এই পরিবারের সদস্য ও অন্যান্য জনেদের কথায়-মুখে মুখে জানা যায়। পাঁচশো বছর আগে যুক্তবঙ্গের সোনারগাঁও অঞ্চলে এই পরিবারের কোনো এক পূর্বপুরুষ দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন।যদিও সব পুজোর পেছনেই এরকম স্বপ্নাদেশের কথা থাকে।সেই সত্য,মিথ্যা, কল্পনা, অতিকথন- সব মিলেমিশে পুজো প্রচলনের কথা আমরা বুঝতে পারি।সেই সময় যে দরিদ্র ব্রাহ্মণ, যিনি স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন, তিনি অত্যন্ত সাধারণ,সাদাসাপটা ভাবে অতি অল্প আয়োজনে দেবী দুর্গার আরাধনা শুরু করেন।আমরা জানি দুর্গাপুজোকে বলা হয় কলির অশ্বমেধ।দুর্গাপুজোর ব্যয় অনেক।কিন্তু এই গুরুকূলবাড়ির দুর্গা আরাধনার কথা বলতে গেলে ইতিহাসের পুরনো পাতা ওল্টাতে হয়।আসলে এই যে সাধারণ ভাবে বেঁচে থাকা ব্রাহ্মণ পরিবার, তাঁদের পাশে জমিদারবাড়ি, সেখানে খুব ধুমধাম করে দুর্গাপুজো হত।ব্রাহ্মণের ইচ্ছে তিনি দুর্গাপুজো করবেন।কিন্তু সাধ আছে সাধ্য নেই।ব্রাহ্মণ সজল নয়নে জমিদার বাড়ির ঢাক-ঢোল- কাঁসি- দুর্গা আরাধনা, মণ্ডপে মানুষের ভীড়, সবটা লক্ষ্য করতে থাকেন।তাঁর মনে হতে থাকে- আমি কী পারব না কোনোদিন এরকমভাবে মাতৃ আরাধনা করতে? তখন এক রাত্রে তিনি স্বপ্নাদেশ পেলেন। দেবী দুর্গা স্বয়ং এসে বললেন, এরকমই শুনে এসেছি আমরা,তুই দুঃখ করছিস কেন? তোর কীসের কষ্ট। ব্রাহ্মণ বললেন- 'মা আমার কষ্ট অনেক, আমি কীভাবে বলি? 'তখন দেবী তাকে বললেন - তুই আমার পুজো কর।ব্রাহ্মণ বললেন -আমি কীভাবে করব? আমার অর্থ কোথায়,সামর্থ্য কোথায়, আমি কী করে আপনাকে সন্তষ্ট করব মা? দেবী বললেন- সব আছে তোর।বাড়ির পাশে যে বড় কলা গাছের ঝোপ আছে সেখান থেকে পাকা কলা ও কলা গাছ নিয়ে আয়।কলা গাছের থোড় দিয়ে খেসারি ডাল রান্না করে ভোগ দিবি।আর কলা দিয়ে তৈরি হবে পিঠে। ব্রাহ্মণ সব শুনলেন,শুনে চুপ করে রইলেন।শেষ রাতের আলো- অন্ধকার তাঁকে ছুঁয়ে গেছে।তাঁর ভেতরে আনন্দাশ্রু। তিনি ঠিক করলেন এবার দুর্গাপুজো হবে।সামনেই দেবীপক্ষ।পিতৃপক্ষ শেষ হয়ে আসছে।ব্রাহ্মণ কোমর বেঁধে নামলেন।তাঁর সমস্ত জ্ঞাতি এবং বংশের লোকজনদের নিয়ে কলা গাছের ওপর ভিত্তি করেই তৈরি হবে দুর্গাপুজোর ভোগ এবং ভোগ-উৎসব।সেই থেকেই শুরু হল ভট্টাচার্য পাড়ার দুর্গাপুজো। অত্যন্ত সাদামাটা ভাবে।

তাঁদের বাড়ির দুর্গা আরাধনা শুরুর পর্বে সেই স্বপ্নাদেশ পাওয়া ব্রাহ্মণ আনাজপাতি যোগাড় করে ভোগ দিতেন।ফল,ফুল- সবই নিজের এক্তিয়ারে, নিজেদের বাড়িতে ফলান। পরে এই পরিবারের উত্তরাধিকারী রামকান্ত ভট্টাচার্য, তিনি ত্রিপুরায় প্রথম আসেন এবং জানা যায়, সেই সময় ঢাকার ভট্টাচার্য পরিবারের সঙ্গে জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারের যোগাযোগ ছিল।বিশিষ্ট সাংবাদিক, গবেষক সুপ্রিয় দত্তের গবেষণা থেকে জানতে পারি যে, সেই সময় বিশিষ্ট শিল্পী ও লেখক গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বেশ কিছু জায়গা-জমি কমলপুর ও কুলাই অঞ্চলে ছিল। ঠাকুরবাড়ির নায়েব প্রীতি সেন রামকান্ত ভট্টাচার্যের বাড়িতেই থাকতেন, সম্ভবত সেটা ১৯২০ সাল।

রামকান্ত ভট্টাচার্যরা ছয় ভাই।পরবর্তী কালে তাঁরা কমলপুরে চলে আসেন এবং তাঁদের বসবাসের এলাকা ভট্টাচার্য পাড়া নামেই আজও পরিচিত। দিনের পর দিন চলে যায়। রামকান্ত ভট্টাচার্য ও তাঁর সাত ভাইয়ের বংশধরদের নিয়ে এখনকার ভট্টাচার্য পাড়া।এই পরিবারের একটি ছোট্ট শাখা কলকাতায়,কয়েকটি পরিবার বর্তমানে ব্যাঙ্গালোর এবং আমেরিকায় নিজেদের শিকড় ছড়িয়েছে। পরিবারের সব মানুষেরা কমলপুরে আসার সঙ্গে সঙ্গে দুর্গার আরাধনা শুরু হয় এবং সেই নিয়মেই আজ পর্যন্ত পুজো চলেই আসছে। এই পরিবারের প্রাচীন মানুষেরা এবং এই অঞ্চলের অন্য অন্য পুরনো বাসিন্দারা, লোকেরা তাদের মুখ থেকে আমরা জানতে পারি উনিশো একাত্তর সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় এই আরাধনা মাত্র একবারই বন্ধ ছিল।

ভট্টাচার্য পাড়ার প্রতিমার বৈশিষ্ট্য হল, এই প্রতিমার মুখ যদি আমরা দেখি, সেই এক হাজার প্রদীপের আলোয় কাঁসর-ঘণ্টা, ঢাক ইত্যাদির শব্দে, সাজে তৈরি হয় দেবীমুখ, তপ্তকাঞ্চনবর্ণা।অর্থাৎ সোনাকে ব্যাপকভাবে তাপ দিয়ে, তার যে রঙ তৈরি হয়, সেই রঙ রয়েছে দেবীমুখে।আমাদের দেবীর রূপের যে বিবরণ আছে, সেখানে দুর্গার নানাবর্ণ। কখনও মুখ বা শরীর অতসী ফুল রঙের। কখনও তিনি তপ্তকাঞ্চনবর্ণা। মহিষাসুরকে বধ করার সময় দেবী তপ্তকাঞ্চনবর্ণা হয়েছিলেন।সেই কথা আমাদের শ্রী শ্রী চণ্ডী জানিয়ে দেয়।কাঁচা হলুদের রঙও থেকে যায় তাঁর গায়ের রঙে।পুজোর যে ঘন্টাধ্বনি, যে কাঁসরের আওয়াজ, আঠারো প্রদীপের আলো, পুরোহিতের হাতে দুলতে দুলতে তা হয়ত চলে যাচ্ছে কল্পনার অমরাবতীর দিকে।আমরা দেখতে পাচ্ছি,দূরে কোথাও ঢাক বাজছে ত্রিপুরার মানিকভান্ডারের সেবিকা ধরও দেখতে পাচ্ছে, ঢাক বাজছে খুব জোরে,সঙ্গে কাঁসি-কাঁসরের কাঁই না না না,কাঁই না না না...।সেখানে একটি কথা,একটি কাহিনি ঘুরেছে মুখে মুখে।কাহিনিটি এরকম।

রাতের অন্ধকারে প্রতিমার মুখে রঙ করতে গিয়ে যিনি প্রতিমা তৈরি করছেন, সেই কুম্ভকারমহাশয়, তিনি ঘুমের ঘোরে ভুল করে অন্য রঙ দিয়ে দেন।তখন তো জোরাল আলো-আলোক শিখা নেই,তখন তো বিদ্যুতের ঝনঝনা নেই,তখন হ্যারিকেন আর কুপির আলোই যথেষ্ট ছিল। তখনতো মানুষের উপায়ও ছিল না বেশি করে আলো জ্বালার। ফলে সাধারণ কেরোসিনের বাতি দিয়েই কাজ চালিয়েছেন তাঁরা অথবা রেড়ির তেলের প্রদীপে। এরকমভাবে দেবী প্রতিমার মুখের রঙ করতে করতে শিল্পী বা কুম্ভকার তাঁর হয়ত ঘুমের ঘোরে ভুল হয়েছিল। দেবী প্রতিমার মুখ দেখে কুম্ভকার বা কারিগর ঘাবড়ে যান।কেননা দেবীর মুখ তপ্তকাঞ্চনবর্ণ হয়ে গেছে।কারিগর, শিল্পী বা কুম্ভকারের- তাঁর ঘুমের ঘোরে ভুল হয়েছিল।ফলে তড়িঘড়ি একটা ধারাল ব্লেড খুঁজে নিয়ে তিনি দেবী প্রতিমার মুখের রঙ তুলতে শুরু করেন।তখন এই বংশেরই একজনকে স্বপ্নাদেশ দিলেন দেবী দুর্গা। তিনি বললেন, এই রঙ থাক।এই রঙ তুলতে আমার বড় কষ্ট হচ্ছে, এই কুম্ভকার বা কারিগরকে থামাও।আমার বড় কষ্ট হচ্ছে। যে রঙ আছে, তাই থাক।' এই স্বপ্নাদেশ পেয়ে স্বপ্নাদেশ প্রাপ্ত ব্যক্তি দৌড়ে চণ্ডীমণ্ডপে যান এবং কারিগরকে নিরস্ত করেন। সেই থেকে দেবীর মুখ,দেবীর শরীর হাত,পা, গলা- সবই তপ্তকাঞ্চনবর্ণ।এখন এরকম কথা, মিথ বা চলন কথা বা দেবীর মাহাত্ম্য প্রতিষ্ঠা করার কথা বহু জায়গায় প্রচলিত রয়েছে।স্বপ্ন, মিথ ইত্যাদি ছড়িয়ে রয়েছে নানাভাবে।এই সমস্ত মিথ কালে-দিনে মানুষের মুখে মুখে তথাকথিত সত্য বা সত্যের কাছাকাছি বলে প্রতিভাত হয় এবং মানুষ সেটা সত্য বলেই বিশ্বাস করতে থাকে।আমরা সেই বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলের মধ্যে যাচ্ছি না।আমরা বরং পিছিয়ে গিয়ে ইতিহাসের দিকে তাকাই।

একসময় প্রতি নবমীতে দেবী মূর্তির সামনে বলির প্রচলন ছিল।তখন কয়েকটা পাঁঠা বলি দেওয়া হত।তবে এখন আর পাঁঠা বলি হয় না।ইদানীং আখ, আদা,কলা, চালকুমড়ো,লেবু বলি দেওয়া হয়।আর কাল্পনিক শত্রুর চেহারা মাটি দিয়ে তৈরি করে, মানকচু পাতায় মুড়ে বলি দেওয়া হয় দেবী প্রতিমার সামনে।নবমীতে দেবী দুর্গাকে মাছ রান্না করে ভোগ দেওয়া হয়। প্রতিদিন তাঁকে ফল-মিষ্টির পাশাপাশি রান্না করা ভোগও দেওয়া হয়। সন্ধ্যায় দেওয়া হয় বৈকালিক ভোগ।আর পরিবারের সবাই ষষ্ঠী থেকে নবমী পর্যন্ত নিরামিষ খেয়ে পুজা করলেও নবমীতে দুর্গা আরাধনার পর আমিষ খাওয়ার অনুমতি আছে।

দুর্গা মূর্তির পাশাপাশি থাকেন নারায়ণ শিলা।যিনি শ্রীধর নামে পরিচিত এবং পূজিত।তাঁরও পুজো হয়ে থাকে এই দেবী পুজোর সঙ্গে। হয় চণ্ডীপাঠ, সন্ধিপূজা এবংলক্ষ্মী পূজা, কালীপূজা। পুজোর এই তিন দিন ভট্টাচার্য পাড়ার সকলে মিলে পাশাপাশি বসে একসঙ্গে আহার সারেন।খুব যে সেখানে বড় বড় কোনো পদের আয়োজন করা হয় তা নয়,সেই আয়োজন না থাকলেও সাদামাটাভাবে যে খাবার হয়,যে প্রসাদ হয়, যে ভোজের আয়োজন হয়, সবাই মিলে তা গ্রহণের আনন্দই আলাদা।প্রতিদিন একজনকে পুজোর যে কাজকর্ম, তার দায়িত্ব দেওয়া হয়।তাঁর ওপরই সব দায়ভার।পাড়ার প্রত্যেক বাড়ির ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা প্রত্যেকে, বৃদ্ধ এবং বৃদ্ধারাও তাঁরা তাঁদের মতো নিজেদের যুক্ত রাখেন।এবং সবাই পুজোর কাজ করেন মন দিয়ে। এই পরিবারের এখন যিনি বয়োজ্যেষ্ঠ সুরজিৎ ভট্টাচার্য-তাঁর বয়স ছিয়াশি।তিনি নিজে দুর্গা আরাধনার পৌরহিত্য করেন।জীবিত সব পুরুষ বংশধরদের নামে সংকল্প করে এই পূজা সম্পন্ন হয়। কোনো নারীর নামে হয় না।কেন নারীদের নামে সংকল্প করা হয় না,তা আমাদের জানা নেই।

সারাবছর ধরে যারা বাইরে থাকে, পুজোর সময় তাদের ঘরে ফেরার একটা টান থেকে যায়।সবার সঙ্গে দেখা হবে।সবার সঙ্গে কথা হবে।এই যে আগ্রহ ও ইচ্ছে, তা কিন্তু সবার মনে তৈরি হতে থাকে।সে যে ঘরের ডাক।বাড়ির ডাক।জন্মভূমির ডাক বা পিতৃভূমির ডাক, তা কেউ অস্বীকার করতে পারে না।ঢাক,ঢোল বেজে উঠে। বাজে কাঁসি, ঘন্টা।আড্ডা, গল্প,ভোগের প্রসাদ, আনন্দ, হৈচৈ-এই চার-পাঁচ দিন কীভাবে কীভাবে যেন কেটে যায়।তিন দিনের পর আসে দশমী।সেখানে তখন সেই লাইনগুলো আমাদের মনে পড়ে- 'যেওনা রজনী আজি লয়ে তারা দলে।'

সকলের চোখে তখন বিষাদাশ্রু।দেবী চলে যাবেন।তিনি চলে যাবেন অর্থাৎ তাঁর নিরঞ্জন হবে। কিন্তু তিনি কোথায় যাবেন? তিনি যাবেন না।আমাদের কল্পনার কৈলাসে তিনি যাবেন।উড়িয়ে দেওয়া হবে নীলকন্ঠ পাখি।এখন তো আর নীলকন্ঠ পাখি ওড়ান হয় না।তার প্রতীকী নীলকন্ঠ পাখি ওড়ানো হয়। বা মাটির নীলকন্ঠ উড়িয়ে দেওয়া হয়।কিন্তু তিনি যাবেন না।তাই আমরা বলি, পুনরাগমনায়চ- অন্তরের দেবী তিনি ঘটে অবস্থান করছিলেন, এবার তিনি আমার অন্তরে বিরাজ করবেন,বসবেন। পরে প্রতিমা ভাসান হলে দেবী শূন্য দালান, সেখানে জেগে থাকা প্রদীপ,প্রদীপের শিখা যেন সার্বিক এক কান্নার ঘোর আমাদের মধ্যে বপন করে। যে আনন্দধারা বয়ে চলে এই পাঁচদিন ধরে, সব যেন নিরানন্দ অন্ধকারে কন্যা- বিবাহের পর, কন্যা-বিদায়ের পর, কন্যা শ্বশুরবাড়ি চলে গেলে বাপের বাড়িতে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়, অনেকটা যেন সেইরকম ছবি ফুটে ওঠে সকলের সামনে।আবার সবাই বলতে থাকেন, বছর ঘুরে আবার এসো মা।এই যে তাঁকে ডাকা, তাঁকে নিয়ে আসার যে বাসনা,সেই বাসনার ঘোর জেগে থাকে নতুন মূর্তি,নতুন প্রতিমার আবাহন নিয়ে। কত কী বদলে যায়,কতজন চলে যায়,যেখান থেকে মানুষ কোনোদিন ফেরে না, যেখানে মৃত্যুর ঘোর অন্ধকার, তার মধ্যে আর দেখা হয় না প্রিয় মুখ।আবার নতুন যে জন্ম, ছোট ছোট হাত,ছোট ছোট পা,তাদের বড় বড় প্রত্যয়, অর্থাৎ নতুন যারা এসেছে, তারা আবার প্রস্তুত হয় দেবী প্রতিমার আবাহনের জন্য।

সুখ -দুঃখ আনন্দ-বেদনা- সমস্ত কিছু গতানুগতিক জীবন ধারা, তার বাইরে গিয়ে এই পুজো। ভট্টাচার্য পাড়ার মধ্যে যেন এক আনন্দ-অনুভূতি এবং চেতনায় যেন ভোরের সূর্য হয়ে জেগে থাকে। যাঁরা বিশ্বাস করেন তাঁরা উচ্চারণ করেন, জগজ্জননী এই যে দুর্গা, তিনি যেন সর্বদা কল্যাণ করেন এই ভট্টাচার্য পাড়ার শুধু নয়,সমস্ত দেশ, সমগ্র জাতির মঙ্গল সাধন করেন তিনি। ভট্টাচার্য পাড়ার মানুষেরা মনে মনে বলতে থাকেন। আবার এসো মা।কল্যাণে এসো,আনন্দে এসো,সূর্যোদয়ে এসো,জীবনে এসো,জীবন ধারায় এসো।

0 comments: