0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in




















২০

লাল ট্রাকটা শহরের মধ্য দিয়ে ধীরগতিতে চলছিল। ট্রাকের চতুর্দিক চেপে বন্ধ করা, গদি আঁটা দরজাটা খিল আটকানো। দরজার দু পিঠেই লেখা আছে, ‘গোরোস ব্রাদার্স, বুদাপেস্ট, সব রকমের মালপত্র বহন করা হয়’। ট্রাকটা থামে। ট্রাকের ছাদের ফুটো দিয়ে একজন মুণ্ডু বের করে চারদিক দেখতে থাকে। লোকটা মাঝে মাঝে নিচু হচ্ছে, আবার চেঁচিয়ে কী সব বলে যাচ্ছে। লোকটা দেখছে আলো দিয়ে সাজানো ক্যাফে, আইসক্রিম পার্লার, রাস্তায় গ্রীষ্মের হাল্কা পোশাকে সুসজ্জিত মানুষজন। কিন্তু হঠাৎ আরেকটা সবুজ রঙের ভ্যানের দিকে লোকটার মনোযোগ আকৃষ্ট হয়। সবুজ ভ্যানটা এই লাল ট্রাকটাকে অপরিসর পথে ওভারটেক করে যাবার চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না। খাকি ইউনিফর্ম পরা একজন চালাচ্ছে ভ্যানটা। চালকের পাশে আরেকজন বসে আছে খাকি ইউনিফর্ম পরা, তার কোলে একটা সাবমেশিনগান। সবুজ ভ্যানের ছাদের খোলা অংশটায় চারদিকে বাঁকানো তারজালি পেরেক দিয়ে আটকানো। সবুজ ভ্যানটা খুব জোরে হর্ন বাজাচ্ছে, এঁকেবেঁকে চলছে রাস্তা দিয়ে। একটু পরে একটা মোড় এলো। তারপর ওই ভ্যানটা লাল ট্রাকটাকে অতিক্রম করে উত্তর দিকে চলে গেল। লাল ট্রাকটা দক্ষিণের রাস্তা ধরেছে। ছাদে মুণ্ডু বের করে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার মুখ গম্ভীর হয়ে ওঠে। লোকটার রোগাপাতলা, বেঁটেখাটো চেহারা, মুখটা বুড়োটে গোছের। লোকটা মাথা নিচু করে ট্রাকের ভিতরের দিকে মুখ করে বলে ওঠে.. ‘এটা পরিষ্কার যে আমরা শহর ছাড়িয়ে দক্ষিণ দিকে চলেছি, আশেপাশে বেশি বাড়ি ঘর দেখা যাচ্ছে না আর!’ লোকটার কথার উত্তরে কেউ জড়ানো চাপা গলায় কিছু একটা বলে উঠল। লাল ট্রাকটা আরও জোরে চলতে শুরু করল। এতটাই জোরে যে সেই গতির জন্য কাউকে বাহবা দেওয়া চলে না। পথঘাট ফাঁকা এবং অন্ধকার। পথের ধারে গাছে গাছে ঝুলে থাকা জোলো বাতাস মিঠে অথচ বেশ ভারি। ছাদ থেকে মুখ বের করে লোকটা আবার চেঁচিয়ে উঠল… ‘একেবারেই কোনো বাড়িঘর দেখা যাচ্ছে না। গ্রামের রাস্তা। দক্ষিণ দিকে চলেছি আমরা।’ ট্রাকের ভিতরের কথার গুঞ্জন আরও জোরদার হয়ে উঠল। ট্রাকটা গতি বাড়াল আবার।



ছাদে মুণ্ডু বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। এর আগে ট্রেনে অনেকখানি পথ পেরিয়ে এসেছে সে। তাছাড়া এখন যে দুটি মানুষের কাঁধে ভর দিয়ে সে দাঁড়িয়ে আছে, তাদের দু’জনের উচ্চতা দু রকম। ফলে লোকটির বেশ শারীরিক কষ্ট হচ্ছে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে। কিন্তু এছাড়া আর কোনও উপায় নেই। কারণ, ট্রাকের মধ্যে একমাত্র তার চেহারাই ছোটখাট, রোগাটে গড়নের। কাজেই তাকেই বেছে নেওয়া হয়েছে বাইরের দৃশ্যাবলীর দিকে নজর রাখবার জন্য। সে অনেকক্ষণ ধরে নতুন কিছু দেখেনি। অন্ধকার প্রান্তর আর পথের ধারে গাছগুলো দেখতে দেখতে একঘেয়ে লাগছে তার। তারপর সে দেখতে পেল রাস্তায় মোটরবাইকের পাশে দাঁড়িয়ে দু’জন সৈনিক একটা ম্যাপের উপরে টর্চ দিয়ে কী যেন দেখছে। লাল ট্রাকটা তাদের পাশ দিয়ে যাবার সময় তারা মুখ তুলে দেখল।



তারপর বেশ কিছুক্ষণ লোকটা কিছুই দেখেনি। তারপর এক কলাম সাঁজোয়া ট্যাঙ্কের বাহিনীর দেখা পেল সে। একটা ট্যাঙ্কে মনে হয় কোনো যান্ত্রিক গোলযোগ হয়েছে। ওটার নিচে শুয়ে চিত হয়ে একজন কী যেন করছে। আরেকজন পাশে কার্বাইডের লণ্ঠন ধরেছে। একটা খামারবাড়ি দেখা গেল। অন্ধকার খামারবাড়ি পেরিয়ে যেতে যেতেই বামদিকে আবার এক কলাম ট্রাক বাহিনী দেখা গেল। খুব দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে এই বাহিনী। ট্রাকে সৈন্যরা বসে আছে। বাহিনীটা তাদের অতিক্রম করে বেরিয়ে গেল। ওই বাহিনীর পেছন পেছন একটা ছোট ধূসর রঙের গাড়ি আসছিল। সেই গাড়িতে কম্যান্ডারের পতাকা আটকানো। ওই গাড়িটা ট্রাকগুলোকে অতিক্রম করে দ্রুতগতিতে বেরিয়ে গেল।





একটা খামারবাড়ির সামনে ফাঁকা জায়গায় কিছু সৈনিক বসে আছে। মনে হচ্ছে ওরা খুব ক্লান্ত। কেউ শুয়ে পড়েছে মাটিতে। কেউ ধূমপান করছে। তারপর একটা গ্রাম এলো। গ্রামটা পেরিয়ে কিছুদূর যাওয়ার পরে ট্রাকের ছাদ দিয়ে মুণ্ডু বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা গোলাগুলির শব্দ শুনতে পেল। রাস্তার ডানদিকে বিশাল সাঁজোয়া গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে।বিশাল খাড়াই কামানের নলগুলো গাঢ় নীল অন্ধকার আকাশের দিকে মুখ করে রাখা। রক্তলাল আভায় কেঁপে উঠল কামানের নলের নিচের অংশ। পাশে খামারবাড়ির গায়েও দেখা গেল রক্তাভা।লোকটা চমকে উঠল। লোকটা এর আগে গোলাগুলির শব্দ শোনেইনি কোনোদিন। লোকটা ভয় পেয়ে গেল। ভয়ের চোটে পেট গোলাতে শুরু করল তার। তার নাম সার্জেন্ট ফিঙ্ক। সে দানিউব নদীর ধারে লিঞ্জ শহরের একটা বড় মিলিটারি হাসপাতালের ম্যানেজার ছিল। তার বস যখন তাকে হাঙ্গেরি থেকে আসল টোকাইয়া আনতে পাঠিয়েছিল, তখন তার ব্যাপারটা মোটেই সুবিধের বলে মনে হয়নি। টোকাইয়া কী এমন একটা ব্যাপার! কী এমন সাদা ওয়াইন, যা বিশেষ জাতের আঙুর থেকে হাঙ্গেরিতেই বানানো হয়! হুঃ… এত জায়গা থাকতে দুনিয়ায়… শেষমেশ হাঙ্গেরিতেই যেতে হবে! তবে হ্যাঁ, সে নিজে, ফিঙ্ক… একমাত্র ফিঙ্ক কদর জানে টোকাইয়ার। গোটা হাসপাতালের মধ্যে সে ছাড়া আর দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি নেই যে আসল আর নকল টোকাইয়ার মধ্যে তফাৎ করতে পারবে। তার বস, প্রধান মেডিক্যাল অফিসার, গিঞ্জিয়ার আসল টোকাইয়া খেতে খুবই ভালবাসে। অবশ্য গিঞ্জিয়ারের এক গেলাসের ইয়ার কর্নেল ব্রেজেন হয়তো আরও বেশি ভালবাসে টোকাইয়া খেতে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও সবাই আধবুড়ো ব্রেজেনকে ডাকাডাকি করে, খাতিরযত্ন করে তার রোগাটে, গম্ভীর মুখের জন্য আর গলায় ঝোলানো এক টুকরো বিরল মেডেলের জন্য। ফিঙ্কের বাড়িতে একটা বার আছে। নানা রকম পানীয়ের সংগ্রহ আছে। এখন এই যে বস তাকে পঞ্চাশ বোতল টোকাইয়া আনতে পাঠাল, এর পেছনে ওই কর্নেলের নির্ঘাত কোনো কারসাজি আছে। নির্ঘাত এরা নিজেদের মধ্যে কোনো একটা বাজি ধরেছে, কিম্বা ওই কর্নেল হয়ত বসের কাছে তার নামে কিছু একটা চুকলি খেয়েছে। বস তার উপরে ক্ষেপে আছে। এখন ঠ্যালা সামলাও!

হাঙ্গেরির টোকাই অবধি গিয়ে পঞ্চাশ বোতল আসল টোকাইয়া কিনেছে সে। সেখানকার এক সরাইখানার মালিক যথেষ্ট সাহায্য করেছে তাকে। সরাইখানা ছাড়াও বেশ কিছু আঙ্গুরখেত আছে লোকটার এবং সে নিজেও জানে আসল টোকাইয়ার মর্ম। টোকাইতে গেলে মানেই তুমি আসল টোকাইয়া পাবে, এত সহজ নয় ব্যাপারটা। সেখানেও প্রচুর জাল জিনিস বিক্রি হয়।যাই হোক, সে আসল জিনিস কিনেছে। একটা স্যুটকেস এবং এক ট্রাঙ্ক ভর্তি টোকাইয়া নিয়ে আসছিল সে। স্যুটকেসটা তার সঙ্গে আছে। এই লাল ট্রাকের পেটের মধ্যে আছে সেটা। কিন্তু ট্রাঙ্কটা আনতে পারেনি সে।



জেন্টগিয়র্গি স্টেশনে নেমে আর সব ঠিকঠাক গুছিয়ে নেবার সুযোগ হল কোথায়? ট্রেন থেকে নামা মাত্রই সব যাত্রীদের ভেড়ার দঙ্গলের মত ঘিরে ধরে এই ট্রাকে তুলে দেওয়া হল। আপত্তি জানিয়ে কোনো লাভ হল না। গোটা স্টেশন ঘিরে রাখা হয়েছিল। কেউ কেউ একটু চেঁচামেচি করে প্রতিবাদ জানাবার চেষ্টা করছিল। কিন্তু প্রহরী সৈনিকরা বোবা কালার মত দাঁড়িয়ে রইল। কিছুই তাদের কানে গেলনা।



ফিঙ্ক আপাতত টোকাইয়া নিয়ে বেশ ভয় পাচ্ছে… তার বস খুব খুঁতখুঁতে ওয়াইনের ব্যাপারে। তাছাড়া নিজের সম্মানের বিষয়ে বিশেষ স্পর্শকাতর। মনে হয়, তার বস কর্নেলকে কথা দিয়েছে যে আগামি রবিবার বসে একসঙ্গে টোকাইয়া খাবে। বোধ হয়, সময়টাও স্থির করে রেখেছে। এদিকে আজই তো বৃহস্পতিবার, নাকি শুক্রবার সকাল? উফফ, তার দিনরাতের হিসেব সবকিছু গুলিয়ে গেছে। আচ্ছা, এখন শুক্রবার মধ্যরাত। তার উপর এই ট্রাক সোজা দক্ষিণদিকে যাচ্ছে প্রবল গতিতে। রবিবারের মধ্যে লিঞ্জে ওয়াইন নিয়ে পৌঁছাবে কী ভাবে সে? ফিঙ্কের বেশ ভয় করছে। বসকে ভয়, তার উপরে ওই কর্নেল বন্ধুকে ভয়… ওই কর্নেলকে তার একটুও পছন্দ নয়। ওই কর্নেল সম্বন্ধে একটা গোপনীয় কথা সে জেনেছে। অবশ্য কাউকে বলেনি ব্যাপারটা। কারণ বললে কেউ বিশ্বাস করবে না, এত বিশ্রী রকমের অবিশ্বাস্য সেই ব্যাপারটা।এতই বিশ্রী এবং বীভৎস সেই কথাটা … নাহ, সে কাউকে বলতেও পারবে না।

মাঝেমধ্যে কর্নেলের ঘরে খাদ্য বা পানীয় নিয়ে যেতে হয়, কিম্বা কোনো বই পৌঁছে দিয়ে আসতে হয় তাকে… তখনই সে ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছে। সে যে ব্যাপারটা দেখেছে, সেটা হয়ত কর্নেল জানেনা। কর্নেলকে খুব সমাদরে রাখা হয়। একদিন সন্ধ্যায় কর্নেলের ঘরের দরজায় টোকা না দিয়েই ঢুকে পড়ছিল সে আরেকটু হলে। তখনই ব্যাপারটা নজরে আসে তার। আধো অন্ধকারে ওই আধদামড়া বুড়োটার মুখচোখের যে অভিব্যক্তি সে দেখে ফেলেছিল, গা গুলিয়ে উঠেছিল তার। ঘেন্নায় সে নিজেই সেদিন এক কণা খাবার দাঁতে কাটতে পারেনি। অল্পবয়েসী কোনো পুরুষ যদি নিজের ঘরে এইসব করে ধরা পড়ত… তার গায়ে ঠাণ্ডা জল ঢেলে দেওয়া হত… আর তাতেই উচিত শিক্ষা হত।

(চলবে)





ReplyForward











0 comments: