3

রম্য রচনা: সৌরেন চট্টপাধ্যায়

Posted in




রম্য রচনা



যান্ত্রিক-অযান্ত্রিক 
সৌরেন  চট্টপাধ্যায় 


এত কি ভাবছেন মশাই? দিনগুলো চলে যাচ্ছে ঢেউয়ের মতন, অথচ কি পেলেন আর কি পেলেন না -- মোদ্দা হিসেব তো সেটাই! তাই নিয়ে এত্তো চিন্তা! 

তা একদিক দিয়ে নেহাৎ কমটাই বা কি হয়েছে দাদা? পার্টির গুরুর ন্যাজ ধরে মোটা মাইনের সরকারি চাকরি, নামকরা আবাসনে মাটি থেকে অত উঁচুতে অমন একখানা হাল ফ্যাশানে সাজানো জম্পেশ নিরিবিলি ফ্যালাট, গ্যারাজে পড়শির চোখ টাটানো ঝাঁ চকচকে নতুন মডেলের রথ! দামী জুতোয় চেকনাই পালিশ, ডিজাইনারের শার্ট! কামানো গালে, বগলে আর রুমালে ভাঁজে ভেবে চিন্তে লাগানো সুগন্ধি নির্যাসে কামনার অঢেল গন্ধ! মাস গেলে বড়দরের গোলামির নিশ্চিৎ পুরস্কার, সঙ্গে আবার নিজের পুরুষাকারে বাঁ হাতে অর্জিত কিঞ্চিৎ এক্সট্রা! 

একজোড়া ধেরে কপোত-কপোতী আর হিসেব কষে ডিমে তা দিয়ে ফোটানো দুটো গাব্দা-গোব্দা হাম্পটি ডাম্পটি। কোথাও তো এতোটুকু খামতি নেই! বেশ তো আছেন, ইহলোকে আর কি চাই, দাদা! 

বুড়ো গাছদুটোকে তো বেশ কায়দা করে বৃদ্ধাশ্রমের বাগানে পুঁতে দিয়ে এসেছেন। তা একরকম ভালোই করেছেন। সেকেলে সিজনড মাল, আপনাদের মত টবের বাহারি লতাদের সঙ্গে ঠিক খাপ খাচ্ছিল না। কি রকম ঝরঝরে লাগছে এখন বলুন দিকি! 

উইকএণ্ডে জরুরী কাজের ছুতোয় কোন বিলাস মৌচাকে সুন্দরী মক্ষীরাণীর সঙ্গে অভিজাত অভিসারের অসভ্যতায় স্ট্যাটাস বজায় রাখা, মাঝে মধ্যে ছুটিছাটায় (পরের পয়সায়) পাহাড় কিংবা সমুদ্র সৈকতে সপরিবারে বিলিতি কায়দায় বিশ্রাম, আপিসের কর্তার ঠ্যাঙে নানা ধরণের তেল-টেল মাখিয়ে বিদেশ ভ্রমণ! কিছুই তো বাদ নেই ওস্তাদ! 

না, না, চটে যাবেন না স্যার, চটে যাবেন না। এই সবেই তো আপনার ফাইভ স্টার পরিচয়! কে না জানে ওটুকু না থাকলে ভদ্দরলোক আর ফালতু লোকের মধ্যে ফারাকটাই বা থাকে কি করে বলুন! চেনা মনুষদের সঙ্গেও মেপে কথা বলতে হবে বইকি, হাজার হোক নিজের হাই লেবেলটা তো ঠিক রাখতে হবে! একটা লক্ষণগণ্ডী তো থাকা দরকার না কি! বন্ধু আর আপনজনদের স্ট্যাটাসও তো ম্যাচিং হতে হবে মোজা আর টাই-এর রঙের মত! ঠিক কি না! না হলে তো মুখ ঘুরিয়ে নিতেই হবে, ইজ্জৎ বলে কথা! 

সাতসকালে বাচ্চাদের ট্যাঁস বানানোর কারখানায় চালান দিয়ে আকাশবাসিনী সইদের সঙ্গে গিন্নীর জমিয়ে পি.এন.পি.সি, দুপুরে পার্লার-বিহার আর শপিং মলে মার্কেটিং; সন্ধ্যেয় আবার দূরদর্শনে শ্বাশুরী-বউএর সিরিয়ালে ঝগড়া আর শাড়ি-গয়নার বাহার দর্শন -- সবই চলছে নিখুঁত যন্ত্রের মত। ওসবে আবার নাক গলালেই তো মুশকিল, তাই না দাদা! 

রাতে একটু ফিল্মি স্টাইলে টং হয়ে ফিরে আভিজাত্যের মুখোশটা খুলে রেখে কাঁচা খিস্তি আর টুকটাক ভাঙচুরের মধ্যে প্রেমের সিরিয়ালটাও হয়ে যায় প্রাণহীন যন্ত্রের মত। পরের দিন সকালে আবার সেই সুখী গৃহকোণ! বাঃ বাঃ বেড়ে খেল দেখাচ্ছেন মাইরী! এক্কেবারে ওই কাপড় কোম্পানীর 'কমপ্লীট ম্যান'।
তো এত্তো  সব  সুখের ভীড়ে দুঃখু  বেচারার  ঠাঁই কোথায় বলুন তো! 

তা এ পর্যন্ত তো মন্দ হল না বস। কিন্তু! --- 

এই মারাত্মক 'কিন্তু'-টাই তো শালা পাগলা করে দেয় মাঝে মাঝে! রক্তে চিনি, হৃদয়ে টাইমিং-এর গোলমাল, মেজাজ খিটখিটে, মনটাও হারামজাদা মনমরা হয়ে যাচ্ছে দিনদিন। বুকের ভেতরে কোথায় যেন একটা ফাঁক থেকে যাচ্ছে, সব কিছু যেন গড়বর করে দিচ্ছে। ওই ব্যাটা লোভী মনটা বোধ হয় একটু সুযোগ পেলেই সেই কৈশোরের মত উচ্ছল হয়ে, মুখোশ-বাঁধন সব ছিঁড়ে খুঁড়ে বাইরে বেরিয়ে এসে বাধাহীন অরণ্যর মত অযান্ত্রিক হতে চায়! কি গুরু, ঠিক বলছি তো! 

এই দেখুন আবার ভাবতে বসলেন! যাচ্চলে!

3 comments: