4

প্রবন্ধ: সীমা ব্যানার্জ্জী-রায়

Posted in





প্রবন্ধ



স্বামীজীর সরল সহজ মাতৃভক্তি 
সীমা ব্যানার্জ্জী-রায়


সব ভক্তির সেরা ভক্তি হল এই মাতৃভক্তি। মিষ্টির থেকেও মিষ্টি আমাদের মায়ের হাসি, একযোট শক্তির চেয়েও শক্তিশালী আমাদের মায়ের আশীর্বাদ, পৃথিবীর সমস্ত ঘনত্ব-কে এক যায়গায় করলেও মায়ের ভালবাসাকে তুলনা করা যায় না। আমাদের মায়ের একটাই চাহিদা, 'তাঁর সন্তান যেন সু-সন্তান হয় আর সে যেন দুধে-ভাতে থাকে'। কথায় আছে, 'কু-পুত্র যদি-বা হয়, কু-মাতা কদাচ নয়।' ভারতীয় সংস্কৃতিতে মাতাই শিশুর প্রথম এবং প্রধান গুরু। প্রাচীন মনুসংহিতায় লেখা আছে- 'গুরু হচ্ছেন সাধারণ শিক্ষকের চেয়ে দশগুণ বেশী পূজনীয়। পিতা হচ্ছেন শতগুণ বেশী এবং মাতা হচ্ছেন পিতার চেয়ে সহস্রগুণ বেশি শ্রদ্ধেয়া।'

ভুবনেশ্বরী দেবী বা স্বামীজী একদিনে জন্মান নি। তাঁর জীবন বহুযুগের হিন্দুধর্মের সাধনার ফল। মায়ের প্রতি তাঁর এই অসাধারণ আত্মনিবেদনের দৃষ্টান্ত মানব সমাজের মঙ্গলের জন্য তিনি আমাদের সামনে রেখে গেছেন।

২০১১ সালে বেদান্ত সোসাইটি থেকে স্বামীজীর সম্বন্ধে লেখা কিছু বই কিনি, আর সাথে সাথে পড়ে ফেলি। পড়তে পড়তে জানলাম আমি স্বামীজীর মাতৃভক্তি সম্বন্ধে অনেক কিছু জানতাম না। তাই ইন্টারনেট খুঁজে ও স্বামী তথাগতানন্দের লেখা “স্বামীজীর মাতৃভক্তি” থেকে কিছু লেখা সংগ্রহ করে এখানে পরিবেশন করছি, আপনাদেরও ভাল লাগবে আশা রাখছি, তাহলে আমার এ লেখা সার্থকতা পাবে।

সহস্র দ্বীপোদ্যানে স্বামীজী বলেছিলেনঃ 'জগজ্জননীর সামান্যতম প্রকাশও যদি কেউ জাগতিক মায়ের মধ্যে দর্শন করতে পারেন, তবে তিনি মহৎ জীবনের অধিকারী হবেন। যদি প্রেম, জ্ঞান চাও তবেই মাকেই উপাসনা কর। আমাদের ভারতীয় পরিবারে মাতৃদেবীই হচ্ছেন গরীয়সী দেবকল্পা, কারণ পৃ্থিবীতে সমস্ত দুঃখ সহ্য করে, সমস্ত স্নেহ দিয়ে নিঃস্বার্থ ভালবাসা উজাড় করে দিতে মা-ই একমাত্র পারেন। মাতৃস্নেহ, মায়ের ভালবাসা ছাড়া আর কোন প্রেম নেই। ঈশ্বরের সাক্ষাৎ নবরূপ হচ্ছেন মা।'

মাতৃগতপ্রাণ শ্রীরামকৃষ্ণের অভিন্নমূর্তি বিবেকানন্দ নিজ জননীকে সারা জীবন ধরে সেবা করে গেছেন। যতিরাজ মহাসন্ন্যাসী সর্বত্যাগী হয়েও তিনি তাঁর গর্ভধারিণী মার দুঃখ কষ্ট উপেক্ষা করতে পারেন নি। তাই তিনি বিশ্বশিক্ষার বিপুল কর্মব্যস্ততার মধ্যেও মার দুঃখে সাড়া দিয়েছেন সারাজীবন। বিদেশের সব যায়গায় ভারতীয় নারীচরিত্রের আদর্শ হিসেবে তিনি তাঁর গর্ভধারিণী মা-কেই প্রকাশ করেছেন বেশি, তা তাঁর লেখা বইগুলি পড়লে জানা যায়। মাতৃত্বের চরম উৎকর্ষ তাঁর স্বার্থত্যাগে। মায়ের অস্তিত্বই হচ্ছে সন্তানের জন্য আত্মত্যাগ।

“জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপী গরীয়সী !!”

-এই ছিল স্বামীজীর জীবনের মূলমন্ত্র!

মার জন্য স্বামীজীর মনোভাবের বেশ কিছু উদাহরণ এখানে …

মা ভুবনেশ্বরী ছিলেন তাঁর 'নয়নের মণি'। স্বামীজী তাঁর মাকে এত ভালবাসতেন যেন মনে হোতো মায়ের জন্যই তিনি এই পৃ্থিবীতে আছেন। যারা ওঁর জীবনী পর্যালোচনা করেছেন তারা সবাই লক্ষ্য করেছেন- তাঁর মায়ের প্রতি স্বামীজীর ভালবাসা কতখানি ছিল। স্বামীজীর মা-এর নৈ্তিক শক্তি ও আত্মপ্রত্যয় নিয়ে চরম দ্বন্দ্বের সময়ও তিনি তাঁর মায়ের অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার জন্য চিন্তা করেছেন - মায়ের প্রতি এমনই ভালবাসা ও শ্রদ্ধা ছিল তাঁর ।

পশ্চিমের গৌরবময় দিনগুলি কাটিয়ে এসে তিনি প্রথমেই মার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। মার কোলে মাথা রেখে একটা সরল ও অসহায় শিশুর মতো তিনি এই বলে কেঁদে ওঠেন - ' মা তোমার নিজের হাতে আমাকে খাইয়ে দাও মা, আমায় মানুষ করো, মা'। কি সহজ আর সুন্দর ভাবে মায়ের কাছে এসে ছেলে
আবদার করেছিলেন।

আর একবার স্বামীজী তাঁর মায়ের সঙ্গে দেখা করতে গেছেন। মা ভুবনেশ্বরীর দিবাহার সদ্য শেষ হয়েছে । স্বামীজী খুব হতাশ হয়ে পড়েন মার প্রসাদ কণামাত্র না পেয়ে। মা একটা ডাঁটা চিবিয়ে ছিবড়েটা ফেলেছিলেন, স্বামীজী সেটা দেখতে পেয়েই মুখে পুরে দেন। তাঁর মুখে তখন পৃথিবীর সব খাবারের সেরা খাবার।

চোখ মুখে তখন সহজ সরল শিশুর আত্ম তৃপ্তির খেলা। মায়ের অন্তরের বাসনা ছিল পুত্রের সঙ্গে একটা সুদীর্ঘ তীর্থ যাত্রা করেন। দুর্বল স্বাস্থ্য সত্ত্বেও স্বামীজী মায়ের এই ইচ্ছা পূরণের জন্য কাতর হন এবং ইচ্ছা করেন তাঁরা দুজনে যেন শেষ জীবনটা একসঙ্গে কাটাতে পারেন। শেষ পর্যন্ত পূর্ববঙ্গে ঢাকায় চন্দ্রনাথ আর কামাখ্যা মন্দির দর্শন করতে আত্মীয়পরিজনসহ- নিজের মাকে -স্বামীজী নিয়ে যান। নানাভাবে স্বামীজী তাঁর মাকে সুখী করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করতেন ।

১৯০১ সালের অক্টোবর মাসে স্বামীজী বেলুড়মঠে প্রথম দুর্গাপূজো করেন শ্রীশ্রীমার নামে । শ্রীম ও শ্রীশ্রীসারদামা এই পূজায় উপস্থিত ছিলেন । স্বামীজীর অনুরোধে তাঁর গর্ভধারিণী মা-ও এই পূজায় উপস্থিত হন। পরে স্বামীজী তাঁর মায়ের বাড়ীতে নিজ তত্ত্বাবধানে জগদ্ধাত্রী পূজা করেন । অন্যান্য অনেক সাধুরা নিমন্ত্রিত হয়ে পুজোয় যোগদান করেন। মা-কে আনন্দ দেওয়াই ছিল তাঁর জীবনের একমাত্র ব্রত।

তাঁর মায়ের একান্ত ইচ্ছায় স্বামীজী কালীপূজার কয়েকদিন পর কালীঘাটে মা কালীর দর্শন করেন। তাঁর মায়ের মানত ছিল। বহুদিন আগে শৈশবে স্বামীজীর এক দুরারগ্য ব্যাধি হয়, তাঁর মা তখন মা কালীর কাছে পুত্রের জীবনপ্রার্থনা করেন। পুত্র ভাল হয়ে গেলে তিনি মা কালীর মন্দিরে পূজা দেবার মানত করেন। এখন স্বামীজীর এই ভগ্ন স্বাস্থ্য দেখে মায়ের মনে পড়ে সেই মানত পালন করা হয়নি। মায়ের কথামত স্বামীজী সমস্ত রকম আচার অনুষ্ঠান দ্বারা তার সেই মানসিক পূর্ণ করেন। আদি গঙ্গায় স্নান করে ভেজা বস্ত্রে তিনি মন্দিরে গিয়ে মা কালীর সামনে তিনবার গড়াগড়ি দেন। তারপর সাতবার মন্দির প্রদক্ষিণ করেন। নিজেই নাটমন্দিরে পশ্চিমদ্বারে যজ্ঞ হোম ইত্যাদি সম্পন্ন করেন। মঠে ফিরে গিয়ে তিনি মন্দিরের পুরোহিতদের খুব প্রশংসা করেন। তাঁর মায়ের মানসপূজা সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করতে অনুমতি দেবার জন্য।

এবং ১৮৯৯ সালের মে মাসেও যখন তিনি ঐ কালী মন্দিরে পূজা দিতে যান, তখনও তাদের একই উদারতা লক্ষ্য করেন।

আবার পড়েছিঃ

"তিনি তাঁর মায়ের প্রতি প্রণতি জানিয়ে স্বীকার করেছেন যে তিনি জীবনে যা কিছু অর্জন করেছেন সবই তাঁর মায়ের নিঃস্বার্থ ভালবাসা ও চারিত্রিক পবিত্রতার জন্য।"

মা বলেছিলেন, সত্য-কে যেন জীবনের ধ্রুবতারা করেন - তাতে যত-ই বাধা আসুক না কেন, সত্য থেকে যেন তিনি বিচলিত না হন। অন্যায়-কে কোনদিন যেন মেনে না নেন তিনি মুখ বুজে।

স্বামীজী  স্কুলে পড়াকালীন একবার সব প্রশ্নের উত্তর ঠিক লেখেন, ভূগোলের মাস্টারমশাই তাও বলেন তিনি ভুল লিখেছেন...কিন্তু স্বামীজী  তা মেনে নেন নি। কারণ তিনি জানতেন তিনি যা লিখেছেন একেবারে শতকরা ভাগ ঠিক। তাই তিনি তর্ক শুরু করলে মাস্টারমশাই তাকে প্রচন্ড বেত্রাঘাত করেন কিন্তু তবুও তিনি অন্যায় প্রস্তাব-কে মেনে নেন নি। মুখ বুজে সত্যের পূজা করেছিলেন।

স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে সব কথা বলতেন তিনি তাঁর আদরিনী মা-কে, সেদিন ও যখন তার দুঃখের কথা মাকে জানালেন, তখন মায়ের ঠোঁট জুড়ে শান্ত আর মিস্টি হাসির ঝিলিক। তাঁর স্নেহ মাখা মিস্টি কথায় সব দুঃখ ভুলে গেলেন তিনি। তিনি ছেলেকে কোলের কাছে টেনে নিয়ে মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করলেন আর বললেন, “ আমি আজ সত্যি খুব খুশি হয়েছি, আর নিজেকে খুব গর্বিত লাগছে তোমার জন্য বিলে। সত্যের পথে সব সময় এগিয়ে যাবে, যত-ই মিথ্যের পাহাড় বাধা হয়ে আসুক না কেন! তুমি যদি জানো, তুমি যা করেছো সেটা ঠিক, তাহলে অন্য লোকে যাই ভাবুক না কেন, তুমি নিজে যা ভাল বুঝবে তাই করবে।” অনেক সময় লোকে তাঁকে ভুল বুঝেছে বিশেষতঃ তাঁর অতি প্রিয় নিকটজনেরাও, এবং তিনি এর জন্য মনোকষ্ট পেয়েছেন। তবু তিনি তাঁর অদ্ভুত খেয়ালমত যেটা নিজের কাছে ন্যায্য মনে হয়েছে, তাই করেছেন। তাঁর কাছে নিজের মা-এর বাণী -ই ছিল ধ্রুব সত্য, তিনি মরে গেলেও সেই পথ থেকে বিচ্যুত হতেন না। এই ছিল তাঁর জীবনের সাধনা।

মাস্টারমশাই পরে বাড়ি গিয়ে দেখেন যে নরেন সব ঠিক লিখেছে। পরের দিন স্কুলে এসে তিনি ক্ষমা চান নরেন-এর কাছে।

আর একবার মাকে সামান্য খুশী করার জন্য স্বামীজীর কাতরতা। একদা তিনি এবং স্বামী ব্রহ্মানন্দ বলরাম বোসের বাড়িতে ছিলেন। ডায়াবেটিসের রূগী, রাতে মোটে ঘুমোতে পারতেন না, সেজন্য দিনে বিশ্রাম নিতেন। একদিন তাঁর মায়ের এক পরিচারিকা সেই অঞ্চলে আসে এবং নরেনের সঙ্গে দেখা করতে চায়। স্বামী ব্রহ্মানন্দ স্বামীজীর ঘরে গিয়ে দেখেন তিনি নিদ্রিত; পরিচারিকাকে সে কথা জানান। সে চলে যায়। ঘুম থেকে উঠলে স্বামী ব্রহ্মানন্দ স্বামীজীকে সেই ঘটনা জানান। তিনি তখন স্বামী ব্রহ্মানন্দকে তাঁকে না ডাকার জন্য খুব তিরস্কার করেন। মা হয়ত কোন বিশেষ দরকারে পরিচারিকাকে পাঠিয়েছিলেন এই কথা মনে হওয়ায়, তিনি তৎক্ষণাৎ একটি গাড়ী ভাড়া করে মার সঙ্গে দেখা করতে যান, এবং সেখানে গিয়ে জানতে পারেন যে মা তাকে পাঠান নি। সে স্বেচ্ছায় নরেনের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলো। স্বামী ব্রহ্মানন্দকে অকারণ তিরস্কার করেছেন বুঝতে পেরে তিনি সঙ্গে সঙ্গে একটি গাড়ী পাঠান ব্রহ্মানন্দকে মার বাড়ীতে আসার জন্য। স্বামী ব্রহ্মানন্দ এসে পৌঁছুলে স্বামীজী তখন বিনীতভাবে তাঁর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করেন।

অনেক পুরনো কথা, কিন্তু স্বামীজী-র বলার ধরণটাই অন্য--- ধক্ করে মনে গিয়ে লাগে, ভুলতে দেয়না কিছুতেই। হাজার, দুহাজার লোকের সামনে বক্তৃতার শেষে এদেশী বন্ধুদের সাথে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফেরার পথে বলতেন-

“আজ তোমাদের পোলাও রেঁধে খাওয়াবো। মাছের টক, খুব ঝাল দিয়ে ছোলার ঘুগনি, ঠিক আমার মা যেমন রাঁধতেন”।

এক সেকেন্ডের জন্য-ও তিনি মা-কে ভুলতে পারতেন না। খাওয়ার পরে গান গেয়ে শোনাতেন কখনও মায়ের কাছে শেখা রামায়ণ-মহাভারতের, পুরানের কখনও বা নিজের মায়ের গল্প। নিত্য নতুন ভাবে সঙ্গীদের সেবা, মনোরঞ্জণ, একটু আনন্দ দেওয়া ছিল মা ভুবনেশ্বরীর সবচেয়ে আদরের বিলের শখ । স্বামীজী স্বভাবতঃই মায়ের চারিত্রিক মহিমা কীর্তন করতেন।

“সবসময় দুর্দশাগ্রস্ত, স্নেহের আধার, মায়ের অহেতুক স্নেহ ভালবাসাই আমাকে বড় করেছে, তাঁর ঋণ কখনও শোধ করতে পারবো না। আমি জানি আমার জন্মের আগে থেকে তিনি এ পর্যন্ত যত উপবাস, প্রার্থনা এবং নানা কৃচ্ছসাধন করেছেন আমি তা পাঁচমিনিটও করতে পারতাম না। ঐ দু বছর ধরে তিনি এ সব করেছেন। আমার যা ধর্মজ্ঞান, আচারবিচার সবই তাঁর কাছ থেকে পাওয়া। আমার মা জেনেশুনেই আমাকে এ ভাবে মানুষ করেছেন। আমার মধ্যে যা সদ্‌গুণ সবই আমার মা জ্ঞানতঃ আমাকে দিয়েছেন।”

মৃত্যুর চার বছর আগে মায়ের দুঃখ দেখে বেলুড় মঠ থেকে স্বামীজী  ১৮৯৮ সালের ২২শে নভেম্বর ক্ষেত্রীর মহারাজা অজিত সিংহকে এক পত্রে লিখেছেন –

“ আমি আজ আপনার কাছে এক বিশেষ আর্জি নিয়ে লিখছি, জানি যে আপনার কাছে খুলে সবকিছু জানাতে আমার এতটুকুও লজ্জা নেই, এই জীবনে আপনিই আমার একমাত্র বন্ধু। অন্তরে একটা পাপবোধ সবসময়ই যন্ত্রণা দেয় এই ভেবে যে দেশমাতৃকার সেবা করতে গিয়ে আমি আমার গর্ভধারিণীর প্রতি অবহেলা করেছি। এখন আমি আমার মার কাছে থাকতে চাই, এতে আমার এবং মায়ের জীবনের শেষ দিনগুলি নির্বিঘ্নে কাটবে। তিনি এখন একটি অপরিসর কুঁড়ে ঘরে বাস করেন। আমি তাঁর জন্য একটি ভদ্রোচিত বাসস্থান তৈ্রী করে দিতে চাই। একদিন যাকে আপনি বন্ধু বলে বরণ করেছিলেন তার জন্য এই অনুগ্রহটুকু করা কি শ্রীরামচন্দ্রের বংশধরের পক্ষে একেবারে অসম্ভব? আমি জানি না আর কার কাছে আমি হাত পাততে পারতাম। আমি তো আমার জন্য কারো কাছে ভিক্ষা চাইতে অপারগ। আমার পারিবারিক অবস্থার কথা মহারাজ সবই অবগত আছেন, যা আর কেউ জানে না। আমি এখন ক্লান্ত, ভগ্নহৃদয় এবং মৃতপ্রায়-আমি কি আপনার কাছে এই শেষ অনুগ্রহটুকু ভিক্ষা করতে পারি?”

স্বামীজীর এই বিখ্যাত পত্রে নিজের মা-এর প্রতি তাঁর এক গভীর মমতা ফুটে উঠেছে। তিনি ছিলেন স্বয়ং প্রেমের প্রতিমূর্তি। চিঠির আবেগ ও গুরুত্ব বুঝতে পেরে মহারাজা সত্বর স্বামীজীর কাছে জানতে চান তাঁর মায়ের জন্য কি পরিমাণ অর্থ তাঁর প্রয়োজন।

১৮৯৮ সালে ১লা ডিসেম্বর স্বামীজী তাঁকে এই মর্মে আবার লেখেন,

“ আপনার কাছে আর একটি প্রার্থনা - আপনি আমার মায়ের আজীবন একশত টাকা মাসোহারার ব্যবস্থা করুন – যেন আমার মৃত্যুর পরেও এই টাকা ঠিকমত তাঁর কাছে পৌঁছায়। যদি কোনদিন আপনার স্নেহ ও দাক্ষিণ্য থেকে বিচ্যুত হই, এই দরিদ্র সাধুকে একদিন আপনি স্বয়ং ভালবেসেছিলেন এই কথা মনে রেখে আমার দুর্ভাগিনী মার প্রতি দাক্ষিণ্যে যেন আপনি কখনো বিমুখ না হন, এই প্রার্থনা করি।”

আর এক পত্রে মিসেস ওলি বুলকে লেখেন,

“ আমার আছে ক্রমশঃ এই ব্যাপারটা নিশ্চিত মনে হচ্ছে যে আপাততঃ মঠের সমস্ত চিন্তা ফেলে রেখে কিছুদিনের জন্য আমার মার কাছে ফিরে যাওয়া উচিত। আমার জন্য উনি অনেক দুর্ভোগ সহ্য করেছেন। ওঁর জীবনের শেষ সময়টা যেন নির্বিঘ্নে কাটে - এখন আমার সেই চেষ্টাই করা উচিত। আপনি নিশ্চয়ই জানেন শ্রীমদ্ শঙ্করাচার্য্য নিজেও ঠিক এই কাজই করেছিলেন। ১৮৮৪ সালে মাকে ছেড়ে আসাটাই আমার পক্ষে একটা বিরাট আত্মত্যাগ – আর এখন সন্ন্যাসী হয়ে ফিরে যাওয়াটা তার চেয়েও বড় আত্মত্যাগ।”

মায়ের প্রতি স্বামীজীর গভীর আনুগত্যই তাঁদের দুজনের সম্পর্ক দৃঢ় ও মধুর করে তোলে। তাঁর আর একটা পরিচয় দিয়ে আমার লেখার এই পর্যালোচনা শেষ করিঃ

দোতলায় গিয়ে তিনি কাতরস্বরে ডাকলেন “বি লু উ উ” সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বালকপুত্র ঘরের কোণা থেকে বার হয়ে এলেন। ভবিষ্যতের বিরাট বিবেকানন্দ তাঁর কাছে সেই বালকের মতই ছিলেন। মা ভুবনেশ্বরীর সঙ্গে স্বামীজী সিঁড়ি দিয়ে নেমে বাগানের পথে যেতে যেতে নিজেদের কথা বলতেন। বেলুড়ে থাকাকালীন মাঝে মাঝে নিজের মা-র কাছে যেতেন। কিন্তু তিনি যদি সপ্তাহে একবারও না গিয়ে উঠতে পারতেন, মা স্বয়ং সাংসারিক সমস্যার আলোচনা করতে বেলুড় মঠে এসে হাজির হতেন। বিলু যে তাঁর বড় আদরের ধন, তাঁর সব সময়ের সাথী।

১৮৯৩ সালে শিকাগো ধর্মমহাসভায় স্বামীজীর চরম সফলতায় ঈর্ষান্বিত হয়ে ব্রাহ্ম নেতা প্রতাপ চন্দ্র মজুমদার স্বামীজীর বিরুদ্ধে কুৎসা রটিয়ে অনেক বাঙ্গালীকে দলে টানেন। স্বামীজী মায়ের অবশ্যম্ভাবী মনোকষ্টের কথা চিন্তা করে ১৮৯৪ সালে ২৬শে এপ্রিল নিউইয়র্কে মিস ইসাবেল ম্যাকিন্ডলিকে লেখেনঃ

“আমার দেশের লোকে আমার বিরুদ্ধে বলছে(মিঃ মজুমদার প্রমুখ) আমার তাতে কিছু আসে যায় না। আমার বৃদ্ধা জননী দেশে আছেন, শুধু তাঁর কথা চিন্তা হয়। সারাজীবন তিনি অনেক দুঃখকষ্ট সহ্য করেছেন, তা সত্ত্বেও জনগণের এবং ঠাকুরের সেবায় আমাকে নিবেদন করার কষ্ট সহ্য করেছেন; তাঁর সবচেয়ে প্রিয় সন্তানকে দান করে এখন যদি তাঁকে শুনতে হয় যে সেই সন্তান দূরদেশে এখন অমানুষের মত জীবন যাপন করছে - যা মিঃ মজুমদার কলকাতায় রটাচ্ছে, সেই দুঃসংবাদ নিঃসন্দেহে মার মৃত্যুর কারণ হবে। কিন্তু ঠাকুরের অসীম কৃপা তাঁর সন্তানদের কেউ কখনো আঘাত করতে পারবে না।”

অথচ আজ এই কম্পিউটার যুগের ছেলেমেয়েরা সময় পায় না বলে মা-কে অজুহাত দেখায়। একটা এক মিনিটের ফোন- তাও তাদের সময় কেড়ে নেয় মা-এর খোঁজখবর করার থেকে।

তিনি সুযোগ পেলেই প্রায়ই মার প্রশংসা, ও তাঁকে বিশেষ সম্মান প্রদর্শন করতেন। তিনি বলতেন তাঁর মায়ের মতন প্রবল আত্মসংযমী এবং তাঁর মতো একটানা ততদিন উপোস কেউ করতে পারে স্বামীজী এমন কাউকে জানেন না। তাঁর মা একসময় একটানা চোদ্দদিন ধরে উপবাস করেছিলেন।

স্বামীজীর অনুগামীদের অনেকেই তাঁর মুখ থেকে শুনেছেন,

“এ কাজ করতে মা আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তাঁর চরিত্র আমার জীবনে এবং আমার কাজে সতত অনুপ্রেরণা দান করে।”

মায়ের গুণকীর্তন করতে স্বামীজীর কখনও ক্লান্তি ছিল না। ১৯০০ সালের ১৮ই জানুয়ারী প্যাসাডিনা, ক্যালিফোর্নিয়াতে তিনি ভারতীয় নারীর ওপর যে বক্তৃতা দেন, তাতে বলেন-

“আমার মা এবং বাবা বছরের পর বছর উপবাস ও প্রার্থনা করার ফলে আমার জন্ম হয়। আমার মা একজন নিষ্ঠাবতী সন্ন্যাসিনীর মত আমাকে লালন করেছেন। তিনি তাঁর শরীর, মন, খাদ্য, বস্ত্র -সব যত্নের সঙ্গে পবিত্র রাখতেন আমি তাঁর কোলে জন্মাবো বলে।”

সেই বক্তৃতাতেই তিনি উল্লেখ করেন তাঁর মায়ের গভীর আধ্যাত্মিক জীবনযাত্রা এবং সেই জীবনের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা তিনি কি করে উপলব্ধি করেছিলেন।

“ছোট বেলায় যখন আমরা বালক ছিলাম প্রতিদিন প্রত্যুষে ছোট এক বটি জল নিয়ে আমরা মায়ের কাছে যেতাম। তিনি তাঁর পায়ের বুড়ো আঙ্গুলটা ছুঁইয়ে দিলে আমরা সেই জল পান করতাম।”

স্বামীজী ছিলেন ফলিত বেদান্তের প্রাণপুরুষ। মায়ের প্রতি তাঁর এই অসাধারণ আত্মনিবেদনের দৃষ্টান্ত মানব সমাজের মঙ্গলের জন্য তিনি আমাদের সামনে রেখে গেছেন। সত্যিকার অর্থেই তিনি ছিলেন বেদান্ত! শুধু যে মাতৃভক্তির নজির রেখে গেছেন তিনি তাই নয় অসংখ্য ক্ষেত্রেই তিনি দ্য ফলোয়ার অব অল। তাঁর জীবনের কত ছোট ছোট এরকম কাহিনী আছে যা আমাদের অজানা থেকে গেছে।

আর আজ আমরা মাকে ভালবাসি “মাদার্স- ডে” করে, কে কত দামি জিনিস মাকে দিয়েছে আলোচনা করে; আর নয়ত মাকে ফুল পাঠিয়ে বা কোন ভাল রেস্টোরান্টে খাইয়ে কিংবা মাকে একখানা দামি শাড়ী কিনে দিয়ে। আর সেই মা ৩৬৫ দিনের মধ্যে ৩৬৪ দিন শুধু মনে মনে বলেন, “ওরে একবার মা বলে ডাক, মা বলে ডাক, মা বলে ডাক মা-কে।”

স্বামীজীর নিঃশঙ্ক উক্তিঃ

“যতদিন দেশের একটি কুকুর পর্যন্ত্য অভুক্ত থাকবে, ততদিন পর্যন্ত্য তিনি মুক্তি চান না।”

তিনি বলেছেনঃ

“অনেক মন্দির আছে, কিন্তু মানুষের শরীর সবচেয়ে বড় মন্দির। আর সেই মন্দিরে যিনি বিরাজ করছেন, তাকে আমরা অবজ্ঞা করি”।

স্বামী বিবেকানন্দ রামকৃষ্ণ সংঘের জন্য এবং বলা যেতে পারে সমগ্র মানব জাতির জন্য দুটি আদর্শ দিয়ে গেলেন...

আত্মনো মোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ, অর্থাৎ –আত্মমুক্তি ও জগতের কল্যাণ। জগদ্ধিতের উদ্দেশ্যে স্বামীজী কর্মযোগ প্রবর্তন করেছেন। কর্মযোগ দুটি নীতির উপর ভিত্তি করে গঠিত। একটি হল—কর্মই উপাসনা, এর অর্থ হল সমস্ত কর্ম প্রচেষ্টা পরমেশ্বরের নিমিত্ত নিবেদিত।

দ্বিতীয় নীতিটি হল--'শিবজ্ঞানে জীবসেবা', অর্থাৎ –মানুষকে ঈশবরজ্ঞানে সেবা করা। স্বামী বিবেকানন্দই সর্বপ্রথম গুহ্যশাস্ত্র থেকে বেদান্তের জীবনপ্রদ শাশ্বত সত্যগুলিকে বার করে তাদের আধুনিক ভাব ও ভাষার‍ মানুষের প্রাত্যহিক জীবনসমস্যার সমাধানে সেগুলি কীভাবে কার্য্যকরী হতে পারে তা ব্যাখ্যা করে দেখান।

স্বামী বিবেকানন্দের বাণীর প্রবুদ্ধকর ভাবগুলিকে দ্রুত পরিবর্তনশীল আধুনিক বিজ্ঞান ও আর্থ-সামাজিক ধ্যান -ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে জনপ্রিয় করা, শক্তিপ্রদ করা, এবং পুনর্ব্যাখ্যার প্রয়োজন ছিল। তিনি ভারতের সর্ব প্রথম মহান চিন্তাবিদ যিনি বিজ্ঞান ও ধর্ম বা আরো সঠিকভাবে বলা চলে, বিজ্ঞান ও বেদান্তের মধ্যে সমন্বয়সাধনের প্রয়াস করেছেন। স্বামীজী দেখিয়েছেন বিজ্ঞান ও ধর্ম---মানবীয় চেতনার দুটি ভিন্ন স্তরে অবস্থান করলেও তাদের মধ্যে অনেক সাদৃশ্য রয়েছে এবং তারা একে অপরের বিরুদ্ধ নয়, বরং পরিপূরক।

বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে আপেক্ষিক তত্ত্ব, গাণিতিক, প্রযুক্তি, পরমাণু, পদার্থবিদ্যা, কণাবিদ্যা, এবং বিজ্ঞানের অপরাপর ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি ঘটেছে। বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কারের প্রেক্ষায় বেদান্তের সনাতন তত্ত্বের স্বামী বিবেকানন্দ-কৃত ব্যাখ্যার নতুন বিশ্লেষণ দরকার ছিল। তিনি রামকৃষ্ণ-সঙ্ঘের জন্য একটি প্রতীক স্থির করেছিলেন যার কেন্দ্রস্থলে একটি রাজহংস আছে। প্রতীকটি পরমাত্মার উপলব্ধির (পরমহংস) গঠনে কর্ম, -ভক্তি- জ্ঞান-ধ্যানের সমন্বয়ের মূর্তপ্রকাশ।

স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর সমগ্র জীবনে এই আদর্শকেই অনুসরণ করেছিলেন এবং সেই আদর্শকেই অনুশীলন করার জন্য সকলকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। তিনি কখনই ব্যক্তিত্বের একদেশদর্শিতাকে সমর্থন করতেন না। স্বামীজী সংস্কৃত ভাষায় লেখা “শ্রী রামকৃষ্ণ স্তোত্রম”-এ তাঁর গুরুরদেবের বর্ণনা করেছেনঃ অদ্বয়তত্ত্বসমাহিতচিত্তং প্রোজ্জ্বলভক্তিপটাবৃতবৃত্তম্ কর্মকলেবরমদ্ভূতচেষ্টং যামি গুরুং শরণং ভববৈ্দম্। (যাঁর চিত্ত অদ্বৈত্তত্ত্বে সমাহিত, যাঁর চরিত্র অতি উজ্জ্বল ভক্তিরূপ বস্ত্রের দ্বারা আবৃত, যাঁর জীবন লোককল্যাণে নিযুক্ত, যাঁর কার্যাবলী অপূর্ব, সেই সংসাররোগের চিকিৎসক গুরুর আশ্রয় গ্রহণ করি।)

স্বামীজী পাশ্চাত্যের শিষ্যদের বলেছিলেন তিনি আবার আসবেন, কারণ তিনি মানুষের প্রেমে পড়েছেন। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেনঃ

“নিন্দাবাদ একেবারে দূর করো। তোমাদের মুখ বন্ধ হোক, হৃদয় খুলে যাক।। এই দেশের এবং সমগ্র জগতের পরিত্রাণ করো। তোমাদের প্রত্যেককেই ভাবতে হবে, সমস্ত ভার তোমাদেরই ওপর।”

তিনি বলতেনঃ

“যত বয়স বাড়ছে, আমি তত ছোট ছোট জিনিসের মধ্যে মহত্ত্ব খোঁজার চেষ্টা করছি। আমার জানতে ইচ্ছে করে একজন মহৎ ব্যক্তি কী খান, কী পরেন, এবং কীভাবে উনি তাঁর পরিচারকদের সংগে কথা বলেন।”

তিনি বলেছেন -

“শক্তিই উপনিষদের বানী। আমি দেহ নই, মন নই, আমি আত্মা - এই বোধ এবং উপলব্ধি থেকেই শক্তির সঞ্চার হয়”।

4 comments:

  1. খুব ভালো পড়লাম। হলাম সমৃদ্ধও। শুভেচ্ছা

    ReplyDelete
  2. সুন্দর সহজ ভাষায় লেখা, পড়তে গিয়ে থামতে পারিনি।

    ReplyDelete
  3. কত সহজ করে লেখ ত্মি। তোমার লেখায় ঠাকুর-মা-স্বামীজীকে বারবার নতুন করে খুঁজে পাই।

    ReplyDelete