গল্প - বিশ্বজিৎ হালদার
Posted in গল্পভোলার একটা মস্ত বড়ো দোষ যে প্রতিদিন সকালে উঠেই দাঁত মাজতে মাজতে হাতে এক মুঠো মুড়ি নিয়ে পুকুরের চারপাড় ঘুরে ঘুরে জলের কাতলা মাছটিকে না খাওয়ানো পর্যন্ত সে কিছুতেই পড়তে বসবে না। এই মাছটি যেন তার প্রাণের দোসর।
বাস্তবিকই ভোলার সঙ্গে এই জলচর প্রাণীটির যেন সর্বদা আন্তরিক সখ্যতা। যে সম্পর্কের কথা হয়তো জগতসংসারে আর কেউ জানে না, হৃদয়ের সঙ্গে হৃদয়ের মিলন ঘটলেই সে সম্পর্কের কথা টের পাওয়া যায়। এরা নিজেরা সেই সত্য হৃদয়ে অনুভব করতে পেরেছে বলেই অন্তত দিনের শুরুটা কেউ কাউকে ছাড়া কল্পনাও করতে পারে না।
যেদিন ভোলার ঘুম ভাঙতে দেরি হয় সেদিন দেখা যায় কাতলা মাছটি ঘাটের কাছে এসে ঠায় দাঁড়িয়ে বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করছে। সে নড়ছে না, চড়ছে না, শুধু আনমনে একবার ঘাটের জল ঢোঁক গিলছে আর পরমুহূর্তে তা অবহেলায় দুই কানকোর ফাঁক দিয়ে বের করে দিচ্ছে। ভোলা এসে সেদিন মুড়ি ছুঁড়ে দিলেও সে তা কিছুতেই মুখে তুলবে না। অবশেষে সে যখন বলে, ‘নে ভুতু খেয়ে নে, আর আমার দেরি হবে না’ তখন তার সব অভিমান গলে জল হয়ে যাবে। ‘গব্গব্’ করে জলের সব ভাসমান মুড়ি নিমেষে সাবাড় করবে।
ভোলা ও ভুতু দুই বন্ধুর নামের সঙ্গেও যেন আশ্চর্য মিল। তবে এইটুকু ছাড়া তাদের দুজনের মধ্যে আর সব বিষয়ে অমিলই বেশি। যেমন ভোলার বয়স আট ভুতুর সবে দুই। ভোলার হাইট তিন ফুট দু’ইঞ্চি, ভুতুর পৌনে দুই ফুট ছুঁই ছুঁই। ভোলার কথা এখন অনেকটাই স্পষ্ট, কিন্তু ভুতু কিছু বলতে পারে না। তবে ভোলা যখন রোজ দশটাই সময় ঘাটে আসে স্নান করতে, ভুতু তখন বুঝতে পারে তার বন্ধুর স্কুলের যাবার প্রস্তুতিপর্ব চলছে। ভুতু অভিমানে জলের উপর মুখ নেড়ে নেড়ে বলে, ‘তুমি যাও আমি তোমার সঙ্গে কথা বলব না।’ ভোলা বলে, ‘কী করবো বল স্কুলে না গেলে বাবা যে খুব বকবে।’ ভুতু ভোলার এই অসহায়তার কথা বোঝে, তাই সে সব রাগ ভুলে গিয়ে লেজের ঝাপটা দিয়ে ভোলাকে ভিজিয়ে দেয়। ভোলা কোমর জলে দাঁড়িয়ে দেখে ভুতু কেমন তার চওড়া লেজটা নৌকোর হালের মতো এদিক ওদিক বাঁকিয়ে সাঁতার কাটছে।
ভোলার ইচ্ছে ভুতুর মতো সেইও সারাদিন জলে সাঁতার কেটে বেড়ায়। কিন্তু সে অধিক জলের দিকে যেতে সাহস পায় না। সে শেষে আফসোস করে বলে, ‘তোমার মতো আমাকেও সাঁতার সেখাবে ভুতু?’
ভুতু একবার জলের উপর হাপ্সি খেয়ে বন্ধুকে দুচারটে সাঁতারের মারপ্যাঁচ দেখাতে দেখাতে যেন জবাব দেয়, ‘তুমি ডাঙার জীব সাঁতার না শিখলেও চলবে। তবে নিতান্তই যদি শিখতে চাও বাড়ির বড়োদের নিয়ে এসো শেখাবো।’ ভোলা আর কোনো কথা না বলে স্নানটি সেরে চলে যায়।
আজ সাতদিন দুই বন্ধুর কেউ কারোর সঙ্গে দেখাশোনা নেই। এই কয়দিন ভোলা প্রবল জ্বরে প্রায় সারাক্ষণ বিছানায় কাতরাচ্ছে। ছেলের চিন্তায় বাড়িতে কারোর খাওয়া ঘুম নেই। ডাক্তারের কথা মতো ভোলার মা ছেলের বিছানার পাশে বসে মাঝে মাঝে জলপট্টি দিচ্ছে। তার বাবা তো নাড়ি দেখতে দেখতে হয়রান।
ভোলার ঠাকুমা সারাদিন ভিজে কাপড়ে ঠাকুর ঘরে হত্যে দিয়ে পড়ে। কাপড় শুকিয়ে গেলে আবার পুকুর ঘাটে যায় ডুব দিতে। গিয়ে দেখে ভুতু ঘাটের কাছে একজায়গাতেই ঠায় ভেসে রয়েছে। লোক দেখেও সে ভয়ে পালাচ্ছে না। একবার ডুব দিতে দিতে ঠাকুমা বলে, ‘ভুতু তোর বন্ধু যে জ্বরে কথা কইতে পারছে না!’ বন্ধুর অসুস্থতার কথা শুনে ভুতু যেন কয়েক মুহূর্ত কিছু ভেবে নেয়, তারপর ডুবসাঁতরে চলে যায় জলের গভীরে। পরেরবার ভোলার ঠাকুমা স্নান করতে এসে আর তাকে দেখতে পায় না।
আটদিনের মাথায় ভোলা একটু সুস্থ হয়ে উঠলো, মুখে আবার সেই আধো আধো কথা। ঘুমের ঘোরেও সে এখন বন্ধুদের সঙ্গে কথা কইছে। ডাক্তার এসে নাড়ি দেখে জানালেন, ‘বিপদ কেটে গেছে। ভোলা এখন অনেকটাই সুস্থ।’ তিনি ভোলার বাবাকে বলে গেলেন ভোলাকে এখন বেশি হাঁটাচলা না করাতে।
বিকেলের দিকে ভোলার মা কী একটা কাজে ঘাটের কাছে গিয়ে দেখে তাদের পুকুরের সবচেয়ে বড়ো কাতলা মাছটা মরে ভাসছে। সরলা ছুটে গিয়ে স্বামীকে খবরটা জানায়।
ভোলার বাবা জল থেকে ভুতুকে তুলে পুকুর পাড়ে শুইয়ে দিয়ে দেখে, ‘মরা ভুতু যেন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে কাকে খুঁজছে। তার ‘হাঁ’ করা গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে পুকুরের পচা পাঁক।’
ভুতুর চোখের দিকে তাকিয়ে ভোলার বাবা-মা দুজনেই হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠে। মাছটির চোখের দিকে চেয়ে ভোলার মা বলে, ‘ভুতু আমি জানি তুই আমার ভোলাকে দেখতে না পেয়ে মরেছিস, কিন্তু তোর এই চলে যাওয়ার খবরটা তোর বন্ধুর কাছে এখনি কী করে দিই বল্? ওরে একথা জানতে পারলে ও যে আর কোনোদিনও ভালো হবে না!’
সন্ধ্যার অন্ধকারে ভোলার বাবা ভুতুকে চুপিচুপি মাটিতে পুঁতে দেয়, ঠিক যেখানে এসে ভোলার হাতের মুড়ি ভুতুকে খাওয়াতে খাওয়াতে শেষ হয়ে যেত। ভোলার মা ছলছল চোখে কবরে মাটি দিতে দিতে স্বামীকে বলে, ‘ওগো, এবার বর্ষাকালে ভুতুর কবরে একটা নারকেল গাছের চারা এনে পুঁতে দিও। দেখো আমাদের ভোলা সেই গাছের মধ্যে খুঁজে পাবে তার বন্ধুকে।’
খুব আশ্চর্য রকমভাবে ভোলা পরদিন সকালে উঠে পেট ভরে ভাত খেতে চায়। সে ডাক্তারের কথা অগ্রাহ্য করে আপনা থেকে ঘরের এদিক ওদিক দুচার পা হাঁটতে থাকে।
কিন্তু তখনও ভয়ে তাকে কেউ ভুতুর খবরটা দিতে সাহস পায় না।
0 comments: