0

প্রবন্ধ - অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in




প্রাণীজগতে “জোর যার মুলুক তার” প্রবাদ বহু প্রচলিত ও সর্বজনবিদিত। অনুকূল পরিবেশে আপাতনিরীহ উদ্ভিদ জগতেও এই প্রবাদ আংশিক সত্য। গুল্মের বাড়বাড়ন্ত একটা আস্ত মোটাসোটা গাছকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দিতে পারে। আবার ছোট জলাশয় পানায় ভরে গিয়ে জলে থাকা মাছেদের জীবন অতিষ্ঠ করে তোলে, অনেকসময় মারাও যায়। এই জোরের শক্তি হতে পারে সংখ্যাধিক্য, ছলচাতুরি, শারীরিক বল অথবা আবেগ সম্পন্ন প্রাণীদের ক্ষেত্রে মানসিক আবেগও হতে পারে। আকাশ থেকে হঠাৎ একটা বাজপাখি নেমে এসে পায়ের আঙুলে গেঁথে একটা পায়রা বা ইঁদুর নিয়ে উড়ে যেতে পারে আবার আট-দশটা শালিক মিলে একটা বেড়াল বা চিলকে পাড়া ছাড়া করতে পারে। একদা বলশালী বাঘ যে একাই হরিণের পাল তাড়া করে শিকার করেছে সেই আবার দৃষ্টিশক্তি কমে গেলে বাণপ্রস্থে যাওয়ার মত নিভৃতে অরণ্যে উপবাসে প্রাণত্যাগ করে। প্রাণীদের ক্ষেত্রে এই একক অথবা গোষ্ঠীগত শক্তিপ্রয়োগ সীমিত কারণে, আত্মরক্ষা আর খাদ্য সংগ্রহ। ব্যতিক্রম মানুষের। মানব গণের মধ্যে আদিতে শক্তির এই দুয়ের প্রয়োগ বজায় থাকলেও পরে যত মস্তিষ্কের উন্নতি হয়েছে এবং বুদ্ধি বেড়েছে ততই বলপ্রয়োগে নিজের শক্তির প্রদর্শনী নানাভাবে করতে থাকে। তার জন্যে তারা পাথরকে অস্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছিল। সেই পাথরকে আবার সুনিপুণভাবে প্রয়োগ করতে ঘষে ঘষে ক্রমান্বয়ে তীক্ষ্ণ ছুঁচলো ধারালো করে তুলল। দূরে ছোঁড়ার জন্যে উপযুক্ত হাতলও বানিয়ে ফেলেছিল। প্রথমে যা ছিল শিকার করে তখনই খাওয়ার ব্যাপার, আগুনের নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার শিখে নেওয়ার পর সংগ্রহ করে রাখতেও শুরু করল। অরণ্যের প্রান্তে এরকম একাধিক মানব গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে থাকত। পরবর্তীকালে যখন তারা আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে পৃথিবীর নানা স্থানে যেতে শুরু করল তখন তাদের সামনে অনেক রকমের বিপদ এসে গেল, ভিন্ন জন্তু জানোয়ারের মোকাবিলা করতে হয়েছিল। সময়ের সাথে মানবগণের বিবর্তনে একাধিক প্রজাতির উদ্ভব হলে ভিন্ন প্রজাতির দল আফ্রিকার বাইরে প্রধানত প্রথমে ইউরোপ ও পরে এশিয়ায় চলে আসত। ইউরোপের ঠাণ্ডা আবহাওয়া তাদের অপরিচিত ছিল। ঠাণ্ডার প্রকোপ থেকে বাঁচতে তাই তারা মূলত গুহায় আশ্রয় নিত। সেইসব গুহায় বাস করত বন্যপ্রাণীরা, তাদের যুদ্ধে হারিয়ে তাড়িয়ে তবে জায়গা পেত সেখানে। ফলে শক্তির ব্যবহার যেখানে প্রথমে ছিল আত্মরক্ষা ও খাদ্য সংগ্রহের জন্যে সেটার সাথে যুক্ত হল আশ্রয়ের সমস্যা মেটাতে। এমন একটা সময় এল যখন একই সময়ে একই জায়গায় ভিন্ন প্রজাতির মানব মুখোমুখি। তখন তাদের মধ্যে থাকার জন্যে জায়গা দখলের প্রবণতা দেখা দিল, শুরু হল গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, সংঘর্ষ। মনুষ্য প্রজাতির মধ্যে শক্তি প্রদর্শনের ব্যাপকতা এবং নানা উপকরণ বিস্তার লাভ করে। মানুষের যুথবদ্ধ সভ্যতা তাকে আরও এগিয়ে নিয়ে গেছে যা শেষ হয়েছে হিংস্রতায়, সৌজন্যে ষঢ়রিপু এবং দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতি। মনুষ্যেতর প্রাণির মধ্যে হিংস্রতা নেই বললেই চলে কারণ তারা প্রয়োজন ছাড়া আক্রমণ করে না, হত্যা করে না। দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতির অনেক সুফল থাকলেও তা মানুষের মনে প্রতিহিংসার জন্ম দেয় যার জন্যে হিংস্রতা আধুনিক মানুষের মধ্যে মহামারি আকার নিয়েছে। মানুষের অবশ্য রিপুকে সংযত করে বুদ্ধিকে ভাল পথে চালনা করারও ক্ষমতা রয়েছে, এবং করেও। মানুষ একসময় তার পূর্বতন জীবিত প্রজাতির সাথে যৌন সঙ্গম করলেও ক্ষমতা দখল ও আধিপত্য বজায় রাখতে তাদের নিকেষ করতে দ্বিধা করে নি। পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে মানুষ পূর্ব মানব প্রজাতিরা তিরিশ হাজার বছর আগে।

জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং সভ্যতার ক্রমোন্নতি মানুষের মধ্যে গোষ্ঠী করে থাকার প্রয়োজন ও প্রবণতাকে উত্তরোত্তর উস্কে দিয়েছে। এই বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে শক্তির তারতম্য তাকে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে প্রলুব্ধ করেছে, এক গোষ্ঠী অন্যকে শক্তিতে পরাজিত করে এলাকা বাড়িয়েছে। প্রত্যেক গোষ্ঠীর একজন নেতা আছে যাকে গোষ্ঠীপ্রধান বা রাজা বলে মেনে নিয়েছে অন্যেরা ফলে গোষ্ঠীর মধ্যেই ক্রমে রাজার শক্তি আরও বেশি হয়েছে। সে তারই গোষ্ঠীর অন্যদের শাসন করে, শাস্তি দেয়। রাজার কিছু সহকারী থাকে, তারা অনুগতও বটে। তারাও অন্যভাবে ক্ষমতার স্বাদ নেয়। এভাবেই পৃথিবীর স্থলভাগ নানা ভূখণ্ডে সীমায়িত হয়ে আলাদা রাজ্য বা দেশ তৈরি হয়েছে। গড়ে উঠেছে ভূ-পরিবেশভিত্তিক জীবন যাপনের পৃথক ধর্ম, সংস্কৃতি ও আচার। যোগাযোগের নিমিত্তে আপন আপন ভাষা। এরই মধ্যে কিছু মানুষ অন্য ধরনের, তারা আকাশের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে পৃথিবী ও জীবনের গোপন এবং প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের গভীর রহস্য। কিছু প্রাকৃতিক সম্পদে সৌন্দর্য খুঁজে পায়। যা কিছু সন্ধান পায় ছন্দে ছন্দে তাকে ব্যক্ত করে যাতে সহজে প্রজন্মবাহিত হয়, হারিয়ে না যায়। এরও অনেককাল পরে সেইসব উক্তি স্মৃতি থেকে লেখা হল। আবেগ দর্শনের মধ্যে স্থায়িত্ব পেল, ও বিশ্বাস জন্মাল।

এক ভূখণ্ডের রাজা লোকলস্কর নিয়ে যখন অন্য ভূখণ্ডে এসে তার দখল নেয় তখন স্থানীয় বা দেশজ মানুষেরা বিপন্ন বোধ করে। যদি স্থানীয় মানুষেরাও ক্ষমতাবান শক্তিশালী হয় তবে যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী। সংখ্যাগুরু স্থানীয়দের কাছে বহিরাগতরা পরাজয় স্বীকার করে পালিয়ে যায়। আর স্থানীয়রা যদি শক্তিশালী না হয় তবে বহিরাগতদের আনুগত্য মেনে নেওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। এক্ষেত্রে বহিরাগতরা সংখ্যালঘু হলেও জোর যার মুলুক তার। এর দুটো দিক আছে, বহিরাগতরা লুঠপাট করে চলে যেতে পারে অথবা সেখানে তাদের রাজত্ব কায়েম করতে পারে। রাজত্ব কায়েম করতে গেলে শক্তি প্রয়োগ করে দেশজ লোকেদের সভ্যতা, সংস্কৃতি ও ভাষার ওপর সরাসরি আঘাত হানতে পারে। অথবা যদি দু পক্ষই সংযমী, সহনশীল হয় তবে দু-দলের মধ্যে এসবের আদান-প্রদান করে মিশ্র সভ্যতা ও সংস্কৃতি সৃষ্টি হয়। শেষেরটায় বেশিদিন রাজত্ব ভোগে সুবিধে হয়। সময়ের সাথে দু ভাবেই দেশজ সংস্কৃতি আস্তে আস্তে মুছে যায় বা দুর্বল হয়ে পড়ে। এইভাবে আমেরিকা, আফ্রিকা ও এশিয়ার অনেক দেশের দেশজ সংস্কৃতি, ভাষা বহিরাগতের অবদানে প্রায় নিশ্চিহ্ণ হতে বসেছে।

পৃথিবীতে একসময় একই ভূ-গাঠনিক প্রক্রিয়ায় প্রথমে আল্পস ও পরে হিমালয়ের উদ্ভব। আল্পস ইওরোপকে সামলে রেখেছে আর হিমালয় কোলে করে আগলে রেখেছে এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল। হিমালয়ের বিস্তার পশ্চিমে আফগানিস্তান থেকে শুরু করে হিমালয়ের অক্ষরেখা ধরে পূর্বপ্রান্ত অবধি এসে দক্ষিণে ঘুরে গিয়ে বর্মার আরাকান পর্বতমালা হয়ে জ্যা-এর আকৃতি ধরে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত। বিস্তীর্ণ এই এলাকায় ভূ-প্রকৃতির বিচিত্রতার জন্যে একাধিক সংস্কৃতি বহমান থাকলেও একটা সুতো কোথায় যেন সবাইকে বেঁধে রাখত যার প্রতিফলন পৌরাণিক কাহিনী মহাভারতে দেখা যায়, সুদূর গান্ধারের সাথে পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে ভারতের হস্তিনাপুরে বৈবাহিক সূত্রে। সাড়ে তিন হাজার বছর আগে পূর্ব ইউরোপ থেকে একদল ইন্দো-এরিয়ান এসে ভারতের সেসময়ের দেশজ লোকেদের সভ্যতা ও সংস্কৃতির ওপর আঘাত হানে। স্থানীয় অধিবাসীদের দুর্বল প্রতিরোধ অতি সহজেই উন্নত অস্ত্র ও যান ব্যবহার করে দমিয়ে দিতে সক্ষম হয়। তারপর দীর্ঘদিন ধরে মিলেমিশে নিজেদের সংস্কৃতি, ভাষা, সভ্যতা ও পৌত্তলিক ধর্মীয় সংস্কার, এবং বর্ণবৈষম্য চাপিয়ে দিয়ে তাদের পরিচিতি গ্রাস করে। বহিরাগতরা মূলত পুরুষ ছিল এবং সমাজে তাদের আধিপত্য ছিল বেশি। তারাই এখানের সমাজে মিশে স্থানীয় নারীদের সাথে যৌনমিলনের ফলে একদিকে সমাজে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে নেয় আবার অন্যদিকে মিশ্র জনমানসের সংখ্যা বাড়তে থাকে। যদিও কিছু প্রাচীন অধিবাসীদের উত্তরপ্রজন্ম এখনও রয়ে গেছে দেশের আনাচে-কানাচে, মূলত অরণ্যে উপজাতি হয়ে। প্রায় হারিয়ে গেছে প্রাক্‌-ইন্দো-এরিয়ান দেশজ ভাষা, সংস্কৃতি ও সভ্যতা। এর হাজার বছর পর নব্য সংস্কৃতির বিরুদ্ধে গিয়ে বুদ্ধের পৌত্তলিক-বর্জিত অহিংস ধর্মের বাণী এশিয়ার প্রান্তে প্রান্তে আলো জ্বালায়। আরও পরে আরবের ইসলাম ধর্ম নেয় ইরান আর ইরানের সভ্যতা আসে আরবে। উত্তর-পশ্চিম এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে আরব-ইরানের ধর্ম। পরবর্তিকালে একাধিক পশ্চিম এশিয়ার রাজা-বাদশাদের আক্রমণ বা আগমণের সঙ্ঘবদ্ধ বিরোধিতা করেনি পরিবর্ত-সংখ্যাগুরু ভারতীয়েরা। আরও একবার তৈরি হয় নতুন সমাজ, মিশ্র ভাষা ও একাধিক ধর্মীয় সংস্কার। প্রায় সাতশো বছর মুসলমান সাম্রাজ্য চললেও সংখ্যাগুরু হিন্দু ধর্মের লোকেরা কঠিন ধর্মবৈষম্য বজায় রেখে বিরোধহীন সমান্তরাল সমাজ মেনে নিয়ে একসাথে কাজ করেছে। সপ্তদশ শতক থেকে একাধিক ইউরোপীয় দেশ পৃথিবীজুড়ে দেশ দখলদারির সাথে এখানেও ঘাঁটি গাড়ে, তাদের নিজেদের সমাজের প্রতিলিপি তৈরি করে ছোট ছোট জায়গায়। উত্তর আমেরিকা সমেত অনেক দেশের জনজাতি কোণঠাসা হয়ে প্রায় বিলুপ্তির পথে চলে যায়। ব্রিটিশ বাণিজ্যতরী নিয়ে এলেও ভারতীয়দের শাসক হতে দেরি করে নি কিন্তু অন্য দেশের মত সম্পূর্ণ গ্রাসও করতে পারেনি। তারাও ছিল সংখ্যালঘু বহিরাগত। সেসময়ের ভারতীয় দর্শন ও সাহিত্য ইউরোপীয় উন্নত সভ্যতার শিক্ষা, প্রযুক্তি, সাহিত্য ইত্যাদির সাথে মিলিয়েমিশিয়ে এদেশের উচ্চবর্ণের শিক্ষিত লোকের মন জয় করে দু-শতকেরও বেশি সময় রাজত্ব চালায়। একসময় ভারতীয় জনগণের মধ্যে রোপিত হয় ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদ ও স্বাধীনতার বীজ। তা বৃক্ষের আকার নিলে ব্রিটিশ শাসনের ভার ভারতীয়দের হাতে সমর্পন করে।

রাষ্ট্রসঙ্ঘের “indigenous” বা দেশজ ধারণা অনুসারে ভারতবর্ষে প্রথম নীলচোখ-ইউরোপীয়দের আগমণের আগে যারা দীর্ঘকাল বসবাস করে এসেছে তারাই দেশজ। ‘নব্য’-সংখ্যাগুরু ভারতীয়রা একাধিক বহিরাগতদের দ্বারা রূপান্তরিত। বর্ণবৈষম্যের নিয়মানুসারে দেশজ লোকেদের বহু শতাব্দী ধরেই দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে। স্বাধীন ভারতবর্ষে আজও তারা একেবারেই প্রান্তিক, সংখ্যালঘু; ২০১১ আদমসুমারি অনুসার ভারতে ট্রাইবদের সংখ্যা প্রায় সাড়ে দশ কোটি অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার সাড়ে আট শতাংশের মত। যে সমস্ত স্থানিক গোষ্ঠী বহিরাগতদের সাথে না মিশে তাদের সভ্যতা, সংস্কৃতি ও ভাষার ঐতিহ্য বজায় রেখে নিজেদের মূল পরিচিতি নিয়ে বাঁচতে চেয়েছে তাদের নিম্নবর্গের লোক হিসেবে চিহ্ণিত করে দমন, পীড়ন ও অচ্ছুত করে রাখার প্রবণতা সেই ইন্দো-এরিয়ানদের আগমনের পর থেকেই বিভিন্ন ভাবে চলে আসছে। এইভাবে সমাজচ্যূত হয়ে থাকতে থাকতেই তারা মানসিক দুর্বল হয়ে পড়েছে। আসল দেশজ ভারতীয় হয়েও তারা নিজের দেশে ভয়ে দিন কাটায়। নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যে তারা কোনোরকমে অরণ্যবাসী হয়ে দিনাতিপাত করছে। সহ্য করছে সংস্কৃতি ও ভাষার লাঞ্ছনা, যাপনের জন্যে প্রশাসনের হাতে শারীরিক ও মানসিক নিগৃহীত, ধর্ষিত। রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন প্রকল্পের প্রায় কিছুই তারা পায় না, অথচ উন্নয়নের জন্যে উচ্ছেদ করা হয় একদা নিশ্চিন্ত অরণ্যবাস থেকে। অবশ্য জঙ্গলের জন্তুদের সাথে নিশ্চিন্তে বসবাস করার আদবকায়দা জানা থাকলেও ‘আর্বান জন্তু’দের হাতে নিগ্রহ, অসম্মানের প্রতিবাদ করতে পারে না। আধুনিক স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের সামনে তাদের নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়। এ শুধু ভারতে নয়, সারা পৃথিবী জুড়ে যেখানেই বর্ণবৈষম্য সৃষ্টি করা হয়েছে। বহিরাগতদের পক্ষে মানুষে-মানুষে, অন্তর্গোষ্ঠী এবং আন্তর্গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব ও বৈষম্য তৈরি ও টিকিয়ে রাখার মূল উদ্দেশ্যই হল যাতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে থাকতে না পারে। যুথবদ্ধ বাস মানুষের সভ্যতার আদিমতম সংস্কৃতি। ঐক্যের শক্তিকে সংখ্যালঘু দুর্বৃত্তেরা সর্বকালে ভয় পায়।

আসলে সারা পৃথিবীতে প্রাচীনকাল থেকেই পরিকল্পনা করে বহিরাগতরা দেশজ অধিবাসীদের নানাভাবে অত্যাচারের দ্বারা মানসিক দুর্বল করে রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে এবং বেশি ক্ষেত্রেই তারা সফল। তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ভাষা সাহিত্য সবকিছু অসম্মান ও অগ্রাহ্য করার প্রবণতা রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে অসত্য প্রচার করে সমাজচ্যুত করছে। নানা ধরনের বর্ণবৈষম্য দিয়ে তাদের মানবতাকে কালিমালিপ্ত করে রাখার চেষ্টা চলছে। ভারতবর্ষও ব্যতিক্রম নয়। এখানের বহিরাগতরা আরও প্রাচীন। তারা আর বহিরাগত বলে ধরাই হয় না, তারাই যেন আসল ভারতীয়। একটা প্রচার আছে সংখ্যা দিয়ে লঘু-গুরু বিচার করে গুরুরা অত্যাচার চালায় লঘুদের ওপর। আসলে দুর্বল শ্রেণিরাই বিপন্ন, শোষিত, সে যে কোন ক্ষেত্রেই হোক না কেন। এভাবেই একদা দেশজ মাতৃতান্ত্রিক সমাজকে নানা সামাজিক নিয়মের মধ্যে বেঁধে দুর্বল করে বহিরাগত পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তাদের শক্তি বিস্তার করেছে। নারীকে দুর্বল শ্রেণি বলে দেগে দেওয়া হয়েছে। পুরুষ ছাড়া তাদের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা হয়েছে। একইভাবে প্রবীণদের জন্যে বাণপ্রস্থের ব্যবস্থা যাতে সামাজিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন লোকেরা দূরে থাকে। আর অসুস্থ ও অশক্তদের তো ধর্তব্যের মধ্যেই রাখা হয় না। এই সব দুর্বল শ্রেণিদের সবল করার জন্যে রাষ্ট্রসঙ্ঘের নানা বিভাগে অনেক পরিকল্পনামাফিক কাজ হচ্ছে যার মধ্যে দুর্বল প্রান্তিক দেশজদের সবল করা। অশক্ত হয়ে বনবাস নয়, সমাজের প্রান্তে এবং বনে বাস যাদের তাদের শক্তি জোগানোই হবে মানবতার পরিচয়।

0 comments: