0

ধারাবাহিক - রাজা মুখোপাধ্যায়

Posted in




















১৫

স্মৃতির শহর

৯৮ এস পি মুখার্জি রোড। এটি নিছক কোনও ঠিকানা নয়। আমাদের মতো কারও কারও কাছে চেতনার নানান স্তর উন্মোচিত হয়েছিল। সরে গিয়েছিল অনেক পর্দা। যার মধ্যে একটা অবশ্যই খানাপিনা সংক্রান্ত। আর যাঁর সূত্রে ওই পরিবারে যাত্রা এবং ঘনিষ্ঠতা, তাঁর নাম অশোক সেন। এমন বর্নময় এবং বিপরীতমুখী বৈশিষ্ট্যের সমাহার সচরাচর দেখা যায় না। কলকাতার এক বিশিষ্ট পরিবারে জন্ম। উচ্চশিক্ষা, সুদীর্ঘ প্রবাস এবং লোভনীয় একাধিক পদ তুচ্ছ নানা কারণে ছেড়ে দেওয়া – এমন বর্ণনায় এই মানুষটিকে চেনা মুশকিল। সত্যি কথা বলতে কি অশোকদাকে বোঝার চেয়ে ভুল বোঝা সহজ ছিল। তাঁর অনেক ঝোঁক বা শখের একটি ছিল রান্নাবান্না। আটপৌরে কোনও এক পদের অসামান্য একটি দিক চিহ্নিত করতে পারতেন অসাধারণ মুনশিয়ানায়। আবার ডাইনিং টেবিলের রীতিনীতি বিষয়ে অনেক পাঠই প্রথম তাঁর কাছে। নিজেও রান্না করতেন চমৎকার। অনেক বছর আগে তাঁরই হাতে প্রথম মুরগির ‘পট রোস্ট’ খেয়ে অতি আহ্লাদিত হয়েছিলাম।

ইউরোপের নানা প্রান্ত থেকে জীবিকা এবং অন্যান্য কারণে লক্ষ্যে মানুষ যখন আমেরিকা মহাদেশে ছড়িয়ে পরে, গড়ে ওঠে নব জনগোষ্ঠী, তাদের জীবনযাত্রার ধরন-ধারণের মধ্যে খাদ্যাভ্যাসের ব্যাপারটিও প্রকাশ পায় বিশেষ স্বাতন্ত্র্য নিয়ে। ফলত অনেক আহার্য, যা ছিল একান্তই ইউরোপের নিজস্ব, কালক্রমে তেমন অনেক কিছুই বদলে গেল চরিত্রগতভাবে আর হয়ে উঠলো ‘অ্যামেরিকান’। যেমন পিৎজা, যেমন স্টেক। এই ‘পট রোস্ট’ ও তেমনই। অশোকদাকে দেখেছিলাম একটা গোটা মুরগির পেটের ভিতর নানারকম আনাজ, যেমন গাজর, ছোটো আলু, পেঁয়াজ পুরে দিয়ে আভেনে ঢুকিয়ে দিয়ে আমাদের সঙ্গে গল্পে (যার মধ্যে বেশিরভাগটাই ছিল পরনিন্দা) মজে যেতেন। ঘণ্টাখানেক পর ‘এস হে’ বলে আমাদের ডেকে নিয়ে যেতেন খাবার ঘরে। সেখানে আমাদের চোখের সামনেই আভেন থেকে বার করা হতো পাখিটিকে। যে ছিদ্র দিয়ে আনাজগুলি প্রবেশ করানো হয়েছিল, সেটি তখনও সেলাই করে বন্ধ করা এবং পা-দুটিও বাঁধা। পরে রান্নাবান্নায় একটু হাত-পাকানোর পর যখন নিজেও এই ধরণের হেঁশেলপনা করতে শুরু করেছি, অশোকদাকে জিগ্যেস করেছি অনেকবার, আনাজ যা ব্যবহার করতেন, তা তো দেখতেই পেতাম, তা ছাড়া আর কী দিতেন? উত্তরে মুচকি হাসতেন কিন্তু সরাসরি কোনও উত্তর দিতেন না। এটাই সাধারণত হয়ে থাকে। খুব নামী কোনও রাঁধুনিও যখন কোনও রান্না শেখান, উপকরণ এবং প্রক্রিয়া সংক্রান্ত জ্ঞান দিয়ে থাকেন নাটকীয়ভাবে কিন্তু আমি বা আপনি যখন সেই পদটি তৈরি করি, একই হয় কি তার ফলাফল? বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হয়না। এর কারণ কি জ্ঞানের অপ্রতুলতা? আধুনিক সরঞ্জামের প্রয়োগ? নাকি আর কিছু? এই আর কিছুর মধ্যেই লুকিয়ে আছে যাবতীয় রহস্য। এই পুরো বিষয়টার ম্যাজিক এখানেই। মিশেলিন তারার অধিকারী কোনও পাচক যখন রান্নার ক্লাস নেন, অনুপুঙ্ঘভাবে তিনি প্রতিটি পর্ব ব্যাখ্যা করেন, কোন উপকরণ কেন, কখন ব্যবহার করা হবে, কোন মাত্রায় করা হবে, এসবই থাকে সেই উপস্থাপনায়। কিন্তু দক্ষতা? এটি এমন এক বস্তু, যার সঠিক কোনও মাপকাঠি হয়না। বুঝে নিতে হয় দুটি লাইনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা কোনও অমোঘ সংকেতকে এবং প্রয়োগ করতে হয় যথাযথভাবে। যে সাবলীলতায় জ্যামি অলিভার মুরগির ফিলো পেস্ট্রির চেয়েও পাতলা, ফিনফিনে ত্বকের মধ্যে অঙ্গুলিসঞ্চার করেন, তার অনেকটাই অর্জিত কিন্তু বাকিটা? থাইম, মারজোরাম আর মাখনের মিলমিশ জ্যামি মুরগিটিকে আভেনে প্রবেশ করানোর অন্তত দুঘণ্টা আগে সেটির ত্বকের মধ্যে চালান করে দেন, যা বলতে গেলে তৈরি করে একটি আলাদা স্তর আর তারপর রান্না হওয়ার সময় ত্বকের মেদ আর মাখন একাকার হয়ে একাত্ম হয়ে যায় মাংসের সঙ্গে আর সৃষ্টি হয় সেই প্রার্থিত স্বাদ!

এ হলো ধান ভানতে শিবের গীত! এবারের কিস্তি আরম্ভ করেছিলাম কলকাতার ক্লাবগুলিতে যে বিশেষ ধরণের রান্নার একটি সংস্কৃতি তৈরি হয়েছিল ঔপনিবেশিক প্রভাবে, সে বিষয়ে কিছু লিখবো বলে। সে সূত্রে অবশ্যম্ভাবীভাবে তাঁর প্রসঙ্গ এসে পড়েছিল, যাঁর সঙ্গী হয়েই ক্লাবযাত্রা শুরু হয়েছিল একদিন। অনেক রবিবার সকালেই তাঁর ফোন পেয়েছি এই মর্মে যে বাড়িতে দুপুরে খাওয়ার মতো (পড়ুন তাঁর পছন্দমতো) কিছু রান্না হচ্ছে না। তাই আমাদের অন্য কাজ না থাকলে ডালহৌসি ইন্সিটিউট-এ তিনি আমাদের মধ্যাহ্নভোজনে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন। কী খাওয়া হতো ওই দিনগুলিতে? প্রায় সেট মেনু। সাদা ভাত, ডাল, ভেজ ঝালফ্রেজি আর চিকেন কোরমা, যাতে আলাদাভাবে আলু দেওয়ার নির্দেশ থাকতো এবং প্রায় প্রত্যেকবারই সেই আলুর সংখ্যা প্রত্যাশামতো না হওয়ার কারণ দর্শাতে হতো খাবারের পরিবেশককে। যে পদগুলির নাম করলাম, সেগুলি একপ্রকার সাধারণ তো বটেই, অতি সাধারণও বলা যেতে পারে। কিন্তু সময়, পরিবেশ, এক টিপিক্যাল রন্ধনশৈলী, উপকরণ এসবের মেলবন্ধনে যে স্বাদটি প্লেটে হাজির হতো তা সত্যিই একেবারে আলাদা, ইউনিক! এর মধ্যে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান প্রভাব তো একটা ছিলই কিন্তু আরও কিছু ছিল, যা জানা নেই। যে সময়টার কথা বলছি, তখনও মোবাইল ফোন আসেনি, মাল্টিপ্লেক্স ব্যাপারটা দেশের মানুষের কাছে অধরা ছিল। আর এই গত দু-আড়াই দশকের মধ্যে যোগাযোগের পৃথিবীতে বিস্ফোরণ ঘটে গেছে। আরও একটা নিঃশব্দ বিপ্লব অনুষ্ঠিত হয়েছে এই সময়ের মধ্যেই। একদিকে যেমন বহির্বিশ্বের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অনেক নিবিড় হয়েছে, ভিন দেশের খাবারের গ্রহণযোগ্যতা এবং জনপ্রিয়তা দুটোই বেড়েছে পাল্লা দিয়ে, ততোই যেন প্রতিটি সংস্কৃতি তার নিজস্বতা হারিয়ে ফেলেছে। বিপন্ন হয়েছে হয়েছে ঐতিহ্য। খাদ্য এর আওতার বাইরে থাকেনি। তাতে হলো কি, বিশেষ বিশেষ রন্ধনপদগুলি বেঁচে থাকা শুরু করলো রেসিপি বইগুলির মধ্যে, বাস্তবে তার আর তেমন অস্তিত্ব রইলো না। তিন দশক আগে যে ক্লাবের ল্যাম্ব রোস্ট বা ইয়েলো রাইস-বল কারি একটা আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল, তা এখন আর পাওয়া যায় না। পাওয়া যায় না সেই রবিবার দুপুরের ভেজ ঝাল ফ্রেজি অথবা চিকেন কোরমা!

নব্বইয়ের গোড়ার দিকে, মধ্যপ্রাচ্যে কিছুদিন কাটিয়ে আসার পর জীবিকার প্রয়োজনে আরেকজন মানুষের সংস্পর্শে এলাম। তিনি তাপস সেন। মুদ্রণজগতে এর কয়েকবছর আগে আকস্মিকভাবে প্রবেশের পর থেকেই লক্ষ্য করেছি এই নামটি সমীহাসঞ্চারী। কর্মজীবনের দীর্ঘতম পর্বটি তাপসবাবুর ঘনিষ্ঠতম বৃত্তে কাটানোর সুবাদে দুটি বড় ব্যাপার ঘটেছিলো। এক, কাজের প্রশ্নে খুঁটিনাটির মধ্যে ঢুকতে চাওয়ার প্রবণতা এবং চূড়ান্ত পেশাদারী মনোভাবটি তৈরি হয় ওই সময়টিতেই, তাঁর স্বভাবের ছোঁয়াচ লেগে। দুই, খাদ্য এবং পানীয় বিষয়ে তাঁর অসীম জ্ঞান আর সূক্ষ্ম রুচিবোধ ভীষণ আকৃষ্ট করেছিল আমায় এবং একথা স্বীকার করতে কোনও দ্বিধা নেই যে এ প্রসঙ্গে আমার ধ্যানধারণার একটা নির্দিষ্ট চেহারা তৈরি হয় তাপসবাবুর সঙ্গে কলকাতার ক্লাবগুলিতে নিয়মিত যাতায়াতের ফলেই।

মনে পড়ে ওইসময় কোনওএকদিন আমরা সন্ধের মুখে হাজির হয়েছিলাম কনক্লেভ-এ। সেই প্রথমদিন কী খাওয়া হয়েছিল, সত্যি বলতে এখন আর মনে নেই। কারণ কনক্লেভ-এর মেনু ‘ফাইন ডাইনিং’- এর গোত্রভুক্ত হলেও এই ক্লাবটি শহরের নব্য ক্লাব কালচারের প্রতিভূ। আর ঠিক সেই কারণে কখনওই ওই পদগুলি আলাদাভাবে আমার স্মৃতিতে রেখাপাত করেনি। ডালহৌসি ইন্সটিটিউট-এর বাইরে বিশিষ্ট ক্লাব ফুডের সঙ্গে আবার মোলাকাত ঘটলো ক্যালকাটা ক্লাবে। ইতিমধ্যে চিংড়ি মাছের প্রতি তাপসবাবুর সীমাহীন ভালবাসার কথাও জানা হয়েছিল। একথা অনস্বীকার্য যে, যেকোনোও খাদ্যবস্তু চিংড়িমাছের ছোঁয়া পেলে হয়ে ওঠে মহার্ঘ্য। বিশ্বসংসারে সম্ভবত এমন কোনও জায়গা নেই, যেখানে এর ব্যতিক্রম ঘটে। প্রথম সেই সন্ধ্যাতেও আমাদের সামনে এসেছিল চিংড়ির দুটি পদ। ‘প্রন অন টোস্ট’ আর ‘প্রন ককটেল’। খাদ্যরসিক কেউ এই প্রশ্ন তুলতেই পারেন, এমন দুটি জিনিস একসঙ্গে একদিনে কেন? প্রথমটি বিশুদ্ধ স্ন্যাক্স পরিবারের। চিংড়ি, রসুন, আদা, ডিমের সাদা, নুন আর মরিচ মিশিয়ে একটা পেস্ট তৈরি করা হয়। তারপর একদিক টোস্ট করা পাঁউরুটির একটি স্লাইসের একদিকে প্রথমে মাখানো হয় মাখন আর তারপর পুরু করে মাখিয়ে দেওয়া হয় চিংড়ির মিশ্রণ আর ওপর দিয়ে ছড়িয়ে দেওয়া হয় তিল। অতঃপর ডুব তেলে বাদামী করে ভেজে তোলা হয় সেই পাঁউরুটির সেই টুকরোটি এবং কোণাকুণি কেটে নেওয়া সেই স্লাইসটি। তারপর এর স্বাদ কেমন হতে পারে, তা বর্ননা করার প্রয়োজন আছে কি? দ্বিতীয় জিনিসটি অ্যাপিটাইজার গোত্রভুক্ত হয়েও তার আলাদা কৌলীন্য রয়েছে। পৃথক এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি পদ হিসাবে অনায়াসে ভাবা যেতে পারে ‘প্রন ককটেল’-কে। বিশেষ ধরণের গ্লাসে, সাধারণত গবলেট-এর তলায় প্রথমে বিছিয়ে দেওয়া হয় লেটুস পাতা আর তার ওপর দিয়ে দেওয়া হয় মাখনে নেড়েচেড়ে নেওয়া চিংড়ি আর ছড়িয়ে দেওয়া হয় মারি রোজ বা সহস্র দ্বীপপুঞ্জের সস! কী সুন্দর নাম না? সবশেষে ওপরে হালকাভাবে তৈরি করা হয় ঘন কুচিকরা স্প্রিং অনিয়নের একটি আলগা আস্তরণ আর গ্লাসের গায়ে আলতোভাবে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় গোটাকয়েক আস্ত চিংড়িমাছ। সৌন্দর্যায়নের স্বার্থে। তবে সবকিছু ছাপিয়ে এসবের ভিড়ে হিমশৈলের চুড়ার মতো জেগে থাকবে ফ্রায়েড প্রন। একটি নির্দিষ্ট মাপের টাটকা চিংড়িকে প্রথমে নুন, অয়েস্টার সস, রসুন পেস্ট, লেবুর রস, সাদা মরিচগুঁড়ো মাখিয়ে অন্তত ঘন্টাদুয়েক রেখে দেওয়া হয় ফ্রিজে। সেইসময় ময়দা, কর্নফ্লাওয়ার আর সামান্য বেকিং সোডা দিয়ে তৈরি করে রাখা হয় আধা তরল বা ব্যাটার। এরপর খালি ডুব তেলে মুচমুচে করে ভেজে নেওয়ার কাজটি বাকি থাকে। চিংড়ির লেজের বেরিয়ে থাকা অংশটি তিন আঙুলে ধরে মুখের দিকটা টাবাস্কো সসে ডুবিয়ে কামড় দেওয়ার সময় ভিতরের সুগন্ধি ধোঁয়াটি মুখগহবরটি ভরিয়ে ফেললে ধরে নিতে হবে কাজটি ঠিকঠাক হয়েছে। এই ফ্রায়েড প্রন-কে ধারাবাহিকভাবে অনবদ্য স্তরে পৌঁছে দিত টলি ক্লাবের হেঁশেল। হয়ত এখনও সেই ধারা বহমান। কিন্তু সেই স্বাদের সন্ধানে আর যাওয়া হয়না অনেকদিন হলো। তার প্রেক্ষাপট আলাদা।

0 comments: