1

গল্প - প্রতিমা নাগ

Posted in


ডোরবেলটা টিপে, এক পা পিছিয়ে দাঁড়ালো পৃথা। মনে তখন তার দারুন উত্তেজনা।তাকেএভাবে হঠাৎ দেখে, শুভর কি প্রতিক্রিয়া হবে কে জানে? মনে মনে শুভর মুখের ভাব আন্দাজ করার চেষ্টা করে পৃথা। অবাক হলে বা বিস্ময়ে ওর ভ্রূদুটো কুঁচকে ধনুকের মতো বেঁকে যায়। দুই ভ্রূর মাঝখানে, ঠিক নাকের ওপর একটা ভাঁজ পড়ে,যেটা কপালের মাঝ পর্যন্ত গিয়ে ইংরেজি ‘Y’-এর আকার নেয়। ওর মুখটা ঈষৎ লাল হয়ে যায় সেই সময়। এখনও, হয়তো শুভর সেই মুখটা দেখতে পাবে সে।আর সেই সময় একটু তোতলায় সে, কিছুক্ষণের জন্য। পৃথাকে দেখেই হয়তো বলবে, ‘ম...ম..মা...? ত...ত... তুমি...?’

কিন্তু দরজা এখনও খুলছে না কেন? এটা শুভর ফ্ল্যাট তো? নীচে কেয়ারটেকারকে জিজ্ঞেস করে লিফটে উঠেছে পৃথা। 7th floor,right side, এই তো নামটাও পরিস্কার লেখা আছে। তবে?

আর একবার বেল টিপলো পৃথা। এবার মনে হলো ভেতর থেকে কিছু অস্পষ্ট শব্দ ভেসে এলো। পৃথা কাঁধের ব্যাগটা নীচে রেখে অপেক্ষা করতে লাগলো। এছাড়া কিছু উপায় নেই। প্রায় মিনিট খানেক পরে,দরজা খুললো সাতাশ-আঠাশ বছরের একটি মেয়ে। উস্কো-খুস্কো চুল,দেখে মনে হচ্ছে, সোজা বিছানা থেকে উঠে এসেছে। হবেই তো। এই সাত-সকালে বিছানা থেকে উঠে আসাই স্বাভাবিক। কিন্তু শুভ কই?

দরজা খুলেই মেয়েটির মুখে ফুটে উঠল প্রশ্নবাচক চিহ্ন, ‘Yes...’

পৃথার মুখ থেকে কোনো রকমে বের হলো,

—Shubho...Shubhomoy Chakraborty...I am his mother...

—O, sorry... sorry, please come in...

তারপর ভাঙা ভাঙা বাংলায় বললো,‘শুভ এখানে নেই,দিল্লী গেছে। কবে ফিরবে ঠিক নেই। আপনি বসুন, আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি...’

পৃথা ঘরে ঢুকেই সোফায় ধপ্ করে বসে পড়ে।তার মনের অবস্থা অবর্ণনীয়। কোথায় সে মনে করেছিল, এভাবে হঠাৎ এসে শুভকে তাক্ লাগিয়ে দেবে, তা নয় বরং তার নিজের তাক্ লাগবার জোগার। কে এই মেয়ে? মেয়েটি শুভর ফ্ল্যাটে কেন? তাহলে কি এই মেয়েটিই শুভর ফ্ল্যাটের কো-হোল্ডার? ইত্যাদি হাজার প্রশ্ন পৃথার মনে। উঃ, সে আর ভাবতে পারছেনা।

বছর তিন হলো, শুভ কলকাতা ছেড়ে ব্যাঙ্গালোরে। সেই থেকে পৃথা একেবারে একা হয়ে গেছে। নাবালক দুই ছেলে আর পৃথাকে রেখে যেদিন অরিন্দম চিরতরে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন, সেদিন মাত্র দুই ছেলের মুখ চেয়ে, সে নিজের মনকে শক্ত করে নিয়েছিল। নাঃ,তাকে এভাবে ভেঙে পড়লে চলবেনা। তাদের সন্তানদের মানুষ করার দায়িত্ব পৃথা একা নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল। শক্ত হাতে সেই দায়িত্ব পালন করেছে সে যথাসাধ্য। নিজের কথা একবারও ভাবেনি সে। সেও তো একটা মানুষ! মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে জীবনের সব সখ-আহ্লাদ কি মিটে যায়? তারও তো মনের, শরীরের চাহিদা থাকতে পারে? কিন্তু নাঃ, সমস্ত ইচ্ছেগুলোর গলা টিপে পৃথা শুধু একলক্ষ্যে এগিয়ে গিয়েছে। বড়ো ছেলেকে ডাক্তারী পড়িয়েছে, ছোটকে ইঞ্জিনিয়ারিং।বড়োছেলে স্কলারশিপ পেয়ে,লন্ডনে পড়ে, ওখানেই সেটল হয়ে গিয়েছে।মাঝে দেশে ফিরে,বিয়ে করে বৌ নিয়ে আবার ফেরৎ চলে গিয়েছে। সে চলে যাওয়াতে অতো খারাপ লাগেনি পৃথার। তখন কেবল মনে হয়েছে, শুভ তো কাছে রইলো। ওকে কিছুতেই কাছছাড়া করবেনা পৃথা। কিন্তু কিছুদিন পরে,ছোটটাও তার কাছ থেকে সরে, তাকে একেবারে একা করে দিল।

প্রথম যেদিন পৃথাকে কলকাতা ছেড়ে ব্যাঙ্গালোর আসার কথা জানায় শুভ, সেদিনের কথা স্পষ্ট মনে আছে তার। সেদিন রাগ-দুঃখ-হতাশা-গ্লানি -অভিমান সব যেন একসঙ্গে গ্ৰাস করে নিয়েছিল পৃথাকে।শুভর চোখে সেদিন কিন্তু অন্যরকম চমক!

—মা.., আমি ব্যাঙ্গালোরে একটি ভালো কোম্পানী জয়েন করছি। মাল্টিন্যাশনাল। ভালো অফার দিচ্ছে। আগামী সপ্তাহে রেরোতে হবে...

পৃথার বিশ্বাস হয় না সহসা। পাল্টা প্রশ্ন করে, ‘কি বলছিস কি তুই?তোকে এই কোম্পানিও তো ভালো মাইনে দিচ্ছে...। তাছাড়া কলকাতা ছেড়ে যাবি কেন তুই...?

—দিচ্ছে...তবে অতটা নয়। তাছাড়া এতে বাইরে যাবার চান্সও পাবো... এই তো কেরিয়ার তৈরীর সময়,কি বলো...?

—কিন্তু আমি যে এখান একেবারে একা হয়ে যাবো...?

কথাটা বলেই পৃথার কেমন অস্বস্তি হয়। নিজেকে বড়ো অপরাধী মনে হয় তার। নিজের কথাটাই সে ভাবছে? ছেলের দিকটা একবারও ভেবে দেখছে না? ছেলের উন্নতির কথা, ভবিষ্যতের কথা? গ্লানিতে ভরে যায় তার মন। সেই সঙ্গে ছেলের ওপর রাগ হয়, অভিমানও হয় । তোরা দুই ভাইও তো শুধু নিজেরটাই ভাবলি? একবারও সংসারে একা বিধবা মায়ের কথা তোদের মনে এলোনা? দুঃখে-হতাশায় পৃথার হৃদয় ভেঙে শত টুকরো হয়ে যায়।

সেই থেকে আজ প্রায় তিন বছর হলো,শুভ ব্যাঙ্গালোরে। মাঝেমাঝে কলকাতায় আসে দু-চারদিনের জন্য।ফোনও করে। তবে পৃথার চিন্তা হয় ছেলেটার জন্য। অনেক দিন শুভকে বলেছে,‘এবার একটা বিয়ে করে সংসার কর...। তুই অত দূরে থাকিস...বড়ো দুঃশ্চিন্তায় থাকি...একটা ভালো দেখে মেয়ে দেখি?তোর কেমন মেয়ে পছন্দ বল...? আচ্ছা তোর কাউকে পছন্দ হলে বল, আমি আপত্তি করবোনা...।

পৃথা আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল। শুভ মাকে থামিয়ে বলে ওঠে, ‘মা..কি হবে এইসব জঞ্জাল ঘাড়ে চাপিয়ে বলো তো?এই তো বেশ ভালো আছি,কেমন খাচ্ছি-দাচ্ছি,ঘুরে বেড়াচ্ছি...যেখানে যখন খুশী যাচ্ছি,বেশ নিজের মতো আছি...আমাকে কি কিছু খারাপ দেখছো...?

একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে পৃথার অন্তর থেকে।নাঃ, এই ছেলেকে সে কিছুতেই বুঝতে পারে না।কেমন বেপরোয়া-ছন্নছাড়া জীবন ওর। মাঝেমাঝে রাত দুটো-আড়াইটের সময় ফোন করবে।তাকে নাকি অত

রাত পর্যন্ত জাগতে হয়। আবার কখনও নাকি দিনের পর দিন শুধু কাজ আর কাজ।তার নাওয়া-খাওয়ার সময়ও থাকেনা।পৃথা জানেনা,এই ছেলে কবে থিতু হবে।

শুভ বলে, ‘তুমি চিন্তা করোনা তো মা..., আমি ভালো আছি। আমার জন্য টেনশন করে কেন নিজের শরীর খারাপ করছো..?

শুভ পৃথাকে জানায় যে, সে এবং তার এক কলিগ একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে। দুজনে মিলে-মিশে ঘরের কাজ করে নেয়।কাজ চালানো গোছের রান্না এখন সে শিখে নিয়েছে। ওপরের কাজ মানে, বাসন মাজা,কাপড় কাচা,ঘর পরিষ্কার করা ইত্যাদির জন্য একটা ঠিকে কাজের লোক আছে।পৃথা বুঝতে পারে,জোড়াতালি দিয়ে শুভর জীবনটা এক রকম কেটে যাচ্ছে।

বর্তমানে ফিরে আসে পৃথা। কিন্তু মেয়েটা কে? তবে কি এই সেই শুভর ফ্ল্যাটের কো-হোল্ডার,যার সঙ্গে সে ফ্ল্যাট শেয়ার করছে?যাক, কিছুক্ষণের মধ্যে জানা যাবে নিশ্চয়।

দরজাটা এখনও খোলা আছে। হঠাৎ পৃথা লক্ষ্য করে শুভর নামের নীচে লেখা আছে ‘ভাবনা পারেখ’। আর কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়।পৃথা বুঝতে পারে,এই মেয়েটিই ভাবনা পারেখ।শুভর কলিগ কাম ফ্ল্যাট শেয়ারার।হে ভগবান! পৃথা সারপ্রাইজড্। শুধু তাই নয় বলতে গেলে শকড্। সারপ্রাইজ তো উনি শুভকে দিতে এসেছিলেন,উল্টে তিনি নিজেই...

একটা মাল্টিন্যাশনাল অ্যাকাডেমিক স্কুলেরপ্রিন্সিপাল,পৃথা চক্রবর্তী সেদিন দেরী করে স্কুল পৌঁছেছিলেন।ডাকে আসা চিঠিগুলোর মধ্যে একটা বড়ো সাদা খাম উঁকি দিচ্ছিল। সেটাকেই আগে বেছে নেয় পৃথা।হেড অফিস থেকে আসা কর্তৃপক্ষের চিঠি। ওদের স্কুলের বিভিন্ন ব্রাঞ্চের প্রিন্সিপালদের নিয়ে একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হতেচলেছে ব্যাঙ্গালোরে।তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। দুদিনের সেমিনার।যাবতীয় খরচ কর্তৃপক্ষের।পৃথা হাতে স্বর্গ পেলেও এতটা খুশি হতো না বোধহয়।সে যাবে... অবশ্যই যাবে। অনেক দিন থেকে শুভকে একবার দেখে আসার কথা ভাবছিল সে। কিন্তু কিছুতেই হয়ে উঠছিল না।এবার যখন সুযোগ এসেছে,সে কিছুতেই তাকে হাতছাড়া করবেনা। সুতরাং নির্দিষ্ট দিনে ব্যাঙ্গালোর পৌঁছে, সেমিনার অ্যাটেন্ড করে,একটা দিন শুভর সঙ্গে কাটানো, এটাই তার প্ল্যান ছিল। কিন্তু সব যেন কেমন এলোমেলো হয়ে গেল।

চিন্তা-ভাবনার গতিকে আটকাতে হলো পৃথাকে।একটা ট্রে-তে দুকাপ চা আর প্লেটে কিছু বিস্কিট আর কেক নিয়ে ভাবনা ঘরে ঢুকলো।ভাঙা বাংলায় বললো, ‘সরি...একটু দেরী হয়ে গেল...

—ঠিক আছে, আমি চা খেয়ে বেড়িয়েছি...।

ভাবনা বুঝতে পারে না,তার ধারণা পৃথা সোজা কলকাতা থেকে আসছেন। সুতরাং পৃথাকে সবটা খুলে বলতে হয়,সে কেন এবং কবে থেকে ব্যাঙ্গালোরে।কিছুক্ষণ কথাবার্তা চলে ওদের।প্রথম পরিচয়ের আড়ষ্টতা কেটে গেছে ততক্ষণে।পৃথা জানতে পারে,ভাবনা বছর তিন হলো, প্রায় শুভর সঙ্গে এই কোম্পানীতে জয়েন করেছে।চাকরি পাওয়ার মাত্র এক বছর আগে সে,তার বাবা-মা,দুজনাকে একটা কার অ্যাক্সিডেন্টে একসঙ্গে হারিয়েছে। পিতৃ-মাতৃহীন ভাবনার দায়িত্ব সেই থেকে তার কাকার ওপর। ইঞ্জিনিয়ারিং-এ মাস্টার্স তার হয়ে গিয়েছিল এবং সে বিভিন্ন জায়গায় চাকরির ইন্টারভিউ দিয়ে, অবশেষে এই মনের মতো চাকরিটা পায়। কিন্তু ঠিক সেই সময়ে,ভারত সরকারের বিদেশ বিভাগে কর্মরত কাকার বদলী হয় মালেশিয়ায়।কাকা-কাকিমার ইচ্ছে, ভাবনা তাদের সঙ্গে মালয়েশিয়া চলুক। কিন্তু ভাবনা নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়।আর মনের মতো পাওয়া চাকরিটা ছাড়তে রাজি নয় সে।এই নিয়ে কাকা-কাকিমার প্রচন্ড অপ্রিয়ভাজন হতে হয়েছে তাকে। দারুন মানসিক দ্বন্দের মধ্যে এখানে জয়েন করেছে ভাবনা। সেই সময় যার কাছ থেকে একটু সহানুভূতি পেয়েছে সে,তার হাতটাই পরম বিশ্বাসে আঁকড়ে ধরেছে ভাবনা।আর সেই সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিল শুভ।ভালো-মন্দর যেটুকু জ্ঞান ভাবনার ছিল,তাই দিয়ে নির্দ্বিধায় শুভর হাত সম্বল করে নেয় সে।

ভাবনার সব কথা মন দিয়ে শোনে পৃথা।সে বোঝে,তার আর কিছু শোনার থাকতে পারে না। কিন্তু তার মনে অসীমিত প্রশ্নের বোঝা জমা হয়েছে।তার অভিজ্ঞ চোখ যা দেখেছে, সেটার সত্যতা যাচাই করতেই হবে তাকে।তাই একটা খাপছাড়া গোছের প্রশ্ন দিয়ে শুরু করলো সে।

—তার মানে...গত তিন বছর ধরে তুমি আছো শুভর সঙ্গে এই ফ্ল্যাটে..?

—হ্যাঁ, বললাম তো, আমরা এক সঙ্গে জয়েন করেছি,এক প্রজেক্টে আছি। তাছাড়া শুভর মতো আমার বন্ধু কেউ নেই এখানে।

একটু থেমে আবার বলে সে, ‘এতে আমাদের অনেক সুবিধে হয়... জানেন তো...

—ও...।একটা কথা তোমায় না জিজ্ঞেস করে পারছিনা, জানিনা তুমি কিভাবে নেবে প্রশ্নটা...

তারপর খানিক ভেবে মনে মনে নিজেকে তৈরী করে নেয় পৃথা। বলে,

—অবশ্য আমার ধারণা ভুল হতেও পারে। তুমি কি প্রেগন্যান্ট?

চমকে ওঠে ভাবনা।চকিতে পৃথার চোখে চোখ রেখে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেয় সে। এই প্রশ্নের জন্য সে একেবারে প্রস্তুত ছিলনা। কিছুক্ষণ লাগে তার স্বাভাবিক হতে। তারপর আস্তে আস্তে বলে,

—আপনি ঠিক ধরেছেন। এ আমাদের মানে আমার আর শুভর সন্তান।

আশ্চর্য! পৃথা সীমা-পরিসীমার সীমানা ছাড়িয়ে হতবাক্। তার মনে হলো, পৃথিবীটা যেন এক লাফে অনেকটা এগিয়ে গেছে। এমন একটা কথা কোনো মেয়ে যে এত সহজে বলতে পারে,এই পঞ্চান্ন বছরের জীবনে তার ধারণার মধ্যে ছিলনা। কিছু সময় লাগে তার ধাতস্ত হতে।সে প্রশ্ন করে,

—শুভ জানে এ কথা...?

—হ্যাঁ, জানে।

—তাহলে, তোমাদের বিয়েটা হয়ে গেলে ভালো হত না...?

—আমরা বিয়ে করছিনা কারণ, শুভর বিয়ে-সংসার এসবের ব্যাপারে পারে কোনো আগ্ৰহই নেই। সে এগুলোকে এক একটা ঝঞ্ঝাট বলে মনে করে।তার মতে, এগুলো মানুষের এগিয়ে যাওয়ার পথে চরম বাধার সৃষ্টি করে। জীবনে উন্নতি করতে সংসারে জড়িয়ে পড়ার মূর্খতা সে করতে চায়না।সত্যি বলতে কি...বাচ্চাটাকে নষ্ট করার কথা শুভ বলেছিল। কিন্তু আমি চাই, শুভর সন্তান আসুক এই পৃথিবীতে। একে আমি মানুষ করবো। আর একে কোনোদিন শুভর উন্নতির পথে বাধা হতে দেবোনা।

কথাগুলো একসঙ্গে বলে চুপ করে ভাবনা। পৃথাও নিরুত্তর। আসলে সে ভেবে পায়না, তার এখন কি বলা উচিত। একে অন্যের দিকে না তাকিয়ে দুই রূদ্ধবাক্ নারী বসে থাকে কিছুক্ষণ। একটু পরে ভাবনা সেই স্তব্ধতাকে ভেঙে বলতে শুরু করে,

—কিছুদিনের মধ্যেই শুভ বিদেশে চলে যাবে। কোম্পানীতে সেই রকম কথা হচ্ছে।এরপর হয়তো ওর সঙ্গে আমার আর কোনোদিন দেখা না হতেও পারে। তবু আমি চাই, শুভ আর আমার সন্তান আসুক পৃথিবীতে। আমাদের ভালোবাসার স্মৃতি জন্মগ্ৰহণ করুক। ওকে আমিই নাম দেবো। আমার নামেই ও বড়ো হোক এই সংসারে।

পৃথা,তার অন্তরে এক অদ্ভুত শুন্যতা অনুভব করে।তার নিজের, নিজের ছেলের,যুগের পরিবর্তনের, নিজের অক্তমতার, আধুনিক আদব-কায়দার ওপর প্রচণ্ড রাগ হয়। রাগ হয় এই অবুঝ মেয়েটার ওপর। কেমন বোকা মেয়ে তুই? গত তিন বছর যাবৎ মানুষটাকে চেনা সত্ত্বেও এই রকম একটা বোকামি কি করে করলি তুই? তাদের সময়ে, কুমারী মায়ের পক্ষে সন্তান মানুষ করা অতিরিক্ত কঠিন,বলতে গেলে দুঃসাধ্য কাজ ছিল।এখন যদিও দিন-কাল বদলেছে, তবুও...

এত কিছুর পরেও কিন্তু মেয়েটার দুঃসাহসের কাছে নতমস্তক হতে হয় পৃথাকে।এক গভীর আক্ষেপের স্বর বেরিয়ে আসে তার অন্তর্মন থেকে। ভাবনার হাত দুটো নিজের হাতে নিয়ে বলে, ‘জানিনা... জীবনে কখনও শুভর বৌ-বাচ্চার মুখ দেখতে পাবো কিনা। তবু তুমি যখন শুভর সন্তানকে আনতে চাইছো পৃথিবীতে...তখন আমি চাই, আমার দেওয়া নাম ধরে তাকে ডাকো...।

একটু থেমে আবার বলে, ‘আলো’,এই নামটা ধরে যদি তুমি ওকে ডাকো...আর,একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, নিজের গলার চেনটা খুলে ভাবনার হাতে দিয়ে বলে, এটা আমার হয়ে ওকে পরিয়ে দিও...

তারপর আর এক মুহূর্তও দেরি না করে,পৃথা পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় দরজার দিকে।সহসা কি মনে করে,ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে, ‘আমি এসেছিলাম,একথা শুভকে জানাবার দরকার নেই।’

ভাবনা নিরুত্তর। পৃথার চলে যাওয়া দেখতে থাকে।

1 comment:

  1. মন ছুঁয়ে যাওয়ার মত গল্পটা ...

    ReplyDelete