ধারাবাহিক - শ্যামাপ্রসাদ সরকার
Posted in ধারাবাহিকলেখকের কথা :
ভারতচন্দ্রকে নিয়ে লেখার ইচ্ছেটা আসলে অনেকদিনের। ভাবতে অবাক লাগে যে রতিরঙ্গ ধ্রুপদী ভারতীয় সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল প্রাক ইসলাম পর্বেও, মধ্যযুগে এসে তা যেন একটি বদ্ধ নীতিবাগীশ শাসনে শুধু মুখ লুকিয়েই থেকে গেল। বৈষ্ণবপদাবলীতে রাধা-কৃষ্ণের প্রেম মুক্তি পেলেও তা দেহাতীত নিকষিত হেম হয়ে সীমারেখা টেনে সামলে নিল। মানুষ মানুষীর মিলন মান্যতা পেল না। যৌনতার বিষয়ে মঙ্গলকাব্যেও সেই সাবধানী গা বাঁচানো রীতিটিই অকারণে বহাল রইলো।
অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে ভারতচন্দ্র যেন ‘প্রমিথিয়ূস’ হয়ে এসে সেই নিষিদ্ধ রতিমঞ্জরীটিকে রসিকজনের সামনে নতুন অলঙ্কারে সাজিয়ে আনলেন। বাংলাভাষা সমৃদ্ধ হল ফার্সী আর হিন্দীর শব্দপ্রয়োগে।এভাবেই নিশ্চুপ হয়ে ভারত কৃষ্ণনগরে বসে বসে ধীরে ধীরে প্রাক উনিশশতকের আধুনিক ভাষা প্রবাহের প্রথম ইঁটটি গাঁথলেন। একদিন সেই পথ দিয়েই স্বচ্ছসলিলা ভাষার গঙ্গাটিকে বয়ে আনবেন ভগীরথসদৃশ স্বয়ং বিদ্যাসাগর। তারও আগে রুশ নাট্যকার লেবেদফ মজেছেন ভারতচন্দ্রে। রুশ ভাষায় অনুবাদ করেছেন ‘বিদ্যা সুন্দর’। পরবর্তী কালে ভারতে মজবেন মাইকেল সহ একঝাঁক তরুণ প্রতিভা। তারা সমালোচনাও করবেন পূর্বজ কবিটিকে দেহবর্ণনার বাহুল্যে। তবুও অস্বীকার করে এড়িয়ে যেতে পারবেন না ভাগ্যবিড়ম্বিত এই কবিপ্রতিভাটিকে যাঁর লেখাকে তার প্রায় দেড়শো বছর পরে আর এক মহাজন রবীন্দ্রনাথ উচ্ছ্বসিত হয়ে বলবেন ‘এ যেন রাজকন্ঠের কন্ঠের মণিমালা’।
‘ভারতমঙ্গল’ আদতে একটি উপন্যাসই। ইতিহাস বর্ণনা নয়, বরং ইতিহাস যাপন। কল্পনা ও সত্যের মিশেলে সেই দিনগুলিতে একটু স্বপ্নিল পদচারণের প্রচেষ্টা মাত্র।
আপনাদের উৎসাহ ও প্রশ্রয়ে শুধু লিখতে বসে আমিও আবিষ্কার করেছি এক অন্য ভারতচন্দ্রকে। মাননীয়া গবেষিকা ও লেখিকা শ্রীমতী বিনীতা চ্যাটার্জীর আনুকূল্য না পেলে এই লেখার উপাদান সংগ্রহই হত না। এ ঋণ পরিশোধযোগ্য নয়।
ইতি-
শ্যামাপ্রসাদ সরকার
রচনাকাল ২০২০-২১
উৎসর্গ :‘সেই সময়’ উপন্যাসের প্রণেতা শ্রদ্ধেয় শ্রী সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মহাশয়’কে নিবেদিত।
পর্ব-১
পল্লীগ্রামের মাঘে মাসের শীতের তীব্রতা সর্বজনবিদিত। চাষের জমিগুলি ক্রমশ ভরে আসছে ফসলের উজ্জ্বলতায়। মনে হচ্ছে রবিশস্যের ফলন এ বছরটায় ভালোরই দিকে। নিজের মনেই একটা লাইন হঠাৎ গুনগুনিয়ে উঠলো এক সাতাশ বছরের যুবক,‘বাঘের বিক্রম সম মাঘের হিমানী’ ..অলঙ্কার শাস্ত্রটি সে ইতিমধ্যে ভালোই রপ্ত করেছে। সংস্কৃত, বাংলা, ব্রজবুলি, মৈথিলী আর ফার্সী শিক্ষায়ও তার কোনও ফাঁকি নেই। শুধু এবার জীবিকায় একটু স্থিতি হলে আপাতত সবটা রক্ষা হয়। ইতিমধ্যেই নিজের এই সদ্যযুবা বয়সে অনেক বিপ্রতীপ অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে সে গেছে। এমনকি তার কারাবাসের স্মৃতিটিও প্রায় সাম্প্রতিকই। এত দোলাচলেও সে তার ভিতরের সরসতার কোন হানি হতে দেয়নি। বংশকৌলীন্য তারও নেহাত কম নয়, কিন্তু আজকের এই নিঃসম্বল অর্থহীনের সে অহঙ্কার আর সাজে না। যদিও সে নিজে এই সামন্ততান্ত্রিক নকল রাজাপ্রজা সেজে ঘুরে বেড়ানো ব্যাপারটায় খুব একটা আগ্রহী নয়। বরং সাধারণ্যের ভীড়টিই তাকে বেশী টানে। বাংলার আকাশে বাতাসে এখন রাজনৈতিক অস্থিরতা শুধু। তারই মধ্যে শাস্ত্রচর্চা আর মনোজ্ঞ কাব্যরচনা করে আত্মপ্রকাশের একটি সুপ্ত বাসনা তার। রাত্রির কালো তারা ভরা আকাশের তলায় দাঁড়িয়ে থাকল সে কিছুক্ষণ। মনটা আজ একদম বশে নেই। মনে হচ্ছে জীবনের দিনগুলি কেবল অপচয়ই হয়ে যাচ্ছে। রাত্রি ক্রমে গভীরতর হচ্ছে। দীনের কুটিরটি স্বাভাবিক কারণেই এখন নিষ্প্রদীপ। রাধা নামের তার বালিকা বধূটি আপাতত নিদ্রিতা। শয্যা ত্যাগ করে নির্ঘুম চোখে এই অনন্ত কালরাত্রির অবসানের প্রতীক্ষায় সে গভীর চিন্তায় মগ্ন। এখনো পর্যন্ত এক কাব্যমনস্ক, রসজ্ঞ, রুচিবান, স্বভাববৈরাগী এক ব্রাহ্মণ সন্তান, এই তার একমাত্র পরিচয়। পিতৃদত্ত নামটি তার ‘ভারতচন্দ্র’।
এই বার একটু তখনকার ভারতের ইতিহাসের দিকে চোখ রাখি। সময়কালটি বড়ই অস্থির। সুজা খাঁর পুত্র সরফরাজ খাঁকে গিরিয়ার যুদ্ধে পরাজিত করে ‘মহাবৎ জঙ্গ’ নাম নিয়ে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার মসনদে নবাব আলীবর্দি খাঁ। দিল্লীর মুঘল অন্দরেও তখন ‘তখত এ তাউসে’র দিকে রয়েছে শ্যেন পক্ষীদের ইতিউতি লোভী নজর। বন্দীদশায় বৃদ্ধ শাজাহান আগ্রাদূর্গে দিন গুনছেন মৃত্যুর, প্রিয়তম পুত্র দারাও নিহত, যুদ্ধে পরাজিত সুজা আরাকানে নির্বাসিত। ঔরঙ্গজেবের পথের শেষ কাঁটাটি হল এখন মুরাদ। কটকের কাছে আলীবর্দির সাথে এই মুরাদের এক ভীষণ লড়াই হল ও মুরাদ যুদ্ধে হেরে দিল্লীর দিকে পিছু হঠলেন। পথের মধ্যেই ঔরঙ্গজেবের চরেদের হাতে ধৃত হলেন ও বন্দী অবস্থায় এলেন গোয়ালিয়রে। কদিন বাদে সেই দূর্গের বন্দীশালায় অকথ্য অত্যাচারের পর তাকেও জাহান্নামের রাস্তাটি সোজা দেখিয়ে দিলেন তার ভ্রাতা বাদশা আলমগীর।
এদিকে বাংলায় ততদিনে শুরু হয়ে গেছে মারাঠা দস্যু রঘুজী ভোঁসলে আর তার অনুগত সেনাপতি ভাস্করপন্থের দ্বারা সংঘটিত বর্গীর হামলা। পল্লীবাংলা তখন জ্বলছে এক নতুন মাৎসান্যায়ের আগুনে। আলীবর্দি এই ভাস্করপন্থকে কৌশলে হত্যা করলেও রঘুজী তাঁর কাছ থেকে কটক সহ উড়িষ্যা দখল করে নেন। বার লক্ষ তঙ্কা নজরানার বিনিময়ে সেই জায়গীর উদ্ধারে তিনি সম্মত হন নদীয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের ভরসায়। কিন্তু তহশীলদার সুজন সিং-এর বিশ্বাসঘাতকতায় নবাব শেষ পর্যন্ত কারারুদ্ধ হন। ঠিক সেই সময় কৃষ্ণনগরাধীশ কৃষ্ণচন্দ্রের কূটকৌশলে কোতোয়ালের দপ্তরে সামান্য উৎকোচের বিনিময়ে তিনি নবাবকে মুক্ত করেন ও মুর্শিদাবাদে অক্ষতদেহে ফেরৎ পাঠান। আলীবর্দি তাঁকে সেই কৃতজ্ঞতাবশত ‘ধর্মচন্দ্র’ উপাধিতে বরণ করেন ও সেবারের মতো নদীয়ার রাজস্বটি মাপ করে দেন। এভাবেই কালের ইতিহাস তার আগম নির্গমের দাবার ছক সাজায় নিজের নিয়মে। সেই বারুদের দিনগুলির উত্তাপের মধ্যেই জন্ম নিল এই আশ্চর্য কবিপ্রতিভাটি।
‘ডিহি কলিকাতা’ এক আজব জায়গা বটে। রাস্তার দুধারে পূরীষবাহী কাঁচা নর্দমা। এখানকার আবহাওয়া মোটেও সুবিধার নয়। গ্রীষ্মকালে ভয়ঙ্কর গরম আর বর্ষাকালে ভীষণ কাদা হয়। এছাড়া সঙ্গে মশা-মাছিরও ভয়ঙ্কর উৎপাত। এরই মধ্যে শহরটা আস্তে আস্তে বদলাচ্ছে তার পূর্বতন চেহারাটা। ২৫ নম্বর ‘ডুমটোল্লা স্ট্রীটে’র একটি অংশে এক বিচিত্রবেশী সাহেবের তাঁবু পড়েছে। সাহেবটি ইংরেজ নন, রুশী। এই হেরাসিম লেবেদফ লোকটি বেশ আমুদে। সে এক এখানে এক অদ্ভূত জিনিসের আমদানী করেছে। একধরণের যাত্রাপালার মত একটা সঙের আসর বসায় সে ফি রোববারে। নাচ -গান, পান -ভোজন সহ এই বিলিতি সঙের আসরটিতে আজকাল সাহেব সুবোদের ভালই ভীড় হচ্ছে। অপেরাটির শুরুতে সাহেব নিজে বিলিতি অর্গ্যান বাজিয়ে দুলে দুলে নেচে খানিক অঙ্গভঙ্গি করে আমোদ দেয়। তারপর দলেরই কয়েকজন ক্লাউন সেজে কিছুক্ষণ মাতিয়ে রাখে। শেষে হয় আসল নাটকটি। ইংরেজদের সাথে সাথে দু একজন ইংরেজীজানা এদেশের ভদ্রলোকও আজকাল অবাক হয়ে এই বিলিতি ভাঁড়ামোটি উপভোগ করতে আসেন। লেবেদফ তাঁর আসরে নেটিভরা আসলে খুশীই হন। এদের সহজ সরল স্বভাবটি নিজে বেশ উপভোগ করেন। তিনি দেখেছেন নেটিভরা সমাজে নিজেদের মধ্যে ছোঁয়াছুঁয়ি নিয়ে বড্ড বাছবিচার করে। আবার তারাই যে কোন সাহেব দেখলে
স্রেফ সাদা চামড়ার দরুণই একটু ভয় মিশ্রিত সমীহ করে দূরে পালায়। আসর চলাকালীন ভিখু নামের এক বোবাকালা কিন্তু দৈত্যাকৃতির বিহারদেশীয় পাহারাদার পিতল বাঁধানো লাঠিহাতে পাহারা দেয়।
কলকাতায় ইংরেজদের সুবিশাল কেল্লাটির কাছেই গঙ্গাতীরটি কিন্তু বেশ মনোরম। তিনি মাঝে মধ্যেই এখানে বেড়াতে আসেন। নদীটিকে দেখলে তাঁর ভোল্গার কথা মনে পড়ে যায়। মনে পড়ে তাঁর স্বদেশকে। হিন্দুরা এই নদীটিকে খুব পবিত্র চোখে দেখে। লেবেদফ তার মধ্যেই দেখতে পান সেই পবিত্র নদীর জলেই কখনো কখনো অর্ধদাহ্য মানুষের মৃতদেহ ভেসে যাচ্ছে আর সেই মৃতদেহের ওপর কি বিচিত্ররূপী একপ্রকার স্টর্ক জাতীয় পাখি সেটা থেকে নরমাংস খুঁটে খুঁটে খেতে খেতে নৌবিহারের মত ভেসে চলছে একপাড় থেকে অন্যপাড়ে। নেটিভরা এই পাখিগুলোকে বলে ‘হাড়গিলে’ পাখি।
তাঁবুতে ফিরেই গড়গড়া টানতে টানতে বিছানায় আদুরীকে কাছে টানলেন লেবেদফ। দশ সিক্কা দিয়ে জিঞ্জিরাবাজার থেকে তাকে কিনে এনেছেন বেশ কিছুদিন হল। এদেশে ফিরিঙ্গী মেয়ে দূর্লভ।তাই অনেক ইউরোপীয়ই পরিবর্ত হিসাবে দেশী বিবি রাখাটাই সহজ বলে তাতেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। এই মেয়েটি সম্ভবত বোধহয় নীচুজাতির। কিন্তু তার দেহবল্লরীটি যথেষ্টই উত্তেজক। এখানকার মেয়েরা গায়ে জামা রাখেনা। শাড়িটিকেই তারা গায়ে পেঁচিয়ে লজ্জ্বা নিবারণ করে। আদুরীও তার ব্যতিক্রম নয়। মেয়েটির বয়েস কম তায় গড়নটিও বাড়ন্ত। গায়ের রঙটি কালো হলেও তার মুখশ্রীতে একটা অদ্ভূত মাদকতা আছে। চেহারাটি দোহারা ও কমনীয়। এইবয়সেই তার স্তনযুগল বেশ বর্তুলকার ও ভারী। এমনকি কোমরের নীচের অংশের গড়নটিও বেশ চটকদার। তাদের বিপরীত বিহারে রতিরঙ্গের সময় হঠাৎ দেখলে শ্বেতপাথরের মহাদেবের উপর উপবিষ্টা উলঙ্গিনী কালীর উপমাই মনে আসে। অর্থোপার্জনের তাগিদে স্বদেশ থেকে এত দূর বিদেশে এসে প্রবৃত্তি নির্বাপণের স্বার্থে এই স্বাদু রমণীটির আসঙ্গ সাহেবের বড় পছন্দ। আর আদুরীও তার সাহেবের সাথে নিত্যদিনের রসরঙ্গটিকে বেশ লাস্যের সাথেই উপভোগ করে বলে মনে হয়।
বিকেলের দিকে তাঁবুতে গোলকনাথ এল। বেঁটে খাটো চেহারার গম্ভীর মেজাজের এক মানুষ সে। লেবেদফ এঁর কাছেই আজকাল বাংলা, ফার্সী আর সংস্কৃত শিক্ষা করছেন। কদিন আগেই ম্যঁলিয়েরের একটি নাটক ‘লাভ ইজ দ্য বেস্ট ডক্টর’ অভিনয় করিয়েছিলেন কিন্তু সেটা মোটেও জমেনি। লেবেদফের দলে এখন সাকূল্যে আটজন অভিনেতার সবাই ফিরিঙ্গী। ইসাবেলা নামের এক এলিট সোসাইটি-নচ গার্ল যে আদতে কোম্পানির হোমরাচোমরা সাহেবদের বিনোদনকারিনীই মূলত, তাকেই প্রয়োজন পড়লে ভাড়া করে নামাতে হয় কোনও গুরুত্বপূর্ণ নারীচরিত্র থাকলে। কদিন আগে পোর্শিয়া চরিত্রে অভিনয়ের সময় সে মাঝপথে সংলাপ ভুলে গিয়ে একটা বিশ্রী ব্যাপার ঘটিয়েছিল। ইসাবেলা খুবই উদ্ধত স্বভাবের। রূপের চটকের সাথে সাথে সে গান আর অভিনয় জানে বলে ধরাকে সরা জ্ঞান করে। আসলে নিয়মিত মহলায় না আসলে অভিনয় ঠিক করে নাটকটা সার্থকভাবে মঞ্চস্থ করা মুশকিল। অথচ বিলিতি নাটকে মেমসাহেবের পার্ট থাকলে তাকেই তোয়াজ করে চলতে হয়। লেবেদফ বোঝেন যে উপযুক্ত দেশীয় কাহিনীর অভাবেই স্থানীয় আমজনতার এই স্টেজের প্রতি আকর্ষণ জাগানো যাচ্ছে না। অথচ ঢপ, খেউড়, যাত্রা এমনকি কবিগানের আসরেও ভালই লোকে ভীড় করে। লেবেদফ ভাবলেন গোলকনাথকে জিজ্ঞাসা করে দেখবেন, যদি কোনও ভাল দিশি মেটেরিয়ালের কথা সে যদি বলতে পারে। একথার দুদিন বাদেই তার তাপ্পিমারা ঝোলার ভেতর থেকে গোলক একটি বই করে দেখায়। বলে ‘এইটে একবার চেখে দেকতে পারেন সায়েব! বড় সরেস বইখানা। শ্রীরামপুরের সায়েবরাও আজকাল এসব বই ছাপচে! ‘কিছুটা বিস্ময় নিয়ে ভ্রূকুঞ্চিত লেবেদফ বইখানার দিকে হাত বাড়ান।
"OONOODAH MONGUL
Exhibition the tales of
BIDDAH AND SOONDER.
To which Added
The Memoirs of Raja Prutupa Ditya
Embelled with six cuts.Calcutta :From the Press of Ferris, 1816"
গোকুলকে সেদিনের মত জলদি বিদায় করে লেবেদফ বইটি সাথে করেই বিছানায় গিয়ে গা এলিয়ে দেন। আজ সারাদিন ধরেই খুব বৃষ্টি। একটা শিরশিরে ঝোড়ো হাওয়ায় কেমন যেন শীত শীত করছে। আদুরী তড়িঘড়ি এসে তাঁবুর ভিতরে সেজবাতিগুলো জ্বালিয়ে দিয়ে গেল। সে এখন খাবার বানাতে বসবে। এইসময় সাহেবের কাছে সেও কিছুক্ষণ ভিড়বে না। পড়াশোনা করার সময় তার সাহেব একেবারে অন্য মানুষ হয়ে যায়। ওদিকে গড়গড়া টানতে টানতে বইটিতে ক্রমশ ডুব দেন লেবেদফ।
আহা! কি অদ্ভূত কাহিনীর বিস্তার আর নাটকীয় মোচড়।
"Having heard an account of Beedyaa from the mouth of Bhaat/The inclinations of Soondor boiled vehemently..."
ভাটমুখে শুনিয়া বিদ্যার সমাচার।
উথলিল সুন্দরের সুখ-পারাবার।।
এই নতুন কাব্যটির কবিটির নাম ‘ভারতচন্দ্র!’ ক্যালকাটায় এরকম একটি অসাধারণ লিরিক্যাল ব্যালাডধর্মী সাহিত্য অবহেলায় পড়ে আছে তা লেবেদফ বিশ্বাস করতেই পারেন না। স্থির করেন আগামী দু’তিন সপ্তাহের মধ্যে বিদ্যা-সুন্দর ই হবে তাঁর পরের নাটক। নায়িকার ভূমিকায় এবার আর কোনও ফিরিঙ্গি নীলনয়না নয়। ‘বিদ্যা’ সাজবে তাঁর প্রিয়তমা আদুরী-ই।
শেষরাত্রিতে ভারত একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল। দিনু বৈরাগীর বৈতালিকের খঞ্জনীর টুংটুং শব্দে ঘুম ভাঙতেই সে বিছানা ছেড়ে উঠোনে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। শীতের কুয়াশার চাদরে এখন সবদিক আচ্ছন্ন হয়ে আছে। এত ভোরেও বদনচাঁদ খেজুরের রস ভরা হাঁড়ি গাছ থেকে নামিয়ে ঠিক বাঁকে করে বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে। ভারতকে সামনে দেখতে পেয়ে বলল,‘একপো রস দেই দা ঠাউর! জিরেন কাঠি ডুবকি তোলা! খুব মিঠে’। ভারত ইষ্টনাম জপ করার আগে কোনও কিছুই জিহ্বাগ্রে স্পর্শ করেনা। তবুও এই কূয়াশাচ্ছন্ন ঊষাকালে সুমিষ্ট ‘রস’ শব্দটি মনের মধ্যে অনুরণিত হতে লাগল। হাত নেড়ে না’বাচক ইঙ্গিত করে সে মুগ্ধদৃষ্টিতে মৌন হয়েই নবীন ভোরটির কলুষমুক্ত স্নিগ্ধ রূপ অন্তর দিয়ে উপভোগ করতে থাকলো।
রামচন্দ্র মুনশীর কাছে ফার্সী শেখা এখন ভারতের শেষের পথে। দেবানন্দপুরের এই শান্ত পল্লীগ্রামের পরিবেশটি তার বেশ ভালই লাগে। গ্রামটিকে ঘিরে আছে একটি বিশাল দিঘি, নাম কুঞ্জসায়র, দিব্যি গাছগাছালি ঘেরা তার চারপাশ আর কাকচক্ষু নির্মল টলটলে জল। দিঘিটি বঙ্গাধীপ লক্ষ্মণসেনের আমলের। এর দুপাশে সেই আমলের পোড়ামাটির দ্বাদশ শিবমন্দিরটি এখনো অক্ষত। জ্যৈষ্ঠমাসে এইখানে ধর্মরায়ের গাজনের মেলা বসে। এছাড়া আছে আদিগন্ত বিস্তৃত প্রচুর সুফলা ধানীজমি আর তার ভিতর দিয়ে এঁকে বেঁকে বয়ে যাওয়া মেটে রঙা আলপথ। ভারত তার সদ্যোন্মীলিত কাব্যপ্রতিভার সহজিয়া দৃষ্টি মেলে এই শ্যামবঙ্গপ্রকৃতির রূপসুধা পান করতে বড় ভালবাসে।
মুসলমান শাসকদের অসহিষ্ণুতাহেতু এখন সংস্কৃত টোলগুলিতে আগের মত ছাত্র হয়না বরং অনেক হিন্দু শিক্ষিত মানুষ মোক্তব খুলেছে। অর্থোপার্জনের জন্য আরবী আর ফার্সী জানাটাই এখন দস্তুর। আজকাল দেওয়ানী বা কাছারিতে একজন সামান্য গোমস্তাকেও এই দুটি ভাষায় দখল রাখতে হয়। ভারতের খুব শীঘ্রই একটি সেরেস্তার কাজ জোগাড় করা আশু প্রয়োজন। যদিও বংশগৌরবের নিরিখে তার রাজা হওয়ারই কথা। ভারতের পূর্বপুরুষ ভরদ্বাজ গোত্রীয় ফুলিয়ার বিখ্যাত নৃসিংহ মুখুটির বংশাবতংশ সদানন্দ রায়। সেই সুপ্রতিষ্ঠিত ভূরসুট রাজবংশের রক্তই তার ধমনীতে বিদ্যমান। বিস্ময়ের ব্যাপার বাঙালীর ইতিহাসে এই বংশেরই শাখায় আরও দু’টি মানুষের নাম একই সাথে বিখ্যাত ও কূখ্যাতির জন্য স্মরণীয়। বিখ্যাতজনটি হলেন ফুলিয়া নিবাসী শ্রীরাম পাঁচালির কবি কৃত্তিবাস ও অন্যজন হিন্দুমন্দির ধ্বংসকারী রাজীবলোচন, যিনি অবশ্য কালাপাহাড় নামেই বেশী পরিচিত।
ভারতের পিতা নরেন্দ্রনারায়ণ বর্ধমানরাজ কীর্তিচন্দ্রের থেকে একশো বিঘা জমি ইজারা নিয়েছিলেন একসময়। দেওয়ান রাজবল্লভের পরামর্শে সেই জমি হঠাৎই খাসভুক্ত করা হয় তাঁকে না জানিয়েই। এ নিয়ে বিবাদ উপস্থিত হলে তিনিও করদানে অসম্মত হন। কীর্তিচন্দ্র একই সাথে সপুত্রক নরেন্দ্রনারায়ণকে রাজ্যচূত ও কারারুদ্ধ করেন। সেই থেকে ভারতের কপাল থেকে রাজতিলকটি চিরঅন্তর্হিত হয়েছে। কারাবাসের দিনগুলি ভারতের কাছে দুঃস্বপ্নভরা রাত্রি যেন।
কদিন হল একটি নতুন ছন্দে একটি সত্যপীরের পাঁচালি লেখা সে আরম্ভ করেছে। ছন্দটির নাম চৌপদী। সত্যপীর দেবতাটি আসলে হিন্দুর সত্যনারায়ণ আর মুসলমানের পীরের বর্ণসঙ্কর আরাধ্য দেবতা। একালে দুইধর্মের মানুষই এই দেবতাটিকে পুজো করে থাকে। সেই সত্যপীরকেই উপজীব্য করে কয়েক ছত্র পাঁচালী রচিত হয়েছে তার কলমে। সূচনার ভণিতাটি পড়তে বেশ সুললিত শোনাচ্ছে নিজের কানেই,
"ভরদ্বাজ অবতংস/ভূপতি রায়ের বংশ/
সদাভাবে হতকংস/ভূরসুটে বসতি/নরেন্দ্র রায়ের সুত/ভারত ভারতী যুত/ফুলের মুখটি খ্যাত/দ্বিজপদে সুমতি...."
রাধার বয়স সবে ষোলো। এগারো বছর বয়সেই ভারতচন্দ্রকে সে স্বামী হিসাবে পেয়েছে। কিন্তু তার বিয়ের প্রথম ক’টি বছর বেশ কেটেছে দূর্যোগপূর্ণ। বর্ধমান রাজের চক্রান্তের জেরে ভারতের কারাবাস তার পতিসুখ উন্মেষের বাধার কারণ হয়েছিল। কারাগার থেকে কৌশলে মুক্ত হয়ে ভারত অনেকমাস যাবৎ আত্মগোপন করে শঙ্করাচার্যের শৃঙ্গেরী মঠে কিছুদিন ভ্রামণিক হয়েই কাটিয়েছে। সেখানে আচার্য সর্বানন্দ পুরীর কাছে নিয়মিত সংস্কৃত শিক্ষায় তার পূর্বতন বিদ্যায় পড়েছে পরিশীলিত প্রয়োগের ছাপ। মুদ্রারাক্ষস, রঘুবংশম্,
অমরুশতক,গাথাসপ্তসতী প্রভৃতি প্রাচীন সংস্কৃত কাব্য ও নাটকের মূলপাঠ্যগুলোর সাথে পরিচিত হবার ফলে তার ভাষাবৈদগ্ধ ও শব্দঝংকার ভারতকে বাগবৈখুরী ও অলংকার শাস্ত্র ব্যবহারে পটু করে তুলেছে। আবার মুনশীর কাছে এই ক’মাসেই যবনাভাষা দুটিও তার ভালই আয়ত্ত হয়েছে বলা যায়।
রাধাও এদিকে ধীরে ধীরে যুবতী হয়ে উঠছে। বালিকার খোলস বদলে ক্রমশ এক অচেনা নারীতে যেন নিত্যই সে প্রকাশিত হচ্ছে। ভারত তাকে আড়াল থেকে লক্ষ্য করে। হাত উপরে তুলে কাঠের কাঁকই দিয়ে তার চুল আঁচড়ানোর সময় তার কুমারসম্ভবের লাইনগুলো মনে পড়ে যায়। শৃঙ্গার রসটিকে বঙ্গদেশে এখনো ব্রাত্য করে রেখেছে পন্ডিতজনেরা। অথচ এই শ্যামলিমা বিধুর বঙ্গললনাটির মধ্যে মধুররসের পূর্ণ প্রকাশ সে দেখতে পায় সততই। বৈষ্ণবপদাবলীর দেহাতীত প্রেমটি মানতে তার মন চায়না। ভারতের মতে প্রেমের আধার হল দেহই। তাকে অস্বীকার করলে পূর্বরাগের দর্শন, শ্রবণ আর স্পর্শনের শিহরণটিই চলে যায়। যদিও দেবদেবীর বাইরে এই প্রেম জিনিসটিকে মেনে নেবার মত সমাজ আজও পরিণতমনস্ক নয়। খুব গোপনে এমনকি অমর্যাদার সাথেই দেহবিনিময় করেই সবাই বাইরের শুদ্ধাচারণরীতিটিকেই প্রশ্রয় দেয়। এই বিকট দ্বিচারিতাটি ভারত মনে মনে মানতে নারাজ। অথচ একসময় এই দেশেই প্রাচীনকালে মদনোৎসব পালিত হত। সেখানে রতিশাস্ত্র ও রতিকান্ত দুজনেই অগ্রাধিকার পেত সসম্মানে।
ভারতের খুব ইচ্ছা করে তার মাতৃভাষা বাংলাতে একটি মধুর রসের আখ্যান রচনা করার। সাধারণ নরনারীই হবে তার আধার, দেবকল্প নয়। জাগতিক দোষত্রুটি মুক্ত আদর্শ মানুষের নীতিগাথার পরিবর্তে প্রেম আর তার সঙ্গে দ্বেষ, লালসা আর বিরহই হবে সেই কাব্যটির উপজীব্য।
কিন্তু তার আগে চাই একটি স্থির জীবিকার সংস্থান। ‘অন্নচিন্তা চমৎকারা’ মাথায় নিয়ে কাব্য রচনা করা বড় কঠিন। সে জানে রাধা’র পরিধেয় শাড়িগুলি বহু ব্যবহারে এখন জীর্ণ। অনেক জায়গায় রাধা গ্রন্থি দিয়ে বেঁধে সেই ছিদ্রগুলি হাসিমুখে আড়াল করে। ভারত নিজের স্ত্রীকে এটুকু স্বচ্ছলতা এতদিনেও দিতে অপারগ সেই অক্ষমতাটিকে একটা চাপা অসন্তোষের মতো সর্বদা বুকে চেপে ঘোরে বা নির্জনে কুঞ্জসায়রের পাশে এসে বসে থাকে। কখনো সেই নিভৃতি ভঙ্গ করে একটি গোসাপ সড়সড় আওয়াজ করে শুকনো পাতার স্তুপ মাড়িয়ে আবার কোনো ঝোপের ভিতর লুকিয়ে যায়।
0 comments: