প্রচ্ছদ নিবন্ধ - শ্রীশুভ্র
Posted in প্রচ্ছদ নিবন্ধরাস্তা ঝাঁট দিয়ে অর্থ উপার্জন বরং অনেক সহজ। কিন্তু লেখালেখি করে অর্থ উপার্জন আদৌ সহজ নয়। পেশা হিসাবে রাস্তা ঝাঁট দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে ও সংসারধর্ম পালন করে বহু মানুষ বেঁচে আছে। কিন্তু পেশা হিসাবে লেখালেখি করে জীবিকা নির্বাহ করে সংসারধর্ম পালন করতে খুব কম মানুষকেই দেখা যায়। তাও জীবনের অনেক বছরের সংগ্রামের পর, জনপ্রিয়তার নিরীখে কোন কোন লেখক সাহিত্যিকের পক্ষেই পেশা হিসাবে লেখালেখিকে আঁকড়ে ধরা সম্ভব হয়। তাদের সংখ্যা গুটি কয়েক। কিন্তু বাকি যাঁরা আজীবন লেখালেখির সাধনায় ব্যস্ত পেশা হিসাবে তাঁদেরকে অন্য কোন না কোন কাজকেই বেছে নিতে হয়। আর নয়তো স্বামী বা স্ত্রীর আয়ের উপর নির্ভর করে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয় লেখালেখির একান্ত সাধনাকে। না রাস্তা ঝাঁট দেওয়ার পেশার প্রতি কোনরকম কটাক্ষ করা আমাদের উদ্দেশ্য নয় আদৌ। বা পেশা হিসাবে ঝাড়ুদারীর সাথে লেখালেখির কোন তুলনা টানাও নয়। বলার কথা শুধু এইটুকুই যে একজন ঝাড়ুদারের পক্ষেও সংসার চালানো সম্ভব হয়। কিন্তু একজন লেখককের পক্ষে সেই একই কাজ দুঃসাধ্য। কিন্তু কেন? প্রশ্নটি সেখানেই।
বিনা পয়সায় কেউই রাস্তা ঝাঁট দেয় না রোজ। সখের স্টান্টবাজি দেওয়া রাজনীতিবিদদের পরিস্কার রাস্তায় একসাথে একধিক নতুন ঝাঁটাসহ টিভি ক্যামেরার ফুটেজ খাওয়ার নির্ধারিত দিন ছাড়া। কিন্তু বিনে পয়সায় লেখা প্রকাশের জন্যে কোন লেখকেরই উদ্যোমের কোন অভাব দেখা যায় না কখনো। একজন ঝাড়ুদার বিনা পয়সায় যে কাজ করেন না, একজন লেখক কেন সেই কাজ পয়সা ছাড়াও অম্লানবদনে করতে এগিয়ে যান? প্রশ্ন এখানেও। তবে কি রাস্তা ঝাঁট দেওয়ার কাজটিকে অর্থমূল্য বিচার করার যে আত্মসম্মান একজন ঝাড়ুদারের থাকে, একজন লেখকের তাঁর লেখাটিকে অর্থমূল্য বিচার করার মতো সেই ন্যূনতম আত্মসম্মানটুকুও কি থাকে না? থাকলে তিনি বিনে পয়সায় তাঁর লেখাকে প্রকাশকের হাতে তুলেই বা দেন কি করে? এর সহজ একটি উত্তর এই মনে হয়, পাব্লিকের রাস্তা ঝাঁট দিয়ে কারুর মনে ব্যক্তিগত আনন্দ হয় না। তাই বিনা পয়াসায় সেই কাজ করতেও কেউ এগিয়ে আসে না। ভোটের ঠেকায় স্টানটবাজির দলীয় উদ্যোগ ছাড়া। কিন্তু পাব্লিকের কাছে বিনা পয়সায় হলেও নিজের লেখাটি পৌঁছিয়ে দিতে পারলেই একজন লেখকের ব্যক্তিগত আনন্দের সীমা পরিসীমা থাকে না বল্লেই হয়। না এইটুকুই সব নয়। আরও একটি বড়ো কারণ রয়েছে। একজন ঝাড়ুদার জানেন, প্রয়োজনে পাব্লিকই নিজেদের গরজে অর্থের বিনিময়ে তাকে দিয়ে রাস্তা পরিস্কার করিয়ে নেবে। নয়তো একদিন রাস্তা দিয়ে চলাচলই দুস্কর হয়ে উঠবে। ঠিক তেমনই একজন লেখকও জানেন তাঁর লেখা পড়ার গরজে পাব্লিক কোনদিনও তাঁর কাছে ছুটে আসবে না, অর্থ মূল্যে লেখা কেনা তো দুরস্থান।
এই যে পড়ার প্রতি অনাগ্রহ, না পড়লেও জীবনের কোথাও কোন অসুবিধা ঘটার কোন কারণই ঘটে না, ঘটবে না কখনোই; এই বোধ ও বিশ্বাস থেকেই লেখকের কাছ থেকে অর্থমূল্যে লেখা কিনে পড়ার মতো পাঠক থাকে না। এই সত্যটুকু সবচেয়ে ভালো জানেন একজন প্রকাশক। তাই স্কুল কলেজ বিশ্বাবিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তক প্রকাশের বিষয়ে তিনি যত আগ্রহী হবেন, একজন লেখকের গল্প কবিতা প্রবন্ধ প্রকাশের বিষয়ে তাঁর যে কোন ব্যবসায়িক আগ্রহ থাকবে না সেতো বলাই বাহুল্য। ডিগ্রী লাভের জন্যে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বই কেনার আগ্রহ থাকুক বা নাই থাকুক, প্রয়োজনটুকু এতটাই সর্বাত্মক যে না কিনে উপায় নাই। তা সে যতই অগ্নিমূল্য হোক না কেন। খেয়ে পড়ে ভালোভাবে বেঁচে থাকতে গেলে য়ে কোন একটি ভালো ডিগ্রী এতই মহার্ঘ্য। কিন্তু একটি ভালো গল্প বা উপন্যাস কিংবা প্রবন্ধ বা গবেষণা গ্রন্থ রোজকার বেঁচে থাকার জন্যে আদৌ জরুরী নয়। কিন্তু একটি পরিস্কার রাস্তা অনেক বেশি জরুরী। তাই সমাজের কাছে একজন লেখকের থেকেও একজন ঝাড়ুদারের প্রয়োজনীয়তা এত বেশি।
আবারও বলি, ঝাড়ুদারের সাথে লেখকের কোন লড়াই বা প্রতিতুলনা এই লেখার বিষয়বস্তু নয়। আমাদের সমাজে একজন লেখকের অপ্রাসঙ্গিকতা কতখানি সেইটুকু অনুসন্ধান করাই বর্তমান লেখার মূল উদ্দেশ্য। অনেকেই হইহই করে উঠবেন হয়তো। তা কেন? তাহলে এত পত্র পত্রিকা এত বইপত্র, এত বইমেলা এসব কিসের জন্যে? খুবই সত্য। কিন্তু এসবই বই প্রকাশের সাথে যুক্ত প্রকাশক সম্প্রদায়ের জন্যে। এইগুলি না থাকলে তাদের ব্যবসায় গণেশ উল্টানো অবধারিত। অনেকেই প্রতিবাদ করবেন এই বলে যে তাঁরা যথেষ্টই বইপত্র কেনাকাটি করেন। পাঠ্যপুস্তকের বাইরেও। তাহলে সমাজে লেখকের অপ্রাসঙ্গিকতার প্রশ্ন ওঠে কি করে? ওঠে, কারণ এই যে এত লেখা, এত লেখক, তার মধ্যে কয়জন শুধু তাঁর লেখাকেই পেশা হিসাবে আঁকড়ে ধরে বহাল তবিয়তে আছেন? আমরা সবাই জানি, সেই মাত্র কয়েকজনের সংখ্যাটাই কি মারাত্মক ভাবে কম। আমরা এটাও জানি, অধিকাংশ লেখকই অন্য কোন না কোন পেশার সাথে যুক্ত থেকেই কেবল মাত্র নেশা আর ভালোবাসা হিসাবেই লেখালেখি চালিয়ে আসছেন। অধিকাংশ বিখ্যাত লেখকই অন্য কোন পেশায় গ্রাসাচ্ছাদনের সুষ্ঠ ব্যবস্থা করে তবেই লেখালেখির নেশাকে টেনে নিয়ে চলেন। সেই লেখা থেকে সামান্য কিছু আয় যদিও কখনো সখনো হয়ও, তা তাদের দৈনন্দিন জীবনের অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের সুরাহা ঘটানোর জন্যে যথেষ্ট নয়। এইখানেই আমাদের সমাজে একজন লেখকের মূল অপ্রাসঙ্গিকতা। অন্য যে কোন পেশাজীবী মানুষের যে সামাজিক প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, যেমন ডাক্তার, উকিল, প্রযুক্তিবিদ, মিস্ত্রী, শিক্ষক, আমলা থেকে শুরু করে দোকানি এমন কি আমাদের লেখার শুরুতে যে ঝাড়ুদারের উপমা টানা হয়েছে, তাদের; একজন লেখকের কি সেই একই সামাজিক প্রয়োজনীয়তা বিদ্যমান এই সমাজে? সামাজিক এই প্রয়োজনীয়তার ভিত্তিতেই কোন কাজের প্রাসঙ্গিকতার নির্ধারণ হয়ে থাকে।
তাই লেখালেখি ও লেখকের কোনরকম প্রাসঙ্গিকতাই গড়ে ওঠে নি আমাদের সমাজে। অবশ্যই স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্যান্য পেশার পাঠপুস্তকের লেখকরা আমাদের এই আলোচনার মধ্যে পড়েন না। মনের খোরাক জোগানো, চিন্তার দিগন্ত প্রসারিত করা, জীবনবোধের বিস্তার ঘটানোর জন্যে যে সব লেখালেখি ও তার লেখকরা দুঃখের বিষয় হলেও আজও সামাজিক ভাবেই ব্রাত্য। তাদের সাধনা ও পরিশ্রম, সমৃদ্ধি ও অর্জনের কোন রকম অর্থমূল্য তৈরী হয়ে ওঠে আমাদের সমাজে। এই যে কোনরকম অর্থমূল্য তৈরী না হওয়া এটাই প্রমাণ করে একটি সমাজে লেখক শ্রেণীর অপ্রাসঙ্গিকতার। শুরুর সেই একই কথার প্রতিধ্বনি করলে বলতে হয়, ঝাড়ুদার প্রাসঙ্গিক কিন্তু লেখক অপ্রাসঙ্গিক।
কিন্তু কেন এই অবস্থা? সেটি মোটামুটি ঠিকমতো বুঝতে গেলে একবার ফিরে তাকাতে হবে আমাদের ইতিহাসের দিকেই। আধুনিক বাংলার ইতিহাস, সাগর পারের সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশের হাতে গড়ে দেওয়া ইতিহাস। হাজার হাজার বছর ব্যাপি গড়ে ওঠা একটি জনপদের ধারাবাহিক অগ্রগতির সামাজিক ইতিহাস নয়। সেই ইতিহাস পলাশীর প্রান্তরেই কবরস্থ। তারপর ব্রিটিশের স্কুলে পড়াশুনো করে মেকলের এ বি সি ডি মুখস্থ করে ব্রিটিশের তৈরী ডিগ্রী বগলদাবা করে আমাদের সুসভ্য হয়ে ওঠা। এটাই আধুনিক বাংলা ও বাঙালির সার্বিক ইতিহাস। যদিও সেই ইতিহাস পর্যালোচনার পরিসর নেই বর্তমান আলোচনায়, তবুও এই ইতিহাসটুকুর সামগ্রিক গুরুত্ব অনুধাবন করতে না পারলে আজকের বাঙালি সমাজে লেখকের অপ্রাসঙ্গিকতার ভিত্তিটুকু ছোঁয়া যাবে না আদৌ। ব্রিটিশের স্কুলে এ বি সি ডি মুখস্থ করে এক একজন অকস্ফোর্ড কেম্ব্রিজ ডিকশনারীর বিশেষজ্ঞ হয়ে ম্যকবেথ থেকে শুরু করে প্যরাডাইস লস্ট আবৃতি করে আমরা শিখেছি কি করে মনমতো একটি সরকারী কি বেসরকারী চাকুরী বাগিয়ে নিতে হয়। এবং শিখেছি সেই বাগিয়ে নেওয়ার পথে প্রতিযোগিতার রাস্তা সাফ করতে কখন কাদের পায়ে সঠিক পরিমাণে তৈলমর্দন জরুরী। কবি কত তীব্র আক্ষেপেই না বলেছিলেন, ‘রেখেছো বাঙালি করে মানুষ কর নি’। এই যে লক্ষ্য উদ্দেশ্য ও অভিজ্ঞতা, একটি সমাজের এই যদি আধুনিকতার সার্বিক চেহাড়া হয়, তবে পাঠ্যপুস্তকের বাইরে সেই সমাজের উঁকি দেওয়ার আগ্রহ কতটুকু থাকবে সে কথা বলাই বাহুল্য। ডিগ্রী আর মাসিক উপার্জনই যে সমাজের সবকিছু বিচারের মানদণ্ড সেই সমাজে লেখকের অপ্রাসঙ্গিকতা আদৌ অস্বাভাবিক নয়। একজন লেখক ঠিক ততখানিই বড়ো লেখক, যত বড়ো তাঁর ডিগ্রী ও যত বেশি তাঁর মাসিক উপার্জন। তারপর তো তিনি একজন লেখক! তারও পরে তাঁর জনপ্রিয়তা। লেখা ও লেখকের সামাজিক কোন প্রাসঙ্গিকতা না থাকলেও। এই হচ্ছে বাংলার সামগ্রিক চিত্র।
ব্রিটিশের স্কুলে সুসভ্য হয়ে ওঠা বাংলা আরও একটি শিক্ষা অর্জন করে নিতে পেরেছে সহজেই। দেশের অধিকাংশ জনগণ যত বেশি পরিমানে উচ্চশিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে, তত বেশি আরামেই দিন কাটবে এ বি সি ডি মুখস্থবিদ ডিগ্রীধারীদের। তাই বৃটিশ চলে যাওয়ার পর সাড়ে সাত দশক অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও আজও অধিকাংশ বাঙালিকেই আমরা অশিক্ষিত করে রাখতে সক্ষম হয়েছি। সমাজে অশিক্ষিত জনসংখ্যার পরিমাণ যত বেশি, লেখকের লেখার পাঠকও তত কম হবে। এতো জানাই কথা। ফলে আমাদের সমাজে একজন লেখকের সামাজিক অপ্রাসঙ্গিকতা কতখানি ব্যাপক সেটি অনুধাবন করতে গেলে এইসব বিষয়গুলির দিকেও সার্বিক নজর দিতে হবে। হবেই। কিন্তু ইউরোপের স্বাধীন দেশগুলির মতোই আমরাও যদি কালের ধারাবহিকতায় একটি স্বাধীন জাতির স্বাধীন সমাজের মতোই মধ্যযুগীয় অন্ধকার থেকে দিনে দিনে সমাজ বিবর্তনের স্বাভাবিক ধারাতে বিকশিত হয়ে ওঠার সুযোগ ও পরিসর পেতাম, বিশ্বের অন্যান্য উন্নত জাতির সাথে স্বাধীনভাবে মোলাকাতের মধ্যে দিয়ে পুষ্ট হয়ে উঠতে পারতাম, তাহলে আমাদের আপন স্বাধিকারে অর্জিত সমৃদ্ধির পথেই আমরাও একদিন অধুনিক যুগে পা রাখতে পারতাম। আধুনিক যুগের চৌহদ্দিতে সেই প্রবেশ ঘটত আমাদের নিজেদের পায়ের দৃপ্ত পদক্ষেপেই। ব্রিটশের তৈরী করে দেওয়া ক্র্যাচে ভর দিয়ে নয়। এই যে ব্রিটিশের তৈরী করে দেওয়া ক্র্যাচে ভর দিয়ে বাঙালির একাংশের আধুনিক হয়ে ওঠার অভিশপ্ত ইতিহাস, এই ইতিহাসেই নিহিত আমাদের সার্বিক ব্যর্থতার আজকের চিত্রগুলি। পরিতাপের কথা আমাদের ইতিহাসের এই দিকটি ও তার গুরুত্ব সম্বন্ধে আমাদের শিক্ষিত মানুষদেরই কোনরকম বাস্তব ধ্যান ধারণা গড়ে ওঠে নি আজকেও। তার মাশুলই গুনছি আমরা প্রতিদিনের সমাজ ও জীবন বাস্তবতায়।
কিন্তু বাঙালির পাঠাভ্যাস ও তার জীবনে বইয়ের প্রকৃত অবস্থা, বাঙালি জনমানসে একজন লেখকের অস্তিত্ব ও সম্মান, এইসব বিষয়গুলি প্রকাশক মাত্রেই জানেন। তাই লেখককে একটি সৌজন্য সংখ্যা ধরিয়ে দিয়েই তিনি কোনরকমে চালিয়ে নিয়ে যেতে পারেন একটি সাময়িকী। কিন্তু বই প্রকাশের প্রয়োজন হলেই প্রকাশকের মাথায় হাত। কে কিনবে লেখকের বই? কয়টি সংখ্যা বিক্রী হবে? বই প্রকাশকের লগ্নীই বা কি করে মুনাফার মুখ দেখবে? তিনি তো আর দাতব্য প্রতিষ্ঠান খুলে বসে পড়েননি? তখনই প্রকাশক লেখকের কাছেই তাঁর বই প্রকাশ করে দেওয়ার নানান রকম স্কীমের ফাঁদ পাতেন। লেখক একবার শুধু ধরা দিলেই হলে। প্রকাশকের লক্ষ্মীলাভ নিশ্চিত। ফেল কড়ি মাখো তেল। তোমারই পয়সা। তোমারই বই। আমি শুধু লাভের বখড়া রেখে বই ছাপিয়েই ক্ষান্ত। তরপর তোমার বই বিক্রীই হোক আর নাই হোক। মাথাব্যাথা আমার নয় তোমার।
কিন্তু লেখকেরই বা এত মাথা ব্যাথা কেন? কি হবে লিখে? কিই বা হবে সেইসব লেখা জমিয়ে বই প্রকাশ করে? নিজের বা নিজের স্ত্রী কিংবা স্বামীর কষ্টার্জিত অর্থ অপচয় করে? প্রথমত লেখক কেন লেখেন? লেখেন নিজের কথাগুলি বলার জন্যে। সে তো ঘরের দেওয়ালের দিকে মুখ করেও বলা যায়। বলাই যদি হয় উদ্দেশ্য। কিন্তু না। শুধু বলাই তো আর উদ্দেশ্য নয়। মূল উদ্দেশ্য অন্য একজনকে শোনানো। বেশ তো, বাড়িতে যিনি শুনতে চান, তাঁকে শুনিয়ে দিলেই ল্যাঠা চুকে যায়। তার জন্যে আবার কষ্ট করে সময় ব্যায় করে লেখাই বা কেন। কারণ তো শুধুই লেখার মধ্যে দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করার মধ্যেই নয়। কারণ সেই লেখাটিকে সংরক্ষণ করে সমাজের বৃহত্তর অংশে ছড়িয়ে দেওয়ার ব্যক্তিগত পরিতৃপ্তিজাত আনন্দের মধ্যেই। সেই আনন্দই হলো সংযেগের আনন্দ। একজন লেখক তখনই লেখক, যখন তিনি পাঠকের সাথে সেই সংযোগ সূত্রটি গোড়ে তুলতে পারেন ঠিকমত। প্রত্যেক লেখকের অস্থিমজ্জায় এই সংযোগেরই সাধনা। লেখক চান তাঁর লেখার মধ্যে দিয়ে বহুজনের সাথে সংযোগ স্থাপনের। এই যে বহুজনের সাথে সংযোগ স্থাপনের একন্ত অভীপ্সা ও নিরন্তর তাগিদ, সেই তাগিদেই একজন লেখক বাজারের সব রকম নিয়মকেই শিরোধার্য্য করে নিতে বাধ্য হন। তাই বাধ্য হন বিনা পারিশ্রমিকেও লিখতে। বাধ্য হন নিজের কষ্টার্জিত অর্থে হলেও সামর্থ্য থাকলে বই ছাপাতে। বাধ্য হন অন্য কোন পেশায় নিযুক্ত হতে লেখালেখি চালিয়ে যাওয়ারই জন্যে। আমাদের সমাজ ও বইয়ের বাজারের কাছে লেখক তাই দাসত্বের শৃঙ্খলেই বেঁধে ফেলেন নিজেকে। না ফেললে যে তাঁর মুক্তি নাই। কেননা তাঁর মুক্তি তাঁর লেখার মধ্যে দিয়েই বহজনের সাথে সংযোগসূত্র গোড়ে তুলতে পারার মধ্যেই।
কিন্তু সার্বিক অশিক্ষিত মানুষের সমাজে মানুষের অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের প্রয়োজন ও প্রাসঙ্গিকতার পরিসরে এমনকি স্বল্পসংখ্যক শিক্ষিত মানুষের জীবনেও লেখকের কোন লেখার সাথে এই সংযোগ সূত্র গড়ে তোলার কোন রকম প্রাসঙ্গিগতাই নাই আমাদের দেশ ও সমাজের জীবনে। তাই সাধারণ ভাবেই কি অশিক্ষিত কি শিক্ষিত সব ধরণের মানুষের কাছেই একজন লেখক ও তাঁর লেখা মূলত অপ্রাসঙ্গিক ও ব্রাত্য হয়েই পড়ে থাকে। পড়ে থাকে অনাদরে অবহেলায়। এইকারণেই আমাদের দেশে মানুষের বইপত্র পড়ার অভ্যস প্রায় নাই বললেই চলে। বইপত্রের পাঠক থাকলেই বইয়ের বাজার থাকতো। আর বইয়ের বাজার যত শক্তিশালী হবে ততই লেখকদের সমাদর ও প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি পাবে। কেবল মাত্র তখনই একজন লেখক লেখাকেই পেশা করে অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের ন্যূনতম চাহিদা পুরণ করতে পারবেন অন্তত। যখন লেখকও হয়ে উঠবেন সমাজেরই প্রাসঙ্গিক একটি অংশ।
অনেকেই হয়তো বলবেন আসলে ইনটারনেট প্রযুক্তির বিপ্লবের কারণেই মানুষের বই পড়ার অভ্যাস কমে গিয়েছে। অনেকেই দোষ দেবেন বোকাবাক্সেরও। কিন্তু আমাদের আলোচনা এই দুইটি বিষয়কে বাদ রাখলেও সর্বাংশেই সত্য। অর্থাৎ নেটে আসার আগে থেকেই বাঙালির পাঠভ্যাস এরকমই লজ্জাজনক ভাবেই কম ছিল। বোকাবাক্স আসারও আগে যে বইয়ের বাজার খুব বিরাট ছিল, না বিষয়টি আদৌ সেরকম নয়। আর ছিল না বলেই কলকাতা বইমেলের জন্ম হয়েছিল। মেলার হুজুগেও যদি কিছু পরিমানে অবিক্রীত বইয়ের সৎকার করা যায়। বাংলায় বইমেলার দাপট দেখে একথা মনে করার কোন কারণই নাই যে বাঙালি বই পাগল জাতি। বরং ঠিক এর উল্টো। বাঙালি বইয়ের থেকে দূরে থাকতেই বেশি অভ্যস্থ বলে বইকেই বাঙালির ঘরের সামনে হাজির হতে বইমেলায়র মাঠে এসে উপস্থিত হতে হয়েছে। অধিকাংশ উন্নত দেশে ও জাতিতে মানুষ সারা বছর ধরেই যে পরিমাণে বই কেনে ও পড়ে, তাতে কিন্তু সেইসব দেশে বইয়ের প্রকাশককে সারা বছর ধরে বাৎসরিক বইমেলার জন্যে হাপিত্যেস করে বসে থাকতে হয় না। তাই সেই সব দেশে বইমেলার হুজুগও বেশি দেখা যায় না। সেখানে মানুষ হুজুগে পড়ে বই কেনে না। কেনে বই পড়ার জন্যেই। পড়ে জীবনের সাথে বইয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবেই। পড়ে তার জীবনকে জানার ও অনুধাবনের একান্ত তাগিদেরই তীব্র সংবেদন থেকেই। সেখানে বই ও লেখালেখির বিরাট বাজার বিদ্যমান। এবং হ্যাঁ ইনটারনেট বিপ্লবের পরেও। কারণ ইনটারনেট একটি মাধ্যম। ছাপাখানার মতোই। সেই মাধ্যম বইয়ের বজার সঙ্কুচিত করার বদলে বরং প্রাসরিত করেই চলেছে। আরও বেশি করে কদর বেড়েছে তাই লেখকদেরও। তাই উন্নততর দেশে ও জাতিতে লেখকের প্রাসঙ্গিকতা সমাজের অস্থিমজ্জাতেই প্রোথিত। হ্যাঁ আমাদের দেশের সেই ঝাড়ুদারদের মতোই প্রাসঙ্গিক। কিংবা হয়তো তার থেকেও বেশি।
0 comments: