রম্যরচনাঃ ইন্দ্রাণী ঘোষ
Posted in রম্যরচনা
রম্যরচনা
ভাষা
ইন্দ্রাণী ঘোষ
জলই জীবন-- এ কথাটা বহু প্রচলিত । তবে জীবনের আরেকটি নামও আছে তা হল, ভাষা । জন্মের পর কান্না শিশুর ভাষা , মাকে সে যেন জানান দেয় যে পৃথিবীর সাথে এবার সে একাই যোগাযোগ করবে । সুস্থ জীবনের শুরু কান্নার ভাষা দিয়ে । যে কোন কমিউনিকেশেন মাধ্যম হল ভাষা । কমিউনিকেশেন ছাড়া মানুষ বাঁচে না । অতএব ভাষা হল জীবন । ভাষা যে শুধু লেখা এবং পড়ার প্রতীক বা সংকেত তা নয়, ভাষার বহু রূপ আছে যেমন হৃদয়ের ভাষা ,চোখের ভাষা, হালফিলের মোবাইলের ভাষা ।
দিন বদলায় মানুষ বদলায়, মন বদলায় আর সেই বদল দেখার আয়না হয়ে যায় ভাষা । জন্মের পরের কান্নার পর, শিশুর ভাষা হয় নানারকম অক্ষরবিহীন আওয়াজ । খুব খুশি হলে সে নাক দিয়ে গরগর আওয়াজ করে থাকে। খুব কাছের মানুষকে দেখলে সে ফোকলা মাড়িতে আলো ছড়িয়ে এমন হাসে যে চারিদিকটা ঝলমল করে ওঠে । এই হাসি পৃথিবীর সবচেয়ে নির্মল ,সবচেয়ে পবিত্র ভাষা । সত্যজিৎ রায় পরিচালিত পথের পাঁচালী ছবির ইন্দির ঠাকুরনের ফোকলা মাড়িতে আলো ছড়ান হাসির ভাষা তুলনাবিহীন । ইন্দির ঠাকুরনের হাসি, যে ভাবনার চলাচল বুঝিয়ে দিতে পারে, মুখের ভাষা বা লেখার ভাষা তা বোঝাতে পারে না ।
সদ্য কথা বলতে শেখা শিশুর ভাষা সবচেয়ে মজার। আমার মেয়ে তখন সবে কথা বলতে শিখেছে ,তখন সে যা শোনে তাই বলে। আমার মুখে সে কোন ভাবে সে ভিক্টর হুগোর উপন্যাস “হানছ ব্যাক অফ নত্রদাম’ কথাটি শুনেছে , সে গম্ভীর হয়ে জিগ্যেস করল “কি বললে ? হাচ পাঁচ নতুন দাম? ”। আমার তা শুনে হাসি কান্না দুটোই পেতে লাগল । আরেকদিন সে শুনেছে “ডিসরেসপেকট”, এবারের প্রশ্ন হল “আচ্ছা ডিস রেট পেট” মানে কি?” তা সে দিন গেছে ,এখন সে খানিক বড় হয়েছে ,স্কুলে চারটি ভাষা শিখছে তার মধ্যে নব আমদানী কিছু বিলিতি গালি । তার দাবী সে এই শব্দের মানে না জেনে সে উচ্চারণ করবে না । এদিকে কৌতূহল অদম্য । অগতির গতি এই “অভাগিনী মা”। যত প্রশ্নবাণ নিক্ষেপিত এই আমারই দিকে । এবার বলতে হবে , অতি প্রচলিত চার অক্ষরের চারটি শব্দের বিলিতি গালাগালির মানেটা কি? আমি দেখলাম সামনে সমূহ বিপদ । ভীষণ গম্ভীর হয়ে বললাম “সব কথার মানে বোঝার ও জানার দরকার নেই, এক সময় নিজেই বুঝবে, বোঝাতে হবে না”। সে যাত্রায় রেহাই পেলাম । এই অনেককিছু নিজে বুঝে নেওয়ার ভাষাটি যে সে অদূর ভবিষ্যতেই বুঝতে শুরু করবে ,আমি তা বেশ বুঝতে পারছি ।
এবার আসি হালফিলের মোবাইল এর ভাষাতে । অক্ষরের এবং নম্বরের এ বড় বিচিত্র মিশেল । যেমন আমার এক বান্ধবী লিখেছে “BTW” আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম “By the way” btw মানে কি ? সে বললে এর মানে হল “by the way, তুই নিজে এক্ষুনি বললি, আর এর মানে জানিস না?” আমি বললাম “খ্যামা দে মা, আমি পুরটাই লিখি ”। আজকাল আরেকটিও সংকেত দেখি , একটি গ্রেটার দ্যন চিহ্ন দিয়ে তারপর ইংরেজির তিন লেখা, তা এর মানে নাকি “আমি তোমায় ভালবাসি” । শুনে তো তাজ্জব হয়ে গেলাম ।
ভাষা পরিবর্তনশীল ,ভাষা স্রোতস্বিনীর মত । কবিতা ও গদ্যের ভাষা বদলেছে দিনে দিনে । কখন বেশী অলঙ্কার ব্যবহার হয়েছে, কখন ভাষা থেকেছে স্বতঃস্ফূর্ত ঝরনার ধ্বনির মত । এই দুই রূপ সমান মোহিনী । গদ্যের ভাষা অনেক সময় কবিতা হয়ে গেছে । ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস পৃথিবীতে বিরল । ভাষার বাস মানুষের আত্মায় আর তাই বোধহয় ইতিহাস দেখে একুশে ফেব্রুয়ারির মত রক্তাক্ত দিন । মাতৃভাষা কে কেড়ে নেওয়া মানে আত্মাকে বিসর্জন দেওয়া ।
মুখের ভাষা ছাড়াও আর দুটি বড় মধুর ভাষা আছে “হৃদয়ের ভাষা” ও “চোখের ভাষা” । আহা চোখ দিয়ে কত কথা বলে ফেলা যায়। কোনদিন চোখে রাগ রইল, কোনদিন কোমল প্রেম, কোনদিন আবার চূড়ান্ত উদাসীনতা, কোনদিন সৃষ্টি সুখের উল্লাস।
এই ভাষা পড়ার মজাই আলাদা । হৃদয়ের ভাষাটির আবার ছায়া পড়ে চোখের আয়নায়, এই দুই ভাষা মিলেমিশে এক নতুন ভাষা তৈরি হয় । আর এই নতুন ভাষা পড়তে গেলে কি চাই? উঁহু চশমা নয়, ভাষাজ্ঞান নয়, শুধু একটি সূক্ষ্ম অনুভূতি সম্পন্ন মন ।
0 comments: