রম্যরচনাঃ সীমা ব্যানার্জ্জী-রায়
Posted in রম্যরচনা
রম্যরচনা
আ মরি ভাষা...
সীমা ব্যানার্জ্জী-রায়
বাংদী
ভারতে মধ্যপ্রদেশের জব্বলপুরে থাকাকালীন দুটো ঘটনা, এই পরিপ্রেক্ষিতে বলে রাখি, এর মধ্যে যদিও জোরালো কোনও কাহিনী নেই, তবু মানুষের অন্তর্লোকের একটু তো বিশ্লেষণ থাকে। কাহিনীহীন একধরণের অব্যক্ত কাহিনী থাকে, যা আসলে জীবনের খাঁটি নিখুঁত চালচিত্র। কোন আটপৌ্রে, ঘরোয়া মুহূর্ত দেখে কী যে মুগ্ধ, কী যে আনন্দিত এবং কী যে দুঃখিত হয়ে পড়ি সেকথা গুছিয়ে বলা মুশকিল। ভাষায় পরিবহন ক্ষমতার নিজস্ব এক সীমাবদ্ধতা আছে। মানুষের জীবনে এমন অনেক মুহূর্ত আছে, এমন অনেক অনুভূতি আছে যে, সেই মুহূর্ত কিংবা অনুভূতির কথা ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না। একটা নির্দ্দিষ্ট জায়গা অবধি পৌঁছে ভাষা আর এগোয় না।
এই প্রসঙ্গে আমার দুইটি ছো্ট্ট অনুভূতির কথা বলি।
তখন জব্বলপুরে মেয়েদের কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। সদ্য মেদিনীপুর থেকে হাইয়ার সেকেন্ডারী পাশ করে কলেজে ঢুকেছি। যদিও ছুটি-ছাটাতে চলে যেতে হত জব্বলপুরে বাবার সাথে দাদা-দিদির কাছে। কাজেই বন্ধবীরা সবাই মোটামুটি চেনাজানা ছিল।
একবার আমার দাদার বন্ধুর দুই জমজ বোন, রিনিদি আর মিনিদি, তা্দের সদ্য বিবাহিত দাদা/বৌ্দির কাছে বেড়াতে এসেছিলেন। থাকতেন আমাদের বাড়ির ঠিক দুটো বাড়ির পাশেই। কলকাতা থেকে সবে কলেজের পড়া শেষ করে এসেছেন। ঠিক হল সবাই একসাথে জব্বলপুরের বিখ্যাত মার্বেল ফলস যেটা 'ধোঁয়াধার' নামে পরিচিত, চৌষট্টী যোগিনী, একদিন দেখতে যাওয়া হবে। শনিবার রবিবার আমার কলেজ ছুটি কাজেই আমিও যাব।
ভোরবেলা ঠিক সাড়ে সাতটায় বেড়িয়ে পড়লাম সবার সাথে। একটা টেম্পো ভাড়া করা হল। জব্বলপুরের টেম্পোগুলোতে কিন্তু বড় মানুষ ১০ জন একসঙ্গে বসতে পারেন। ১০ জনের বেশি লোক ওরা ওঠায় না। পুলিশ ধরলে তার ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়ে নেবে। আমার দাদারা থাকতেন আর্মস এ্যন্ড এ্যম্বুলেশন ফ্যাক্ট্ররীর কোয়ার্টারে। সেইজন্য আরো বেশি কড়াক্কড়ি ছিল। যাই হোক, লুচি, আলুর দম, ক্ষীর, শশা, কমলা লেবু, জল এইসব খাবার দাবার নিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু হল।
আমাদের বাড়ি থেকে নর্মদা ফলস প্রায় দুই ঘন্টা সময় লাগে। গল্প আর গান করতে করতে পৌঁছে গেলাম। গিয়ে দেখি তখনই টুরিস্টদের ভীড়ে একেবারে থৈ থৈ করছে। এগিয়ে চললাম আমরা। হঠাৎ দেখি রিনিদি আর মিনিদি একটা দোকানদারের সাথে হাত পা নেড়ে নেড়ে কী যেন বলছেন। আমি সবার ছোট কাজেই আমাকেই যেতে হল ওদের ডেকে আনতে। পাহাড়ি রাস্তা, উবড়ো -খাবড়ো। তাও প্রায় দৌড়েই গেলাম। পাহাড়ে ওঠার মুখে বেশ কিছু হাতে গড়া মার্বেল রক্সের তৈরী জিনিস পাওয়া যায় যেগুলো বড় দোকানের থেকে দাম বেশী। আর তখনই বানিয়ে দেবে যদি কেউ নিজের পছন্দমত কিছু চায়। গিয়ে তো থ...বলে কি এরা?
রিনিদি হাসছে আর মিনিদি বলে চলেছে তার মিস্টি মধুর বাংলা মেশানো হিন্দি কথা...
“ চালাকি পায়া হ্যায়, চালাকি পায়া। ভাবতা হ্যায় কিছু বুঝি না। বড় শহর কলকাতা থেকে আয়া হ্যায়। ওরা এগিয়ে যায়া হ্যায় আর আমাদের ঠকাতা হ্যায়? দাঁড়াও ডাকতা হ্যায় ওদের।”
দোকানদার যত বোঝায়, সে কথা বুঝবে মিনিদি -তবে তো! কান দেবে কে? শুনবে কে? আমার চেয়ে বড় ওনারা, কিছু বলতেও পারছি না। তাও বললাম অবশ্য। আমিও খুব একটা এক্কেবারে যে হিন্দিতে চৌখোশ তা নয়। তাও ওনাদের বুঝিয়ে বললাম। কি মনে হল, আমার সাথে চলতে শুরু করলেন বকবক করতে করতে।
পানের দোকানের পাশ দিয়ে যেতে যেতে স্বাভাবিক ভাবে পানওয়ালা হেঁকে চলেছে-- “ হেই বাঙালি দিদি পান লিজিয়ে মিঠা পান। বহুত বড়িয়া হ্যায়। খাকে দেখিয়ে।”
এইবার আবার মিনিদির দাঁড়িয়ে উত্তর আর তার সাথে অ্যাক্টীং করে দেখানোঃ “ পান খেলে মাথা ঘুড়কে পড়ে যাগা। তখন কি করেগা তুমি, হ্যাঁ।” আর কথা বাড়াতে দিলাম না। তাদেরকে টেনে নিয়ে চললাম সবার কাছে। মিনিদি নিজেই গিয়ে নিজের বাংদী(বাংলা+হিন্দী) ভাষার কথা নিজেই বলে কী হাসি সবার সাথে।
আরো একবার আমাদের মেয়েদের কলেজ বাস না আসাতে টেস্ট পরীক্ষার সময় আমরা টেম্পো করে যাচ্ছি। আমাদের চেনাশোনা এক দাদার মা উঠলেন আমাদের টেম্পোতে। তিনি সবে এসেছেন কলকাতার বেলুড় থেকে। আমরা বন্ধবীরা নিজেদের মধ্যে আসন্ন পরীক্ষার বিষয় নিয়ে আলোচনায় মত্ত। উনি বসেছিলেন এক্কেবারে দরজার মুখে।
হঠাৎ বেসুরো গলায় চিৎকার করে উঠলেন... “আমিকো গিরনা হ্যায়? আমিকো গিরনা হ্যায়।”
“গিরনা হ্যায়?”...ড্রাইভার জানে বাঙ্গালীদের। তাই বলল “মাসীমা আপনে নেহি গিরেঙ্গে। আরামসে বৈঠিয়ে।” কিন্তু তিনি বলেই চলেছেন। আমি একটু ঝুঁকে বাইরে দেখলাম দরজা দিয়ে। দেখলাম দাদাদের ফ্যাক্ট্ররী আসছে, উনি বোধহয় এইখানে নামতে চান। আমি একমাত্র বাঙ্গালী ছিলাম আমার বান্ধবীদের মধ্যে। বললাম “মাসীমা আপনি পড়ে যাবেন কেন?” বলেন, “আমি বলতে চাইছি এখানে নামব। তা এরা বুঝছে না।” খারাপ লাগল। বললাম ড্রাইভারকে বুঝিয়ে যে, “উনি ফ্যাক্ট্ররী তে নামতে চাইছেন।”
কতখানি বাংলা ভাষার মধ্যে আমরা ঢুকে থাকি যে, নিখুঁত অন্য ভাষা বলতে আমাদের বেশ বেগ পেতে হয়। নয়ত আমরা ইচ্ছে করে বলি না কি? ইংলিশের বেলায় ও দেখেছি যখন বুঝতে পারি না, তখন 'ইয়েস' অথবা 'নো' বলে ছেড়ে দি। মনে হয় ~আহা! এই সময় যদি একজন বাঙ্গালী পেতাম তাহলে বেশ মনের সুখে গল্প করতে পারতাম। বিশেষ করে কলকাতার বাইরের বাঙ্গালীদের মনে এটা জন্মায়। যারা ছোটবেলা থেকে হাইস্কুল পর্য্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে মানুষ।
পাক্কা বাঙ্গালী
অনেকদিন হল দেশের বাইরে। দেশে থাকতাম মধ্যপ্রদেশের জব্বলপুরে, যেখানে বাঙ্গালীরাও হিন্দী বলত, বেশ মজার তাই না? আমি কি করে বাংলা শিখলাম? সম্পূর্ণ বাঙ্গালীয়ানা বাড়ী তাই, হিন্দী কেন, কোন বিদেশিয়ানাই চলত না সেই বাড়ীতে।
তবে এটা সত্যি, এই বিদেশে এসে বাঙ্গালীয়ানাকে একেবারে পুরোপুরিভাবে মনে গেঁথে ফেলেছি। বাঙ্গালীর সব কিছুই অসাধারণ বলে মেনে নিয়েছি। মা বাবার কাছে থাকলে যেমন তাঁদের চেনা যায় না...ঠিক তেমনি দেশে থাকলে আমাদের মিস্টি মাতৃভাষাকে আমরা অবহেলা করি।
অবশ্য যেখানে যেমন, সেখানে তেমন, তাই নয় কি? প্রথম এসে এই মার্কিণ মুলুকে যে শহরে এলাম একেবারে বাঙ্গালীবর্জিত বলা চলে। যাও বা দু একজনকে দেখা যেত, বাঙ্গালী বলে ঠাহর করা দুষ্কর। যাই হোক, তাতে আমার কোন অসুবিধা হবার কারণ দেখা যায় নি। বাড়িতে তো দিব্বি বাঙ্গলা কথা বলছি গড়গড়িয়ে, হাপুস হুপুস শব্দে বাঙ্গলা খাবার খাচ্ছি ঠিক মত। কাজেই কে বা বাঙ্গালী তা খোঁজার আশে পাশে যেতাম না।
এই বিদেশে ভিনদেশীরা নিজেদের সংস্পর্শে থাকবে বলে কোন পুজো, পিকনিক, জন্মদিন, বিবাহ বার্ষিকী, গ্রাজুয়েশন, নয়ত পটলাক পার্টি করে নিজেরা আনন্দ করে। অবশ্য- বাচ্চারা ইংলিশ কথা বলে নিজেদের মধ্যে, তা হলেও বা - বাঙ্গালী বাচ্চাদের সাথে তো আছে, এই আমাদের মতন এডাল্টদের সান্ত্বনা।
এইরকম এক হাউস ওয়ার্ম পার্টিতে গেছি এক শনিবারে আমার এক ডাক্তার বান্ধবীর বাড়ীতে।
পাক্কা বাঙ্গালী যাকে বলে, এসেছে কলকাতার সাদার্ণ এ্যভিনিউ থেকে। একেবারে পোস্ত, বিউরির ডাল(কলাই-এর ডাল) থেকে আরম্ভ করে পুঁই চিংড়ি, বড়ির ঝাল, ভাপা ইলিশ, মাংসের দো-পেঁয়াজী, খেজুর গুড়ের সন্দেশ, মিস্টি দই, ক্ষীরের মালপোয়া.. একাকার। আর রান্না ~আহা! যেন মুখে লেগে থাকে। আমার মনে হয় ঠাকুর ওকে পুরোপুরি ভাবে তৈরী করেছেন রূপে লক্ষী আর গুণে সরস্বতী করে। বিদেশে একেবারে বাঙ্গালী বাড়ি তাতে পুরদস্তুর বাঙ্গালীয়ানা। ওর কাছেই শুনেছিলাম নাকি দেশ থেকে বঁটি ও শিল নোড়াও এনেছে। ভাল-ই লাগে যখন দেখি নিজের কৃষ্টিটাকে ধরে রেখেছে কি সুন্দরভাবে।
ওকে রান্নাঘরে সাহায্য করবার পর এসে আর সকলের সাথে কথা বলছিলাম হঠাত কানে এল-“ আই ফরগট বেঙ্গলী ল্যাঙ্গুয়েজ-এন্ড ওয়াটস ডি ইউজ টু স্পিক আওয়ার ল্যাঙ্গুয়েজ হোয়ার উই হ্যাভ টু স্টে...ই ডিস খা... আ. আ..ন্ট্রি?”
হাজার হোক বাঙ্গালী তো, তাই কানটাকে খাড়া করেই রাখলাম, বেশ লাগে কিন্তু কথোপকথন শুনতে। এক স্যুটেড বুটেড মাঝারি বয়স্ক ভদ্রলোক আরেক ধুতি পাঞ্জাবী পরা বয়স্ক ভদ্রলোকের সাথে কথা বলছিলেন। আগে কি রিয়াকশন হয়...এবং তার কি অ্যাকশন হয় তার জন্য উদ্গ্রীব বাঙ্গালী আমি।
কথায় কথায় শুনলাম, মাঝারি বয়স্ক ভদ্রলোকের নাম নাকি নীল ব্যান্ডো... ওরফে... নীলমাধব বন্দ্যোপাধ্যায়। আর তাঁর স্ত্রীর নাম সোফিয়া ব্যান্ডো....ওরফে .সুপ্রিয়া বন্দ্যোপাধ্যায়।
ব্যাস! তেলে পড়ল ফোড়ন, “সে কি মশাই বাংলা ভুলে গেছেন? কবে এসেছেন এই দেশে”? জিঞ্জাসা করলেন বয়স্ক ভদ্রলোক।
মিঃ ব্যান্ডো কিন্তু ইংলিশ ছাড়ার পাত্র মোটেই নন। বয়স্ক ভদ্রলোক তখন নির্ভুল আমেরিকান এক্সেন্ট-এ বললেন, “ওয়ার ইউ ফ্রম”? জবাব শুনলাম,... কলকাতার সোনারপুর। ওই যে বলেছি কানটা খাড়া করা আছে। সঙ্গে সঙ্গে আবার প্রশ্ন, “উইচ স্কুল”? আমতা আমতা করে উত্তর...-জগবন্ধু বিদ্যালয়।
আর বলার কিছু নেই।
প্রশ্ন আর উত্তর তড়তড় করে এগিয়ে চলল...
আমিও খাবার সার্ভ করার জন্য উঠে গেলাম। মিঃ ব্যান্ডো দেখি খাবার রুমে এসেই আগে কিন্তু পুঁই চিংড়ি নিলেন আর বেশ রসিয়ে রসিয়ে বাংলা খাবার খেতে লাগলেন। ডাক্তার মানুষ তিনিও। তাই শুনলাম তিনি বলছিলেন পাশের জনকে যে, “বেঙ্গলী ফুড ইজ অলসো ভেরি হে...ল...দি”। খাবার দাবার হলো-এবার বাড়ী ফেরার পালা...।
হঠাৎ শোনা গেল, ... “ওগো শুনছো...ও, বাড়ি যেতে হবে... না- হ...বে না...আ?”
মনে মনে ভাবলাম তাজ্জব ব্যাপার, এই বলছিলেন শুনলাম বাংলা ভুলে গেছেন, আবার তাহলে? আড়চোখে বয়স্ক ভদ্রলোকের দিকে তাকাতে উনি আমার দিকে চোখ মুচকে ছুঁড়ে দিলেন অবজ্ঞার হাসি.... বুঝে গেলাম আ মরি বাংলা ভাষাকে কি আমরা কোথাও গিয়ে ভুলতে পারব?
লুপিতা
আমাদের ধারণা আমরা যখন ইংলিশ বুঝতে পারি না, তখন আমরা ইয়েস অর নো করে কাটিয়ে দি বা না শোনার ভান করি। এই “ইয়েস নো” সব দেশেই সব যায়গায় একই প্রযোজ্য। “ইয়েস অর নো” নিয়ে আমরা অনেক গালগল্প বা সিনেমা দেখেছি। কিন্তু নিজের অভিজ্ঞতায় একটা সাংঘাতিক অবস্থার সন্মুখীন হতে হয়েছিল সেটা বলি।
আমি থাকি একেবারে মেক্সিকোর বর্ডার, টেক্সাসে। উপরি পাওনা হিসেবে, বেশ কিছু মেক্সিকান আর স্প্যানিশ আমার বান্ধবী হয়ে উঠেছে। একবার এক ছুটির দিনে হঠাৎ করে আমার প্রিয় মেক্সিকান বান্ধবী সিয়েরা -এসেছিল ওর আরেক বান্ধবী লুপিতাকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের বাড়ী বেড়াতে । আনকোরা নতুন লুপিতা একটু যেন জড়োসড়ো। নতুন এসেছে পুয়ের্তো রিকো থেকে। আমরা যারা প্রথম দেশ থেকে আসি আমাদেরও সেই দশা হয়। কারণ একেবারে আনকোরা নতুন দেশ, আচার ব্যবহার সব নতুন। যেখানে ইলেক্ট্রিকের স্যুইচ পর্য্যন্ত উলটো দিকে চলে। যদিও আমি এই ব্যাপারে ঠাকুরের অনেক কৃপা পেয়েছি। কারণ আমার নিজের বাড়ির মানুষজন আগেই এখানকার পুরোপুরি বাসিন্দা। আমি স্প্যানিশ ভাষা বুঝি, তবে বলতে গেলেই কুপোকাৎ ।
এখানকার কলেজ ছাড়ার সাথে সাথেই স্প্যানিশ শেখার “ইতি গজ” হয়েছিল যে! ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজ ছাড়া এখানে ডিগ্রী পাওয়া যায় না। কাজেই এই স্প্যানীশ নিতে হয়েছিল।
কি করব? এত ভাষা তো আর ছোট্ট মাথার হার্ড ডিস্কে রাখতে পারি না... মেমারি খুবই কম। এক্কেবারেই উদ্ভট এই আমার আমি।
নভেম্বর- এর এক সুন্দর গোধূলি বেলায় কলিং বেল শুনে দরজা খুললাম। খুলেই দেখি আমার অফিসের দুই স্প্যানিশ বান্ধবী। দরজা খোলার সাথে সাথেই “ওলা” বলে দুজনেই গাল-এ গাল রেখে কুশল বিনিময় করা হল। তারপরেই আমার আর সিয়েরার কথার ফুলঝুরি জ্বলতে শুরু হয়ে গেল অবশ্য-ই ইংলিশ-এ। ওদের নিয়ে আমাদের বাইরের প্যাটিও-তে গিয়ে বসলাম। দিক ছায়া প্যাটিও-টা সবার খুব পছন্দ। আমার যত সুখ দুঃখের সাথি এই প্যাটিও।
এখানেই বসে হাবজিগাবজি আমার লেখালিখি।
তিনজনে বসলাম তিনটে গার্ডেন চেয়ারে। আমরা যে কি গল্প করছি কিছুই বুঝছে না নতুন দেশ থেকে আসা বেচারি লুপিতা। আমাদের হাসতে দেখে ও -ও হাসছে । খুব মজা লাগছিল ওকে দেখে । এক মাথা লম্বা সোজা কালো চুল আর ছোটখাটো গোলগাল লুপিতাকে কিন্তু দেখতে খুব মিষ্টি । Mexican বা Spanish দের দেখতে অনেকটা ভারতীয়দের মত হয় । আমি যে কতবার এই ধন্ধতে পড়েছি তা অগুন্তি। দু একটা কথার মুখস্থ জবাব দেবার শেষে 'ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি-র' মত বলতে হয়েছে
-আমি পুরোপুরি ভারতীয়!
আমি খুব ভালবাসি নানা দেশের লোকের সাথে মিশতে । বই পড়ে বা সিনেমা দেখে মানুষের সম্বন্ধে জানা যায় না বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস । ওদের সাথে না মিশলে ওদের ভালভাবে জানা যায় না। মেক্সিকো থেকে যারা প্রথম আসে তারা একদম-ই ইংলিশ বলতে বা বুঝতে পারে না। লুপিতাকে দেখে মনে হল, ও বোধ হয় কিছু কিছু বুঝতে পারে।
কারণ, আমি আর সিয়েরা যখন কথা বলছিলাম- ও আমাদের সাথে সমান তালে 'Yes/No' করছিল। আর ঠিক ঠিক যায়গাতেই করছিল কিন্তু। এ নয় যে ইয়েস এর জায়গায় নো বা নো এর যায়গায় ইয়েস।
কথা বলতে বলতে ভাবলাম এবার ওদের কিছু স্ন্যাক্স দেওয়া উচিত। তাই ওদের hot না cold কফি খাবে জিজ্ঞাসা করাতে সিয়েরা বলল, -'cold কফি' খাবে । লুপিতাকে জিগেস করলাম, 'Hot অর Cold' কফি?
লুপিতা হেসে বলে, - “Okkay !”
আবার জিগেস করলাম, আবার ও ঘাড় নেড়ে বলে, -
“Okkkayy”!
সিয়েরা ঠান্ডা কফি বলে আমাদের জন্য ফ্রাই চিকেন উইঙ্গস আনতে গেছে। কারণ ওরা না জানিয়ে দুম করে বেড়াতে এসেছিল এদিকে আমি পড়লাম মহা ফ্যাসাদে। শেষে বাড়ির ভেতরে গিয়ে আইস ট্রে নিয়ে এলাম আর সূর্য্যেকে দেখিয়ে দু পাশের ঘাড়টাকে কানের কাছে কুঞ্চিত করে বললাম,
-“Umm cold or Ufffs hot” ?
আবার হেসে বলে,
- Okkayyyyyyy !!!!!
কি করব ভেবে না পেয়ে শেষে cold কফিই বানালাম আমাদের তিনজনের জন্য । সিয়েরা খাবার নিয়ে ফিরে আসতে ওকে ঘটনাটা বললাম । সে তো হেসে গড়াগড়ি দেয় আর কি । সিয়েরার এখানেই জন্ম কাজেই ও দুটো ভাষাতেই সমান পারদর্শী। আমাদের হাসতে দেখে লুপিতাও হাসছিল, খারাপও লাগছিল ওকে দেখে।
তবে ও একটু চালাক মনে হল। শিখে যাবে একদিন ও । ওকে আমরা 'okayy' করে ডাকতে শুরু করে দিলাম। কিন্তু আশ্চর্য লুপিতা নির্বিকার... কোন রাগ নেই । ও ও আমাদের সাথে সমান তালে হেসে গেল। ওর প্রতি আমার ভালো লাগা অনেক ধাপ বেড়ে গেল। লুপিতা গাইল আমার দিকে তাকিয়ে......
cuando nos con si has
alguin con que recordar.......
ওর গানের ভাষা আমি এইভাবে বুঝেছি...
কি আনন্দ! যখন আমাদের মাঝে
সেই তুমিই! তখন আছো সাথে...!!
গানের শেষে আমাকে বললঃ Seema que preciosa!!!!! তুমি সুন্দর।
que dios te la bendiga siempre. ভগবান তোমায় আশীর্বাদ করুন সবসময়।
কি সুন্দর গান গায় এই লুপিতা । চারিদিকে ওর মিস্টি গানের রেশ ঘুরেফিরে বেড়াতে লেগেছিল।
Khub mojadar.Valo laglo pode.
ReplyDeleteমজলিসী আড্ডায় গল্প বলার মত পরিচ্ছন্ন ও ঝরঝরে লেখা । অভিজ্ঞতাভিত্তিক হালকা ঢঙে লেখাটা পড়তে ভালো লাগে ।
ReplyDeleteভীষণ সুন্দর লাগল দিদি! অভিনন্দন!
ReplyDelete