0

ছোটগল্পঃ সকাল রয়

Posted in




ছোটগল্প


পুড়ে যাচ্ছে যা কিছু
সকাল রয় 


১. 

মন্দির জ্বলছে!
দাউ দাউ তার লেলিহান শিখা! আগুনের নৃত্য চলছে যেন! উদ্দাম নৃত্য! মাটিতে পড়ে আছে মা কালীর ছিন্ন মাথা। পুড়ে যাচ্ছে এপাড়ার একমাত্র মন্দিরটি। মাটির দেবতারা অপলক হয়ে তাকিয়ে আছে, নির্বাক মুখে মধুর হাসি নিয়ে। ধ্বংসে কোন ভ্র“কুটি থাকেনা। হিন্দু পাড়ার মাটির দেবতারা জ্বলছে কড়িকাঠের মতো। পুড়ে যাচ্ছে লাল-নীল রঙে রাঙানো রুনুর আঁকা আল্পনা গুলো। আগুন তার উত্তাপ উন্মাদনায় পুড়িয়ে দিচ্ছে মনসামঙ্গল আর পদ্মপুরাণ! কেউ আগুন নেভাতে আসছে না ভয়ে! আগুনের সাথে সাথে পাড়ার বুড়ো-বুড়িরা একটানা বিলাপ করে বলছে- ভগবান ওগরে দেহেনা? আমরা কি ওগর মসজিদে আগুন দিবার গেছি? ওরা কেন তাইলে মন্দিরে আগুন দিল? কেন দিল? আগুনের সাথে সাথে অনেকর প্রশ্নও পুড়ে যাচ্ছে অবলীলায়! 

কুলুপাড়ার ছেলে মধু দাড়িয়ে আগুন দেখছে। চোখে ভয়ানক বিদ্রোহ নিয়ে। তার একপাশে বিলাপ, অন্য পাশে আগুনের উত্তাপ! হিন্দুগো ভগবান মনে হয় দুর্বল! ওদের বিরোধী ফুটবল টিমের লেংচা’র মতো। ভালো খেলার ডায়লগ দেয় কিন্তু খেলার মাঠে বড্ড দুর্বল। বিলাপে ভেসে আসা কথা গুলোর উত্তর মধুর জানা থাকলেও হিন্দু পাড়ার কেউ এর উত্তর দেবেনা তাহলে জানে মারা পড়বে। তাদের সেয়ানা মেয়েদের দ্রৌপদীর মতো বস্ত্র হরণ করা হবে। সেগুলোর ভিডিও ক্লিপ অনলাইনে ছাড়া হবে। পুনরায় সেগুলো ডাউনলোড করে হিন্দু গো মাইয়ারা বেশরম! বেশ্যা, মাগী -এসব বলে সামাজিক কলঙ্কের অলঙ্কার দেয়া হবে। তাই কুলুপ এঁটেছে হিন্দুপাড়ার মানুষগুলো। 

মধু শুরু থেকেই মন্দির পোড়া দেখছিল। মুখোশ আটা একদল লোক পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। ওদের কাছে দেশলাই ছিল না, মধুর কাছ থেকে নিয়েছে। মধু অবিশ্যি সিগারেট খায় না কিন্তু দেশলাই সাথে রাখে। বড় বাড়ির মাষ্টার বাবু চশমা মুছতে মুছতে এলেন, বাঁধা দিয়ে লাভ হলোনা। উনাকে শাসিয়ে গেছেন তেনারা। বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেবেন। মাষ্টার বাবু নির্বাক! বলে কি? 

সব পুড়ে গেলেও থামল না বুড়োদের কান্না। শেষ বয়সে শক্তিহীন ভগবানের ছাইরূপ দেখার কোন সাধ ছিলো না তাদের। যৌবনে যুদ্ধ ছিল পাক বাহিনী ধর্ষণ করে চোখ খুলে দিলেও এই মাটি থেকে টলাতে পারেনি কিন্তু এবার বউ-মেয়ের সম্ভ্রম বাঁচাতে মাটি ছাড়তে হবে। সব পুড়ে যাবার পর ঘরপোড়া ছাই হাতের মুঠোয় নিয়ে শাপ-শাপান্ত করে গেলো অযথাই। পাড়ার হিন্দু বউ গুলো মুখ ভোতা করে দাড়িয়ে রইল মন্দিরের চারপাশে দাঁতে আঁচল চেপে। মধুর মনে প্রশ্ন জাগে হিন্দুদের ভগবানকে পুড়িয়ে লাভ কি হলো? এবার কি এখানে মসজিদ হবে? পুরাকালে অনেক মন্দির ভেঙ্গে মুসলমান রাজারা অনেক মন্দির গড়েছিল একসময়। এই সব কাহিনী অনেক আগেই শুনেছিল সে। তাজমহল নাকি শিবমন্দির ছিল সম্রাট শাজাহান নতুন রূপ দিয়েছেন। এসব কি সত্যি? মধু ভাবছে। তার ভাবনা দীর্ঘায়িত হতে পারেনা কারণ সব প্রশ্নের উত্তর তার জানা নেই। চোখের সামনে যা হচ্ছে তা হাতের উল্টো পিঠের মতো সত্যি। শীল পাড়ায় গতকাল কারা যেন আগুন দিয়েছে। দৈনিক পত্রিকার সাংবাদিক ভোটের লাইনে দাড়ানো হিন্দু মহিলাদের ছবি দিয়েছিল পত্রিকায়। তারপরই শীল পাড়ায় আগুন! এই শালার সাংবাদিক গুলোর পাছায় আগুন দিলে ভালো হতো! মধুর মুখে যুতসই কোন গালি আসেনা। না হলে চার-পাঁচটা গালি দিয়ে ফেলত সে। 

রুনু। হিন্দু পাড়ার মেয়ে। মধুর শিক্ষা জীবনে হাতেখড়ির মাষ্টার। রুনুকে মাসি বলে ডাকে সে। তাকে বর্ণমালা শিখিয়েছে। শুধু মধু নয় মুসলিম পাড়ার সব দরিদ্র ছেলেমেয়েকে অক্ষরজ্ঞান দেবার উদ্যোগ ছিল তারই। রুনু গার্মেন্টসের সুপার ভাইজার। দরিদ্র মহিলাদের কাজের সুযোগ করে দেয়। কিন্তু পাড়ার আলেম-উলামারা তাকে দেখতে পারেনা। তাদের চোখে রুনু বেশরম শয়তান মহিলা। 


২. 

জুম্মার নামাজের পর ঈমাম সাহেব বললেন ভাইয়েরা সামনে ভয়ঙ্কর দিন আইতাছে, আমাগো সজাগ থাকতে হইব। এলাকার বেলেল্লাপনা বন্ধ করনের লাইগ্যা মালোয়ান গুলারে তাড়াইতে হইবো, নাইলে দেশটা দোজখ হয়া যাইবো। মালোয়ান হিন্দু গুলান হইল নাপাক! ঈমাম সাহেব মসজিদ মাঠ থেকে ফিরবার সময় ভাবলেন হিন্দুরা নাপাক এটা কেন বললেন তিনি? হাদিসে তো নাই! অমুসলিমরা কি নাপাক নাকি? মসজিদ মাঠের কথাগুলো সকলেই শুনলো। খানিকটা সময় বলাবলি করলো। সব কথা ঠিক না। কয়েকজন বললো ঈমাম সাহেবরে মনে হয় শয়তান জ্বীনে ভর করছে। কয়েকজন বললো ঈমাম সাব ঠিকই কইছে, হিন্দুগো মাটির মুর্তি আসলে বেহুদা! ওগুলো ভাঙলেই ওরা ভয় পাইবো, আর ওগুলার ভিতরে তো কিছু নাই মাডি ছাড়া! এতদিন ধইরা যে মুর্তি ভাঙ্গা হইছে দেখছস কারো কিছু হইতে? কিছু হয় নাই! সো নো টেনশন কামে লাইগ্যা যাই। 

মধুও মসজিদ মাঠেই শুনেছিল হিন্দুরা নাপাক! মন্দির আর মুর্তি সব হলো নাস্তিক। কথাগুলো ঠিক ভাবে মাথায় সাজাতে পারেনি সে। বাড়ির পথ ধরে ঘাটে এসে দেখলা দুঃখু মাঝির নৌকা ভাঙা হচ্ছে। তিনি খ্রিষ্টান! উনার ছেলে ঢাকায় গণআন্দোলনে নামছে, সেটা নাকি নাস্তিকদের আন্দোলন! তাই। নাস্তিক দুঃখু মাঝির নৌকা ভাঙা হচ্ছে। তিনি কাঁদছেন কোন উপায় নেই। ফটোতে ঝুলে থাকা যিশু এদের কিসসু করতে পারবেনা কারণ ঈশ্বর যতই শক্তিশালী হোক শয়তানের লেজ অনেক লম্বা। নৌকা ভেঙে পঙ্গপালের দল রহিম মাঝির নৌকায় উঠলো। 

সন্ধ্যের সময় কোন কারণ ছাড়াই পুলিশ চিরুনি তল্লাশী করলো পাড়াময়! তেমন কিছু পেল না। পুলিশকে খবর দিয়েছিল রুনু। পাড়ায় গণ্ডগোল হচ্ছে ভেবে এসেছিল, কিছু না পেয়ে চলে গেলো পুলিশ। পুলিশ দেখে মধু ভেবেছিল ভয়ঙ্কর কিছু হবেনা। কিন্তু বাড়ির গেট খুলে ঘরে ঢুকতেই আসে হঠাৎ চিৎকারের আওয়াজ কানে লাগলো। দৌড়ে গলির শেষে দাঁড়াতেই দেখতে পেলো মসজিদ মাঠের সেই লোকগুলো অকথ্য ভাষায় রুনুকে শাসাচ্ছে! শালী গার্মেন্টসে কাজ করস! গার্মেন্টসে তোর পাছা দিয়া দিমু! মান্দার ঝি! 


৩. 

মধু রুনুদের আধপাকা টিনের চালা ঘরের সামনে দাড়িয়ে হাঁক-ডাক দিলো, ও রুনু মাসি ঘরে আছো নাকি? দরজায় কড়ায় হাত দিতে হলোনা। রুনু বেড়িয়ে এলো। মলিন কাপড়। মলিন মুখ। গতকালের কান্নার দাগ এখনো চোখের কোলো জমে আছে। দেখলেই বোঝা যাচ্ছে রুনু ঘুমায়নি গতকাল! রুনুর মতো অনেকের চোখ থেকে ঘুম চলে গেছে গত কদিনের তান্ডব লীলায়।

উঠোনে পা রাখতেই মধু বললো- মাসি এ পাড়ার সবাই নাকি চলে যাবে? তোমরাও কি চলে যাবে?
না গিয়ে উপায় কি বল? সবাই গেলেও আমি হয়তো যাবো না।
মধু অবাক হলো! আর কতটা সর্বনাশ হলে পরে ভিটে ছেড়ে দেয় মানুষ। আর কতটুকু সর্বনাশ হবার বাকী আছে? পাড়া তো এখন প্রায় দখলে চলে যাচ্ছে। মালোয়ানদের জায়গা এটা নয় ইমাম সাহেব বলেছেন। হিন্দুরা হলো মালোয়ান! আচ্ছা মালোয়ান মানে কি? যুদ্ধের সময় নাকি হিন্দু মেয়েদের ধর্ষন করতো মুসলমান বানানোর জন্য, এটা কি সত্যি? রুনু মাসির তেমন কিছু হবে না তো? 

রুনু মুখ ধুয়ে এসে বারান্দায় দাড়িয়েছে সবে। মধু ফিরে এসে বললো, তুমিও চলে যাও মাসি? ওরা তোমাকে মারবে? রুনু চোখ মুছে বললো মারুক! আমি কিংবা আমরা যাবো না। বলতে পারিস কেন যাবো আমরা? এই মাটি আমার জন্মস্থান। আমার বাবার ভিটে এই মাটি আমার প্রাণ। এ পাড়ায় গোড়াপত্তনের সময় মাত্র দু’ঘর মুসলমানের বাস ছিল। ওদের তো কাফনের কাপড় কেনার টাকাও ছিলনা। আমার বাবাকেই টাকা দিতে হতো। খাটিয়া কাধে নেবার লোক ছিলনা আমার বাবা কাঁধে তুলত। আর আজ ভন্ড গুলো মাথায় টুপি পড়ে আল্লাহর নাম নিয়ে বলছে হিন্দুরা নাপাক! কোথায় ছিল তখন ওরা? রুনু দাতে দাঁত চেপে বললো আমরা কেন যাবো বলতে পারিস? আমরা তো এ মাটির সন্তান। মধু ওরা হয়ত নতুন সমাজ গড়ার কথার বুলি ছাড়তে পারে কিন্তু এই মাটিকে ভালোবাসতে পারবেনা। আমরা যারা সংখ্যালঘু আছি তারা কিন্তু ভালোবাসি এই মাটিকে, এই দেশকে। কথাগুলো শোনার পর মধুর চোখে জল চলে এলো। চোখের জল লুকিয়ে বললো, এ বেলা তবে যাই। 

রুনু কাঁদছে। মেঘে আকাশ ঢেকে যাচ্ছে। কালো মেঘ তুমুল বৃষ্টি নিয়ে ধেয়ে আসছে। পুবের বাতাস বইতে শুরু করে দিয়েছে। কান্না থামছে না রুনুর। তুমুল বৃষ্টি ভাসিয়ে নেবে সব। মধু বললো, রুনু মাস, আমি তবে যাই। মধু বৃষ্টি মাথায় বেড়িয়ে পড়লো ওর পায়ের তলায় ততক্ষণে বিদ্রোহের তুমুল যুদ্ধ বেঁধে গেছে। আর ওদিকে ধেয়ে আসছে একদল ধর্মান্ধ মানুষ। রুনুর উঠোন বরাবর।

0 comments: