0

ধারাবাহিকঃ নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in


ধারাবাহিক


ছুটি কথা ৬ 
নন্দিনী সেনগুপ্ত



কখনও কখনও এমন হয় যে বর্তমানের একটা ঘটনা একটানে ফিরিয়ে নিয়ে যায় অতীতে। দুদিন আগে অমনটিই হল। এক পারিবারিক অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম বড়মামার বাড়ি বেহালায়। প্রসঙ্গত বলে রাখি, যে সোদপুরের মামাবাড়িটির কথা লিখেছি ছুটি কথার বিভিন্ন পর্বে, সেটি এখনও আছে বটে, তবে সেখানে আর আমার কোনও মামা থাকেন না, বিক্রি হয়ে হাতবদল হয়েছে। ঐ বাড়ির ইঁট-কাঠের খাঁজে খাঁজে হয়তো এখনও জড়িয়ে আছে আমার এবং আমাদের বিরাট গুষ্টির সব পোলাপানদের শিশুবেলার দুষ্টুমি। 

যাই হোক, যা বলছিলাম যে, গিয়েছিলাম বড়মামার বাড়ি। সেখানে বসার ঘরে বসে কথা বলছিলাম অন্য আরও কিছু আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে। হঠাৎ দেখি একটি শিশুকন্যা, গোলাপি রঙের ফ্রক পরা, (তার মুখটাও ভাল করে দেখতে পেলাম না) এক অদ্ভুত সুন্দর গতিময় ছন্দে আমার সামনে দিয়ে হেঁটে (নাকি দৌড়ে) বসার ঘর পেরিয়ে চলে গেল বারান্দার দিকে। তার পেছন পেছন গেলেন ন’মামী, তার হাতে ভাতের থালা। আমি একটানে ফিরে গেলাম অতীতে। 

ঠিকই, অতীতে হয়তো বা প্রায় আড়াই যুগ আগে এরকম একটা দৃশ্য বহুবার দেখেছি বলে মনে পড়ে গেলো- এইরকম একই ছন্দে বসার ঘর পেরিয়ে বারান্দার দিকে চলে যাচ্ছে একটি শিশু, তার পেছন পেছন ভাতের থালা হাতে বিপন্ন চোখ- মুখ নিয়ে যাচ্ছেন ন’মামী। এই মুহূর্তে ন’মামী ডাকছেন ‘গুড়িয়া, গুড়িয়া... শোন শোন, খাওয়াটা শেষ করে যা’। অতীতে ডাকতেন... ‘শুভ, শুভ...শোন শোন, খাওয়াটা শেষ করে যা’। স্থান বদল হয়েছে, সেটা ছিল সোদপুর, আর এটা বেহালা; কাল বদলেছে; পাত্র-পাত্রীর মধ্যে বদলে গেছে শিশুটি। ন’মামী অতীতে আরও তীব্র গতিতে ছুটে যেতেন নিজের অর্ধভুক্ত শিশুপুত্রের পিছনে। এখন তার গতি মন্থর হয়েছে, চুলে প্রচুর পাক ধরেছে, তবু সেই একই দৃশ্য। এখন তিনি চলেছেন তার পৌত্রী গুড়িয়ার (শুভর কন্যা)পিছনে ভাতের থালা নিয়ে। 

শুভ, আমার ন’মামার জ্যেষ্ঠ পুত্র । কনিষ্ঠ যিনি, বুয়ান, শিশুকালে এমন কিছু কখনো ঘটায় নি, মানে বেশ ইন্টারেস্টিং কিছু, যাতে তাকে নিয়ে লেখার চরিত্র বানানো যায়, কিছু মনে করিস নি, বুয়ান, তুই। শুভ, সবাই নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন এতক্ষণে যে, সে বেশ একটা কেউকেটা গোছের হবে। শুভর জন্মের অব্যবহিত পরে এরকম কোন চরিত্রলক্ষণ দেখা গিয়েছিল কিনা আমার জানা নেই, বা মনে নেই। স্মৃতিতে ধূসর আস্তরণ পরে গেছে। তবে শুভর অন্নপ্রাশন আমার বেশ মনে আছে। প্রথমে সে তার মামামণির কোলে চড়ে ভাত খাওয়ার ব্যাপারটা বেশ উপভোগ করছিল। তারপর, বিভিন্ন মাসি, পিসি, দিদির দল তাকে সাজাতে শুরু করলো এটা ওটা অলঙ্কার পরিয়ে। মাথার টোপর, গলার হার, হাতের আংটি অবধি ঠিক ছিল; গোলযোগ বাঁধল যখন কেউ একজন তার হাতে বাজুবন্ধ পরাবার চেষ্টা করল। ছোটবেলা থেকেই কেউ ওর হাত চেপে ধরলে ও ভয়ানক খেপে যেতো। সেদিন তার শুরু। শুভ প্রবল ভাবে বিদ্রোহ করল। কেউ থামাতে পারেনা, এমন কান্না। যাই হোক, পরে সে ধীরে ধীরে শান্ত হল। শুভর যে জিনিসটা ছোটবেলা থেকেই মানুষের নজরে পড়ত, তা হল ওর চোখ। ভারি সুন্দর দীঘল বড় বড় শান্ত চোখ, যা দেখলে কারুর মনে একবারও আসবে না যে ঐ চোখের মালিক কি সাঙ্ঘাতিক সব অশান্ত কাজ করে ফেলতে পারে। 

যেমন বলছিলাম, ঐ চলার ছন্দের কথা। শুভকে শিশুবেলা থেকে কৈশোর পর্যন্ত কোনওদিন আমি হাঁটতে দেখিনি; ওর চলা শুধু দৌড় নয়, এক অদ্ভুত গতিময় উড়ান। ঐ চলার মধ্য দিয়ে যেন ও নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলত চারপাশে যা কিছু ঘটে চলেছে এইসবের থেকে; নিজেকে আবদ্ধ করে ফেলত যেন ওর নিজস্ব একটা রঙিন জগতের মধ্যে। রঙিন বলতে মনে পড়ল, শুভ ভারি সুন্দর ছবি আঁকত। ওর ছবির রেখার মধ্যে, রঙের খেলার মধ্যেও থাকত সেই গতিময় চলন। হয়তো শুধু ছবি আঁকবার সময়টুকুই শুভকে চুপচাপ বসতে দেখা যেত। ঐ সময় আর ঘুমের সময়টা বাদ দিলে শুভ আর গতি এই দুটো শব্দ সমার্থক বলা যেতে পারে। 

শুভর কৈশোর বলতে আমার শুভর থেকেও বেশী মনে পড়ছে উদ্বিগ্ন চোখমুখ নিয়ে ন’মামীর ‘শুভ-ও-ও-ও’ বলে একটা ডাক। ন’মামী ভারি শান্ত প্রকৃতির মানুষ। ঈশ্বর মানুষের প্রকৃতির পরিবর্তন কিছুটা হলেও ঘটাতে পারেন যদি তার সন্তান শুভর মত গতিময় হয়। ন’মামী মৃদুস্বরে কথা বলতেন, রবীন্দ্রসঙ্গীতও গাইতেন মধুর মৃদুস্বরে। ভটচায্যি বাড়ির বৌএর কণ্ঠস্বর বাড়ির চৌহদ্দির বাইরে তো দুরস্থান, বাড়ির অন্দরমহলেও খুব কান পাতলে তবে শোনা যেত। শুভর বড় হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ন’মামীর কণ্ঠস্বরও শোনা যেতে লাগল স্বাভাবিক কারণেই। শুভর গতিময়তার দরুণ সে যে কখন কোথায় থাকবে এই ব্যাপারটা খুব কঠিন অঙ্ক ছিল। শুভ সাইকেল নিয়ে কোথাও উধাও হয়ে যেতে পারে, তারপর মাঠে গিয়ে ওর থেকে অনেক বড় দাদাদের সঙ্গে ফুটবলে টক্কর দিতে পারে, বড় দাদারা খেলতে না নিলে শুধু শুধুই একা দৌড়াতে দৌড়াতে পরিক্রমা করতে পারে বড় মাঠ, এসব করতে ভাল না লাগলে সাঁতরে হেলায় এপার ওপার করে পুকুরের জল ঘোলা করে তুলতে পারে, এরকম অনেক অনেক কিছু করে ফেলতে পারে, যখন যেটা শুভর পছন্দ। শুভ নিজেও বোধহয় ভেবে পেতনা যে কোন মুহূর্তে সে কি করে বসবে। পরীক্ষামূলক ভাবে অনেক কিছু করে ফেলত, এর মধ্যে খেলনাগাড়ি খুলে ভেতরে কি আছে দেখা থেকে শুরু করে নিজের চোখে কাঁচালঙ্কা ঘষে ‘দেখি না কি হয়’ ধরনের কাজও ছিল। দিদা এবং ন’মামী যখন উঠোনে টিউবওয়েলের নীচে ওর চোখ ধুইয়ে ধুইয়ে ওকে প্রায় স্নান করিয়ে ফেলছেন আর ধমকাচ্ছেন ‘কেন চোখে কাঁচালঙ্কা ঘষলি?’ বলে, ও তখন একটু আগের কান্নাটা মিচকি মিচকি হাসিতে রূপান্তরিত করে বলে যাচ্ছে, ‘এই দেখছিলাম যে- কেমন লাগে!’ 

শুভ খুব অবলীলায় দুঃসাহসিক কাজকর্ম করে ফেলতে পারতো। এক দুপুরের কথা মনে আছে। আমি আমার অভ্যেসমত পুকুরের জলের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছি একতলার ছাদে। হঠাৎ শুনতে পেলাম শুভর গলা; শুভ আমাকে ডাকছে। আমি পিছনে তাকা্লাম, না কেউ তো নেই! শুভ আমায় কোথা থেকে ডাকছে? আবার শুনলাম, এবার আরও স্পষ্ট; শুভ ডেকে উঠল, ‘মামণি দি-ই-ই, এই যে একটু নীচে তাকাও, আমি এখানে’। নীচে তাকিয়ে আমার চক্ষুস্থির। শুভ তখন বালক, উচ্চতা খুব বেশী হলে দুফুটের কাছাকাছি, সেই বালক মনের আনন্দে একতলার কার্নিশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি ঘাবড়ে তুতলে কি বলব ভেবে পাচ্ছিনা। কিছু বলতে গেলে যদি কার্নিশ থেকে পড়ে যায়! ভয়ে কাঁটা হয়ে চোখ কপালে তুলে দেখতে লাগলাম। দেখলাম ও কার্নিশ ধরে হেঁটে প্রায় গোটা বাড়িটা প্রদক্ষিণ করে পৌঁছে গেল মেন গেটের কাছে। কার্নিশে ভর দিয়ে এক লাফে নেমে গেল মেন গেটের একদিকের স্তম্ভে, তারপর স্তম্ভে বসে ভর দিয়ে আরেক লাফে নামলো বাড়ির পাঁচিলে। যাক বাবা, আমার ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। পাঁচিলে তো আমিও উঠি, পাঁচিল থেকে পড়লে এমন কিছু ব্যাপার নয়, কিন্তু কার্নিশটা ছিল বেশ উঁচু। পুরানো আমলের বাড়ি - সিলিঙ, কার্নিশ সবই বেশ উঁচু। এখনকার দিনের প্রায় দেড়তলার সমান। পরে শুভকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে ও কার্নিশে উঠল কিভাবে, কারণ ও যে পথ দিয়ে নামলো, সেখান দিয়ে নামা যেতে পারে, কিন্তু শুভর তখন যা শারীরিক উচ্চতা তাতে ঐ পথে খালিহাতে ওঠা অসম্ভব। শুভ একটু মুচকি হেসে উত্তর দিয়েছিল, ‘কেন মামণিদি, ভারি সোজা তো! পেছনের আমগাছ থেকে রান্নাঘরের কার্নিশটা খুব কাছে। আমগাছ থেকে কার্নিশে যাওয়া আবার একটা ব্যাপার নাকি!’

এমন ছেলে বড় করে তোলা মোটেই খুব সহজ কাজ নয়। ন’মামী খুব সাফল্যের সঙ্গে সেই কাজটাই করে ফেলেছেন। যদিও পুত্রের পিছনে দৌড়াদৌড়ি করে কোনওদিন এতটুকু মেদ তার শরীরের ধারেকাছে ঘেঁষতে পারে নি, আর ভবিষ্যতেও পারবেনা, কারণ সেদিনই শুভর কন্যা গুড়িয়ার বড় বড় দীঘল শান্ত চোখে আর মুচকি হাসির মধ্যে প্রত্যক্ষ করলাম শুভর শিশুকালের সেই গতিময় ছায়া।

0 comments: