0

প্রবন্ধঃ মৌসুমী ঘোষ দাস

Posted in


প্রবন্ধ



ভাষা নিয়ে কিছু কথা 
মৌসুমী ঘোষ দাস 


ছোটবেলায় আমরা অনেক কল্প কাহিনী পড়েছি । সেসব কাহিনী নিয়ে এখন প্রচুর কার্টুন ছবিও তৈরি হয়েছে। যেমন ধরা যাক শিশুদের প্রিয় কার্টুন ‘মুংলি’ তৈরি হয়েছে ‘ নেকড়ে গুহায় মানব শিশু’ এই কাহিনিকে নিয়ে । কাহিনীটা এইরকম, একটি ছোট্ট শিশু মা বাবার কাছ থেকে হারিয়ে গিয়ে একটি নেকড়ের গুহায় আশ্রয় পায়। নেকড়ে মা- এর কাছে আর চারটে নেকড়ে শিশুদের সাথেই সে মানুষ হয় । এবং দেখা যায় যে সেই শিশুটি কথা বলতে পারেনা। জঙ্গলের পশুদের ভাষা ছাড়া ‌ কোন মানুষের ভাষা সে জানেনা বোঝে না । টারজানের গল্পটাও কিছুটা এমন ছিল । জঙ্গলে থাকতে থাকতে টারজান শুধু জঙ্গলের পশুদের ভাষা বুঝতে পারে , কিন্তু মানুষের ভাষায় সে কথা বলতে পারেনা বা বোঝেও না। এ তো গেল গল্প কাহিনীর কথা। শোনা যায়, সম্রাট আকবরও একবার একটি শিশু কে বেশ কিছুদিন নিঃসঙ্গ অবস্থায় রেখে পরীক্ষা করে দেখেন যে, শিশুটি মানুষের ভাষায় কথা বলতে শেখে নি। [ সুত্রঃ ভাষার ইতিহাস ভাষাতত্ত্ব / অধ্যাপক তপন কুমার চত্তপাধ্যায় ] 

ভাষা বিজ্ঞানীদের মতে, মানব শিশুরা অনুকরণপ্রিয়। অনুকরণের দ্বারা তারা শব্দ শোনে, শব্দ শেখে, শব্দ বলে। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে একটি শিশু তার আশেপাশে যা শোনে , তাই শেখে। তবে একেবারে ছোট শিশু যারা, তারা মুখে বিভিন্ন রকম অর্থহীন ধ্বনি বা আওয়াজ করে থাকে, যার মর্মার্থ একমাত্র তার মা ই বুঝতে পারেন, সেই ধ্বনিকে কিন্তু ভাষা বলা যায় না। যদিও সেই ধ্বনি বাগ যন্ত্রের সাহায্যেই উচ্চারিত হয়। ছোট মানব শিশু ছাড়াও প্রাণীজগতে অন্যান্য জীবজন্তুদেরও বাগ যন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত ধ্বনি বা আওয়াজ আছে। যেমন , খাবারের সন্ধানে কাকের ডাক, আর একটি কাক দুর্ঘটনাগ্রস্ত হলে অন্য কাকদের কা কা রবে পাড়া মাথায় করা ধ্বনি এক নয়। চোর বা অপরিচিত মানুষ দেখলে গৃহপালিত কুকুরের ঘেউ ঘেউ ধ্বনি , আর তার প্রভুকে দেখলে আদরের কুঁই কুঁই ধ্বনি এক নয়। গাছে পাখির বাসার কাছে কোন প্রানীকে এগোতে দেখলে মা পাখির বাচ্চাদের সতর্ক করে দেওয়ার জন্য তীক্ষ্ণ চিৎকার, আর সঙ্গী বা সঙ্গিনীকে দেখে মিলনের আনন্দে মুখ থেকে বেরনো ধ্বনি বা আওয়াজ এক নয়। যদিও এইসব প্রাণীর ধ্বনি বা আওয়াজ থেকে আমরা মোটামুটি তাদের মানসিক অবস্থার একটা ধারণা করে নিতে পারি। তথাপি এই ধ্বনি বা আওয়াজকে ভাষা বলা যায় না।কারন, এই উচ্চারিত ধ্বনি মনের ভাব প্রকাশ করে না বা সকলের বোধগম্য হয় না। 

সকল প্রাণীর মধ্যে সব চেয়ে উন্নত প্রাণী হল মানুষ। আর এই মানুষ হল সমাজবদ্ধ জীব। মানুষ বুঝেছে সমাজে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে গেলে একে অপরের সাথে মনের ভাব বিনিময় একান্ত প্রয়োজন। আর এভাবেই ধীরে ধীরে ভাষা সৃষ্টি হয়েছে। ভাষাবিদদের মতে, ভাষা হল মনের ভাবপ্রকাশের একটি মাধ্যম। বাগ যন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত ধ্বনি যা মনের সুস্পষ্ট ভাব প্রকাশ করে তাই হল ভাষা । বড়দের চেয়ে ছোট্ট শিশুদের মধ্যে প্রবৃত্তিগত কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে , যার ফলে তারা শিশু বয়সেই প্রথম মাতৃভাষা অর্জন করতে পারে। তাছাড়া যে ভাষা তাদের আশেপাশে বলা হয়, তারা সেই ভাষাই চট করে শিখে ফেলে, এমনকি যদি তাদের পিতামাতা বা পরিবারের কেউ অন্য কোন ভাষাতে কথা বলেন, তা হলে সেই অন্য ভাষাটিও সে শিখে ফেলে। শিশুরা বংশগত ভাবেই এই দক্ষতা নিয়েই জন্মগ্রহণ করে। ছোট্ট ছেলে তিতির সারাদিন টিভিতে কার্টুন দেখে কাটাত। ওর মা একা ঘরে ছেলেকে টিভির সামনে বসিয়ে কার্টুন চালিয়ে ঘরের কাজ সারত, কার্টুন চালিয়ে ছেলেকে খাওয়াত। আর তখন তার প্রিয় কার্টুনের চরিত্রদের মুখে হিন্দি ভাষা শুনতে শুনতে নিজে মুখে আওড়াতে আওড়াতে স্বাভাবিক নিয়মেই তিতির হিন্দি ভাষা শিখে ফেলে। অথচ ওর পরিবারে কেউ হিন্দি জানে না বা বলেও না। মনে পড়ে আমার পাশের বাড়িতে এক তেলেগু পরিবার বাস করতেন। ওদের ছোট্ট বাচ্চা ছেলেটি মাতৃভাষা তেলেগুর সাথে সাথে সুন্দর বাংলা ভাষাও বলতে শিখেছিল। অথচ আমরা বড়রা চেষ্টা করেও দু একটা তেলেগু শব্দ ছাড়া ভাষাটা শিখতেই পারিনি। 

ভাষাবিদদের মতে, যেকোন সুস্থ স্বাভাবিক মানব শিশু পৃথিবীর যেকোন ভৌগোলিক, সামাজিক, জাতিগত বা অর্থনৈতিক পরিবেশে ধাপে ধাপে একাধিক ভাষা শিখে ফেলতে পারে। অবশ্য বয়ঃসন্ধির পরে দ্বিতীয় কোন ভাষা শিখতে মানুষকে অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হয় এবং প্রায়শই সেই ভাষাতে সে উচ্চ স্তরের দক্ষতা অর্জন করতে পারে না। যদিও বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় ভাষা শেখার ওপর জোর দেওয়া হয়, তবুও মাতৃভাষার মত দক্ষতা, অন্য কোন ভাষায় অর্জন করতে সবাই পারে না। মানুষ ছোট বেলায় যে ভাষায় কথা বলতে সবচেয়ে বেশি পারদর্শী, যে ভাষাটি সে তার পিতামাতা বা অভিভাবকের কাছ থেকে ছোটবেলায় শিখেছে, ও যে অঞ্চলে সে বড় হয় সে অঞ্চলে যে ভাষাটি বহুল প্রচলিত, তাকে সাধারণভাবে মাতৃভাষা বলা হয়।

আমরা বাঙালি। আমাদের মাতৃভাষা, প্রাণের ভাষা [?] বাংলা। ভাষাবিদদের মতে, ‘মাগধী অপভ্রংশ’ থেকে বাংলা ভাষার জন্ম। যদিও অনেকে বলেন সংস্কৃত ভাষাই বাংলা ভাষার জননী। সংস্কৃতের সঙ্গে বাংলার শব্দকোষ ও রূপতাত্ত্বিক নিয়মের মিল আছে বলেই হয়তো তাঁরা একথা বলেন। তাছাড়া মধ্য যুগে বাংলা সাহিত্যের ওপর সংস্কৃতের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। তবুও ভাষাবিদদের মতে, সংস্কৃত হল একটি কৃত্রিম ও লেখ্য ভাষা। এ ভাষায় কেউ কখনও কথা বলেনি। যে ভাষায় কেউ কখন কথা বলেনি সে ভাষার কোন পরিবর্তন হয় না। আর পরিবর্তন হয় না বলেই সে ভাষা একটি মৃত ভাষা। মৃত ভাষা কখন কোন ভাষার জন্ম দিতে পারে না। তথাপি বাংলার প্রায় আশি শতাংশ শব্দ সংস্কৃত থেকে জাত। বাংলা ভাষা যে আজ আন্তর্জাতিক মান অর্জন করেছে তার জন্য সংস্কৃতের অবদান কিছুতেই অস্বীকার করা যায় না [সুত্রঃ বাংলা ভাষাতত্ত্ব/ কৃষ্ণ গোপাল রায়]। 

আন্তর্জাতিক ভাষা তালিকায় বাংলা ভাষা পঞ্চম স্থান অধিকার করেছে। অথচ প্রতিনিয়ত আমাদের প্রিয় এই ভাষাটির দূষণ ঘটিয়ে আমরা এর বিশুদ্ধতা নষ্ট করে চলেছি। পৃথিবীর বহু জাতি কেবলমাত্র মাতৃভাষাকে আশ্রয় করে উন্নতি করেছে। স্বয়ং রবিঠাকুর বলেছেন, ‘কোন শিক্ষা স্থায়ী করিতে হইলে, গভীর করিতে হইলে, ব্যাপক করিতে হইলে, তাহাকে চিরাচরিত মাতৃভাষায় বিগলিত করিয়া দিতে হয়’। আর আমরা আমাদের আভিজাত্য দেখানোর জন্য বাংলা বাক্যের সাথে হিন্দি বা ইংরাজি মিশিয়ে কথা বলে গর্ববোধ করি। বুক ফুলিয়ে বলি, সন্তান একটু আধটু বাংলা বলতে পারলেও লিখতে একদম পারে না। মাতৃভাষা বাংলা নিয়ে এই অবহেলা ভবিষ্যতে সমূহ বিপদ ডেকে আনবে না তো? কোনও একটি ভাষা ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৫০ হাজারের কম হলে ওই ভাষাকে বিপন্ন ভাষা হিসেবে চিহ্নিত করেন গবেষকরা। আইসল্যান্ডে মাত্র ২ কোটি ৭৫ হাজার মানুষ যদি মাতৃভাষায় কথা বলে সেই ভাষাটি স্ব মহিমায় বাঁচিয়ে রাখতে পারে, তবে আমরা পারব না কেন? তাই আসুন, আজ এই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে সবাই মিলে আমরা আমাদের মাতৃভাষাকে রক্ষা করার শপথ গ্রহণ করি।

0 comments: