ছোটগল্পঃ তাপসকিরণ রায়
Posted in ছোটগল্প
ছোটগল্প
রমাকান্ত নামা—স্পর্শকাতরতা
তাপসকিরণ রায়
অভিজ্ঞতার অভাব নেই। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে জমতে থাকে জীবনের উপলব্ধি। রমাকান্ত তাঁর জীবনের ঊনসত্তরটা বছর কাটিয়ে দিলেন। এক পুরানো প্রেমিকা এক তোড়া রজনীগন্ধা নিয়ে এসে তাঁর হাতে তুলে দিয়ে বলল, জন্মদিনের অভিনন্দন গ্রহণ করো, রমাকান্ত দা !
ওরে বাবা ! হঠাৎ যেন রমাকান্ত জিয়ে উঠলেন। আজ বহু বছর পেরিয়ে এলো, এই জন্মদিনটির কথা তিনি বেমালুম ভুলে গিয়ে ছিলেন। হাসার চেষ্টা করলেন তিনি, অন্তত মুখের বয়স্ক রেখাগুলি প্রসারিত হল তার।
শ্যামলী, রমাকান্তর জীবন জুড়ে রয়ে গেছে বলতে হয়। মাঝে বেশী কম কয়েকটা বছর ডুব দেয়, আবার ভেসে ওঠে। তবু সে ধরা আছে তাঁর জীবনে, ছুঁয়ে আছে উপলব্ধির তন্তু শিকড়ে। আয়ু পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে , জন্মদিনে সেটা বেশী ভাবে ধরা পড়ে। আবার এটাও ভালো লাগে যখন মনে হয় যে এখনও নিজের লোক বলে পাশে কেউ আছে যে কি না এখনও রমাকান্তকে স্মরণ রাখে !
--কি হল রমা দা, তুমি খুশি হলে না মনে হল? মুখ এমন বেজার করে আছ কেন ? যেন জোর করে হাসতে চেষ্টা করছ ? শ্যামলী বয়সের লাগাম ছেড়ে ঈষৎ শরীর দুলিয়ে বলে উঠলো।
--না, না, ঠিক তা না, জানো তো বয়স আরও একটা আমার বেড়ে গেল !
--বয়সের কথা মনে করতে নেই--দেখ না আমায়, কি সুন্দর হেসে খেলে আছি ?
রমাকান্ত তাকালেন শ্যামলীর দিকে, হ্যাঁ, তা বটে, ষাট বছর ছুঁই ছুঁই কে বলবে ওকে দেখলে ! এখনও রঙ-শাড়ি পরে দিব্বি আছে শ্যামলী, মুখে অবশ্য বললেন, হ্যাঁ, তোমায় দেখলে মনে হয় না--
--কি মনে হয় না ? এখনও পুরুষ টলান চেহারা আছে আমার বলে ?
হাসলেন রমাকান্ত, বললেন, টলানর না হোক, বুড়ো হাবড়াদের নাকানি চুবানি খাওয়াবার মত--
--যা--অমন কাজ আমি করি না--
--এখনও সেই পুরনো রোগটা আছে নাকি তোমার ?
আশ্চর্য হয়ে রমাকান্তর দিকে প্রশ্ন সূচক চোখ তুলল শ্যামলী।
রমাকান্ত নিজের হাতের কব্জি তুলে ধরলেন শ্যামলীর দিকে, শ্যামলীর কামড়ের দাগ এখনও রমাকান্ত ধারণ করে আছেন। সে দিনগুলি ছিল প্রেমিক যুগলের মোক্ষম সময়। রমাকান্ত শ্যামলী সেদিন ছিলেন আলিঙ্গন বদ্ধ। প্রেমের শেষ পর্বের দৃশ্য এগিয়ে আসছিল। রমাকান্ত শ্যামলীর নিষিদ্ধ বলয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, ঠিক এমনি সময় ঘেচাং করে শ্যামলী রমাকান্তর হাতের কব্জিতে দাঁত ফুটিয়ে দিয়ে ছিল। সে কথা বহুদিন আগের--রমাকান্তর প্রাক্ বিবাহ কথা।
শ্যামলী এই বয়সেও সে কথা ভেবে লাজুক হয়ে উঠলো, বলল, সত্যি আমি না--
--এখনও সেই রোগ--
--জানি না--আজ দশ বছর হল আমি নির্লিপ্ত--তবে তোমায় একটা ঘটনা না বলে পারছি না।
--তুমি হয়ত জানো, বিপুল, আমার স্বামী ছিল, যে আমায় ডিভোর্স দিয়ে ছিল, তার কথা বলছি।
--তার সঙ্গে আছ নাকি? কৌতূহলী হলেন রমাকান্ত।
--না, ও জানোয়ারের সঙ্গে কে ঘর করে?
--কেন কি হয়েছে?
--জানো, ও আমায় রেপ করেছে--
আঁতকে উঠলেন রমাকান্ত, বল কি ?
--আমায় একদিন ওর খালি ঘরে ডেকে নিয়ে--
--তুমি কিছু করতে পারলে না ?
--ওর গায়ে বেশ কয়েকবার আমি দাঁত ফুটিয়েছি। আর সে কারণেই ও আমাকে ডিভোর্স দিয়ে ছিল।
--এবার কামড়াতে পার নি? তোমার সে রোগ কি সেরে গিয়ে ছিল ?
--না, তা না, আমার কামড়ের বদলা নেবে বলে বিপুল আগে থেকেই তৈরি ছিল--আমার সঙ্গে একটা দুটো কথা বলেই, আমায় ধরে মুখ বেঁধে খাটে শুয়িয়ে দিয়ে ছিল।
--বল কি! ওর বিরুদ্ধে কেস কর নি ?
--না, ওর প্রতি ঘেন্না এসেছিল বটে, তারপর কিছু দিন যাবার পর যখন দেখলাম প্রেগনেন্সি আসে নি, তখন আমি চুপ করে গেলাম।
রমাকান্ত ক্ষণিকের মাঝে ভেবে নিলেন, বিপুল শ্যামলীকে বিয়ে করেও দীর্ঘ দু বছর প্রেম সুখ নিতে পারে নি, বরং সুখের বদলে শ্যামলীর কামড়টুকুই উপভোগ করে ছিল! আর তাই বুঝি বিপুলের এই পুরুষালি বদলা নেওয়া! মুখে রমাকান্ত বললেন, তারপর ?
--তার আর পর নেই--এখন আমি একা--
রমাকান্ত পরিবেশ সহজ করার জন্যে হেসে বললেন, এখন তুমি একা, আর আমিও একা--
--কি ব্যাপার রমাকান্ত দা ? কৌতুকী চোখ রমাকান্তর দিকে তুলে ধরল শ্যামলী।
বয়স যতই হোক, শরীর এখনও আছে, অনেক অভিজ্ঞতা যে এ দেহ ছুঁয়ে গেছে ! চামড়ায় বয়সের ভাঁজ এলেও, ইচ্ছেগুলি সুপ্ত হলেও তো তা একেবারে মরে যায় নি! যত দিন প্রাণ আছে, তত দিন তপ্ততা থাকবেই--একেবারে শেষ পরিণতি হল ঠাণ্ডা—পূর্ণ স্তব্ধতা। ঊনসত্তর বছরের পূর্ণতার মাঝেও সামান্য আনন্দ যে মনে এসে লাগছিল না তা নয়। কিছুটা উষ্ণতা মন ও শরীরের গভীরতা থেকে উঠে আসছিল বটে। শ্যামলী এখনও তার শরীর কাঠামোয় নরম পেলব ধরে আছে। রং শাড়ি তার দেহে। মুখে তার কিছু আমিষ গন্ধের ছোঁয়া।
--আমি এ বেলাটা তোমার ঘরে আছি, রমা দা!
এই সেরেছে--এই বৃদ্ধ বয়সে আবার না জানি কি অঘটন ঘটে যায় ! রমাকান্ত ভেবে নিলেন, সুপ্ত ঘুমন্ত ভাবনাগুলিকে ধূপ ধুনোর আবেশে কি আবার জাগিয়ে দেওয়া যায় ? হ্যাঁ যায়, অন্তত রমাকান্তর তাই যেন মনে হচ্ছে।
শ্যামলী কোমর কাছিয়ে রান্নায় লেগে গিয়ে ছিল। রমাকান্ত রান্নার ব্যবস্থা সামগ্রী শ্যামলীকে দেখিয়ে দিয়ে একা এসে বৈঠকখানায় বসে ছিলেন। এ সময় রমাকান্তর স্ত্রীর কথা খুব করে মনে পড়ে যাচ্ছিল। স্ত্রী শৈলবালার কথা, সংসার জীবনের কথা। শৈলবালা মারা গেছে তা প্রায় বার বছর পার হয়ে গেছে। তারপর থেকে একেবারে একলাটি তিনি এই পৈত্রিক বাড়িতে পড়ে আছেন। ছেলে বিদেশ থেকে বছরে একবার এসে সপরিবারে কটা দিন এখানে থেকে যায়। সে ক’দিন রমাকান্তর বেশ হই হল্লায় কেটে যায়। নাতনীর সঙ্গে তিনি দস্তুর মত ছোটাছুটি করে খেলে বেড়ান।
এক সময় রান্না স্নান সেরে শ্যামলী রমাকান্তর সামনে এসে দাঁড়ালো। চমকে উঠলেন রমাকান্ত। শ্যামলীর পরনে তাঁর স্ত্রীর পুরনো একটা সাড়ি ! হালকা লাল ছাপার শাড়ি যেটা কিনা শৈলবালা প্রায়ই পরে থাকত। রমাকান্তর খুব পরিচিত ছিল শাড়িটা।
--কি রমা দা, চমকে উঠলে মনে হল? বউ দির শাড়ি পরেছি, তাই ?
--না মানে--রমাকান্ত মুখ ফুটে বলতে পারলেন না যে না, শ্যামলী তুমি কিন্তু এটা ঠিক কর নি--
--কি রমা দা, রাগ হল না কি--তা হলে ছেড়ে আসি--
--না, না, তা না, তোমায় তো শাড়ি চেঞ্জ করতেই হত--
--তা হলে বলছ পরে থাকতে?
রমাকান্তর অস্বস্তি ভাবটা ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছিল। শ্যামলীর দিকে তাকালেই স্ত্রীর কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। শ্যামলীর শরীরের ঢক পদ অনেকটা শৈলবালার মত।
দুপুরে খাওয়া দাওয়া সেরে নিলো দুজনে। শ্যামলী বলল, তুমি বিশ্রাম নাও, আমি যাই--
রমাকান্তর শ্যামলীকে আরও কিছু সময় ধরে রাখতে ইচ্ছে হচ্ছিল। সত্যি কথা বলতে কি আজ তাঁর জন্মদিন। একটা বিশেষ আনন্দের দিন। এ কথা শ্যামলীই তাকে জানালো। সে এক তোড়া রজনী গন্ধা আর এক প্যাকেট মিষ্টি নিয়ে এসেছে। রমাকান্ত মুখ না খুলে পারলেন না, খেয়ে উঠেছ, একটু বিশ্রাম নিয়ে যাও ! এসো আমরা পালঙ্কে বসেই গল্প করি।
রমাকান্তর নাকে পুরনো শাড়ির সোঁদা গন্ধ এসে ঠেকছিল। সে সঙ্গে ঘরে রাখা পাউডারের ভিনি ভিনি খুশবু। ঘুম নয়, কেমন একটা আমেজ আসছিল। রঙিন স্বপ্নের কিছু ছাতা যেন আকাশে উড়ছিল ! রমাকান্ত ফিরে যাচ্ছিলেন অতীতের স্মৃতি পৈঠায়। তারই মাঝে শ্যামলীর ধীর কণ্ঠ ভেসে এলো, কৈ আমায় কেমন লাগছে বললে না তো ?
সেই খেলার আয়োজন, লুকোচুরি খেলা, ছোঁয়া ছুঁই খেলার বেলা, বয়স যেখানে বাঁধন হারা, সমস্ত কর্মযজ্ঞ পেরিয়ে ফুল পাতা ঝরা বৃক্ষের মনন অনুরণন। রমাকান্ত বলে উঠলেন, সুন্দর, খুব সুন্দর লাগছ তুমি, ঠিক যেন--রমাকান্ত থেমে গিয়ে ছিলেন।
শ্যামলীর আবেশ গলা, ঠিক যেন--বল--বল--
ধীর লয়ে রমাকান্ত বলে উঠলেন, ঠিক যেন আমার শৈলবালার মত !
এরপর দুজনে খানিক নীরবতার মাঝে বসে থাকলো। আস্তে আস্তে রমাকান্ত এগিয়ে গেলেন শ্যামলীর দিকে। নীরবতা ভেঙ্গে যেন বাতাসের মাঝে রমাকান্ত কথা ভাসিয়ে দিলেন, তুমি কি আমার শৈলবালা ? বৃদ্ধ বৃক্ষেও তো সবুজ পাতার উদ্গম হতে পারে, দু একটা রঙিন ফুল সেখানেও তো ফুটে উঠতে পারে! ওদের ক্ষণিক শব্দ বিনিময়ের সংলাপ তৃতীয় ব্যক্তির কাছে বড় দুর্বোধ্য মনে হবে। অনেকটা সময় ওরা শুধু পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকলো। শান্ত দুটি প্রাণ কেবল আভ্যন্তর অনুভূতিতে ডুবে যাচ্ছিল। ওরা নিজেদের অজান্তে একে অন্যকে বৃক্ষ লতার বেড়ে নিলো। ওরা অতীতকে খুঁজে ফিরছিল। কারও মাঝে তীক্ষ্ণ ভাবনা নেই--মৌমাছির মাঝে ফুল বিদ্ধ করার মনোভাবনা নেই।
0 comments: