0

প্রবন্ধঃ সুধাংশু চক্রবর্ত্তী

Posted in


প্রবন্ধ


(বাংলা) ভাষা ও বাংলা সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস 
সুধাংশু চক্রবর্ত্তী





মানুষের সবচেয়ে কালান্তকারী আবিষ্কার :

মানুষের সব চেয়ে কালান্তরকারী বিবর্তন হলো – কথা ও লিখিত ভাষার বিবর্তন । যার ফলে আমাদের পক্ষে ভাবের আদানপ্রদান করা, হাজার হাজার মাইল দূরে থাকা প্রিয়জনদের চিঠি লেখা এবং কয়েকশো বছর আগে মৃত লেখকের লেখা পড়ে তাঁর বক্তব্য উপলব্ধি করা সম্ভব হয়েছে । মধ্যপ্রদেশের ভীমভেটকা,ফ্রান্সের লাসকা,স্পেনের আল্‌তামিরা প্রভৃতি জায়গায় গুহার ভিতর বিশ-ত্রিশ হাজার বছরের পুরনো মানুষের হাতে-আঁকা অপূর্ব ছবির মধ্যে দিয়েই আমাদের দাগ কাটা ভাষার জন্ম হয়েছে । এই ধরণের ছবিই ক্রমশ সরলতর হয়ে অনেক সময় প্রাথমিক মানে বদলে গিয়ে মানে-হীনও হয়ে পড়েছে । এই অসাধারণ মানে-হীনতার মধ্য দিয়েই অক্ষরের সৃষ্টি হয়েছে আমাদের জীবনে । যেমন – গরু লেখার জন্য প্রথমে গরুর মুখ আঁকা হয়েছিলো । সেই মানেই বদলে যে লিপি তৈরি হলো তা আর গরু লেখার জন্য ব্যবহারই হয় না । উপরন্তু সেই লিপি থেকে A বা a অন্যান্য হাজার শব্দের জন্ম হলো । এই ধরনের সাধারণ মানে-হীনতার জন্য এই লিপি ব্যবহার করে বিভিন্ন শব্দ লেখা শুরু হলো । যেমন – 



সাধারণ মানে-হীন লিপি ব্যবহার করে বিভিন্ন শব্দ লেখা শুরু হলো । আবার শব্দ যোগ করে বাক্য তৈরি হলো । এক-একটা বাক্য এক-এক ধরণের মানের বোঝা বহন করে । ক্রিয়াই বাক্যের গমন-শক্তির উৎস । আমাদের ছয় ইন্দ্রিয়ের মধ্যে চোখের দেখা এবং সেই দেখার মাধ্যমে যে ভাবের আদান-প্রদান,মানের বিনিময়, সেটাই প্রধান । প্রত্যেক ইন্দ্রিয়ের নিজস্ব এক-একটা সংকেতময় জগৎ আছে । তার ব্যবহার এবং ব্যাখ্যা দিয়ে আমরা এক ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ গড়ে তুলেছি । তাই কথা বলার সময় হাত নেড়ে, শরীর দুলিয়ে, চোখ নাড়িয়ে অনেক ভাব প্রকাশ করে থাকি । লেখার সময়ও ম্যাপ,ডায়াগ্রাম,ছবি ইত্যাদি ব্যবহার করে মনের কথা বোঝানোর চেষ্টা করি । তবুও অনেক কিছুই ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয় । যেমন,কোনো দুর্ঘটনায় মৃত ব্যক্তির নিকটজনের বিয়োগ-ব্যাথা বা তাঁর বুক ফাটা কান্নার সীমাহীন আকুলতা কোনোমতেই ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয় । আবার কোনো বস্তু বা বিষয় কতটা ভালো লাগছে তাও পুরোপুরি ভাষায় বোঝানো সম্ভব নয় ।

হাজার হাজার বছর আগে মানুষ পাহাড়ের গুহায় দোয়ালে দাগ কেটে তাদের মনের চিন্তার ছবি এঁকেছিলো । এ রকম ছবিরই বিবর্তন হয়েছে আজকের হরফে । বাংলা বা দেবনগরী হরফ ‘ক’-এর বিবর্তন একধরনের যোগ-চিহ্ন থেকে হয়েছে । যেমন –



প্রায় সমস্ত হরফের শুরুই হয়েছে ছবি থেকে । ছবি থেকে রোমান হরফও এসেছে । দাগ কাটা এবং দাগ কাটার মাধ্যমে ভাষা প্রকাশের মূল কারণই হলো অন্য মানুষের সঙ্গে এক ধরণের একাত্মীকরণ, শ্রদ্ধা ও দরদ – অন্য মানুষকে নিজের মনের কথা বোঝানোর চেষ্টা ।



বাংলাভাষার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস :

বাংলা ভাষার বয়স হাজার বছরের ওপর । এর সাহিত্যও অত্যন্ত ঐশ্বর্যমণ্ডিত । পৃথিবীর প্রায় সাড়ে সাত হাজার ভাষার মধ্যে বাংলা হলো পঞ্চম অথবা ষষ্ঠ বৃহত্তম ভাষা । বাংলা ভাষা মূলত সংস্কৃতের সন্তান হলেও বাংলা ভাষার মধ্যে তথ্য সংস্কৃতির মধ্যে এমন সব অজস্র শব্দ মিশে আছে যাদের সংস্কৃত বলে ভুল হয় । আসলে সেগুলো প্রাক-আর্য-অষ্ট্রিক-দ্রাবিড় অথবা ভোট-তিব্বতিয় ও মন-খুমের উৎস থেকে গৃহীত । স্বাভাবিক কারণেই সংস্কৃতে গৃহীত হওয়ার কালে সেগুলোর রূপ বা আকার সংস্কৃতায়িত হয়েছে মাত্র । যেমন বাংলা ভাষায় বহুল ব্যবহৃত - লিঙ্গ,কুড়ি,পণ,নোড়া,খাঁকার,ঠেঙ,ছোট,ঝাড়,চোঙ ইত্যাদি শব্দসমূহ অষ্ট্রিক উৎস থেকে এসেছে । আবার একান্ত সংস্কৃত বলে মনে হওয়া শব্দ যথা - অণু,কামার,কলা কুণ্ড,নানা,নীল,পুষ্প,সায়ম-কাল,পুকুর,ফেণা ইত্যাদি সবই দ্রাবিড় ভাষা সমুহের অবদান । আবার নাথ,তিস্তা ইত্যাদি সবই ভোট-তিব্বতীয় । এমনকি কোল-সাঁওতাল ‘দ্যা্‌’(জল) সংস্কৃতের বহুল ব্যবহৃত ‘ক’, ‘কা’ প্রত্যয় যোগে ‘দ্যা্‌’>দ্যা্‌ক>উদক (জল)-এ রূপান্তরিত হয়েছে বলে ইতিহাসকার নীহাররঞ্জন রায় লিখেছেন । 

এসব আদিবাসী জাতি-সত্তার অসংখ্য শব্দ সংস্কৃতায়িত হয়ে বাঙলার অজস্র স্থানের নামের সাথে জুড়ে রয়েছে । যেমন করে অষ্ট্রিক ‘সাঁকো-টিকর’ দ্রাবিড় ‘দামল-লিত্তি’ যথাক্রমে ‘শক্তিগড়’ ও ‘তাম্রলিপ্ত’ হয়ে গৃহীত হয়েছে । গুড়ি (শিলিগুড়ি), জোড় (মুলাজোড়), জুড় (ডোমজুড়), দহ (শিয়ালদহ), জুলি (নয়নাজুলি), হাট ((রামপুরহাট), হাটি (বামনহাটি) ইত্যাদি নামগুলি অষ্ট্রিক-দ্রাবিড় নামেরই অবশেষ । অষ্ট্রিক শব্দ দাম+দ্যা্‌ক বর্তমানের দামোদর নদ হয়েছে । কব+দ্যা্ক হয়েছে কপোতাক্ষ নদী । ভোট-তিব্বতীয় ‘দিস্তাং > তিস্তা > ত্রিস্রোতা হয়ে সংস্কৃতায়িত হয়েছে । আর্যদের সংস্কৃত ভাষার ‘সংস্কৃত’ শব্দের অর্থই হলো – যা কিছু অনার্য শব্দকে সংস্কার করে গৃহীত হয়েছে তাই সংস্কৃত । খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০ অব্দ পর্যন্ত বঙ্গীয় এলাকায় বসবাসকারী বাঙালীদের ভাষা ছিলো প্রাকৃত ভাষা । শেষ পর্যায়ে আর্যদের সংস্কৃত ভাষার মিশ্রণের কাজ শুরু হয়েছিলো । সমসাময়িক কালে বৌদ্ধ ধর্ম এসে আছড়ে পড়েছিলো বঙ্গীয় ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় । তখন স্বয়ং গৌতম বুদ্ধের নির্দেশে পোশাকি পালি ভাষার জন্ম হলো । খ্রিষ্টপূর্ব ২০০ অব্দ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০ অব্দ পর্যন্ত পালি ভাষা এবং সংস্কৃত বিবর্জিত প্রাকৃত ভাষা বিশেষ প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিলো ।

ভাষাবিদদের মতে, মাগধী প্রাকৃত হচ্ছে বাংলা ভাষার আদিপুরুষ । বাস্তবে তখনও বাংলা ভাষার জন্ম হয়নি । এরপর ৬০০ খ্রিষ্ট থেকে ১০০০ খ্রিষ্ট পর্যন্ত গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চলের জনগোষ্ঠী কোনো রকম ব্যাকরণের নিয়ম-কানুননের তোয়াক্কা না করে মাগধী প্রাকৃত ভাষার ব্যবহার শুরু করে । এই সময়কালকে ‘অপভ্রংশ যুগ’ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে । বঙ্গীয় অঞ্চলের বৌদ্ধ পাল বংশের আমলেই সংস্কৃত-প্রাকৃত-অপভ্রংশের খোলাস ছেড়ে খ্রিষ্টীয় দশম শতাব্দীতে বাংলা ভাষার জন্ম হলো । সংস্কৃত পণ্ডিতেরা একেই মাগধী অপভ্রংশ বাংলা হিসাবে চিহ্নিত করেছেন । খ্রিষ্টীয় দশম শতাব্দী থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত কালকে চার্যপদের যুগ হিসাবে অবহিত করা হয় । চর্যাপদের পুরো নাম হলো ‘চর্যাচর্য বিনিশ্চয়’ । বিশিষ্ট ভাষাবিদ ও পণ্ডিতেরা মত প্রকাশ করেছেন যে, সবদিক বিবেচনা করে ‘চর্যচর্যাবিনিশ্চয়’-কেই আদি যুগের বাংলা সাহিত্যের একমাত্র নির্ভরযোগ্য ও প্রামাণিক নিদর্শন বলে গ্রহণ করা যায় । প্রখ্যাত ভাষাবিদ ও পণ্ডিত মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯০৭ সালে নেপালের রাজদরবারে হাজির হন পুঁথির সন্ধানে । তিনি এখানেই আবিষ্কার করেন বৌদ্ধ ভিক্ষুদের প্রাচীন বাংলা অক্ষরে লেখা অমূল্য সম্পদ ‘চর্যাচর্যবিনিশ্চয়’ বা চর্যাপদ । প্রকৃতপক্ষে ‘সন্ধ্যাভাষা’ নামে হেঁয়ালিভাষায় এসব চর্যাপদ রচিত হয়েছে । সেকারণেই চর্যাপদের ভাষা বেশ দুর্বোধ্য ও রহস্যময় । 

বাংলা ভাষার ইতিহাস ঘাঁটলে লক্ষ্য করা যায়, এই ভাষা মাতৃজঠরে অবস্থান করছিলো প্রায় ১২০০ বছর পর্যন্ত । খ্রিষ্টপূর্ব ২০০ অব্দের পালি ভাষা । খ্রিষ্টপূর্ব ২০০ অব্দ থেকে ৬০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সংস্কৃত বিবর্জিত প্রাকৃত ভাষা । ৬০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১০০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বৌদ্ধ পাল রাজাদের আমলের মাগধী অপভ্রংশ ভাষা । এই সময় কালকেই ‘বাংলাভাষার মাতৃজঠরে অবস্থানের যুগ’ বলা যেতে পারে । বাংলাভাষার ইতিহাসবিদ্‌দের মতে বৌদ্ধ পাল বংশের আমলে অর্থাৎ খ্রিষ্টীয় দশম শতাব্দীতে সংস্কৃত প্রাকৃত অপভ্রংশের খোলস ছেড়ে যে-সময়ে বাংলাভাষা ভূমিষ্ট হলো সে-সময় থেকেই বাংলাভাষার সূচনা হলো । তাও হাজার বছর আগে । ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাভাষার ইতিহাসকে চারটি পর্যায়ে বিভক্ত করা যেতে পারে । প্রথমতঃ খ্রিষ্টপূর্ব ২০০ অব্দের পালিভাষা থেকে দশম শতাব্দীর বৌদ্ধ পাল রাজাদের আমল পর্যন্ত ‘বাংলাভাষার বিস্মৃতির যুগ’ । দ্বিতীয়তঃ খ্রিষ্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত বিস্তৃত যুগ হলো ‘আদি যুগের বাংলাভাষা বা প্রাচীন বাংলাভাষা’ । তৃতীয়তঃ খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ‘মধ্যযুগের বাংলাভাষা’ । চতুর্থতঃ ইংরেজ আমল । সেসময়ে ইংরেজি, ফরাসী আর পর্তুগিজ শব্দ সম্ভার বাংলাভাষায় স্থান পেলো । বাংলাভাষা ও সাহিত্য নতুন খাতে বইতে শুরু করলো । 



বাংলা সাহিত্য :

একটা লোকের চিন্তা, ভাবধারা ও পারিপার্শ্বিক জগতের ঘটনাসমূহ পর্য্যবেক্ষণ করে যখন ভাষায় লিপিবধ করা হয়, তখন তাকে বলা হয় সাহিত্য । সাহিত্যের মধ্যে আমরা সমাজতত্ত্বের মাপকাঠি দিয়ে প্রত্যেক যুগের কৃষ্টির পরিচয় পেতে পারি । এইজন্য সাহিত্যে সনাতনধারা বা অখণ্ড বস্তু বলে কিছু নেই । জাতীয় জীবনের প্রত্যেক যুগের চিত্র আমরা সাহিত্যের মধ্যে অঙ্কিত হতে দেখি ।

সাহিত্যের মধ্যেই সমাজতত্ত্বের সন্ধান পাওয়া যায় । আবার সাহিত্যের বড় অবদান হলো ভাবপ্রচার । একেই বলা হয় সাহিত্যের ‘আক্টিভ রোল’ । সকলে স্বীয় চিন্তার ধারাকে মাতৃভাষায় লিখে জনসমাজে প্রচার করার চেষ্টা করে সেই বিষয়ে একটা সাহিত্য সৃষ্টি করেন । তাই যে সমাজে যত সংঘর্ষ সেই সমাজে ততই সাহিত্যের নানামুখী বিকাশ দেখা যায় । সমাজে যেমন কোনো সনাতন ধারা নেই সাহিত্যেও তেমন কোনো সনাতন ধারা নেই । সাহিত্য একটা নির্দিষ্ট যুগ বা সামাজিক গণ্ডী বা চিন্তাধারার মধ্যে আবদ্ধ থাকতে পারে না । বাংলা সাহিত্য ১০০০ বছরেরও পুরনো । গৌড় প্রাকৃত নানা অভিব্যক্তির মধ্যে দিয়ে বাংলাভাষা আকার ধারণ করেছে । ঐতিহাসিকেরা বাংলার সঠিক ইতিহাস খ্রিঃ ৭ম শতকের শশাঙ্ক ও নরেন্দ্র গুপ্ত থেকে আরম্ভ করেন । 

বাঙলার মানুষ এবং বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির উন্নতিকল্পে জেমস লং-এর ভূমিকা বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে আছে । তিনি দৃঢ় ভাবেই বিশ্বাস করতেন মাতৃভাষাই শিক্ষার উপযুক্ত বাহন । জেমস লং বাংলায় সমাজবিজ্ঞান চর্চায় পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন । উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে জেমস লং প্রবাদ সংগ্রহে ব্রতী হয়ে নবীনচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ও রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সহায়তায় প্রবাদগুলি তিন খণ্ডে প্রকাশ করেন । ১৮৫০ সালে ঠাকুরপুকুরে একটা প্রাইমারি স্কুল স্থাপন করে সেখানেই বসবাস করতে থাকেন । এই সময় থেকে শুরু হয় তাঁর বাংলাভাষা-সাহিত্য নিয়ে বহুমুখী চর্চা । তিনি কলকাতায় একটি বাংলা বইয়ের লাইব্রেরি গড়ে তোলেন । ১৮৫১ সালে কলকাতায় ‘বঙ্গভাষানুবাদক সমাজ’ স্থাপিত হয় । জেমস লং এই সমাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন ঘনিষ্ঠভাবে । ১৮৫২ সালে প্রকাশ করেন তাঁর প্রথম পুস্তকতালিকা ‘গ্রন্থাবলী’ । তিনি তাতে ১০৪৬টি বাংলা বইয়ের কথা উল্লেখ করেছেন । 

উনিশ শতকের বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্পর্কে আগ্রহীজনের কাছে এর মূল্য অপরিসীম । ভার্নাকুলার লিটারেচার কমিটির লাইব্রারীতে রক্ষিত ৯৫৪টি বই ও পত্রপত্রিকার তালিকা প্রস্তুত করতে গিয়ে জেমস লং লক্ষ্য করেন প্রচুর বই ফরাসী ও উর্দু মিশিয়ে একটি বিচিত্র ভাষারীতিতে লেখা হয়েছে । তিনি এটাও লক্ষ্য করলেন বইগুলি কলকাতা ও ঢাকার মুসলমান সমাজে খুবই জনপ্রিয় । তিনি বিচিত্র এই ভাষারীতির নাম দেন ‘মুসলমানি বাংলা’ । ১৮৫২ সালে ‘ফ্রেন্ড অফ ইন্ডিয়া’য় ‘মুসলমান বেঙ্গলি লিটারেচার’ নামে যে-লেখাটি তিনি প্রকাশ করেন তাতে এই বিচিত্র ভাষায় লেখা ছত্রিশটি বইয়ের সংক্ষিপ্ত বিবরণ পাওয়া যায় । ১৮৫৩-৫৪ সালে সরকারের অনুরোধে তিনি কলকাতার বিভিন্ন ছাপাখানা থেকে প্রকাশিত বই-পত্রের একটি তালিকা প্রস্তুত করে প্রকাশ করেন । এই কাজে তাঁকে কলকাতার বিভিন্ন ছাপাখানায় ঘুরে ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করতে হয়েছে । বাংলায় বই ছাপার কাজ শুরু হবার প্রায় সূচনাকাল থেকে প্রকাশিত বইগুলির তালিকা প্রকাশ করে জেমস লং সেগুলিকে চিরতরে হারিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করেন । এই তালিকা প্রকাশনার পেছনে তাঁর একটাই উদ্দেশ্য ছিলো । তিনি বলেন, দেশীয় প্রকাশনার দিকে জনসাধারণ বিশেষ করে সরকারী কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণই ছিলো তাঁর উদ্দেশ্য – কারণ এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে দেশীয় ভাষাশিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি । 



প্রাচীন কালের পুঁথি ও তার লিখন পদ্ধতি :

মানুষ তার মনের ভাব প্রকাশ করে লিখিত, খোদিত বা অঙ্কিত সাংকেতিক চিহ্নসমূহের মাধ্যমে যাকে বলা হয় লিপি । বাংলাসহ ভারতীয় উপমহাদেশের প্রায় সব লিপিই ‘ব্রাহ্মীলিপি’ থেকে উদ্ভব হয়েছে । এই ‘ব্রাহ্মীলিপি’ ক্রমবিবর্তনের মধ্য দিয়ে নাগরী / দেবনাগরী ও বাংলা লিপিতে রূপান্তরিত হয়েছে । আবার পুঁথি হলো সেই মাধ্যম যার মাধ্যমে পুরোনো আমলে কবি বা লেখকের জ্ঞানানুশীলনের যাবতীয় সম্ভার লিখিত রূপ পেতো । লেখকের লিখিত গ্রন্থটিকে বলা হতো মূল পুঁথি যা হাতে লেখা হতো । মূল পুঁথি থেকে এক বা একাধিক প্রতিলিপি লেখা হতো । তারপর প্রতিলিপিগুলি থেকে আরও অনেক প্রতিলিপির উদ্ভব হতো । প্রাচীন কালে হাতে লেখা পুঁথিকে বলা হতো ‘পুস্তক’ । পুঁথি প্রথম দিকে চামড়া’র উপর লেখা হতো বলে প্রাচীন কালে সাহিত্যকৃতিকে ‘পুস্তক’ বলা হতো । ‘পুস্তক’ সংস্কৃত শব্দ । ‘পুস্তক’ শব্দ এসেছে ‘পোস্ত’ বা ‘পুস্ত’ শব্দ থেকে । ‘পোস্ত’ শব্দের অর্থ চামড়া । প্রাচীন কাল থেকেই ভারতবর্ষে পুঁথির প্রচলন ছিলো ।

পুঁথি সাধারণত দুই ধরনের হয়ে থাকে – (১) আদর্শ পুঁথি বা মূল পুঁথি – যা লেখক স্বহস্তে লিখতেন । এই পুঁথি খুবই বিরল ।

(২) অনুলিখিত পুঁথি বা প্রতিলিপি – আদর্শ পুঁথি থেকে লিপিকরের দ্বারা লিখিত এক বা একাধিক প্রতিলিপিই হলো অনুলিখিত পুঁথি । আবার অনুলিখিত পুঁথি’ও তার প্রকৃতি অনুযায়ী তিন ধরনের হয়ে থাকে – (ক) ‘সুরক্ষিত প্রতিলিপি’ যা লিপিকর সতর্কতার সঙ্গে অনুলিখন করে থাকেন । (খ) ‘অরক্ষিত প্রতিলিপি’ যা লিপিকর স্বাধীনভাবে অনুলিখন করে থাকেন এবং (গ) ‘সংশোধিত প্রতিলিপি’ যাতে লিপিকর সংশোধন চিহ্ন প্রয়োগ করে শুদ্ধপাঠ রচনা করেন । পুঁথি লেখার কাজে বিভিন্ন উপকরণ ব্যবহৃত হতো । যথা - শিলালিপি, তাম্রলেখ, মৃৎফলক, তালপাতা, গাছের ছাল, তুলট কাগজ, কাপড়, চামড়া, কাঠের তক্তি ইত্যাদি । প্রাচীন যুগে পুঁথি লিখন কার্যে সীলমোহর, তাম্রফলক, ধাতবপাত, পাথর, পশুচর্ম, কাষ্ঠফলক, ইট, কার্পাস, কাপড় ইত্যাদি উপকরণ ব্যবহৃত হতো । তবে বর্তমানে যে সমস্ত পুঁথি পাওয়া গেছে সেগুলি তালপত্র, ভূর্জপত্র, তেরেটপত্র, কদলীপত্র, বৃক্ষবল্কল, তুলট কাগজ, হাতে তৈরি পাতলা মাড়ের কাগজ ইত্যাদি উপাদানে প্রস্তুত । পুঁথি লেখার কাজে তিনটি উপকরণ ব্যবহৃত হতো । যথা - লেখপত্র, লেখনী এবং কালি ।

লেখপত্র : এতে লেখা হতো । বিভিন্ন ধরণের লেখপত্র ব্যবহৃত হতো । যথা - ১) শিলালিপি, ২) ধাতবপাত, ৩) কাষ্ঠফলক, ৪) ইট, ৫) সুতি কাপড় বা কার্পাস কাপড়, ৬) পশুচর্ম , ৭) ভূর্জপত্র, ৮) তালপত্র, ৯) বৃক্ষবল্কল এবং ১০) কাগজ ।

লেখনী : ভারতবর্ষে লিখন পদ্ধতির প্রচলনের সঙ্গে সঙ্গে বাঁশের কঞ্চি, শর, ময়ুর বা শকুনের পালক, ধাতব লেখনী, মোটা ঘাস, খাগ ইত্যাদি উপাদানের অগ্রভাগ সরু করে বা সূচালো করে কলম তৈরি করা হতো । 

কালি : হাতে লেখা পুঁথিতে সাধারণত কালো কালি ব্যবহৃত হতো । কালি তৈরীর উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হতো শিমুল গাছের ছাল, ছাগলের দুধ, তেল, লাক্ষা, লোহার গুঁড়ো, মাদার কাঠের কয়লা, জবার কুঁড়ি, গাবের ফল, হরীতিকী, আমলকী, বাবলা গাছের ছাল, জাটির রস, কচি ডালিমের রস, অর্জুন গাছের ছাল প্রভৃতি । কখনো কখনো চাল পুড়িয়ে ভূষাকালি তৈরী করা হতো । লোহার গুঁড়ো মিশিয়ে কালিকে উজ্জ্বল করা হতো । আতপচাল মাটির হাঁড়িতে ভেজে গুঁড়ো করে লাউয়ের ডগার রস ও জল মিশ্রিত করে স্বল্প ব্যয়ে স্বল্পমেয়াদী কালি তৈরী করা হতো । লেখার সময় বেশী কালি পড়ে গেলে বালির পুটলি ব্যবহার করা হতো অতিরিক্ত কালি শুষে নেওয়ার জন্য । 



বাংলা অভিধান :

বাংলা ভাষার পরিবর্তনের ইতিহাস জানার মস্ত একটা হাতিয়ার হলো বিবর্তনমূলক অভিধান । এমন এক অভিধান যাতে থাকে শব্দের চেহারা এবং তার অর্থের বিবর্তন । বাংলা ভাষার কোনো বিবর্তনমূলক অভিধান রচিত হয়নি । অথচ রোমান হরফে প্রথম বাংলা অভিধান ছাপা হয়েছিলো ১৭৪৩ সালে - ২৭২ বছর আগে । ইংরেজি-বাংলা প্রথম অভিধান প্রকাশিত হয় ১৭৯৩ সালে । তারপর ১৭৯৯ ও ১৮০১ সালে হেনরি পিটস ফরস্টার দুই খণ্ডে যথার্থ ইংরেজী-বাংলা এবং বাংলা-ইংরেজি অভিধান প্রণয়ন করেন । বাংলায় লেখা প্রথম বাংলা অভিধান রচনা ও প্রকাশ করেছিলেন রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ ১৮১৭ সালে । তারপর থেকে অন্তত শ’দুয়েক ছোটবড় অভিধান প্রকাশিত হয়েছে । সেসব অভিধানে আছে প্রচলিত-অপ্রচলিত এবং বাংলা-অবাংলা শব্দ, শব্দের এক বা একাধিক অর্থ, আর শব্দগুলোর পদ পরিচয় । কোনো কোনো অভিধানে শব্দগুলো কীভাবে প্রয়োগ করা হয় অথবা প্রয়োগ করতে হয় তার দৃষ্টান্তও দেওয়া আছে । অনেক অভিধানে দেওয়া আছে এসব শব্দ কীভাবে পূর্ববর্তী লেখকরা ব্যবহার করেছেন । শুধুমাত্র তৎসম শব্দের অভিধান, ব্যুৎপত্তির অভিধান, আঞ্চলিক ভাষার অভিধান, বাংলা ভাষায় বিদেশি শব্দের অভিধান, স্ল্যাং-এর অভিধান, অপরাধজগতে প্রচলিত শব্দের অভিধান ইত্যাদি বিচিত্র ধরনের অভিধান প্রকাশিত হলেও বাংলা ভাষায় ‘অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারি’র মতো অভিধান আজও রচিত হয়নি, যাতে বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত তাবৎ শব্দ আছে । কীভাবে শব্দগুলোর অর্থ এবং বানান ধীরে ধীরে বদলে যায়, কোনো বাংলা অভিধানেই তা দেওয়া নেই । 

বাংলা ভাষায় প্রথম ব্যাকরণ রচনা করন রামমোহন রায় ( ১৭৭৪- ১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দ) । পুস্তকটি ১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দে ‘কলিকাতা স্কুল বুক সোসাইটি’ প্রকাশ করে । রামমোহন রায় তাঁর পুস্তকে খোদ ভাষাটিকে প্রায় সার্বজনীনভাবে ‘গৌড়ীয় ভাষা’ বলে উল্লেখ করেছেন । সেন-রাজত্বের আমলে ব্রাহ্মণ্যবাদ প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই বর্ণহিন্দুর দৃষ্টিতে প্রাকৃতের মধ্য দিয়ে উদ্ভুত স্থানীয় ভাষা ঘৃণার্থে শুধুমাত্র ‘ভাষা’ বলেই অভিহিত হয়েছে (অষ্টাদশ পুরাণানি রামস্য চারতানি চ ভাষায়াং মানবঃ শ্রুত্বা রৌরবং নরকং ব্রজেৎ) । রামমোহন রায় নিজের পুস্তকে কয়েকবার বিক্ষিপ্তভাবে ভাষাটিকে ‘বঙ্গভাষা’ বলে উল্লেখ করেছেন কিন্তু বাঙলা ভাষা বলে তাকে সম্বোধন করেননি । হ্যালহেড সাহেবের বাঙলা ভাষার ব্যাকরণ লেখা হয়েছিল রোমান হরফে ।

সুবল মিত্রের ‘সরল বাঙ্গালা বাংলা অভিধান’ প্রকাশিত হয়েছিলো ১৯০৬ সালে । এবং জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের ‘বাঙ্গালা ভাষার অভিধান’ প্রকাশিত হয় ১৯১৭ সালে । হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ অভিধানটির কাজ শুরু করেছিলেন ‘অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারি’ প্রকাশিত হওয়ার প্রায় দু’দশক আগে । কিন্তু তাঁর সেই অভিধানের শেষ খণ্ডটি প্রকাশিত হয় ১৯৪৬ সালে । জ্ঞানেন্দ্রমোহন ও হরিচরণ – উভয়েই শব্দগুলোর সম্ভাব্য ব্যুৎপত্তি ও যতদূর সম্ভব অর্থান্তর দিয়েছিলেন । কিন্তু তাঁদের প্রভূত পরিশ্রম এবং আন্তরিক নিষ্ঠা সত্ত্বেও সেই অভিধানে অনেক অপূর্ণতা থেকে গেছে । জ্ঞানেন্দ্রমোহনের ‘বাঙ্গালা ভাষার অভিধান’-এ শব্দের সংখ্যা প্রায় এক লাখ পনেরো হাজার । জ্ঞানেন্দ্রমোহনের অভিধান প্রকাশিত হবার পর প্রায় একশো বছর পার হয়ে গেছে এবং হরিচরণের অভিধান প্রকাশিত হয়েছে আশি বছর আগে । ইতিমধ্যে হাজার হাজার নতুন শব্দ, বিশেষ করে যৌগিক শব্দ তৈরি হয়েছে । ব্যাকরণ সিদ্ধ নয়, এমন হাজার হাজার যৌগিক শব্দও তৈরি হয়েছে । তাছাড়া বিচিত্র ব্যবহারের মাধ্যমে শব্দের অর্থান্তরও বৃদ্ধি পেয়েছে । হারিয়ে যাওয়া হাজার হাজার শব্দও আবিষ্কৃত হয়েছে অজানা ভাণ্ডার থেকে । গত একশো বছরেরও বেশি সময় ধরে নিরন্তর গবেষণা করে পণ্ডিতেরা মধ্যযুগের বিপুল কাব্যসাহিত্য এবং আঠারো শতকের ক্রমবিকাশশীল বাংলা গদ্যের প্রচুর উপাদান আবিষ্কার করেছেন । গত এক শতাব্দীতে বাংলা শব্দসংখ্যা বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে ।

১৯৪৭ সালে দেশভাগ এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে অভ্যুদয়ও বাংলা ভাষার ওপর বিপুল প্রভাব বিস্তার করেছে । কলকাতাকেন্দ্রিক প্রামাণ্য ভাষায় বহু পুর্ববঙ্গীয় শব্দ গৃহীত হয়েছে । শব্দের অভিধানও বদলেছে । জ্ঞানেন্দ্রমোহন এবং হরিচরণ যে-ভাষার অভিধান রচনা করেছিলেন, সেই বাংলা ভাষা আর এখনকার বাংলা ভাষা ঠিক এক নয় । হরিচরণ তাঁর শব্দকোষে সংস্কৃত ভাষার প্রতি যে-গুরুত্ব দিয়েছিলেন, বাংলা ভাষার চর্চায় তার প্রাসঙ্গিকতাও এখন অনেকটাই হারিয়ে গেছে । বাংলা বিবর্তনের ধারায় কয়েকটি তরঙ্গ লক্ষ্য করা যায় । যেমন চর্যাপদ এবং শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ভাষা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, তা সংস্কৃতানুগ নয় । ফলে সংস্কৃত থেকে সে ভাষা অনেক দূরে সরে গিয়েছিলো । অথচ ষোড়শ শতাব্দীতে যে বিশাল বৈষ্ণব সাহিত্য রচিত হয়, তা সংস্কৃত ও সংস্কৃত থেকে আগত শব্দে ভরা । মুঘল আমলের রাজভাষা হলেও, ফারসির প্রভাব বাংলা ভাষায় পড়েছিলো সীমিত পরিমাণে । তার প্রধান কারণ জনপ্রিয় বৈষ্ণব সাহিত্য এবং বৈষ্ণব ধর্ম বাংলা ভাষাকে ফারসির হামলা থেকে দূরে সরিয়ে রাখে ।



এরপর বাংলা ভাষাকে আঘাত করে আঠারো শতকের দ্বিতীয় ভাগে শাসনকর্তা বদলে যাওয়ায় । ১৭৭০-এর দশকেই মুসলমান-শাসকদের সরকারি ভাষা ফারসিকে দূর করার একটা বিকল্প হিসেবে ইংরেজরা বাংলা ভাষাকে পৃষ্ঠপোষণা দিতে আরম্ভ করেছিলো । তাছাড়া সরকারি কাজকর্ম ক্রমবর্ধমান মাত্রায় কাগজভিত্তিক হওয়ায় নতুন নতুন শব্দ আমদানি করার এবং সংস্কৃত ভাষাভিত্তিক পরিভাষা সৃষ্টি করার প্রয়োজনও দেখা দিয়েছিলো । এভাবে উন্মেষশীল বাংলা ভাষা আরও একবার সংস্কৃত ভাষার দিকে ঝুঁকে পড়লো । ইংরেজ আমলে কলকাতায় রাজধানী স্থাপিত হওয়ায় প্রামাণ্য বাংলা ভাষাটিও ধীরে ধীরে মহীরুহে পরিণত হলো তারই বৈশিষ্ট্য নিয়ে, যদিও সে ভাষার উপকরণ এসেছিলো বঙ্গদেশের অন্য অঞ্চল থেকেও ।



রবীন্দ্রনাথ এসে ভাব প্রকাশের প্রয়োজনে নতুন শব্দ ব্যবহার করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে পুর্ববর্তী লেখকদের ব্যবহৃত শব্দগুলোর সঙ্গে লেজ জুড়ে দিয়ে হাজার হাজার সমাসবদ্ধ নতুন শব্দ গঠন করেছেন । এছাড়াও প্রমথ চৌধুরীর উৎসাহে প্রামাণ্য কথ্যভাষাকে লেখ্যভাষার আসনে বসিয়েছেন । সেইসঙ্গে মুখের ভাষাকেও লিখিত ভাষার দিকে খানিকটা টেনে এনে বাংলা ভাষাকে সহজ সুন্দর ও সাবলীল করে তুলেছেন । রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় শেষ দু’দশকে নজরুল ইসলামও একটা নতুন শব্দভাণ্ডারের দ্বার খুলে দিলেন – আরবি–ফারসির । আরও একটা নতুন শব্দভাণ্ডারের দ্বার খুলে দিলেন জসীমউদ্দীন । 



বাঙলা ভাষার প্রথম যথার্থ শিল্পী - ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর :

বিদ্যাসাগর বাঙলা ভাষার ‘প্রথম যথার্থ শিল্পী’ অর্থাৎ শুধু লেখক নন, প্রচারক নন, শিক্ষাগুরু নন; সেসবের সীমা অতিক্রম করে, বিদ্যাসাগর সাহিত্যশিল্পী । এই পরিপ্রেক্ষিতে বিদ্যাসাগরের পূর্ববর্তী প্রধান দু-চারজনের দানের কথা স্মরণ করা দরকার । প্রধানত স্মরণীয় – উইলিয়াম কেরি, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, রামমোহন রায়, ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্যারীচাঁদ মিত্র, অক্ষয়কুমার দত্ত প্রভৃতির দান । সেই সঙ্গে বাঙলা সংবাদপত্রের দানও মনে রাখতে হবে । উইলিয়াম কেরির ‘কথোপকথন’ (১৮০১ খ্রীঃ) অসামান্য বস্তু । বিভিন্ন শ্রেণির ও বিভিন্ন স্তরের বাঙালীর শিষ্ট আলাপ থেকে মেয়েলি কোঁদল পর্যন্ত নানা রীতির কথিত বাঙলার নিদর্শন এতে পাওয়া যায় । মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারকেই কেউ কেউ প্রথম গদ্যশিল্পী বলে গণ্য করেন । মৃত্যুঞ্জয়ের লেখায় স্বভাবতই বিষয়বৈচিত্র্য এবং ভাষার বৈচিত্র আছে । ‘প্রবোধচন্দ্রিকা’য় (রচিত ১৮১৩, প্রকাশিত ১৮৩৩) আমরা অন্তত তিন রকম গদ্যরীতির নমুনা পাই । একদিকে সংস্কৃতানুরাগী সাধুভাষা, মাঝখানে সরল সচ্ছন্দ সাধুভাষা এবং অন্যদিকে প্রায় কথ্য ভাষা – যা কেরির ‘কথোপকথনে’র কথা মনে করিয়ে দেয় । মৃত্যুঞ্জয়ের শিল্পকৌশল স্বীকার্য । কিন্তু অনেক কারণেই তাঁর শিল্পবোধ খণ্ডিত এবং শিল্পরীতিতেও ব্যাহত । তিনি নানারূপ ভাষার পরীক্ষা করেছেন অথচ সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেননি । বিষয়ের দিক থেকে বৈচিত্র্য থাকলেও রীতিস্থিরত্ব নেই । বিচার-যুক্তিতেও তিনি কুযুক্তিপরায়ণ, অশালীন, কটুক্তিবিলাসী । রামমোহন রায়ের বাংলা গদ্য সম্বন্ধে ‘সংবাদ প্রভাকর’-এ (১৮৫৪ সালে) বলা হয়েছে – “রামমোহন জলের ন্যায় সহজ ভাষা লিখিতেন । তাহাতে কোনো বিচার ও বিবাদ ঘটিত বিষয় লেখায় মনের অভিপ্রায় ও ভাব সকল অতি সহজে স্পষ্টরূপে প্রকাশ পাইত; এজন্য পাঠকেরা অনায়াসেই হৃদয়ঙ্গম করিতেন, কিন্তু সে লেখায় শব্দের বিশেষ পারিপাট্য ও তাদৃশ মিষ্টতা ছিল না ।”



রামমোহন রায়ের আমলের পণ্ডিতদের মধ্যে মৃত্যুঞ্জয় ছিলেন গদ্যগুরু । নানা ধরণের লিপিকৌশল দেখাতে ওস্তাদ ছিলেন । রামমোহন রায় আয়ত্ব করেছিলেন বাঙলা ভাষার মূল রূপটিকে । তিনি বিচার ও আলোচনার গদ্যই তৈরি করতে চেয়েছিলেন । কিন্তু রামমোহন শিল্পী নন – বিচারকুশল তার্কিক । গদ্যসাহিত্য সৃষ্টি তাঁর কল্পনায়ও ছিল না । রামমোহনের বিচারপদ্ধতিও সংস্কৃত শাস্ত্রবিচারের ঐতিহ্যানুযায়ী মধ্যযুগের স্কুলম্যান-এর পদ্ধতি । কারণ, পণ্ডিতের ঐতিহ্যপদ্ধতির তখনো সমাজে প্রতিষ্ঠা ছিল । রামমোহন প্রথম থেকেই (বেদান্তগ্রন্থের অনুবাদ, ১৮১৫) বাঙলা বাক্যের মূল প্রকৃতি ধরতে পেরেছিলেন । বাঙলা গদ্যভাষার ‘অন্বয়’ – কর্তা, কর্ম, ক্রিয়া প্রভৃতির বাক্যমধ্যে চমৎকার প্রমাণ । রামমোহন বক্তব্যকে সরল করার জন্যই লিখতেন – শব্দ বা বাক্যের খেলা দেখাবার ইচ্ছায় নয় । তার্কিক রামমোহন বিপক্ষের বিরুদ্ধে কটূক্তি প্রয়োগ করেননি এবং অপরের কটূক্তিকে যুক্তির দ্বারা নিরসন করেছেন । ‘প্রবর্তক-নিবর্তক সংবাদ’-এ স্ত্রীজাতির গুণাবলীর সমর্থনে শুধু অদ্ভুত উদার দৃষ্টির পরিচয় দেননি, সে লেখাতে রীতিমত আন্তরিকতার স্পর্শও আছে । বিদ্যাসাগরের গদ্যরচনায় এসব গুণের (রসবোধের সঙ্গে) সমাবেশ ঘটেছে । তাতেই বিদ্যাসাগর গদ্যশিল্পী ।



রামমোহন রায়ের সময়কার ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় (নববাবুবিলাস) কিন্তু গদ্যসাহিত্য রচনা করেছিলেন । সে দিক থেকে টেকচাঁদ ঠাকুরের (প্যারিচাঁদ মিত্র) ‘আলালের ঘরের দুলাল’-এর গুরুত্বই সর্বাধিক । লেখাটি চমৎকার । একথা ভোলা উচিৎ নয় যে, বাঙলা গদ্য গড়তে এঁরাই সর্বাপেক্ষা বেশি সাহায্য করেছেন । ‘তত্ত্ববধিনী পত্রিকা’-র বাঙলা গদ্যও উল্লখেযোগ্য । স্বয়ং বিদ্যাসাগর ছিলেন সে পত্রিকার সঙ্গে জড়িত । যদিও দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাজনারায়ন বসু ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’য় বাঙলা গদ্যে আরও সজীবতা সঞ্চার করছিলেন তবুও অক্ষয়কুমার দত্ত ছিলেন ‘তত্ত্ববধিনী’র সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য লেখক । ‘বাহ্যবস্তুর সঙ্গে মানববস্তুর সম্বন্ধবিচার’ (১৮৫২-৫৩) ও ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ (১৮৭০-১৮৮৩) বস্তুনিষ্ঠ আলোচনায়, লিপিকুশলতায় বাঙলা ভাষার চিরকালের সম্পদ । কিন্তু অক্ষয়কুমার দত্তের ভাষায় সরসতা কম । তা বিশুদ্ধ যুক্তিবাদের ভাষা এবং অনেকটা বিশুষ্ক যুক্তিবাদের ভাষা । এখানেই বিদ্যাসাগরের গদ্যরচনার সার্থকতা । তাঁর যুক্তিবাদী লেখা কিন্তু সরস এবং প্রয়োজনমত রসাভিষিক্ত যা বুদ্ধিকে জীইয়ে তোলে, প্রাণকে সজীব করে । বিদ্যাসাগরের হাতে বাঙলা গদ্য তাই আত্ম-আবিষ্কার করলো । বাংলা গদ্যের ক্রমবিকাশ ও ক্রমপ্রতিষ্ঠার ধারায় কাউকে ‘জনক’ বলতে হলে বিদ্যাসাগরকেই বলা চলে । বিদ্যাসাগর বাংলা লেখায় সর্বপ্রথম কমা, সেমিকোলন প্রভৃত ভেদচিহ্নগুলি প্রচলিত করেন ।



ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের বাংলা সাহিত্যকে বলা হয় বঙ্কিম যুগ । আর বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধকে বলা হয় রবীন্দ্র যুগ । রবীন্দ্র যুগ হলো বাংলা সাহিত্যের স্বর্ণযুগ । বাংলা কথা সাহিত্যের আসর তখন জমজমাট । রবীন্দ্রনাথ তখন ‘চোখের বালি’, ‘গোরা’, ‘শেষের কবিতা’, ‘চতুরঙ্গ’, ‘যোগাযোগ’ আর ‘গল্পগুচ্ছের’ বিচিত্র ধরনের গল্পের ঐশ্বর্য্য নিয়ে বিরাজ করছেন । সঙ্গে আছেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়, প্রমথ চৌধুরীর মতো উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কগণ । এছাড়াও ‘ভারতী’, ‘মানসী’, ‘সবুজপত্র’, ‘বিচিত্রা’, ‘কল্লোল’, ‘কালিকলম’, ‘শনিবারের চিঠি’র নবীন প্রবীণ কথাশিল্পীগণ ।



বাংলা পরিভাষা এখনো মুখের ভাষা হয়ে উঠলো না :

বিশিষ্ঠার্থবোধক শব্দ যা বিশেষ প্রসঙ্গে বিশেষ অর্থ গ্রহণ করে কিংবা বিশেষ বস্তু, বস্তুধর্ম, প্রক্রিয়া ইত্যাদি বোঝায় তা হলো পরিভাষা । যেমন – বিশেষ্য, যৌগ, রাগ (সঙ্গীতের), দ্বিবীজপত্রী ইত্যাদি । অনেক শব্দ সাধারণভাবে এক বা একাধিক অর্থে ব্যবহৃত হয় । আবার পারিভাষিক ব্যবহার পেয়ে যেতে পারে বিশিষ্ট অর্থে । একই শব্দের এই দুই জাতীয় অর্থের মধ্যে সাদৃশ্য থাকতেই পারে । কিন্তু তারা কখনোই এক নয় । যেমন ‘আলাপ’ শব্দটির কয়েকটি মানে আছে কিন্তু উচ্চাঙ্গ সংগীতে ‘আলাপ’ বিশেষ অর্থবহ পারিভাষিক শব্দ । আহ্নিক, সন্ধ্যাহ্নিক, সন্ধ্যা ইত্যাদি শব্দের আলাদা মানে থাকলেও উপাসনা প্রসঙ্গে তাদের বিশিষ্ট, স্বতন্ত্র ও স্বীকৃত মানে আছে । তেমনই রোধ, ক্ষমতা, শক্তি, কার্য ইত্যাদি শব্দের আলাদা মানে থাকলেও পদার্থবিজ্ঞানে তাদের বিশিষ্ট মানে আছে । পারিভাষিক শব্দের প্রতিশব্দ হয় না ।

জ্ঞানচর্চার সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন শব্দ ভাষায় আসে । সেইসাথে আসে পরিভাষা । লোকসভা, বিধানসভা, বিচ্ছিন্নতাবাদ ইত্যাদির যে মানে আমরা ব্যবহার করে থাকি তা আগে ছিলো না । কিছু লোক মিলে সভা করলেই তা লোকসভা হবে না । লোকসভা আর জনসভা শব্দে সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস বোঝায় । লোকসভা পারিভাষিক শব্দ । জনসভা পারিভাষিক শব্দ নয় । গ্রামের লোকে সভা করে কাউকে একঘরে করার বিধান দিলেও সে সভা কোনোমতেই বিধানসভা হতে পারে না । এতকাল ছিলো যিনি বিধান দেন তিনিই বিধায়ক । বিধায়ক শব্দের মানে একই থাকলেও আজ তার একটি নতুন মান হয়েছে – বিধান সভার সদস্য । কিছুকাল আগেও যাকে বলা হতো ‘স্বতন্ত্র’ তাকে এখন পারিভাষিক অর্থে বলা হয় ‘নির্দলীয়’ । ‘স্বতন্ত্র’ নামে একটি রাজনৈতিক দল এসে যাওয়ায় ‘নির্দলীয়’শব্দটি ব্যবহৃত হতে লাগলো ।



বাংলা ভাষায় পরিভাষা নেই – এই অভিমত আংশিক সত্য । যে দেশে যে বিদ্যার চর্চা হয়েছে, যে জিনিস আছে তার প্রকৃতি, পরিবেশ, সামাজিক আচা-আচরণে, ধর্মে, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতে, সে দেশের ভাষায় তার জন্য সাধারণ অথবা পারিভাষিক শব্দ অবশ্যই পাওয়া যায় । বাংলা শব্দ সম্ভারের মধ্যেও আমাদের নিজস্ব ধ্যান-ধারণাকে ধরে রাখা যাবে । উদাহরণ স্বরূপ আমাদের সঙ্গীত বিষয়ক কিছু পরিভাষা যেমন তান, লয়,পকড়,আলাপ ঝালা, তেহাই –এসব সহজেই প্রকাশ করা যায় । অন্যদিকে নায়িকা, গুরু – এসব শব্দের সহজে ইংরেজি করা যায় না । কিংবা ছাঁদনাতলা, শুভদৃষ্টি, গায়েহলুদ । গায়ে হলুদ মাখলেই তো গায়েহলুদ হয় না । আবার বিছানায় ফুল ছড়িয়ে রেখে ঘুমোলেই ফুলশয্যা হয় না । এসবই হলো পরিভাষা । ছাঁদনাতলা, গায়েহলুদ ইত্যাদি আমাদের দেশের সংস্কৃতিতে আছে বলেই তার জুতসই বাংলা শব্দও আছে । আগে ছিলো না, পরে হয়েছে, এমন জিনিসের জন্যও দরকারি শব্দ আমাদের শব্দভাণ্ডারে এসে ঢুকেছে । তাদের আর বিদেশি বলে চেনার উপায় নেই । মুসলমান শাসনের আমলে প্রচুর শব্দ এসেছে । যেমন - মোকদমা, উকিল, সমন, জেরা, খারিজ ইত্যাদি । মুসলমান ওস্তাদেরাও ভারতীয় সংগীতে অনেক জিনিস যোগ করেছেন । সেইসাথে অনেক শব্দও এসে ঢুকেছে আমাদের শব্দভাণ্ডারে । যেমন - বন্দিশ, সেতার, মিরজাব, জমজমা ইত্যাদি শব্দ ।



আমাদের বাংলা শব্দের উৎস সংস্কৃত, আরবি, ফরাসি, পোর্তুগিজ, ইংরেজি । এটাও ঠিক যে বিদেশ থেকে আমদানি করা ভাবনা, জিনিসপত্র, বিদ্যা, জীবনযাপনের পদ্ধতি – এসব নিয়ে বলতে বা লিখতে গেলে আমাদের ভাষায় বেশ অসুবিধা হয় । তাদের কিছু শব্দকে হয়তো অনুবাদ করে নিতে পেরেছি, অনেকগুলোই পারিনি । আমরা যতই স্বদেশী, দেশীয় বলে থাকি না কেন, আমাদের এখনকার জীবনযাত্রার প্রণালী, স্কুল ও কলেজে যা লেখাপড়া করি তার সবটাই বিদেশি । এদেশে পাকাবাড়ি ছিলো না । তাই কেবলমাত্র পাকা বাড়ির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এমন শব্দ আমাদের ভাষাতেও ছিলো না । অথচ কাচা বাড়িতে লাগে কিংবা কাঁচা-পাকা দু’রকম বাড়ির জন্যই দরকার এমন শব্দ আমাদের শব্দভাণ্ডারে আছে । যেমন - ছাদ, সিঁড়ি, চাল, মুনি, থাম, বেড়া ইত্যাদি । যেসব শব্দ পাওয়া যায় না তা হলো – শিক (ফার্সি), সিমেন্ট, লিন্টেন, জানালা (পোর্তুগিজ), সিলিং, রেলিং ইত্যাদি । পাই না ঘরের মধ্যেকার টেবিল, সোফা, ডিভান, ড্রয়ার, আলমারি, পাইপ, বসিন, সিংক, কমোড ইত্যাদি । আমাদের পরনের প্যান্ট, শার্ট, ব্লাউজ, শায়া, জুতো, মোজা সোয়েটার –এসবই বিদেশি শব্দ । রান্নাঘরের কাপ, প্লেট, ডিশ, সসপ্যান, ফ্রিজ, কুকা, গ্যাসলাইটার ইত্যাদি ব্যবহৃত শব্দই বিদেশি । বিদেশি শব্দগুলো স্বরূপে বা ঈষৎ পরিবর্তিত হয়ে মিশে গেছে আমাদের ভাষায় । 



বাংলা সাহিত্যসেবী, বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে পরিভাষা নিয়ে ভাবনাচেষ্টা কম হয়নি । আবার বিদেশী শব্দের ভাষান্তর ঘটেছে কোনো কোনো অজ্ঞাত ব্যক্তি দ্বারা । যেমন – ঘড়ির কাঁটা । আমাদের দেশে কাঁটাওয়ালা ঘড়ি আগে ছিলো না । ইংরেজিতে ঘড়ির কাঁটাকে বলা হয় ‘হ্যান্ড’ । কিন্তু কবে কোন অজ্ঞাত ব্যক্তি এর নামকরণ করলেন ‘কাঁটা’ । ‘ফায়ার ইঞ্জিন’কে কোনো এক অনামা অজানা ব্যক্তি করে গেছেন ‘দমকল’ । দমকল একটি স্বাভাবিক পরিভাষার উদাহরণ । ‘হসপিটাল’ এর পরিবর্তিত রূপ হয়েছে ‘হাসপাতাল’ । অনেকেই জীবীকার দায়ে ‘ব্রেক’-কে বলেন ‘বেরেক’, ‘প্লাগ’কে বলেন ‘পেলাগ’ । এরাই আবার টাইম, সাইজ, পিস ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করে থাকেন । এছাড়াও অনেক পরিভাষার উদাহরণ দেওয়া যায় যা আমাদের বাংলাতেই আছে । যেমন – প্রাণ-কে পরাণ, শাঁখ-কে শঙ্খ, কান্দী-কে কাঁদি, বম্ব-কে বোমা, ব্রাশ–কে বুরুশ ইত্যাদি । অন্যদিকে শিক্ষিত বাঙালির চিন্তাভাবনা ইংরেজি ও বাংলা মিশিয়ে তৈরি হয় । যেমন – ‘ট্রেন অ্যাক্সিডেন্টের পর বহু ডেডবডির পরিচয় পাওয়া যায়নি’ । বাংলা পরিভাষিক শব্দের অনেক কিছুরই ইংরেজি অনুষঙ্গ নেই – তাদের অনুবাদও অসম্ভব । যেমন – ত্রিভঙ্গ, রস, পটুয়া ইত্যাদি ।



পরিভাষা প্রণয়ন বলতে আমরা সেই ঘটনাটা বুঝবো যেখানে শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান, কলা, প্রশাসন প্রভৃতি ক্ষেত্রে যে ইংরেজি ও অন্য বিদেশী শব্দ আছে তার বাংলা করা, কিংবা বাংলায় গ্রহণীয় রূপ দেওয়া । বহু প্রাতঃস্মরণীয় মানুষ এ কাজ করেছেন কিন্তু সমস্যা মেটেনি । ইদানিং সমস্যা আরও বেড়েছে । বাংলা ভাষায় যে ভাবে পরিভাষা প্রণয়ন করা হচ্ছে বা হয়েছে তাতে মনে হয়, যাঁরা এগুলো করেন তাঁদের প্রধান বিবেচ্য হয় কোনো রকমে একটা শব্দ দাঁড় করানো । নইলে ‘মৃত্যুকালীন উক্তি’র পরিভাষা ‘মূমূর্ষশ্রাবিতক’, ‘এস্টিমেট’-এর পরিভাষা প্রাক্‌কলন’, ‘ওয়ারেন্ট’-র ‘প্রগ্রহণ পত্র’, ‘ব্যালট পেপার’-এর ‘মতপত্রী’ ইত্যাদি শব্দ বাঙালির মুখের ভাষায় না এলে পরিভাষার ভবিষ্যৎ নেই । এই সব পরিভাষা যাঁরা করেছেন, তাঁরা সকলেই বিশিষ্ট ব্যক্তি । তাঁদের বিদ্যাবত্তা, পাণ্ডিত্য নিয়ে কোনো সংশয় নেই । তবুও এসব এখনো পর্যন্ত বাঙালির মুখের ভাষা হয়ে উঠতে পারলো না । 



বাংলাভাষার অস্তিত্ব আজ বিপন্ন :

ভাষার স্বভাব নদীর মতোই পরিবর্তনশীল । নদীর এই পরিবর্তনশীল স্বভাবের কারণেই তার বুকে জমে চোরাবালি এবং ব্যহত হয় তার স্বাভাবিক স্রোত । তেমনটাই হয়ে থাকে ভাষার ক্ষেত্রেও । ভাষাব্যবহারকারী সমাজ যদি তার ভাষা নদীর বুকের তলার চোরাবালি প্রতিনিয়ত সরিয়ে না দেয়, তাকে যদি স্বাভাবিক স্রোতস্বিনী করে তুলতে না পারেন, তাহলে এই আধুনিক ভাষাসংঘাতের যুগে সেই সমাজের ভাষা আর টেঁকে না । বদলে যায় । গত একশ বছরে পৃথিবীতে অনেক মানুষ তাদের মাতৃভাষাকে বদলে নিয়েছে । বাংলাভাষাও এই চক্রের বাইরে থাকতে পারে না । যতো ভাষাপ্রেমই থাকুক না কেন এবং বাংলা গানে যত যাদুই থাকুক না কেন এ ভাষা যদি ঘরে-বাইরে সর্বত্র আমাদের মুখ্যভাষা না হয়ে উঠতে পারে, আমরা যদি সেভাবে তাকে গড়ে তুলতে না পারি তাহলে আজ যে ক্ষয়কে মনে হচ্ছে অতি ক্ষুদ্র তা কিছুকালে মধ্যেই সুবিপুল ধসে রূপান্তরিত হবে । পৃথিবীতে গত একশ বছরে অনেক দেশের ভাষাই হারিয়ে গেছে । দেখা গেছে সে-সব হতভাগ্য দেশে সমৃদ্ধ ভাষা ও নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এসে সে-দেশের মাতৃভাষাকেই উপড়ে ফেলে দিয়েছে । যে-দেশে উপনিবেশ দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে সেখানকার মাতৃভাষার মহীরুহ উপড়ে গিয়ে খিচুড়িভাষার বুনোজঙ্গলের উদ্ভব হয়েছে । যেমন ঘটেছে হাইতি, ফ্রেঞ্চ, গায়না, জামাইকা ইত্যাদি দেশে । আমাদের দেশেও ভাষা প্রবল গতিতে খিচুড়ি হচ্ছে । আজকালকার লেখা গল্প উপন্যাস পড়লে দেখা যায় তাতে বাংলার সাথে বেশ কিছু ইংরেজি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে । আচার্য সুনীতিকুমার ১৯৪১ সালের এক বক্তৃতায় বলেছিলেন - ‘বাঙলায় প্রায় ৮/৯ শত ইংরেজি শব্দ ইতিমধ্যেই পুর্ণরূপে গৃহীত হয়ে বাঙলা বনে গিয়েছে ।’



চল্লিশ দশকের পর বাংলা ভাষায় ইংরেজি শব্দের অনুপ্রবেশ যে বিপুল হারে বেড়েছে তা ইতিমধ্যেই প্রমাণিত । একটু খুঁটিয়ে দেখলে দেখা যাবে, এখন যে-কোনো ইংরেজি শব্দ এমনকি ইংরেজি বাক্যগঠনপ্রণালীও বাংলায় অবলীলাক্রমে ব্যবহৃত হচ্ছে । এই খিচুড়ি ঘটাটাই হচ্ছে ভাষাবদলের প্রথম ধাপ । কলকাতার উপভাষা হচ্ছে আমাদের নানা প্রান্তের নানা উপভাষার মধ্যে সকলের জানা বাওয়ারি উপভাষা । এ ভাষায় আমরা বই পড়ি, খবর পড়ি, গান গাই । কলকাতার উপভাষাকে সরিয়ে রাখলে বাংলার প্রান্তিক ভাষাভাষীদের পক্ষে পরস্পরের ভাষা বোঝার উপায় থাকবে না । এই ভাষা যদি পর্যাপ্ত ইংরেজি গিলে খিচুড়ি হয়ে অবশিষ্ট বাঙালির কাছে দুর্বোধ্য হয়ে পড়ে তাহলে আমরা আবার এক নতুন বিপদের সন্মুখীন হবো । আমাদের দেশে ভাষার ক্রম-অবলুপ্তির একটি অন্য ধরনও লক্ষ করা গেছে । পশ্চিমবঙ্গে সাঁওতালি মাতৃভাষা এখন প্রায় ১৮ লক্ষ মানুষের এবং নেপালি মাতৃভাষা প্রায় ৭ লক্ষের । এদের মধ্যে নেপালি ভাষাগোষ্ঠীর মানুষেরা তাঁদের মাতৃভাষা পড়ছেন । অন্যদিকে সাঁওতালি ভাষাগোষ্ঠীর মানুষেরা তাদের মাতৃভাষা পড়ছেন না যে তার প্রমাণ পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের পরিসংখ্যান থেকেই জানা যায় । নেপালি ভাষার পরীক্ষার্থীর সংখ্যা সাঁওতালি ভাষার পরীক্ষার্থীদের থেকে অনেকগুণ বেশি । মাতৃভাষার প্রতি আকর্ষণ ও প্রীতি মানুষমাত্রেই সহজাত ও স্বাভাবিক । কিন্তু ভাষার প্রতিদানের ক্ষমতার উপর তার ব্যবহারের ব্যাপ্তি নির্ভর করে । জীবিকাক্ষেত্রে সাঁওতালি জ্ঞানের কোনো মূল্য নেই । সাঁওতালি শিখে কেউ চাকরি পাবে না । উচশিক্ষাক্ষেত্রে সাঁওতালদের আধুনিক বিদ্যাচর্চায় এ ভাষার স্থান এখনো দৃঢ়ভাবে গড়ে তোলা যায়নি । বিশ্বভারতীর একটি ডিপ্লোমা কোর্সের বাইরে এদেশে সাঁওতালি শিক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই । শিক্ষক নেই । শিক্ষক গড়ে তোলার, বই লেখার সংগঠনও নেই । অন্যদিকে নেপালিও ছোটো গোষ্ঠীর ভাষা । কিন্তু বহির্জীবনে তার ব্যবহার ক্ষেত্র গড়ে উঠেছে । সম্প্রতি নেপালি একাদেমি হয়েছে । তাদের দৈনিক পত্রিকা, টাইপরাইটার ইত্যাদি আছে । দার্জিলিংয়ের চাকরি পেতে হলে নেপালি জানতে হয় । অথচ নিরক্ষর সাঁওতাল ছেলেটিকেও বর্ধমানে বাংলা রাজমহলে মৈথিলি শিখতে হয় । অর্থাৎ কর্মক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত ভাষাই শিখতে হচ্ছে তাকে । এতেই প্রমাণিত হয় যে কর্মক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত ভাষাই আজকের দিনে স্বাভাবিকভাবে ক্রম প্রসারতা লাভ করে ।



বাংলাভাষার সংসার থেকেই চুরি গেছে মালদার খোট্টা উপভাষা ও জলপাইগুড়ির প্রায়-বঙ্গীভূত সাদরি উপভাষা । আজকাল দেশে নবাগত এই ভাষাসাম্প্রদায়িকতার কারণ হিন্দির ঊর্ধ্বচাপ । ভারতে একমাত্র আমাদের অর্থাৎ বাঙালিদেরই এই সমস্ত উৎপাত তুচ্ছ করার শক্তি ছিলো । কিন্তু আমরা বাঙালিরা আমাদের ভাষার প্রতি যে ব্যবহার করছি তারও কোনো তুলনা নেই । এখন বাংলাভাষা ভুলতে চাওয়াই হচ্ছে বাঙালির প্রাত্যহিক বাসনা । এখন তিনিই উপহাসাস্পদ যিনি নিজ সন্তানকে বঙ্গভাষার স্কুলে পাঠান । বাংলায় চিঠি লেখেন । সভায় বাংলা বলেন । ইংরেজি মাধ্যমে না-পড়ানো আর ইংরেজি না-পড়ানো এক নয় । রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘ইংরেজি আমাদের পক্ষে কাজের ভাষা, কিন্তু ভাবের ভাষা নহে । ভাবের ভাষা কাজের ভাষা থেকেও বেশি প্রয়োজন । কারণ আমাদের দেহ সাড়ে তিন হাতের মধ্যে বদ্ধ,কিন্তু তাই বলিয়া ঠিক সাড়ে তিন হাত পরিমাণ গৃহ নির্মাণ করিলে চলে না । স্বাধীন চলাফেরার জন্য অনেকখানি স্থান রাখা আবশ্যক ।’ সেই স্বাধীনতা যেহেতু আমরা শিক্ষায় রাখিনি সেজন্য ‘তেমন মুঠা করিয়া কিছু ধরিতে পারিতেছি না, তেমন আদ্যোপান্ত কিছু গড়িতে পারিতেছি না, তেমন জোরের সহিত কিছু দাঁড় করাইতে পারিতেছি না ।’ মাতৃভাষাকে শিক্ষার বাহন করে তোলার প্রচেষ্টা আমরা শুরু করেছি প্রায় একশ বছর আগে থেকে । কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ বিষয়ে শুরু হয়েছিলো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভারতীয় উপাচার্য গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়কে দিয়ে । আশুতোষ মুখোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থাকাকালীন মাতৃভাষাকে শিক্ষার বাহন করার উদ্যোগ নিলেন ১৯২১ সালে । আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যু হলো তাঁর সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবার আগেই । ভারতবর্ষে আধুনিক ভাষা ও সাহিত্য শিক্ষার মডেল কি হওয়া উচিত আশুতোষ মুখোপাধ্যায় তাঁর আমলে বাংলা এম এ-র পাঠক্রমে তার এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন । সেই নিয়মানুসারে যে বাংলায় পড়বে তাকে অন্য দুটি ভারতীয় ভাষাও শিখতে হবে । অন্য ভাষাভাষীদের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম । আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর পিতার অসমাপ্ত কাজ নতুন করে শুরু করলেন পুত্র শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় । রবীন্দ্রনাথের কলমও কিন্তু থেমে থাকেনি । তিনি অনেক প্রবন্ধ লিখেছেন এই বিষয়ে । অবশেষে ১৯৩৫ সালে সরকারী অনুমোদন পাওয়া গেল । ছাত্রছাত্রীরা মাতৃভাষার মাধ্যমে পরীক্ষা দিলেন ১৯৪০ সাল থেকে । রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর এক বছর আগে ।



সরকারী কাজকর্মে বাংলাভাষার প্রচলন বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ভূমিকা যথেষ্ট রয়েছে । ঠিক হলো যে ১৯৬৫ সাল থেকেই পশ্চিমবঙ্গে সব কাজ বঙ্গভাষায় হবে । অথচ ১৯৬৫ সালের আগেই ১৯৬৪ সালে পশ্চিমবঙ্গের ১৯ নম্বর অ্যাক্টে বলা হলো যে, বাংলার সুবিধা প্রত্যাহার করা হচ্ছে না । কিন্তু ইংরেজি থাকবে । কলেজ, আদালত, স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়, সরকার - কোথাও আমরা বাংলাভাষাকে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছি না । শুধুমাত্র সাহিত্যের জোরেই বাংলাভাষা আজ তার অন্তিম লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে ।



১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষে ইংরেজ সাম্রাজ্যের অবসান হলো । দেশ বিভাগের সময় বঙ্গভূমি বিভক্ত হয়ে মধ্য উত্তর আর পূর্ব এলাকা নিয়ে পাকিস্তানের কাঠামোতে পূর্ব বাংলা গঠিত হলো । ঢাকাকেন্দ্রিক বাংলা সাহিত্য গড়ে উঠতে শুরু করলো নতুনভাবে । তবে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বাংলা ভাষার স্বাভাবিক অগ্রগতি রোধ করা ছাড়াও এই বলিষ্ঠ ভাষাকে বিকৃত করার প্রচেষ্টা করলো । হিন্দুয়ানির হাত থেকে বাংলা ভাষা রক্ষা করার অজুহাতে শাসক কর্তৃপক্ষ রাতারাতি উর্দু ও ফরাসী শব্দের আমদানি করার ষড়যন্ত্রে মেতে উঠলো । নববর্ষের উৎসব, রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী ইত্যাদিকে বিদেশী সংস্কৃতি বলে আখ্যায়িত করলো । শুরু হলো প্রতিরোধের সংগ্রাম । ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্যে ছাত্রদের রক্তে ঢাকা রাজপথ রক্তাক্ত হলো । শুরু হলো দুর্বার আন্দোলন । চুয়ান্নোর সাধারণ নির্বাচন, বাষট্টির ছাত্র আন্দোলন ব্যাপক ভাবে আছড়ে পড়লো পূর্ব বাংলার মাটিতে । ছেষট্টির ছয়দফা আন্দোলন হলো । ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান হলো । একাত্তরের স্বাধিকার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লেন পূর্ব বঙ্গের বাঙালিরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে । একাত্তরের ষোলোই ডিসেম্বর বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে জন্ম হলো বাংলাদেশের । বিশ্বের মধ্যে একমাত্র রাষ্ট্র যার রাষ্ট্রভাষা হলো বাংলা ।



সূত্র – ১ ) বাংলাদেশের বাঙালি জাতির আত্মপরিচয় – এম আর আখতার মুকুল । ২) বাঙ্গালী – মহম্মদ আমীর হোসেন এবং অন্যান্য কিছু গ্রন্থ (পুঁথি, দেশ পত্রিকা ইত্যাদি)

0 comments: