1

বিশেষ প্রবন্ধ: ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

Posted in


বিশেষ প্রবন্ধ



নজরুল সংগীতের কিংবদন্তী  ‘গানের পাখি’ ফিরোজা বেগম
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়



কোন কোন শিল্পী তাঁর নানান সৃষ্টির মধ্যে যে বিশিষ্টতা অর্জন করেন সেই বিশিষ্টতার মধ্যেই তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকেন মৃত্যুর পরেও বহুকাল । সদ্যপ্রয়াতা সংগীত শিল্পী ফিরোজা বেগম ছিলেন তেমনই এক শিল্পী যাকে শুধু একজন সংগীত শিল্পী বলে চিহ্নিত করলে সবটুকু বলা হয় না । নজরুল-গানের শিল্পী হিসাবে নিজেকে কিংবদন্তীর উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন ফিরোজা । সেই কবে, ১৯৪২এ ফিরোজা তখন ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে পড়েন, বারো বছর বয়সে প্রথম কলকাতায় রেডিওতে গান গাইলেন । ফিরোজার গান গাওয়ার পাঠ শুরু অবশ্য তার আগে থেকেই । ফরিদপুরের গোপালগঞ্জ মহকুমার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম ফিরোজার, ২৮শে জুলাই ১৯৩০ । এবং কি আশ্চর্য স্বামী কমল দাশগুপ্তর জন্মতারিখটাও ছিল তাঁর জন্মের ১৮বছর আগের এক ২৮শে জুলাই । পিতা মোহম্মদ ইসমাইল ছিলেন নামী আইনজীবি । মাতা বেগম কাওকাবুন্নেশা ছিলেন সংগীতানুরাগী । ছয় বছর বয়স থেকেই ফিরোজার গান গাওয়ার শুরু । কিন্তু তাঁর ‘ফিরোজা বেগম’ হয়ে ওঠা মোটেই কুসুম বিছানো পথ ছিল না ।

নিতান্ত শৈশবে পাঁচ/ছয় বছর বয়সে শোনা গানের কথা আমার কি করে মনে আছে কে জানে ! হয়তো জীবনে সেই প্রথম কলের গান শোনার বিস্ময় আজও স্মৃতিতে জমা হয়ে আছে । পাড়ায় কোন এক বাড়ি থেকে গ্রামফোন রেকর্ডের একটা গান ভেসে আসছিল । ‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই’ । তখন, নিতান্ত শৈশবে কার গান, কে গেয়েছেন – এসব জানার কথা নয় । পরে পরিনত বয়সে জেনেছিলাম গানটা ছিল ‘সাপুড়ে’ ছায়াছবিতে নজরুল ইসলামের সংগীত পরিচালনায় কানন দেবী গেয়েছিলেন গানটি । তারপর বছর কুড়ি আগে একদিন ভোরে আমার কানের সঙ্গী এফ এম রেডিওতে শুনলাম সেই গান আবার ফিরোজা বেগমের কন্ঠে – ‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই’ । কন্ঠস্বরের কি অনুপম ঐশ্বর্য ! আগেও তাঁর গান অনেক শুনেছি । কিন্তু সেদিন খুব কম প্রচারিত সেই গানের সুর কেন দীর্ঘদিন পরেও মনে থেকে যায়, তার কোন ব্যাখ্যা আমার জানা নেই । অনেকেই নজরুলের প্রচুর গান গেয়েছেন, প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন । সেইসব শিল্পীর কোন একটি বা দুটি গান গায়নগুনে অন্যতর মর্যাদা পেয়ে যায় । সুপ্রভা সরকার গীত ‘কাবেরী নদীজলে কে গো’, জ্ঞাণেন্দ্র প্রসাদ গোস্বামীর ‘শূন্য এ বুকে পাখি মোর আয়’, ধীরেন্দ্রচন্দ্র মিত্রর ‘শাওন আসিল ফিরে’ কিংবা শচীনদেব বর্মণ গীত ‘কুহু কুহু কোয়েলিয়া’ এমনই গান, যেগুলি অন্য অনেক শিল্পী গাইলেও মনে থাকে তাঁদেরই গায়নশৈলী । একই কথা বলতে হবে ফিরোজা বেগমের গান সম্পর্কে । ১৯৬০সালে পূজায়, গ্রামফোন রেকর্ডে গাওয়া দুটি গান ‘দূর দ্বীপ বাসিনী’ এবং ‘মোমের পুতুল মমির দেশে’ ফিরোজাকে প্রবল জনপ্রিয় করে তোলে । এই গান অনেকেই হয়তো গেয়েছেন, কিন্তু সংশয় নেই যে গানদুটির জন্য ফিরোজা বেগমের কথাই মনে এসে যায় । তেমনই ‘নূরজাহান’, ‘চাঁদ সুলতানা’, ‘মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী’, ‘নয়ন ভরা জল গো তোমার’, ‘তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি’, ‘আমি চিরতরে দূরে সরে যাব’, ‘ওরে নীল যমুনার জলচিল’এমনই বরষা ছিল সে দিন’, ‘মুশাফির মোছরে আখী জল’ এমন বহু কালজয়ী নজরুল গানে তাঁর কন্ঠের ইন্দ্রজাল অক্ষয় হয়ে আছে ।

৯ বছর বয়সে ফিরোজা কলকাতায় আসেন । কলকাতায় কোন এক গানের আসরে নজরুল ইসলাম তাঁর গান শুনে মুগ্ধতা প্রকাশ করেছিলেন । নজরুল তখনও সুস্থ ও পূর্ণ দীপ্তিতে এবং গ্রামফোন কোম্পানীর প্রধান প্রশিক্ষক । এই সময়েই ফিরোজা গ্রামফোন কোম্পানীতে অডিশন দেন । নজরুল ইসলামের কাছ থেকে গানের তালিম নিয়েছিলেন এই সময়ে । তারপর ১২ বছর বয়সে ফিরোজার প্রথম গ্রামফোন রেকর্ড প্রকাশিত হয় ১৯৪২এ চিত্ত রায়ের সুরে । গানটির কথা ‘মরুর বুকে জীবনধারা কে বহাল’ । ঐ বছরই কমল দাশগুপ্তর তত্বাবধানে দুটি উর্দু গান রেকর্ড করেছিলেন । 

ফিরোজা তাঁর কৈশোরে নজরুল ইসলামের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন । কিন্তু বাংলা সংগীত ভুবনে তাঁর সূচনা পর্বের সময় নজরুল নির্বাক হয়ে গিয়েছিলেন । গ্রামফোন কোম্পানীর প্রধান প্রশিক্ষক তখন নজরুল স্নেহধন্য কমল দাশগুপ্ত । ১৯৪০এর দশক থেকে ষাটের দশকটা ছিল বাংলা গানের স্বর্ণ যুগ । আধুনিক বাংলা গানের ভুবনে তখন শচীন দেববর্মণ, জগন্ময় মিত্র, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, যুথিকা রায়, সুধীরলাল চক্রবর্তী, বেচু দত্ত, সুপ্রভা সরকার, তালাত মাহমুদের মত গায়ক, হিমাংশু দত্ত, কমল দাশগুপ্ত, অনুপম ঘটক, সলিল চৌধুরী, নচিকেতা ঘোষের মত সুরকার – সে এক বিস্ময়কর শিল্পী সমাবেশ । ফিরোজা যুক্ত হলেন এই শিল্পী সমাবেশে । মনে রাখা দরকার যে, তখন সমভ্রান্ত মুসলমান পরিবারে মেয়ের পক্ষে রেকর্ডে গান করা মোটেই সহজ ব্যাপার ছিল না । 

নজরুল ইসলাম নীরব হয়ে গেলেন, কিন্তু বাংলা গানের ভান্ডারে রেখে গিয়েছিলেন কয়েক হাজর গান । ফিরোজা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি অন্য কোন গান নয়, তিনি শুধু নজরুলের গানই গাইবেন । তাঁর নজরুল গীতির কিংবদন্তী শিল্পী হয়ে ওঠায় শংসয়াতীত অবদান ছিল কমল দাসগুপ্তর । কমল দাশগুপ্ত নিজে নজরুলের বহু গানে সুর দিয়েছিলেন । গ্রামফোন কোম্পানীর সঙ্গীত প্রশিক্ষক থাকা কালীন তিনি একের পর এক নরুলের গান গাইয়ে ছিলেন ফিরোজাকে দিয়ে । নজরুল-গানের মাধুর্যের প্রতি ফিরোজার যে টান তার নির্মাণ করে দিয়েছিলেন কমল দাশগুপ্তই । পাকা জহুরীর মত তিনি চিনেছিলেন ফিরোজা কে । যে ভাবে কমল দাশগুপ্ত ফিরোজার অগ্রজা-প্রতীম যুথীকা রায়কে মীরার ভজনের অনন্য শিল্পী করে তুলেছিলেন । নজরুলের গান নিয়ে প্রকাশিত তাঁর প্রথম রেকর্ড বের হয় ১৯৪৯ সালে। এরপর থেকে আর ফিরোজাকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি । নজরুল সঙ্গীতের নানা রসধারায় সিক্ত হয়ে ফিরোজা বেগম গেয়েছেন, রেকর্ড করেছেন এবং শ্রোতাদের বিমোহিত করেছেন সুরের ইন্দ্রজালে। ফিরোজার কন্ঠ মাধুর্যে যেন নজরুল জীবন্ত হয়ে উঠতেন তাঁর গানে । ফিরোজা বেগম নজরুলের সব ধরনের গান গেয়েছেন। গজল, কীর্তন, ইসলামী গান, দাদরা-নানা ঢঙের সঙ্গীতরসে সিক্ত সঙ্গীতের মালা গেঁথে গেলেন তিনি সেই কৈশোর থেকে আমৃত্যু ।

ফিরোজা ১৯৫৪ থেকে ১৯৬৭ এই ১৩বছর কলকাতায় ছিলেন । এই সময়েই ফিরোজার প্রতিষ্ঠা । এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন “দীর্ঘ সময় চিত্ত রায় ও কমল দাশগুপ্তের কাছে গান শিখেছি। কমল দাশগুপ্তের কাছ থেকে অনেক ধরনের গান শিখেছি। সেই সময় আমরা সবাই এক পরিবারের মতো ছিলাম। একসঙ্গে গান-বাজনা এবং নিয়মিত গানের চর্চা করতাম। প্রায়ই বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সান্নিধ্যেও গান করেছি। পরিবারের কাছ থেকে গান-বাজনা করার জন্য বেশ উৎসাহ পেতাম। তাই হয়তো গান-বাজনা করতে আমার কোনো বাধা ছিল না” । তাঁর সংগীত প্রশিক্ষক, বয়সে তাঁর চেয় ১৮বছরের বড় কমল দাশগুপ্তর সঙ্গেই বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হলেন ফিরোজা কলকাতায় ১৯৫৫তে । 

ফিরোজার পরিবার, আত্মীয়-পরিজন ও কাছের মানুষেরা ওদের অসম বিবাহ মেনে নেয় নি । ফলে বিবাহপরবর্তী দাম্পত্যজীবন অনেক দুঃখময় থেকেছে । কলকাতায় কমল দাশগুপ্তর কোন বাড়ী ছিলনা । সেই সময়, নানান বিপর্যয়ে আর্থিক স্বচ্ছলতা মোটেই ছিল না । হাতে তেমন কাজও ছিল না । একটি চলচ্চিত্র প্রযোজনা করতে গিয়ে আর্থিক বিপর্যয় ঘটে যায় । তার মধ্যেই ফিরোজা স্বামীর সঙ্গে নজরুলের গান ও স্বরলিপি সংরক্ষণে নিরলস কাজ করে গেছেন । নির্বাক অসুস্থ নজরুলকে গান শোনাতেন । নজরুল সংগীতের শুদ্ধ স্বরলিপি ও সুর সংরক্ষণের জন্য নিরলস ভাবে কাজ করে গিয়েছেন । ফিরোজা-কমল দাশগুপ্তর অসম বিবাহ কলকাতাও খুব আদরের সঙ্গে মেনে নিয়েছিল, এমন নয় । বিস্ময়কর মনে হবে যে, কলকাতায় থাকাকালীন অজস্র নজরুলগীতি রেকর্ডে গেয়েছিলেন ফিরোজা, কিন্তু কলকাতার একটিও গানের জলসায় গান গাইবার জন্য তাঁর উপস্থিতি দেখা যায় নি । অথচ বাংলা গানের সেই স্বর্ণ যুগে কলকাতায় গানের জলসা লেগেই থাকতো । ১৯৭২এর ২৭শে অক্টবর কলকাতার রবীন্দ্র সদনে প্রথম একক সংগীতানুষ্ঠান করেন ফিরোজা । তখন তিনি ঢাকায় চলে গিয়েছেন সপরিবারে ।

১৯৬৭তে স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য সপরিবারে ঢাকায় চলে গেলেন ফিরোজা । ওখানে তখন আয়ুব খানের সামরিক শাসন । শোনা যায় ফিরোজাদের চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে ঢাকা ছাড়ার ফতোয়া জারি হয়েছিল । সেই সময় তাঁর পরিবার ও অনেক মানুষ তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, কোন সমঝোতা করেননি ফিরোজা । তাই সেই আয়ুব খান সরকার যখন ইসলামাবাদ টেলিভিশন কেন্দ্রের উদবোধনে প্রথম গানটি গাইবার জন্য ফিরোজা বেগমকে আমন্ত্রণ করেন, ফিরোজা শর্ত দিয়েছিলেন তিনি উর্দু নয় - বাংলা গান গাইতে দিতে হবে । নজরুলের ‘ও ভাই খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি, আমার দেশের মাটি’ গানটি গেয়েই সূচনা করেছিলেন ইসলামাবাদ টেলিভিশন কেন্দ্রের ।' নিজের ঐন্দ্রজালিক কন্ঠ নিয়ে অন্য অনেকের মতই চলচ্চিত্র বা লঘু গান করে পরিবারের আর্থিক সুরাহা করতে পারতেন । নজরুল গানে নিবেদিতা ফিরোজা সে পথে যাননি । স্বামী কমল দাশগুপ্ত পঞ্চাশের দশকে সুরকার হিসাবে যার ভারতজোড়া খ্যাতি, প্রায় আট হাজার গানের সুরকার – তাকে ঢাকায় মুদিখানার দোকান খুলতে হয়েছিল আর্থিক সংস্থানের জন্য । স্বাধীনতার পর, ১৯৭২এ বাংলাদেশ সরকার নজরুলকে সে দেশে নিয়ে আসেন জাতীয় কবির মর্যাদা দিয়ে । বাংলা দেশে নজরুল চর্চা গতি লাভ করে । গড়ে ওঠে নজরুল ইনস্টিটিউট – যার ভাবনা ফিরোজা বেগমের । সেখানে ফিরোজা বেগম নজরুল সঙ্গীতের স্বরলিপি প্রত্যয়ন বোর্ডেরও প্রধান হয়েছিলেন। ১৯৭৪এর ২০শে জুলাই নিতান্ত অনাদরে প্রায় বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু হয় স্বামী কমল দাশগুপ্তর আর গত ৯ই সেপ্টেম্বর চলে গেলেন এক হাজার ছ’শ গান করা এই প্রবাদপ্রতীম সংগীত শিল্পী ৮৪ বছর বয়সে ।

দীর্ঘ সংগীত জীবনে অনেক সম্মাননা পেয়েছেন তেমনভাবে প্রচারের আলোয় না থাকা ফিরোজা । কিন্তু নিশ্চিত ভাবেই তাঁর শিল্পীজীবনের শ্রেষ্ঠ সম্মান বিশ্বের অগণিত বাঙ্গালীর হৃদয়ে নজরুল-গানের কিংবদন্তী, ‘গানের পাখি’ হয়ে তাদের হৃদয়ে বিরাজ করা ।

1 comment:

  1. bhalo laglo.jhinuker buke mukto sristi hoar moto sundor jibonkotha.

    ReplyDelete