0

রম্যরচনা: আশিস খাস্তগীর

Posted in





রম্যরচনা




আঁচল 
আশিস খাস্তগীর 



“ছোড় দো আঁচল জমানা ক্যা কহেগা”- তামাম ভারতের যুবকদের বুকে একদা দোলা দিয়েছিল এই গান। এখন আর দেয় না। তখনকার জামানা আঁচল ধরে টানাটানি করলে অনেক কিছুই বলতে পারত, এখন আর বলে না ।কারণ আঁচল ছিল এক নিষিদ্ধ ফল। তার ভাঁজে ভাঁজে ছিল রহস্য। ছিল গোপনীয়তা, ছিল ইশারা। উচ্চশিক্ষায় সহপাঠ শুরু হবার পর পুরুষ মহলে যে কি উন্মাদনা দেখা দিয়েছিল তা আমরা অনেকের স্মৃতিকথায় পড়েছি। উড়ন্ত আঁচলের ছোঁয়া লাগলে অনেকের মূর্ছা যাওয়ার যোগাড় ঘটত। জমানা পাল্টেছে, তাই শুধু আঁচল কেন, সবকিছু ধরে টানাটানি করলেও জমানা কিছু বলে না। সে নীরব দর্শক। এটা ‘পি পু ফি শু’ র যুগ। আপনি বাঁচলে বাপের নাম।

কেউ যখন কিছু বলবে না তবে আঁচল ধরে আমরা একটু টানাটানি করতেই পারি।

কিন্তু টানব কি? আঁচল কোথায়! এখন ত সবই ওড়না। আঁচলের দিন কি তবে গেল? হতাশ হবেন না। আঁচল আছে স্বস্থানেই।মায়ের আঁচল, প্রিয়ার আঁচল, বউএর আঁচলের মার নেই। পথে - ঘাটে যেতে যেতে চোখে পড়বে বাড়ীর নাম ‘মায়ের আঁচল’। কিন্তু কখনই দেখবেন না ‘বাপের কাছা’। কেন নেই? এ প্রশ্নের উত্তরটি সহজ । মায়ের আঁচল হল শান্তির প্রতীক, আশ্রয়ের প্রতীক। তুলনায় বাপের কাছা বড্ড বেশী গদ্যরসাত্মক, কঠরতার প্রতীক। মায়ের আঁচলকেও কখন অন্য ভাবে দেখে থাকি। ব্যাঙ্গ করে যদি বলি ‘মায়ের আঁচলে থাক’ তাহলে বুঝতে হবে যে কোন শান্ত শিষ্ট মাতৃভক্ত ছেলে কে বোঝান হচ্ছে। এই উক্তিটি শোনা যায় খিপ্ত, অনাদর, অবহেলাপ্রাপ্ত পত্নীর মুখে। আর বউএর আচলাশ্রিত ছেলেটি অবশ্যই স্ত্রৈণ এবং ভীরু। তেমন পত্নি -অনুগত, অঙ্গুলিচালিত পুরুষকে বহু মহিলা পছন্দ করে থাকেন। সহজ কথায়, তেমন স্বামীকে বলে আঁচলে বাঁধা স্বামী। সেই যে গোপাল ভাঁড়ের গল্পটি -বউএর নির্দেশমত যে ভিড়ের মধ্যে না থেকে একলা দাঁড়িয়ে ছিল। 

শরৎচন্দ্রের বই সিনামাতে দেখতে যাঁরা ভালোবাসেন, তাঁরা জানেন যে প্রত্যেক সিনেমাতে সন্ধ্যারানীর আঁচল লুটিয়ে দৌড়ান কতখানি অপরিহার্য। যারা উত্তম সুচিত্রার বই এর ভক্ত, তাঁরা জানেন সুচিত্রার আঁচল উড়িয়ে চলার দৃশ্য। নায়ক নায়িকার উচ্ছাস ফোটাতে আঁচল ওড়াতেই হয়। উড়ন্ত আঁচল বাঁধনছাড়া আবেগের প্রতীক। শুধু স্বপ্নে কেন, প্রত্যেক পুরুষ তাঁর নায়িকাকে এমনি উড়ন্ত আঁচলে দেখতে ভালবাসেন। 

আর কোমরে আঁচল? কাজের সময় কোমরে আঁচল না গুজলেই নয়। কিন্তু অন্য সময়? সে দৃশ্য সম্ভবত কোন পুরুষই দেখতে চাইবেন না। কারণ ঝগড়ার সময় কোমরে আঁচল গোঁজার প্রয়োজন হয়। নাহলে ঝগড়ার মুড আসে না । কখনই দেখবেন না আঁচল লুটিয়ে কোন মহিলা ঝগড়ার আসরে নেমেছেন । সে সময় অনিবার্য ভাবে ওই মহিলার আঁচলটি কোমরে গোঁজা। মনে হয়, ওপরওয়ালা নারীকে ঝগড়ার সময় হাতদুটি কে যথেচ্ছ বিহারের জন্যই এই সহজাত প্রবৃত্তির অধিকারী করেছেন।

আঁচল মাল্টি ফাংশানাল । প্রেমের সঙ্গে আঁচলের ইন্টার রিলেসানসিপ রয়েছে। এই সেদিন পর্যন্ত, শাড়ী যখন কিশোরী বয়েস থেকে একমাত্র পরিধেয় ছিল, তখন প্রেমের কথা বলতে গেলে নারীর আঙুলে জড়ান থাকত আঁচলের কোনাটুকু। এখন অবশ্য শাড়ীর আঁচলের পরিবর্তে উঠে আসে ওড়নার আঁচল। তবু আঁচলের ভুমিকা একেবারে উঠে যায় নি। পরিণত গিন্নী যখন কোন আবদার নিয়ে স্বামীর কাছে হাজির হন, তখন আঙ্গুলে জড়ান থাকে আঁচলটুকু। শহরে, গ্রামে, গঞ্জে একান্ত ধীর লয়ে চলমান প্রেমিক যুগলের মধ্যে আঁচলের গুরুত্ব যে কতখানি তা ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। পাশের বাড়ীর খেন্তি যখন দুপাটি দাঁত বার করে দুপাটি দাতের ফাঁকে আঁচল গুঁজে পটলচেরা চোখে আড় চাহিনি দেয় , তখন তা দেখে কি মনে হয় না, দে মা আমায় পাগল করে? 

আঁচল হল ছাতার সাবস্টিটিউট । অতি রোদ্দুর বা সামান্য বর্ষায় ছাতার কাজ করে। মাথা বাঁচাতে আঁচল শিরোধার্য করেছেন মহিলারা এ দৃশ্য হামেসা দেখা যায়। বৈষ্ণব পদাবলীতে শ্রীরাধিকা অবশ্য ঘন ঘোর বর্ষায় আঁচলকে ছাতা হিসেবে ব্যাবহার করেছিলেন। কবি বলেছেন, বারি কি বারই নীল নিচোল ? মজার ব্যাপার হল, মাথায় আঁচল তোলার অধিকার বিয়ের পরই মেয়েরা পেয়ে থাকেন। কিন্তু রোদে বর্ষায় অধিকারী অনধিকারী ভেদ নেই। যদিও এই দুটি ক্ষেত্রে আঁচল তোলার ঢঙ ও রূপ আলাদা। 

কবি বিদ্যাপতির সেই বিখ্যাত পদটি মনে পড়ছে। শীতের ওড়নি পিয়া গিরীষের বা, বরিষার পিয়া দরিয়ার না । আঁচল কাঁথার সাবসটিটিউট । অল্প অল্প শীতে গায়ে জড়িয়ে নিলেই হল। চাদর বইবার দরকার নেই। মাফলারের কাজ করে আঁচল। হঠাৎ হিম পড়ছে -এই অবস্থায় গলায় আঁচল জড়াতে দেখা যায় বহু মহিলাকেই। 

আঁচল হল লজ্জা নিবারক। গ্রামাঞ্চলের মহিলারা নদীতে বা পুকুরে স্নান সেরে আঁচলটিকে প্রথমে গায়ে জড়িয়ে নেন, তারপর গামছা । সাধারণভাবে কোন তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সামনে সঙ্কুচিত মহিলারা আগে আঁচলের খোঁজ করেন গায়ের ওপর টেনে দেবার জন্য। 

আঁচল যেন শুচিতার প্রতীক । পুজোর সময় ভক্তের পিঠে আঁচলের অবস্থান থাকে না, গায়ের ওপর নেমে আসে। প্রণামের সময় মহিলারা গলবস্ত্র হয়েই প্রণাম সারেন। গলবস্ত্র অর্থাৎ গলায় আঁচলের অধিষ্ঠান। পূজায় অঞ্জলি দেয়ার সময় মহিলারা আঁচলটি টেনে নেন। নারীর কাছে আঁচল হল ভক্তি প্রকাশের একটি উপায়। 


আঁচল কখন সখনও রিমাইনডার এর কাজ করে। ধরুন, আপনার গৃহিণীর খুব ভুলো মন । প্রায়শই বিভিন্ন বিষয় ভোলেন। তার ফলে বাড়ীতে ছোট খাট অশান্তি লেগেই আছে। এর দাওয়াই আছে। গৃহিণী আঁচলে গিঁট দিতে বলুন। দেখবেন সব মনে পড়বে। এই টোটকা অনেকেই জানেন। তাই এই পদ্ধতিটি তাঁরা প্রায়ই নিয়ে থাকেন। পুরুষের তো আঁচল নেই রুমাল আছে । এ জন্য আঁচলের বিকল্প হিসেবে রুমালেই গিঁট দিতে বলা হয়। 

সনাতন কাল থেকে আঁচল কেরিয়ারের কাজ করে চলেছে। এখনও বনেদি বাড়ির গিন্নিদের বা বয়স্ক মহিলাদের এ বিষয় সচেতন দেখবেন। তাদের আঁচলে বাঁধা থাকে চাবির গোছা। আগে একান্নবর্তী পরিবারের সমস্ত চাবি বিশাল আকারে গিন্নিমার আঁচলে বাধা থাকত। সেই চাবির পেছনে ঘুরত কত জোড়া চোখ। পৃথুলা গিন্নিমা, মুখে পান, চলেছেন হেলেদুলে। তাঁর আঁচলে কি শুধু চাবি বাধা? তাঁর কর্তাটির হৃদয় কি সেখানে স্থান পায় না? পরিবার ভাগ হওয়ার পর আপন আপন সংসারে চাবির স্থান হল বৌমাদের আঁচলে। হালের বৌমারা অবশ্য এমনিতে শুনেছেন, দেখেওছেন হয়ত। কিন্তু সেটি অনুসরণ করার কথা ভাবেন না। কারণ শাড়ী পরার ঢঙ বদলেছে ,ব্যস্ততার জীবনে সেই সময় আর নেই। 

কালেভদ্রে আঁচল কেরিয়ারের কাজ করে। তখন আঁচল হয়ে ওঠে ঠোঙা বা ব্যগের বিকল্প। গ্রামাঞ্চলে অনেক মহিলাই আঁচলকে এই ভাবে ব্যবহার করে থাকেন । ভিক্ষাপ্রার্থীদের কাছেও আঁচলের প্রয়োজনীয়তা অনেক। 

প্রয়োজনে আঁচল ব্যান্ডেজের কাজও করে। সিনেমায় হামেশাই দেখবেন, নায়কের হাত কেটে গেছে, মাথা ফেটে গেছে। হাতের কাছে ফার্স্ট এইড নেই। চিন্তা কি? নায়িকা বা নায়কের মা তো আছেন। তিনি নির্বিকার চিত্তে তাঁর পরনের দামি শাড়িটি ফড়ফড় করে ছিঁড়ে ফেলবেন। তারপর পরম মমতায় ক্ষতস্থানে তা বেঁধে দেবেন। পাশাপাশি তাঁর বাবা, কাকা,‌ দাদা যদি থাকেন তাঁরা তাঁদের ধুতির কাছা খুলে ছিঁড়ছেন- এমন দৃশ্য দেখেছেন কি? আসলে ব্যান্ডেজের অধিকার একমাত্র আঁচলের। সেটি বেঁধেই নায়ক পটাপট অপনেনটকে মেরে শুইয়ে দেবে। 

আঁচল মাঝেমধ্যে বিপদও ডেকে আনে। মহাভারতের কথাই ধরুন । দ্রৌপদীর যদি আঁচল না থাকত তবে দুঃশাসন কি ধরে টানাটানি করত? দুঃশাসন তেমন দুঃসাহসিক কাজ করেছিলেন বলেই না শ্রী কৃষ্ণকে পরিত্রাতার ভূমিকায় দেখা দিতে হয়েছিল । আর সেই কারনেই আস্ত একটা কাপরের মিল সাপ্ল্যাই করেছিলেন তিনি। একালেও বহু দুঃশাসন দ্রৌপদীদের খোঁজে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায় । পেয়েও যায়। তাই খবরের কাগজে বা টিভিতে সংবাদ হয়। আন্দলন,তদন্ত,বিচার হয় বা হয় না।

আঁচলের অন্য বিপদ আছে। আত্মহননকারিদের কাছে আঁচল অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য সহায়ক। ফ্যানের ব্লেড, ছাদের হুক, গাছের ডালে ঝুলতে গেলে প্রথম আঁচলের কথাই মনে পড়ে। গলায় ধুতি বেধে ঝুলছে এমনটা কমই শুনবেন।

আঁচলের দৈর্ঘ্য একেককালে একেকরকম । পৌরাণিক কালে আঁচল কতটা ঝুলত তা গবেষণার বিষয় । আমরা সে রিস্ক নেব না । আমাদের প্রপিতামহি,ত স্য প্রপিতামহী অবশ্যই দীর্ঘ আঁচল রাখতেন। কারণ শাড়ি পরার ধরণ ছিল আঁচলকে এক প্যাঁচ দিয়ে চাবির গোছা সহ আবার পিঠে ফেলা । ঠাকুরবাড়ীর মহিলারা লম্বা আঁচল রাখতেন, ছবিতেই দেখেছি। এরপর দিন বদলাল। আঁচল ছোট হল। ফ্যাশান অনুযায়ী সাইজ কমতে কমতে রুমাল আকার ধারণ করল। গত ষাট কিংবা সত্তর দশকের নায়িকাদের দেখুন আঁচলের দৈর্ঘ্য কোথায় ঠেকেছিল। ঠিক হাতির লেজের মতই।

কিন্তু এমনটি বেশিদিন রইল না। সম্ভবত আঁচলে চোখ মোছা,দাঁতে আঁচল কামড়ান,আঙুলে জড়ান, কোমরে গোঁজা, বা নায়কের ক্ষতস্থানে চটজলদি আঁচল ছিঁড়ে বাঁধার সুযোগ পাওয়া যাচ্ছিল না। এমনও হতে পারে, ভিলেনকুল নায়িকার আঁচল ধরে টানাটানি করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছিল বা স্বয়ং নায়কও তাঁর নায়িকাকে আঁচল টেনে পাকে পাকে খুলে আবার পাকে পাকে জড়িয়ে দিতে পারছিলেন না। ফলে আঁচলের দৈর্ঘ্য আবার বাড়তে শুরু করল। বাড়তে বাড়তে তা ধরণী ছুঁই ছুঁই। হালের হিন্দি দেবদাস ছবির দুই নায়িকার আঁচলের দৈর্ঘ্যএর কথাই মনে করুন। মাটি ঝাঁট দেয়া আঁচল নিয়েও কি অবলীলাক্রমে তাঁরা কঠিন কঠিন নাচ নেচে গেছে। ধন্যি মেয়ে। 

নায়িকাদের আঁচল বেড়েছে মানে মহিলা দর্শকদের আঁচলও বেড়েছে । এখন আর পাঁচ মিটার কাপড়ে শাড়ি হয় না। ছয় মিটার সওয়া ছয় মিটার লাগে।। আঁচল লম্বা চাই যে। যেসব কিশোরী নতুন শাড়ি পরা ধরেছে বা যারা কালেভদ্রে শাড়ি পরে তারাও আঁচল লম্বা থাকবে কিনা হিসেব করে নেয়। আজকাল দীর্ঘাকৃতি মহিলাদের তো কথাই নেই হ্রস্বাকৃতি মহিলাদেরও আঁচল লম্বমান।

শাড়ির বিজ্ঞাপনে আঁচলের গুরুত্ব সবাই স্বীকার করেন। সাধারণ প্রিন্ট থেকে বুটিকের শাড়ি, বেনারসি থেকে বালুচরি -সব শাড়ির আঁচল হল মুল আকর্ষণ। 

বেনারসি বা বালুচরির আঁচলের দৈর্ঘ্য ও ঘনত্বের উপর দাম ওঠে । সৌন্দর্যও। বিজ্ঞাপনে দেখা যায় মডেলরা আঁচলটিকেই মেলে ধরেছেন দর্শকের দিকে। সেটি দেখে ক্রেতারাও প্রলুব্ধ হন। 

গানের কথা একটু বলি । ঝড়ে উড়ে যায় গো, আমার মুখের আঁচলখানি যিনি বলেন, তিনি দেশ মাতৃকার বন্দনায় আঁচলকে ভোলেন না -তোমাতে বিশ্বময়ী বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা। নজরুলের গানেও আঁচল-ছাড় ছাড় আঁচল বঁধু। আধুনিক গীতিকারও গান বাঁধেন আঁচলকে নিয়ে । নাছোড়বান্দা নায়ককে নায়িকা অনুযোগ করেন-লক্ষিটি দোহাই তোমায় আঁচল টেনে ধোরো না। লোকে দেখে বলবে কি, দুষ্টুমি আর কোর না। এত করেও কি আঁচলের প্রতি মায়া কাটান যাবে?

0 comments: